" কীসের কাজ এখন?"
" কর কর ঢঙ কর। মেয়েদের কাজ তো ঢঙ করাই। তোরা বুঝবি তোদের জামাই জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে তবুও জিজ্ঞেস করবি, কী হয়েছে?"
সহনের কথায় খিলখিল করে হেসে উঠলো তাহমি। সহন দিলো মুখ ভেংচি তাতে। এজন্যই বলে কারো পৌষ মাস আর কারো সর্বনাশ। সহনেরও এখন সর্বনাশ হচ্ছে আর তার বউয়ের হাসি দেখে গা-পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে । তাহমি আহ্লাদী হয়ে বললো,
" আহারে বেচারা বর আমার! "
" এই চুপ কর। কথা বলবি না একেবারে। গায়ের উপর উঠে বস তো আগের মতো। তারপর একটা চুমু খা ঠোঁটে।"
" ছি! কী নির্লজ্জতা, কী নির্লজ্জতা! "
" তাহমি! বেশি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু.... "
সহন দাঁতে দাঁত খিঁচিয়ে কথাটি বললো। তাহমি আলতো করে সহনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। সহন এক হাত তাহমির পিঠের নিচে ঢুকিয়ে অন্য হাত উদরে রেখে তাহমিকে নিজের শরীরের উপর তুলে নিলো। দু'জন দু'জনার দিকে তাকিয়ে রইলো খানিকক্ষণ।
" শোন!"
" হ্যাঁ বল। "
" আজকে ঘুমাতে দে?"
তাহমির কথায় কিছু একটা ছিলো। সহন ‘না’ বলতে পারলোনা। না বলা সমস্যা যেনো চোখের ইশারায় বুঝে গেছে সে।
" ঠিক আছে। তবে আমার বুকে মাথা রেখে ঘুমাবি।"
" অবশ্যই ডিয়ার বর। ”
" ওকে। শুভ রাত্রি। "
" মিষ্টি রাত্রি!"
তাহমি হেসে বুকে মাথা রাখল প্রিয়তম স্বামীর। সহনও তাহমিকে বুকে জড়িয়ে নিশ্চিতে ঘুমের দেশে পাড়ি জমালো।
ঘুম ঘুম চোখে বালিশের পাশে হাতড়ে ভাইব্রেট হওয়া ফোনটা হাতে নিলো আয়ান। কার ফোন দেখার মতো হুঁশ না থাকায় এমনি রিসিভ করে কানে লাগাল ফোন। কিন্তু অপরপ্রান্তের থাকা মানুষটির প্রতিক্রিয়া শুনে প্রায় দশ সেকেন্ডের মধ্যে বড়ো বড়ো চোখ করে আশেপাশে তাকিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলো আয়ান। বোনের বাড়ি এসেছিল দু'দিন আগে। বোন আর বোনের জামাইয়ের আবদারে থেকে গেছে এই ক'দিন।
" অনিমা কী হয়েছে তোমার? এভাবে হু হু করে কাঁদছ কেন? "
আয়ান ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলো। অনিমা কোনো উত্তর না দিয়ে মরার মতো কাঁদতে ব্যস্ত এখনো। আয়ান খুব কষ্ট করে ধৈর্য ধরে চুপ করে আছে। এই মেয়েকে বারবার জিজ্ঞেস করেও লাভ নেই। নিজে না বললে কান্নার কারণ আয়ানের পক্ষে ধমকে জানা সম্ভব নয়। তাই চুপ করে রইলো মিনিট পাঁচেক। ততক্ষণে অনিমার কান্নার বেগ কিছুটা কমেছে। কাঁদো কাঁদো গলায় বলে অনিমা,
" আজ দুদিন হয়ে গেলো তোমাকে দেখি না,রাতে জড়িয়ে ধরি না। আমার বুকটা খালি খালি লাগে রে এএএ। আমার এখন কী হবে বলো? আমার আর ভালো লাগে না কেনো?"
খুব করে একটা ধমক দিতে ইচ্ছে করলেও সেটা পারছে না আয়ান। ছোটো মেয়ে ধমক দিলে আবার অন্য ঝামেলা। খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে অসুস্থ হয়ে যাবে।
" অনিমা আমি আজকে বিকেলে রওনা হবো। রাতের মধ্যে বাসায় ফিরবো। সেই হিসেবে কালকে আমাদের দেখা হবে ইনশাআল্লাহ। এবার চোখমুখ ধুয়ে এসো যাও।"
" পরশু! কালকে? না থাক, ঠিক আছে। কিন্তু দেখা হবে? আর কিছু হবে না? আমাকে জড়াবে না বুকে? "
আল্লাহ! এই মেয়ের অদ্ভুত আচরণে অতিষ্ট হওয়ার যোগাড় হয়েছে আয়ানের। এইটুকু মেয়ের মাথায় সব আঠারো প্লাস চিন্তা সারাক্ষণ! মাঝে মধ্যে আয়ানের ইচ্ছে করে এখুনি বিয়ে করে বিয়ের সাধ ঘুচিয়ে দিতে। আয়ান লম্বা করে শ্বাস নিলো। নিজেকে শান্ত করে বললো,
" তোমার যা যা লাগে সব হবে। ওকে? এখন চুপচাপ ঘুমাও আর আমাকেও ঘুমাতে দাও।"
" ঠিক আছে। লাভ ইউ এন্ড উম্মাহহ।"
" হুম দুই।"
" দুই আবার কী? বলো লাভ ইউ টু। আর একটা পাপ্পি দাও! "
" উম্মাহ এর চৌদ্দ গুষ্টির তুষ্টি! "
আয়ান বিরবির করে বললো কথাটা। অনিমা শুনতে পায়নি ঠিকমতো তাই আবারও জিজ্ঞেস করলো। আয়ান চোখ বন্ধ করে কোনোরকমে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে বললো,
" উম্মাহহহ,লাভ ইউ টু, থ্রি, ফোর। টাটা।"
" টাটা। "
অনিমা কল কাটতেই হাঁপ ছেড়ে বাঁচল আয়ান। দিন যত যাচ্ছে অনিমার পাগলামি বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগে তো তা-ও টিচার ছিলো একটু-আধটু ভয়ডর পেতো মেয়েটা। কিন্তু এখন তো সে ডোন্ট কেয়ার মুডে থাকে সব সময়। যতসব ন্যাকামি মার্কা কার্যকলাপ আছে সবকিছুই করে সে। এজন্যই দামড়া ছেলেদের নিব্বিদের সাথে প্রেম করতে নেই। মনে মনে এসব বলে নিজেকে গালিগালাজ করলো আয়ান। তারপর ফোনটা রেগেমেগে খাটের নিচে রেখে ফের ঘুমানোর চেষ্টা করলো। সকাল পাঁচটা বেজেছে সবে। এখনো ঘন্টা তিনেক ঘুমানোর প্ল্যান আছে আয়ানের। বিকেলের বাসে উঠে বাড়ির দিকে রওনা দিবে। বোনের সংসার বেশ ভালোই চলছে। সেজন্য মনে মনে ভীষণ প্রশান্তি অনুভব করেছে আয়ান।
স্কুল শেষে আজকে একটু বাবার বাড়ি যাবে বলে ঠিক করেছে তাহমি। শরীরটা কেমন লাগছে ক'দিন ধরে। প্রেশার কমে গেছে খুব। মা'কে দেখতে ইচ্ছে করছে হঠাৎ। আয়ান বাড়িতে নেই, মা একেবারে একা ভেবেই বিকেলে যাওয়ার প্ল্যান করেছে তাহমি। সহন একবার বলেছিল ও নিজেও অফিস শেষ করে শ্বশুর বাড়ি যাবে। কিন্তু তাহমি মানা করে দিয়েছে। সব সময় না বলতেই যেতে হবে কেন? যেকোনো জায়গায় নিজের মূল্য বজায় রেখে চলতে হয়। তাই আজকের রাতের মতো বিচ্ছেদ হয়েছে দু'জনার। আসরের আজানের কিছুক্ষণের মধ্যেই তাহমি তার বাবার বাসায় পৌঁছে গেছে। আয়ানকে কল করেছিল তাহমি। জানিয়েছে সে বাসে আছে। বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত একটা কিংবা দু'টো বাজতে পারে।
" তাহমি সহন এলো না কেনো? কিছু আবার হয়নি তো?"
বসার ঘরে সোফায় বসে আছে মা ও মেয়ে। মায়ের কথায় নড়েচড়ে উঠলো তাহমি। সত্যি বলতে তো কিছু হয়নি। সেসব মাকে বলা স্বত্বেও মা একই প্রশ্ন করে যাচ্ছে।
" কিছু হয়নি তাহলে এলোনা কেন? ঝগড়া করে এসেছিস নাকি?"
" আরে না। এমনি আসতে পারি না বলো?"
" পারবি না কেনো? কিন্তু বিয়ের পর কখনো একা আসতে পারবি না। হয় তুই এখনই বাড়ি চলে যাবি নয়তো সহনকে কল দিয়ে আসতে বলবি। মাগরিবের আজান হয়নি এখনো, আরামসে চলে যেতে পারবি তুই।"
মায়ের কথায় চমকাল, থমকাল তাহমি। উনি আসলেই ওর মা? জামাইকে সাথে আনলো না বলে ফেরত পাঠিয়ে দিতে চাইছেন! তাহমি ক্লান্ত ভঙ্গিতে বললো,
" আসতে বললাম মেসেজ করে সহনকে। এবার ঘরে যাই আমার? "
" যা গিয়ে বিশ্রাম কর। সহন এলে আমি ডেকে দিবো।"
" দিও।"
তাহমি নিজের ঘরের দিকে এগোলো। বাড়িটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে আজ। তৃষার বিয়ের পর আজকেই প্রথম এ বাড়িতে এলো তাহমি। ছোটো বোনটার অনুপস্থিতি খুব পোড়াচ্ছে তাহমিকে। যদি আসার আগে কল দিয়ে কথা বলেছে তৃষার সাথে। তবুও চোখে দেখা আর ফোনে কথা বলার মধ্যে অনেক পার্থক্য!
" ভাই আজ জলদি যাচ্ছেন যে? "
সহনকে অফিস থেকে বের হতে দেখে দারোয়ান সালমান জিজ্ঞেস করলো হেসে। সহন দাঁড়িয়ে গেলো একটু। সহাস্যমুখে বললো,
" শ্বশুর বাড়ি যাবো সালমান ভাই। তুমিও বিয়েটা করে নাও। "
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মলিন হাসলো সালমান।
" সাবধানে যেও তবে। "
" আচ্ছা সালমান ভাই এলাম।"
সহন বেরিয়ে গেলো অফিস থেকে। সালমান চোখ বন্ধ করে হারানো প্রেয়সীর মুখশ্রী দেখে নিলো একবার। এই পৃথিবীতে সব পুরুষ প্রেয়সীকে হারিয়ে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে পারে না। পারে না প্রেয়সীকে ছাড়া নিজের অস্তিত্ব ভাবতে। সালমানও ঠিক সেই ধরনের পুরুষ।
.
.
.
চলবে........................