আরোরা - পর্ব ০৩ - তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া - ধারাবাহিক গল্প


#আরোরা (ফ্যান্টাসি, হরর, রোমান্টিক)
#পর্ব_৩
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া



আলেক্সার পিছু পিছু এগোতে লাগলো পাহাড় ডিঙিয়ে রাজপ্রাসাদের দিকে। সবাই দলবেঁধে সামনে এগোচ্ছে। পাহাড় ডিঙিয়ে সমতল ভূমিতে এসেছে ওরা। সেলিনের চোখের জল শুকানোর নয়। অবিরত কেঁদে যাচ্ছে সে। আর্থারের সাথে ঘনিষ্ঠ মুহুর্তের দৃশ্যগুলো বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে।
" সবাই পা চালাও। "
আলেক্সার বলায় সবার হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলো। আলেক্সা হলো ওয়ারউলফদের মন্ত্রীর মেয়ে। বর্তমানে মন্ত্রী অসুস্থ থাকায় আলেক্সা নিজেই সকল কাজকর্ম সামলাচ্ছে। কিছুদূর এগিয়ে যেতেই নব্য ওয়ারউলফদের নজরে এলো বিশালাকৃতির এক প্রাসাদ। সবাই আস্তে আস্তে প্রাসাদের দিকে এগোলো। অজানা কৌতূহলে সবার মনটা আকুপাকু করছে। আলেক্সা সবাইকে প্রাসাদের মূল ফটকে ঢোকার পর নিজে মানবী রূপ ধারণ করে অন্য একটা কক্ষের দিকে সবাইকে নিয়ে গেলো। সেখানেই বসে আছে ওয়ারউলফ কিং নিক এবং কুইন হেক্সা। রাজা নিকের বয়স হচ্ছে, রাণী হেক্সারও একই অবস্থা। তবুও রাজ্য সামলাতে হয় উনাদের। কারণ উনারা নিঃসন্তান। 
" কিং সবাইকে নিয়ে এসেছি। "
আলেক্সা নিককে দেখিয়ে বাদবাকি সবাইকে ইশারায় বোঝালো এই হচ্ছে তাদের রাজা। সবাই ভয়ে ভয়ে সমস্বরে বলে উঠলো,
 " জয় আমাদের রাজার জয়, জয় মহারাণীর জয়।"

নিক সবাইকে হাত উঁচিয়ে থামতে ইশারা করলো। সাথে সাথে সবাই মানব রূপে ফিরে এলো। নিক সরু চোখে সবার দিকে দৃষ্টিপাত করলো। সেলিনের চোখে তখনও জল। নিক চমকাল। আজ পর্যন্ত ওয়ারউলফ মহলে কাউকে এতটা আবেগপ্রবণ হয়ে কাঁদতে সে দেখেনি।
" আলেক্সা ওই মেয়েটি কাঁদছে কেনো?"
আলেক্সা সেলিনের দিকে তাকিয়ে দেখে নিলো একবার। 
" সে তার প্রেমিককে খুন করেছে। এজন্য মন খারাপ। "
" খুন! নিজের সাথে নিয়ে এলেই তো হয়ে যেতো। আমাদের দলও ভারী হতো আর ওর সঙ্গী হিসেবে থাকতো। "
সেলিন অবাক হলো রাজার আচার-আচরণে। যথেষ্ট ভালো মনের উলফ বলেই মনে হচ্ছে তাকে। আলেক্সা বিরক্তি নিয়ে বললো,
" কিং এদের আমি থাকার জায়গা দেখিয়ে দিয়ে আসছি।"
" বেশ যাও।"
নিকের আদেশ পেতে আলেক্সা সবাইকে নিয়ে কক্ষ ত্যাগ করে। হেক্সা নিকের দিকে তাকিয়ে বলে,
" আর কতদিন আমরা অপেক্ষা করবো কিং? আমাদের আসল কিং এবং কুইনের খুনিদের শাস্তি কি হবে না? "
হেক্সার কথায় নিক দীর্ঘশ্বাস ফেললো কেবল। কিছু সময় কথা বলেও লাভ হয় না। সঠিক সময়ের অপেক্ষা করতে হয় কেবল। কিং নিকও তাই করছে। সঠিক সময় এলে তবেই ভ্যাম্পায়ারদের পতন নিশ্চিত হবে। 

সন্ধ্যা নেমেছে হলিথান শহরে। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। মাঝে মধ্যে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। জানালা আঁটকে দিলো আরোরা। টেবিলের উপর লণ্ঠন জ্বলছে। এনা শুয়ে শুয়ে একটা চিকিৎসা বিষয়ক বই পড়ছে। বোনের মুখে সাঁচির বিষয় শুনে মনটা খচখচ করছে আরোরার। সাঁচি আরোরার পরিচিত। বয়সে ছোটো হলেও মেয়েটা দেখা হলে একেবারে বন্ধুর মতোই আচরণ করে। ভয় লাগছে আরোরার,যদি সত্যি সত্যি সাঁচিকে মেরে ফেলে পিশাচেরা! ভালো লাগছে না কিছুই। আরোরা বন্ধ জানালার দিকে এগোলো। জানালার কপাট খুলে বাইরের দিকে দৃষ্টিপাত করলো সে। ঝুম বৃষ্টি বাইরে, সাথে শীতল হাওয়া। ডান হাত বাড়িয়ে কিছুটা বৃষ্টির পানি হাতে নিলো আরোরা। বেশ ভালো লাগছে এবার। যতদূর দৃষ্টি যাচ্ছে শুধু বৃষ্টি আর বৃষ্টি। একেবারে নির্জীব একটা গ্রাম। হঠাৎ সামনের রাস্তার দিকে তাকাতেই চমকাল আরোরা। কে জানি দাঁড়িয়ে আছে সেখানে এবং আরোরার দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ তার। আরোরা বৃষ্টির পানি ঝেড়ে দু'হাতে চোখ মুছে আবারও সেদিকে তাকাল। নাহ কোনো ভুল হচ্ছে না। এডওয়ার্ড দাঁড়িয়ে আছে? না-কি অন্য কেউ! পোশাক দেখে তো তেমনই মনে হচ্ছে। কিন্তু চেহারা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। আরোরা এসব ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল। একটু বাদে ফের তাকিয়ে দেখে সেখানে কেউ নেই! ভড়কে গেলো মেয়েটা। তাহলে কি দৃষ্টিভ্রম? 
" আরো! এই আরো কী দেখছিস তখন থেকে?"
এনার ডাকে আরোরা চমকে উঠলো। দ্রুত জানালা আঁটকে বিছানায় বোনের পাশে এসে বসে লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
" আপা তোমাকে বলেছিলাম না? এডওয়ার্ড নামে একজন সেদিন এগিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন?"
" হ্যাঁ, তো?"
" মনে হলো উনাকে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। "
বোনের মুখে এমন কথা শুনে জোরে হেসে উঠলো এনা। আরোরার মুখটা মলিন হয়ে গেছে তাতে।
" একে তো বৃষ্টি! তার ওপর আমাদের এলাকায় সন্ধ্যার পরে কেউ প্রাণের ভয়ে বাইরে নামেই না,আর তুই বলছিস লোকটা প্রাণের মায়া ত্যাগ করে তোকে দেখার জন্য রাস্তায় এসে দাঁড়িয়ে ছিলো?"
" আপা! আমি কি বলেছি আমার জন্য এসেছে? আমি বলেছি শুধু দেখেছি।"
" যা রুটি খেয়ে আয়। তারপর কাঁথা মুড়ি দিয়ে বৃষ্টিতে সুন্দর একটা ঘুম দে। আমার বই পড়া শেষ হলে আমি তারপর ঘুমাবো। "
" ঠিক আছে। "
আরোরা আর কিছু বললো না। চুপচাপ গুড় দিয়ে রুটি খেতে লাগলো। 

এনার কথামতো সাঁচি জানালা থেকে শুরু করে ঘরের চারপাশে রসুন রেখে ঘুমিয়েছে দু'দিন। আর তাতেই কাজ হয়েছে। এই দু'দিন আরামে ঘুমিয়েছে সাঁচি। কিন্তু ম্যাক আজকেও সাঁচির কক্ষের বাইরে উড়ছে। সাঁচিকে সে চায়, খুব করে চায়। ম্যাক হতাশ হয়ে বৃষ্টির মধ্যেই রাস্তায় হাঁটতে লাগলো। কী হচ্ছে তার সাথে? যেখানে সে সাঁচির রক্ত চুষতে এসেছিল সেখানে সে প্রথম দিনেই সাঁচির সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে আলিঙ্গন করেছিল তাকে। তারপর পরপর কয়েকদিন কাছাকাছি যেতেই যেনো অনুভূতি আরো তীব্র থেকে তীব্রভাবে বেড়ে গেলো। না, না মানুষের সাথে ভ্যাম্পায়ারের কিছু সম্ভব নয়। না মানসিকভাবে তাদের মিল হবে আর না শারীরিক। ম্যাকের অসহ্য লাগছে নিজেকে। বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে সেদিকে খেয়াল নেই তার। হঠাৎ সামনে কাউকে দেখে থমকে দাঁড়ালো ম্যাক। মুখ থেকে অস্ফুটে স্বরে বেরিয়ে এলো,
" রাজকুমার এডওয়ার্ড আপনি! "
এডওয়ার্ড নিজেও চমকাল ম্যাককে দেখে। 
" তুমি এখানে কী করছো ম্যাক?"
" আমি শিকার করতে এসেছিলাম রাজকুমার। "
ম্যাক মাথা নিচু করে বললো কথাটা কিন্তু এডওয়ার্ডের কাছ থেকে যে কিছু লুকানো যাবে না সেটা ভালো করে জানে ম্যাক।
" তা মনে হচ্ছে না আমার। শিকার করতে এলে তোমার চোখেমুখে হিংস্রতা থাকত। অথচ তোমাকে ভীষণ হতাশ লাগছে। "
" রাজকুমার আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি আপনাকে সঠিক কারণ বলতে পারবোনা। আমি আসছি।"
এডওয়ার্ড আর কিছু বলার আগেই আকাশে ডানা মেলে উড়ে গেলো ম্যাক। চিন্তিত হয়ে গেলো রাজকুমার এডওয়ার্ড। আনমনে হাঁটতে হাঁটতে সামনে এগিয়ে যেতেই চোখ বন্ধ করে ফেললো এডওয়ার্ড। রসুনের গন্ধ আসছে আশেপাশ থেকে। এডওয়ার্ড মাটি থেকে উপরে উঠে ডানা ঝাপটে রসুনের উৎস খুঁজতে লাগলো। বলা বাহুল্য এডওয়ার্ডের উপর রসুনের কোনো প্রভাব পড়ে না। একটু খুঁজতেই সাঁচির কক্ষের দিকে নজর গেলো। জানালার কাছে এগিয়ে গেলো এডওয়ার্ড। বিছানায় শুয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন এক যুবতী। বিছানার চারপাশে পর্যন্ত তার রসুন। এডওয়ার্ডের বুঝতে অসুবিধা হলোনা ম্যাকের আগমনের হেতু। কিন্তু এই মেয়ের সাথে তার উদাস চেহারার কী সম্পর্ক সেটা বুঝতে পারছে না। আচমকা দূর থেকে নেকড়েদের হাঁকডাক ভেসে আসছে। আকাশে তো চাঁদ নেই, তবুও কেনো এলো গ্রামে তারা? এডওয়ার্ড অহেতুক ঝামেলা পছন্দ করে না। কিন্তু যেচে কেউ ঝামেলা করতে এলে এড়িয়েও যায় না। 

" কী করছো ডেবিট! "
ঘরে ঢুকতেই আচমকা জড়িয়ে ধরায় চমকাল আলেক্সা। ডেবিট আলেক্সার প্রশ্নের কোনো প্রত্যুত্তর দিলো না। আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে ঠোঁটের স্বাদ নিতে ব্যস্ত হয়ে উঠলো সে। আলেক্সাও তালে তাল মিলিয়ে আলিঙ্গন করতে লাগলো ডেবিটকে। উদরে হাত বুলিয়ে ধীরে ধীরে হাত পিঠের দিকে নিয়ে গেলো ডেবিট। ঠোঁট ছেড়ে ঘাড়ে ওষ্ঠ ছুঁয়ে দিলো। কিয়ৎক্ষণ বাদে ডেবিট আলেক্সাকে ছেড়ে দিয়ে বললো,
" সারাক্ষণ কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকো,আমাকেও তো সময় দিতে হবে? "
" তুমি আমার স্বামী। তোমার জন্য তো আমার সবটা সময় বরাদ্দ থাকে ডেবিট। কিন্তু কাজ তো করতে হয়! বাবার দায়িত্ব এখন আমার উপর। তোমার কাজ তো কম তাই টের পাও না কিছু হু।"
" হ্যাঁ হ্যাঁ জানি তো আমি। আমার অর্ধাঙ্গিনী অনেক কাজ করে। "
" হ্যাঁ সেই সাথে তোমাকে ভালোবাসে। "
ডেবিট মুচকে হেসে ফের জড়িয়ে ধরে আলেক্সাকে। 

সারারাত বৃষ্টির পর সকালের মিষ্টি রোদে হলিথান শহরের লোকজন নিজ নিজ কাজে বাইরে বেরিয়েছে। শহরের প্রধান বাজারে হঠাৎ একলোকের চিৎকারে ছুটে আসে সবাই। খুন হয়েছে আবারও! অর্ধবয়স্ক এক মহিলার ছিন্নভিন্ন লাশ পড়ে আছে বাজারের মধ্যে। চেহারা দেখে বোঝার উপায় নেই লাশটা কার। তবে কারো বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না এসব উলফদের কাজ। শহরে যেসব নতুন নতুন উলফের জন্ম হয়েছে তারাই এরকম খুনগুলো করছে। ভ্যাম্পায়াররা যাও খুন করলে লাশটা অন্তত অক্ষত থাকে কিন্তু ওয়ারউলফরা মারলে শরীরের অংশ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়ে যায়। 



চলবে............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন