#আরোরা (ফ্যান্টাসি, হরর, রোমান্টিক)
#সূচনা_পর্ব
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
দূরে কোথাও থেকে নেকড়ের ডাক ভেসে আসছে। পূর্ণিমার রাত! চারদিকে চাঁদের আলোতে ঝলমল করছে। মাঝে মধ্যে আবার মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ছে চাঁদ। নিশুতি রাতে চারদিক জনমানবশূন্য। দূর দূর পর্যন্ত শুধু শেয়াল আর কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছে। এখানে সন্ধ্যার পরে আর কেউ বাড়ির বাইরে বের হয় না। এটা হলো হলিথান শহরের ছোট্ট একটা গ্রাম, নাম মিচবা। এখানেই একটা দোতলা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে আর্থার। আর্থার পেশায় চিকিৎসক, দেখতে শ্যামবর্ণ, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী বটে। সে অন্য শহরের মানুষ। চাকরির সুবাদে এখানে এসেছে। তাই এখানকার প্রচলিত ধারণা তেমন বিশ্বাস করে না। আর্থার তার প্রেমিকা সেলিনের জন্য অপেক্ষা করছে। গতকাল সেলিনকে পাত্রপক্ষ এসে দেখে গেছে বলে জানিয়েছে সেলিন। সেই বিষয় কথা বলার জন্যই এই মাঝরাতে ছুটে এসেছে আর্থার। সেলিনের সাথে পরিচয় তার কয়েকমাসের হলেও ভালোবাসার পরিমাণ অনেক বেশি। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখে নিলো আর্থার। রাত দেড়টা বাজে। সেলিন কি আর্থারের চিঠি পায়নি তাহলে? ভাবনায় হারালো আর্থার। সন্ধ্যায় যখন আর্থার সেলিনের বাসায় সামনে দিয়ে যাচ্ছিল তখুন সে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে ছিলো। তখনই সবকিছু জানায় সেলিন। আর্থার তখন এটাও বলে যে গভীর রাতে সে দেখা করতে আসবে। সেলিন অবশ্য রাতে তাকে বাইরে বেরোতে বারণ করেছিল কিন্তু আর্থার বড্ড জেদি এবং একগুঁয়ে লোক।
" আর্থার!"
সমস্ত জল্পনাকল্পনা থেকে বেরিয়ে এসে আর্থার পেছন ফিরে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। ওই তো সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেলিন। ধবধবে ফর্সা দেখতে মেয়েটার কোমর ছাপিয়ে কালো রঙের চুলগুলো ভীষণ সুন্দর লাগে। আর্থার সেলিনের দিকে এগিয়ে গিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তাকে।
" এতো দেরি করে এলে কেনো সেলিন? আমার চিন্তা হচ্ছিল তো!"
আর্থারের চিন্তিত মুখখানা দেখে সেলিন মৃদু হাসলো। কোনো উত্তর না দিয়ে প্রেমিক পুরুষের চুলগুলো একহাতে খামচে ধরে তড়িৎ গতিতে ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো। আর্থার কেঁপে উঠল সেলিনের আগ্রাসী চুমুতে। এক হাতে পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে অন্য হাতে আর্থার এলোমেলোভাবে ছুঁয়ে দিতে লাগলো সেলিনকে। সেলিনের নিঃশ্বাসের সাথে সাথে বক্ষ উঠানামা করছে। কিয়ৎক্ষণ বাদে দু'জন দু'জনাকে ছেড়ে শান্ত হলো। আকাশে মেঘ করেছে। চাঁদের আলো ঢাকা পড়ে আছে সেই মেঘের আড়ালে। সেলিনকে পেছন দিক থেকে জড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে আর্থার। সেলিন কথা বলতে লাগলো,
" আর্থার তোমার উচিত এখন এখান থেকে চলে যাও। আমরা কালকে দিনে কথা বলবো। আমাকে এখুনি যেতে হবে। "
আর্থার সেলিনের কথায় নারাজ হলো। সেলিনের ঘাড়ে অস্বাভাবিক কিছু আঁচড়ের দাগ দেখে সেলিনের ঘাড়ে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করলো ,
" তোমার ঘাড়ে কী হয়েছে সেলিন?"
সেলিনের অস্থির লাগছে ভীষণ। সত্যি কথাটা আর্থারকে বললে চিন্তা করবে বলে লুকিয়ে গেলো সে।
" বাগানে ঝোপগুলো পরিষ্কার করতে গিয়ে এমন হয়েছে। তুমি এখন যাও আর্থার পরে কথা হবে। "
" তোমার বিয়ে নিয়ে কথা বলতে এসেছি আমি সেলিন। আমি একজন প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসক। তুমি তোমার বাসায় আমার বিষয় কেনো জানালে না?"
" আর্থার আমার বিয়ে হয়ে যায়নি এখনও। প্লিজ তুমি যাওওও। আমার পক্ষে আর বেশিক্ষণ থাকা সম্ভব না।"
সেলিনের ফ্যাকাসে মুখখানা আর্থার দেখতে পাচ্ছে না। পূর্ণ চাঁদের আলোতে সেলিনের চেহারার অস্পষ্টতা ফুটে উঠছে। মেঘ সরে গিয়ে চাঁদের আলোয় আবারও ঝলমল করছে মিচবা গ্রামের অলিগলি । আরো জোড়ালোভাবে দূর থেকে অনেকগুলো নেকড়ের ডাক ভেসে আসছে। সেলিনের সমস্ত শরীর ব্যথায় ঝিমিয়ে আসছে। সহ্য করতে না পেরে আর্থারকে নিজের থেকে ছিটকে দূরে সরিয়ে দিলো সে। আর্থার সেলিনের আচমকা বলপ্রয়োগে টাল সামলাতে না পেরে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। চাঁদের আলোয় সেলিনের দিকে তাকিয়ে আর্থার যা দেখলো তাতে রক্তহিম হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে তার। সেলিনের শরীরের চামড়া ভেদ করে বড়ো বড়ো লোম বেড় হয়েছে। ধীরে ধীরে তার শারীরিক আকৃতি পরিবর্তন হয়ে আকার নিয়েছে এক বিশালাকার নেকড়ের। ধূসর রঙের লোমশ শরীর আর হলদেটে দাঁতে বড়োই ভয়ংকর লাগছে সেলিনকে। আর্থার শুকনো ঢোক গিলে ভয়ে বসেই রইলো। তাকে যে এই মুহুর্তে পালাতে হবে তা-ও যেনো ভুলে গেছে সে। সেলিন তার দানবীয় দাঁত বের করে আর্থারের দিকে দৃষ্টিপাত করলো। আর্থার চিৎকার করে উঠার আগেই চোখের পলকে সেলিন তার শরীর থেকে মাথা আলাদা করে ফেললো। আর্থারের শরীর পড়ে রইলো সেখানেই আর মাথা ছিটকে গিয়ে পড়লো কিছুটা দূরে। সেলিন থামলো না সেখানে। চাঁদের আলোর দিকে তাকিয়ে জোরে ডেকে উঠে মিচবা শহরের জঙ্গলের দিকে এগিয়ে গেলো। জঙ্গল পেরোলেই পাহাড়ি অঞ্চল। সেদিকে কোনো পশুপাখি পর্যন্ত থাকে না। সেখানেই পাগলের মতো ছুটে যাচ্ছে সেলিন। সেখানেই আছে তার সমজাতীয়রা!
ভোরের আলো ফুটতেই মিচবা শহরে ডাক্তার আর্থারের মৃত্যুর সংবাদ ছড়িয়ে পড়েছে। সবাই ভয়ে ভয়ে আর্থারের লাশ দেখছে। এমন বিভৎস রকমের খুন এর আগেও হয়েছে এই গ্রামে। তবে গত দুই বছরের মধ্যে আবার এমন খুনের কোনো ঘটনা ঘটলো আজ। আর্থারের মৃত্যু সংবাদে সবাই কেমন আতংকিত হয়ে গেছে।
" শুনেছিস? গতকাল রাতে ডাক্তার সাহেব খুন হয়েছে! "
গরম পানির মধ্যে একপ্রকার গুড়ো মেশাতে মেশাতে আরোরাকে উদ্দশ্য করে বললো এনা। এনাও পেশায় একজন চিকিৎসক তবে তার চিকিৎসা পদ্ধতির সবটাই জড়িবুটির মাধ্যমে হয়। অর্থাৎ বিভিন্ন লতাপাতা, গাছের বাকল,ফল ও ফুল দিয়ে সে নিজেই ঔষধ তৈরি করে। আরোরা এখনো বিছানায় শুয়ে আছে। দু-চোখে তার ঘুম। বোনের কথায় বিশেষ খেয়াল নেই তার। বাবা-মা নেই ওদের। দু'জনের ছোটো সংসার। আরোরা পাশের স্কুলে চাকরি করে। আজ ছুটির দিন।
" হুম।"
আরোরার হু হুা করা খুব বিরক্ত লাগে এনার। মেয়েটা সব সময় এমন ঘুমিয়ে হু হা করবে কেনো? এনা হাতের কাজ রেখে আরোরার পাশে এসে বসে চোখেমুখে পানির ছিটে দিলো। আরোরা বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে ফেলে বললো,
" ওহ আপু! দিলে তো ঘুমের বারোটা বাজিয়ে! ভাল্লাগে না। "
এনা এতক্ষণে আবার নিজের ঔষধ বানানোর কাজে লেগে পড়েছে। এনা বয়সে আরোরার পাঁচ বছরের বড়ো। দেখতে সুন্দরী, লম্বা রোগা-সোগা শরীর। আরোরা চবিশ বছর বয়সী এক যুবতী। ধবধবে দুধে আলতা গায়ের রঙ তার, চোখগুলো নীলাভ সবুজ। কোমরের নিচ পর্যন্ত হালকা সোনালী রঙের চুলগুলোতে রোদের আলো পড়ে কেমন ঝলমল করছে তার।
" কথা না বলে তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাস্তা সেড়ে নে। আমাদের বেরোতে হবে। "
আরোরা কথা বাড়ালো না। সে জানে আর্থার মারা যাওয়াতে তার বোন মনে মনে খুশি হয়েছে। কারণ এখন হলিথান শহরে আর কোনো চিকিৎসক নেই। ছোট্ট মিচবা গ্রামে বাইরে থেকে সহজে কেউ আসতে চায় না। বেচারা আর্থার এসেছিল সাহস করে। সেই সাহসের বিনিময়ে নিজের প্রাণ হারাতে হলো তাকে। রাত নামলেই হলিথন শহরে নেমে আসে অশুভ শক্তির ছায়া। মাঝে মধ্যে দুই অপশক্তির মধ্যে লড়াইও হয়। হলিথান শহরের দুই দিকে রয়েছে দু'টো আলাদা সম্প্রদায়ের আবাসস্থল। কেউ কেউ বলে তারা একে অপরের শত্রুপক্ষ। একদল আসে এখানকার মানুষের রক্ত চুষে খেতে আর অন্যদল রক্তমাংস সব!
ঘুমন্ত অবস্থায় শরীরের স্পর্শকাতর জায়গায় কারো ছোঁয়া পেয়ে নড়েচড়ে উঠলো সাঁচি। তবে সাঁচির ঘুম যথেষ্ট গাঢ়। তাই ঘুম ভাঙলো না তার। কিন্তু তার অবচেতন মস্তিষ্ক বুঝতে পারছে কেউ তাকে বাজেভাবে ছুঁয়ে দিচ্ছে,শরীরের প্রতিটি স্পর্শ অনুভব করছে সে। গলা থেকে বক্ষ বিভাজনের মাঝ বরাবর প্রচন্ড জ্বালাপোড়া অনুভূতি হচ্ছে সাঁচির। ধীরে ধীরে সেই জ্বালাপোড়া তলপেটের নিচ অবধি পৌঁছে যেতেই হুড়মুড় করে উঠে বসলো সে। ঘনঘন শ্বাস-প্রশ্বাস নিচ্ছে সাঁচি। সেই সাথে পুরো ঘরে নজর বুলিয়ে নিলো কেউ আছে কি-না সেজন্য। কপালে ঘামের বিন্দুগুলো চিকচিক করছে ডিম লাইটের মৃদু আলোয়। সাঁচির ভীষণ অস্বস্তি লাগছে। গা কেমন ঘিনঘিন করছে। বিছানা থেকে উঠে গিয়ে রুমের বাতি জ্বেলে দিলো সে। আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই চমকাল সাঁচি। নিঃশ্বাস বন্ধ যাবে এমন মনে হচ্ছে। গলায় স্পষ্ট কারো নখের আঁচড়! ঘাড়ে সুচের মতো কিছু একটা বিঁধেছে। ক্ষীণ দাগ একটা! ভয়ে ভয়ে পরনের কামিজের কিছু অংশ খুলে বুকেও আঁচড় আছে কি-না চেক করলো সাঁচি। মেয়েটার দিশেহারা অবস্থা এখন। শরীরের যেসব জায়গায় জ্বলুনি হচ্ছে সেসব জায়গায় একইরকম লালচে হয়ে গেছে। কিন্তু এই দোতলার ঘরে কেউ কীভাবে ঢুকলো! সাঁচির মাথা ঘুরছে, দুচোখ ঝাপসা হয়ে আসছে ক্রমশ।
" ম্যাক! তোমার কী সমস্যা? তোমাকে কতবার আমি বলেছি শহরের বাইরে যাবে না। গেলেও সাথে কাউকে নিয়ে যাবে।"
বাবার কথায় বিশেষ কোনো ভাবমূর্তির পরিবর্তন ঘটলো না ম্যাকের। পঁচিশ বছর বয়সী যুবক ম্যাক,বলিষ্ঠ দেহ। সোনালী রঙের চুলগুলো চাঁদের আলোয় ভীষণ সুন্দর লাগছে। চোখের মনি লালচে নীলাভ তার। মুখের দু'পাশে সুচালো দু'টি হিংস্র দাঁত। তবে সে চাইলে দাঁতগুলো লুকোতে পারে।
" বাবা আমার দরকার ছিল তাই গিয়েছিলাম। "
" তুমি জানো আমাদের এরিয়ার বাইরে মিচবা গ্রামে নেকড়ের দলও ঘুরে বেরোয়। তারা আমাদের জন্য কতটা বিপজ্জনক সেটা নিশ্চয়ই তোমাকে বলে দিতে হবে না? "
ছেলের দিকে তাকিয়ে রাগী গলায় বললো কিয়াম। ম্যাক বেপরোয়া স্বভাবের ভ্যাম্পায়ার। সে তার কালো আলখেল্লার ভেতর থেকে একটা সুচাল রুপোর অস্ত্র বের করে বাবার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
" আমি সব সময় নিজের প্রটেকশন রাখি বাবা। অযথা চিন্তা করা আমার পছন্দ না।"
কিয়ামকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিজের কক্ষে চলে গেলো ম্যাক। মানবীর শরীরের আকর্ষণে সে আবারও যাবে গ্রামে। রক্তের তৃষ্ণা নয়,এবার সে মজেছে এক মানবীর যৌবনে। মনে মনে এসব ভেবে মুচকি হাসলো ম্যাক। কিয়াম ছেলের আচরণে হতাশ। ভ্যাম্পায়ার রাজ্যের রাজপুত্র এডওয়ার্ডকে সরিয়ে নিজের ছেলে ম্যাককে সিংহাসনে বসানোর স্বপ্ন তার বহুদিনের। কিন্তু এই ছেলের ভাব-গতিক দেখে খুব রাগ হয় কিয়ামের।
চলবে........................