নিশীভাতি - পর্ব ৬৮ - মুশফিকা রহমান মৈথি - ধারাবাহিক গল্প


"হুসনেয়ারা, আমাদের অতিথিরে একটু খাওন দিয়ে যাও। যতই হোক মন্ত্রীমশাইয়ের বউ সে"

কথাটা শুনতেই একজন মহিলা ঘরে প্রবেশ করে। যাকে দেখতেই হুমায়রার চোখ বিস্ফারিত হয়। অবিশ্বাস তীব্র ভাবে ছেয়ে যায় মুখে। অস্পষ্টস্বরে বলে,
 "আম্মা"

হুমায়রার বিমূঢ় মুখশ্রী দেখে মৃদু হাসলো যুবাইদা। একেবারে মুখোমুখি দাড়ালো। হাসি মুখে শুধালো,
 “কেমন আছিস মা?”
 “আপনি এখানে?”

হুমায়রার বিহ্বল প্রশ্নের সাপেক্ষে তার ঠোঁট বিস্তৃত হলো। মিষ্টি স্বরে বললো,
 “আমার ঘরে আমি থাহুম না তো কে থাকবো?”
 
হুমায়রা এবারো কিছু বুঝলো না। ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে রইলো শুধু। সব কিছুই কেমন যেনো ঘোলাটে লাগছে। হঠাৎ যুবাইদা তার মুখোভাব বদলালো, হুমায়রার বাঁধা হাতে আলতো করে ছুঁইয়ে বললো,
 “আহারে, কেমনে বাইধে থুইছেন। মাইয়াডার কষ্ট হইতেছে না। যতই হোক মন্ত্রীর বউ। একটু সজ্য কর মা। ছাইড়্যা দিম। শুধু তোর ওই বদ বরডা আমগোর কথা হুনলি তোরে ছাইড়্যা দিমু”

হুমায়রাকে নিশ্চুপ, হতবাক, বিমূঢ় দেখে যুবাইদা আবার হাসলো। নিজের মাথায় চাটি মেরে বললো,
 “ইশ! মেলা চমকায় দিলাম তোরে। ভয় পাইছোস? ভয় পাইস না। উনি খারাপ লোক না। উনি আমার সোয়ামী। তোর ক্ষতি করার জন্য তোকে আনি নাই। আনতামও না, এই সব হইছে তোর বরের জন্য। ফাইজান খা**** পুতে যদি ঝামেলা না করতো এডি কিছুই হইতো না। তাই রাগলি ওর উপরে রাগ“

হুমায়রার মাথাটা ঝিম ধরে আছে। যুবাইদার এমন রুপ তার কল্পনাতীত। সে তো সত্যি তাকে বিশ্বাস করেছিলো, ভেবেছিলো এতো কিছুর পরও হয়তো মানুষটির মাঝে মাতৃত্ব জেগে উঠেছে। তাকে ভালো না বাসলেও মানুষটি ভাইজানকে সত্যি ভালোবাসে। ভাইজানের জন্য সে চিন্তিত। তাই তো নির্লজ্জএর মতো হুমায়রার কাছে সাহায্য চাইতো। কিন্তু ভুলে গিয়েছিলো, জন্ম দিলেই নারীর মাঝে মাতৃত্ব জন্মায় না। কিছু নারী মা হয় না, তারা হয় বিষধর সাপ। যুবাইদাও তেমন একটি বিষধর সাপ। হুমায়রা তাচ্ছিল্যভরে শুধালো,
 “আপনি আমাকে মিথ্যে বলেছেন? আপনার উদ্দেশ্য কখনোই ভাইজানকে বাঁচানোর ছিলোই না”
 
যুবাইদা নির্লজ্জের মতো হাসলো। তার হাসিতে মিশে রইলো দূর্বোধ্য অর্থ। হাসি থামিয়ে বলল,
 “ঠিক কইছো, আমি মিথ্যা কইছি। যে মানুষডারে নিজ হাতে মারিলাম, তার মরণের সাক্ষী দেই কেমনে। আমি তো ছিলাম ই না রাশাদের লগে। আমি তো খালি তোরে বাইর করতে চাইছি। তোর ব্যাডা যেমনে তোরে লুকাইয়্যা রাখছিলো। তুইও ঘাপটি মাইরে ছিলি। কেমনে তোরে বাইর করতাম। ওই ফাইজান, ওয় আমারে হুমকিও দেছিলো যেনো তোর লগে যোগাযোগ না করি। ও বুইঝে গেছিলো আমার মতলব। ভাবছিলাম কাওছাররে কামে লাগাই। কোনো ছুতা দিয়া ঘরে ঢুকবো। কিন্তু ওইহানেও ফাইজান বা হাত দেলো। আর কাওছারডা এমন ছাগল। শুধু টেহাই খাইতে পারে, কাম হয় না। ওর থাহা আর না থাহা এক। শুধু শুধু টেহা নষ্ট। মইরে অন্তত কামে আয়। তয় ওরে মারার সময় মেলা শান্তি পাইছি। পত্তেক মাইরের হিসাব নিছি। আহ শান্তি! আর ফাসলো রাশাদ। আহারে”
 “ভাইজান তো আপনার ছেলে! আপনার আর আপনার আগের স্বামীর নিশানী। আমাকে ঘৃণা করেন আমার আপত্তি ছিলো না। কিন্তু ভাইজানের উপর এতো ক্ষোভ কেনো আপনার? এতো জঘন্য একটা ষড়যন্ত্র কি করে করলেন?”

হুমায়রার কন্ঠে ক্রোধ স্পষ্ট। তার শরীর কাঁপছে রাগে। যুবাইদা এবার অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। ফ্যাসফ্যাসে স্বরে বলল,
 “তোর এহনো মনে হয় আমি যা কইছিলাম ঐডি সত্য? ওইডাতো বানানো গপ্প ছেলো। নয়তো বারবার তোর লগে কতা কওয়ার ছুতা কনে পাইতাম। বলদ ছেমরি। কাওছারের আগের বিয়া, সেই বিয়া থেইক্যা বাচ্চা এডি সব মিথ্যা। রাশাদ আমার আর ঐ জাওড়া কাওছারের পোলা। ওইডি তো আমি বানাইছিলাম কারণ আমি জানতাম রাশাদের কতা কইলেই তুই নরম হইবি। আর আমি যে কান্ড করিছি সেডাও মাফ করে দিবি”
 “কিন্তু আব্বা যে সবার সামনে কইছিলো……”
 “কাওছার মিঞায়ে টেহা দিলে ও নিজেরেও জারজ কইবো। তুই এত্তো বোকা কে রে হুমায়রা। তোর সত্যি লাগে আমি পচতাইছি বলে ক্ষমা চাইতে আইছি। না রে। সে তো উনি কইলো তোর বিয়া বাসুরের শত্রুর লগে হইছে। তাই তো বাঘ শিকার করতে জাল বুনিছি। তুইও ভেড়া, আর চারা। তুই চারা খাইতে আইছোস। এবার বাঘ আইবো জালে আটকাইতে। ফাইজান ঐহানে পাগল হইতাছে। ওর চেয়ার নড়লো বইলা”

হুমায়রার শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল রক্তের স্রোত নেমে গেলো যে। অজান্তেই কি ফাইজানের ক্ষতি করে বসলো।

***

প্রেস কনফারেন্সের আয়োজন হলো পুলিশ সুপারের অফিসে। হুট করে আয়োজনে সাংবাদিকদের মাঝে বেশ উত্তেজনা। তাদের একের পর এক প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হচ্ছে। এর মাঝেই পুলিশ সুপার বললেন, 
 “আমরা অবশেষে ফাইজান ইকবালের উপর আক্রমনের দূর্বৃত্তদের খোঁজ পেয়েছি। অলরেডি তাদের দুজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। চেয়ারম্যান দেলোয়ার সরদার এবং তার পুত্র আমান সরদারকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আমাদের কাছে ইনফোরমেশন রয়েছে এই আক্রমণে তাদের প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ রয়েছে। তবে আমাদের ধারণা এই আক্রমণের পেছনে আরোও মানুষের হাত আছে। ফাইজান ইকবাল সাহেবের স্ত্রীও বিকাল থেকে মিসিং। অপহরণকারী অফিসের গাড়ি নিয়েই গিয়েছিলো। গাড়ির লোকেশন ট্রাক করা হয়েছে। যেখানে গাড়িটি ফেলে আসা হয়েছে সেখানে অলরেডি ফোর্স রেইড দিচ্ছে। অপহরণকারী ছেলেটি নাদিম, তার ফোন ট্রাক করা হচ্ছে। তাকে খুব জলদি গ্রেফতার করা হবে। শুধু তাই নয়, যে খু’নের জন্য তার আত্মীয়কে ফাঁসানো হয়েছিলো সেখানেও খুব শকিং ঘটনা জানা গেছে। কেউ ইচ্ছেকৃতভাবে তাদের ঘরে অস্ত্র লুকিয়ে এসেছিলো। সেই সিসি টিভি ফুটেজও উদ্ধার হয়েছে। অন্ধকার হবার জন্য তার মুখখানা স্পষ্ট নয়। বিষয়টা খুব বড় ষড়যন্ত্র। ষড়যন্ত্রের মুলে যাওয়ার জন্য তদন্ত চলছে”

রুমের বাহিরে ফাইজান বসা ছিলো। তার মুখখানা শান্ত। পুলিশ সুপারের সাথে কনফারেন্স আগুনের মতো ছড়িয়ে গেলো। শুধু তাই নয় ফাইজানের সাথেও কথা বলার জন্য সাংবাদিকদের উৎসুকতা বাড়লো। ফরিদের বিরক্তি বাড়ছে। হুমায়রা বিকাল থেকে গায়েব। অথচ ফাইজানের সেদিকে মাথা ব্যাথা নেই। সে যদি লোকেশন জানে তাহলে কেনো সেখানে ফোর্স পাঠাচ্ছে না। এসব করে কি লাভ? তার ভয় তীব্র থেকে তীব্র হচ্ছে। বিরক্তি নিয়ে বললো,
 “সময় নষ্ট কেনো করছো ফাইজান? হুমায়রা ওদের হাতে”
 “জানি”
 “তাহলে এসব কেনো? ফোর্স নিয়ে ওখানে”
 “লাভ নেই, কারণ অলরেডি ওখানে ফোর্স চলে গেছে। গাড়িটা যেখানে রাখা সেখানে ওরা নেই”
 “তাহলে এখন?”
 
ফরিদের আতংক বাড়লো। ফাইজান খুব নিষ্পৃহ কন্ঠে বলল,
 “তোমার কি ধারণা আমি কেনো মামা আর আমানকে গ্রেফতার করিয়েছি? কারণ তারা জানে আসল লোকেশন। নিজেরা বাঁচার জন্য ঠিক উগড়াবে”
 “আর না উগড়ালে?”
 
ফরিদের প্রশ্নের উত্তর তার কাছে নেই। ফরিদ আবার একই প্রশ্ন করলো। অধৈর্য্য হয়ে বললো,
 “যদি ওরা না উগড়ায় কি করবে?”
 “যেভাবে সার্চ হচ্ছে সেভাবেই হবে”

কঠিন কন্ঠে উত্তর দিলো ফাইজান। ফাইজানের মুখশ্রীতে সেই কাঠিন্য স্পষ্ট। চোয়াল শক্ত হয়ে আছে তার। ফরিদ কিছু বলতে যেয়েও থেমে গেলো। ফাইজানও কথা বাড়ালো না। সবকিছুই বিরক্ত লাগছে তার। ইচ্ছে করছে সবকিছু ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিতে। পদ নামক গলার কাঁটা না থাকলে সে খু’ন করে ফেললো কেতাব চৌধুরী আর তার লোকদের। শুধু তাই নয়, নাদিমকে যদি সামনে পেতো সে নিজেও জানে না সে কি করতো। চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ফাইজান। মনে মনে বলল,
 “হুমায়রা একটু অপেক্ষা করো, একটু”

******

ফরিদ বেরিয়ে এলো বিল্ডিং থেকে। অনেক চিন্তা করে সে ফোন করলো একটি নাম্বারে। ওপাশের মানুষটি ফোন ধরতেই সে বলে উঠলো,
 “ভালো আছেন?”
 “আরে ফরিদ সাহেব যে?”
 “ভালোই চাল দিয়েছেন জব্বার সাহেব। ফাইজান তো কুপোকাত। তবে আমার মনে হয় না এতো জলদি তাকে পরাস্থ করা যাবে। আমার কাছে একটা প্লান আছে। সামনাসামনি কথা বলা যাবে?”…………
.
.
.
চলবে......................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp