আরোরা - পর্ব ০২ - তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া - ধারাবাহিক গল্প


#আরোরা (ফ্যান্টাসি, হরর, রোমান্টিক) 
#পর্ব_২
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া



সকালের রোদের আলোতে অর্ধ উন্মুক্ত শরীরে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে আছে এডওয়ার্ড। প্রতিদিন এই সময় সূর্যের আলো সবচেয়ে ক্ষীণ থাকে। তাই এই সময়টাতেই একটু প্রাকৃতিক আলো গায়ে মেখে নেয় এডওয়ার্ড। সূর্যের আলো যেমন ভ্যাম্পায়ারদের জন্য ক্ষতিকর তেমনই আবার সকালের এই সূর্যকিরণ উপকারী। সেজন্য এই সকাল সকাল এডওয়ার্ডের এভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। সুঠাম দেহের অধিকারী এডওয়ার্ড, রক্তবর্ণ চোখজোড়ার উপরে সুন্দর জোড়া ভ্রু দারুণ শোভা পাচ্ছে চেহারায়। সুচালো দু'টি হিংস্র দাঁত ঠোঁটের দুই পাশে। 
" এডওয়ার্ড ভেতরে এসো। সূর্যের তেজ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তোমার শক্তিক্ষয় হতে পারে। "
হেলগার দিকে দৃষ্টিপাত করলো এডওয়ার্ড। ব্যাস! এডওয়ার্ডের মনপ্রাণ যেনো শীতল হয়ে গেছে। মায়ের দিকে তাকালে যেকোনো সন্তানের হৃদয়ে শীতলতা ছেয়ে যায়। হেলগা ভীষণ শান্ত প্রকৃতির একজন ভ্যাম্পায়ার। তবে প্রয়োজনে যথেষ্ট অশান্ত হয়ে উঠতেও পিছপা হননা তিনি। এডওয়ার্ড মায়ের পাশে এসে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসলো। হেলগাও ছেলের হাসিতে হাসি মিলিয়ে তাকাল।
" কিছু বলবে মা?"
" তোমার বাবা চান এই পূর্ণিমায় তোমার রাজা হিসেবে অভিষেক হোক। যথেষ্ট যোগ্য তুমি এখন। "
এডওয়ার্ড একটু সময় নিলো ভাবতে। কিয়ৎক্ষণ বাদে বললো,
" ঠিক আছে মা। আমি একটু বাইরে বেরোবো এখন। "
" কোথায় যাবে?"
" হলিথান শহরে।"
" নাহ এডওয়ার্ড। তুমি কি জানো না সূর্যের আলোতে আমরা বেরোতে পারি না? তাছাড়া ওয়ারউলফদের আনাগোনা আছে মিচবায়। হলিথান শহরের মধ্যেও হয়তো আছে। "
" মা! আমরা কি ওয়ারউলফদের থেকে কম শক্তিশালী? সব সময় ওদের এতো ভয় কেনো পাও?"
" শক্তিতে আমরা সমকক্ষ হলেও মায়া বিদ্যায় ওরা সেরা। তাছাড়া ভ্যাম্পায়ারদের ওয়ারউলফদের সাথে কয়েকশো বছর ধরে শত্রুতা চলে আসছে। ওদের অঞ্চলে না যাওয়া আমাদের জন্য ভালো। "
এডওয়ার্ড মায়ের হাত ধরে বললো,
" মা তোমার ছেলে কোনো দিক থেকে কম নয়? আমি যাচ্ছি। বাইরে তাকিয়ে দেখো আকাশ মেঘলা হয়ে গেছে। আজকে আর সূর্যের দেখা মিলবে না। আমি আসছি।"
" এডওয়ার্ড শোনো! এডওয়ার্ড! "
এডওয়ার্ড বাদুড়ের রূপে উড়ে যেতে লাগলো হলিথান শহরের দিকে। হেলগা চিন্তিত হয়ে গেছে। এডওয়ার্ড তো জানে না তাদের পূর্বপূরষরা ওয়ারউলফদের সাথে অন্যায় করেছিল, ঘোর অন্যায়। সেই জন্য ভয় লাগে। যদি সে ফিরে আসে! তবে ভ্যাম্পায়ার সভ্যতার বিনাশও হতে পারে!

এনার চেম্বারে বসে আছে সাঁচি। সাঁচি একজন শিক্ষার্থী। সামনে লেখাপড়া শেষ করবে। গত কয়েক রাতে তার শরীরে অস্বাভাবিকভাবে জ্বালাপোড়া ও ব্যথা হচ্ছে। সেই কারণেই ডাক্তারের শরণাপন্ন হলো সাঁচি। এনা সাঁচির সব কথাবার্তা মনোযোগ সহকারে শুনেছে এতক্ষণ। 
" সাঁচি আপনার ঘরের জানালা কি খোলা থাকে রাতে? "
সাঁচি একটু সময় নিয়ে বলে,
" হ্যাঁ। গরমে জানালা বন্ধ করলে হাসফাস লাগে। "
" আজকের পর থেকে জানালা বন্ধ করে রাখবেন। আর এইগুলো জানালার পাশে রাখবেন। "
এনা কতগুলো রসুন আর লেবু সাঁচির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো। সাথে কিছু পবিত্র পানীয়। সাঁচি কিছুটা অবাক হলো বটে কিন্তু বুঝতে অসুবিধা হলোনা কিছু। 
" আপনি বলতে চাচ্ছেন এসব ভ্যাম্পায়ারের কাজ? আমার সাথে.....! "
" হ্যাঁ। বিচলিত হবেন না। "
" কিন্তু আমাকে একেবারে না মেরে এরকম আচরণ কেনো করছে?"
" সেটা তো আমি বলতে পারবোনা তবে আপনার শরীর থেকে রক্ত শুষছে না তেমন একটা। হয়তো সে আপনার সাথে ফিজিক্যাল হতে চাচ্ছে। "
এনার কথায় সাঁচি কিছুটা ভয় পেলো। কী ভয়ংকর কথা! সাঁচির শরীর খারাপ লাগছে। 
" ম্যাম আমি আজকে আসছি। আমার শরীর খারাপ লাগছে। "
এনা যাবতীয় ঔষধ একটা ব্যাগে ভরলো। তারপর সেগুলো এগিয়ে দিলো সাঁচির দিকে। 
" আপনি শুধু সব জায়গায় রসুন রাখুন তবেই হবে। পিশাচগুলো রসুন সহ্য করতে পারে না। আপনি মনোবল হারাবেন না একদমই। "
" ঠিক আছে ম্যাম। আসছি।"
সাঁচি দ্রুত উঠে বাইরে বেরিয়ে গেলো। বাইরে মেঘলা আকাশ,এনা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এমন একটা জায়গায় আছে যেখানে সবদিক থেকেই বিপদ। প্রাণ হাতে নিয়ে বাঁচতে হচ্ছে সবাইকে। হঠাৎ আরোরার কথা মনে পড়লো এনার। স্কুলে কী করছে মেয়েটা? ভ্যাম্পায়াররা আবার শহরে আসবে না তে? মেঘলা আকাশ দেখলেই এ শহরের সবাই আতংকে থাকে। রাত হলে নেকড়ের ভয় আর দিনে! 

স্কুল থেকে বেরিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে চেপে বসলো আরোরা। মেঘলা আকাশের কারণে আগেভাগে স্কুল ছুটি দিয়ে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। আরোরার ভীষণ বিরক্ত লাগছিল তাতে। এই পিশাচদের জন্য স্বাভাবিক মানুষের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে গেছে একেবারে। হঠাৎ ঘোড়াগুলো অস্বাভাবিক আচরণ করায় গাড়ি থেমে গেলো। আরোরার ধ্যানও ভঙ্গ হলো তাতে। 
" কী হলো সওয়ারি সাহেব?"
" বুঝতে পারছি না দিদিমনি। মনে হচ্ছে ওরা অশুভশক্তির আভাস পাচ্ছে। কী করবো এখন!"
আরোরা আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো একবার। শহরের সব মানুষ নিজ নিজ ঘরে চলে গেছে। গুটিকয়েক লোকজন ছাড়া কেউ নেই বাইরে। 
" আমি তো হেঁটে যাচ্ছি না হয় কিন্তু আপনি ঘোড়াগুলো নিয়ে কী করবেন? "
" আপনি চলে যান। আমি ঘোড়া রেখেই যাচ্ছি। প্রাণের থেকে তো ওদের দাম বেশি না। যান যান দিদিমনি।"
ঘোড়া সওয়ারি লোকটা আর কালক্ষেপণ করলোনা। দ্রুত পা চালিয়ে অন্য দিকে চলে গেলো। আরোরা এগিয়ে গেলো নিজ পথে। 
" একা একা যেতে ভয় লাগছে? "
হঠাৎ পুরুষালী গম্ভীর আওয়াজে থমকে দাঁড়ালো আরোরা। পেছন ফিরে তাকাল কন্ঠস্বরের অধিকারীকে দেখতে। এডওয়ার্ড আরোরার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আরোরার নীলাভ সবুজ চোখ দুটিতে যেনো এডওয়ার্ড আটকে গেছে। সোনালী চুলগুলো মৃদুমন্দ বাতাসে উড়ছে। 
" আপনি? "
আরোরা সামনে থাকা লোকটাকে এবার পরখ করে নিতে ব্যস্ত হয়ে উঠলো। কালো রঙের লম্বা পোশাক তার পরনে। চুলগুলো ঘাড় ছাপিয়ে গেছে। চোখগুলো কেমন লালচে রক্তিম বর্ণের!
" আমি এডওয়ার্ড। আপনি? "
" আমি আরোরা। "
" আপনি চাইলে আমি আপনার সাথে আপনার বাসা পর্যন্ত যেতে পারি। শহরের সবাই তো যার যার ঘরে অবস্থান করছে। আপনার নিশ্চয়ই একা যেতে ভয় লাগছে? কখন আবার রক্তচোষা পিশাচেরা আক্রমণ করে বলা তো যায় না! "
আরোরা লোকটার কথায় একটু ভাবুক হলো। ভুল বলেনি সে।
" বেশ চলুন।"
এডওয়ার্ড হাসলো নিঃশব্দে। আরোরা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে ছিলো সেই হাসির দিকে। কী সুন্দর হাসি! পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো দু'জন। কেউ কোনো কথা বলছে না। তবে এডওয়ার্ডের উসখুস লাগছে। আশেপাশে যখনই মানুষ দেখছে তখনই রক্ত তৃষ্ণা পাচ্ছে। কিন্তু অদ্ভুতভাবে আরোরার প্রতি কোনো আকর্ষণ হচ্ছে না এডওয়ার্ডের। সে কারণেই আরামসে দু'জন পথ চলছে। 

রাতের অন্ধকার নামতেই মিচবা গ্রামের দক্ষিণের পাহাড়ে সমবেত হয়েছে মায়ানেকড়ের দল। সেলিন দাঁড়িয়ে আছে অনেকগুলো নেকড়ের মধ্যে। মেয়েটা কাঁদছে। আশেপাশে আরো নেকড়েরা মানুষের রূপ ধারণ করেছে। সেলিনের বয়সী একটি মেয়ে সেলিনকে কাঁদতে দেখে এগিয়ে গেলো তার কাছে। 

" কী হয়েছে তোমার? এভাবে কাঁদছ কেনো? "
" আমাকে মেরে ফেলুন আপনারা। আমি এভাবে বাঁচতে চাই না। আমি নিজের হাতে আমার ভালোবাসার মানুষকে খুন করেছি। আমাকে মেরে ফেলুন।"
সেলিন বসে পড়লো। মেয়েটিও বসলো পাশে। আকাশে মেঘের আড়ালে চাঁদ ঢেকে আছে। সবাই নিজেদের মধ্যে কিছু একটা আলোচনা করতে ব্যস্ত। এঁরা সবাই এতদিন এখানে ছিলো আজকে ওয়ারউলফদের প্রাসাদে যাবে। নতুন ওয়ারউলফরা নিজেদের শক্তি সম্পর্কে অবগত নয় এখনো। কীভাবে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয় তা-ও আয়ত্ত করতে পারেনি। এখানে যারা আছে সবাই কোনো না কোনো নেকড়ের আঘাতে পরবর্তীতে নেকড়েতে পরিবর্তিত হয়েছে। 
" দেখো মেয়ে আমরা চাইলেও নিজে থেকে মরতে পারবো না। আমিও তোমার মতোন নতুন। জানি না কীভাবে এই জীবন থেকে মুক্তি মিলবে। আমাদের জীবন অভিশপ্ত। তুমি সবকিছু ভুলে যাও। এমনিতেই যখন নেকড়ের রূপ ধারণ করি আমরা তখন মানবীয় সমস্ত অনুভূতি হারিয়ে যায়। "

সেলিনের বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। আর্থারও যদি কোনোভাবে নেকড়ে হয়ে যেতো কতই না ভালো হতো! 

" এই তোমরা চলো। প্রাসাদে যেতে হবে আমাদের। সবাই নিজেদের আসল রূপে ফিরে এসো। "
আলেক্সার কথায় সকল নব্য ওয়ারউলফরা নেকড়ের রূপে ফিরে এলো। তারপর আলেক্সার পিছু পিছু এগোতে লাগলো পাহাড় ডিঙিয়ে রাজপ্রাসাদের দিকে। 



চলবে.........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন