আরোরা - পর্ব ০৪ - তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া - ধারাবাহিক গল্প


#আরোরা (ফ্যান্টাসি, হরর, রোমান্টিক)
#পর্ব_৪
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া



নিজের ঘরে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে এডওয়ার্ড। বর্ষা মৌসুমে প্রায় সময় আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকে। যার ফলে ভ্যাম্পায়ারদের আনাগোনা এ সময় শহরে বৃদ্ধি পায়। কিন্তু উলফরা তেমন আসে না। পূর্ণিমা রাতেই কেবল ওদের শক্তি সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকে। সেই সময় ছাড়া ওদের নিয়ে কোনো চিন্তা নেই এডওয়ার্ডের। আপাতত আরোরার চিন্তায় মশগুল সে। মেয়েটার কথা বলার ধরণ, চোখের চাহনি, হাসি সবকিছুই যেনো চোখের সামনে দেখছে এডওয়ার্ড। একজন মানবীর প্রেমে কীভাবে পড়তে পারে ভ্যাম্পায়ার রাজ্যের ভবিষ্যত রাজা? কিন্তু প্রেম তো এসব দেখে হয় না। প্রেম এমন এক অনুভূতি কখন কার প্রতি এক পলকেই এসে যায় বলা মুশকিল। এডওয়ার্ড তো গিয়েছিল আরোরার রক্ত খেতেই! কিন্তু আরোরার চাহনি, টানা টানা চোখগুলো যেনো কথা বলে। ওমন চোখ এডওয়ার্ড জীবদ্দশায় আর দেখেনি। কী অদ্ভুত সবুজ রঙের চোখের মনি! উফ! এডওয়ার্ড এসব ভাবতে ভাবতে যেনো আরো বেশি করে আরোরার মধ্যে ডুবে যাচ্ছে। সে কি একবার হলিথান শহরের দিকে যাবে এখন? আরোরারা এখন মিচবাতে থাকে না। এনার ডাক্তারির সুবিধার জন্য প্রধান শহর মানে হলিথানে থাকে। বাইরের দিকে দৃষ্টিপাত করলো এডওয়ার্ড । মনে হয় না আজকে আর রোদের দেখা মিলবে। তাহলে তো যাওয়াই যায়। এডওয়ার্ড আরকিছুই ভাবলো না। জানালার ফাঁক দিয়ে উড়ে বেরিয়ে গেলো কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য। 

ইদানীং স্কুল প্রায় বন্ধ থাকছে। কারণ এখন বর্ষাকাল। বর্ষাকালে শহরে আতঙ্ক বেশি থাকে বলে অভিভাবকেরা তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠায় না। আর দু'চার জন ছাত্রছাত্রী নিয়ে তো আর স্কুল চলে না। সে কারণে আরোরার বেশিরভাগ সময় বাড়িতে কাটে।
 বিকেলবেলা, আরোরা জানালা দিয়ে বাইরের লোকজনের হালচাল পর্যবেক্ষণ করছে। জীবনটা কেমন অসহ্য লাগছে আজকাল। এনা তো নিজের কাজে চেম্বারে ব্যস্ত থাকে কিন্তু আরোরার তো বাইরে কাজ নেই। এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ এডওয়ার্ডকে দেখে চমকাল আরোরা। নিজের চোখের ভুল কি-না পরখ করতে হাত দিয়ে ইশারা দিলো সে। এডওয়ার্ড হাসলো বদলে। আরোরা চমকাল, থমকাল সেই হাসিতে। কী ভয়ংকর সুন্দর সেই হাসি! 
" আরোরা ঘুরতে যাবেন?"
এডওয়ার্ড গলা উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো। আরোরা দোটানায় পড়ে গেল। এনাকে না বলে কি অচেনা একটা লোকের সাথে বের হওয়া ঠিক হবে? এডওয়ার্ড উত্তরের আশায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। আরোরা কী করবে ভাবছে। চোখাচোখি হতে এডওয়ার্ড ফের মুচকি হাসলো। ইশ! আরোরার যেনো কী হলো। 
" আসছি।"
সময় নিলো না সে। শুধু গায়ে একটা বড়ো ওড়না পেচিয়ে চুলগুলো খোঁপা করে বাসা থেকে বেরোলো। এডওয়ার্ড আরোরাকে দেখে সামনে এগোচ্ছে। 
" কেমন আছেন? "
" এইতো ভালো,আপনি?"
" হুম এখন ভালো।"
" এখন ভালো? আগে বুঝি খারাপ ছিলেন? "
আরোরার প্রশ্নে ফের হাসলো এডওয়ার্ড। ছেলেটার এতো হাসতে হবে কেনো? দু'জনে পাশাপাশি হাঁটছে। 
" তাই হয়তো হবে। "
" গোলমেলে ব্যাপার। আচ্ছা আপনি কি এরমধ্যে একদিন সন্ধ্যায় বৃষ্টির মধ্যে মিচবা গ্রামে এসেছিলেন? "
আকাশে মেঘের আনাগোনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। উত্তরের ঠান্ডা হাওয়া জানান দিচ্ছে হয়তো বৃষ্টি আসার সময় ঘনিয়ে আসছে। আলগোছে আরোরার সোনালী চুলগুলো খুলে গেল হঠাৎ। এডওয়ার্ড মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। বিষয়টা আরোরা বুঝতে পেরে ওড়না দিয়ে চুলগুলো ঢেকে ফেললো। এডওয়ার্ড দৃষ্টি সংযত করে বললো,
" হ্যাঁ এসেছিলাম। তবে আপনাকে বিব্রত করতে চাইনি বলে পরে চলে গিয়েছিলাম।"
" আমি তাহলে ভুল দেখিনি! "
" আপনি ভুল নন ফুল!"
আরোরা এডওয়ার্ডের কথায় যতটা না অবাক হচ্ছে এডওয়ার্ড নিজে তারচে বেশি অবাক হচ্ছে নিজের কথাবার্তায়। ফুলের কথা তা-ও ভ্যাম্পায়ারের মতো নিষ্ঠুরতম প্রাণীর মুখে? আরোরা কোনো উত্তর দিলো না। চুপচাপ দু'জনে হাঁটতে হাঁটতে একটা ভাঙা বাড়ির সামনে দাঁড়াল। এদিকটায় কেউ তেমন আসে না। কারণ বেশি গাছপালার কারণে জঙ্গলের মতো লাগে । দিনের বেলায়ও সূর্যের আলো তেমন পৌঁছে না। 
" আমার ফিরতে হবে এডওয়ার্ড। হয়তো বৃষ্টি হতে পারে। এমনিতেই সন্ধ্যা হয়ে আসছে। বুঝতেই পারছেন দু'দিকে বিপদ।"
এডওয়ার্ডের বুঝতে অসুবিধা হলোনা আরোরার কথা। এরমধ্যেই টিপটিপ বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। 
" ঠিক আছে। চলুন আপনাকে এগিয়ে দিয়ে আসি।"
" আচ্ছা। "

সন্ধ্যা নেমেছে হলিথান শহরে। মিলা নামের ষোল বছরের একটি মেয়ে রাস্তা দিয়ে দ্রুত হাঁটছে। মিলা সাঁচির বোনের মেয়ে। খালার বাড়িতে আসবে বলে সেই বিকেলে বের হয়েছিল সে। কিন্তু পথিমধ্যে বৃষ্টি শুরু হওয়ায় এক দোকানে দাঁড়িয়েছিল মিলা। কপাল খারাপ, দোকানদার চরিত্রহীন একজন পুরুষ। মিলার দিকে বাজে দৃষ্টিতে বারবার তাকাচ্ছিল সে। একপর্যায়ে মিলাকে খারাপভাবে স্পর্শ করতে চাইলে মিলা দ্রুত দোকান থেকে বেরিয়ে হাঁটতে শুরু করে। নিজের অসম্মানের চেয়ে মৃত্যু শংকা ঢেরবেশি ভালো। এখন অবশ্য বৃষ্টি থেমে গেছে। আচমকা কী যেনো উড়ে গেলো মিলার আশেপাশে। চমকে উঠলো মেয়েটা। ভয় লাগছে তার ভীষণ। দ্রুত পা চালাতে শুরু করেছে মিলা। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির সাথে হালকাপাতলা মেঘের গর্জন আর বিদ্যুৎ চমকানির আলোতে কেমন ভয়ংকর লাগছে সবকিছু। মনেপ্রাণে সৃষ্টিকর্তার নাম নিতে নিতে সাঁচির বাড়ির প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে মিলা। ভয়ে ভয়ে মিলা অবশেষে বাসায় ভেতরে ঢুকে গেলো। ম্যাক স্বরূপে ফিরে বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটা যে সাঁচির কোনো আত্মীয় সেটা বুঝতে পেরেই প্রাণে রক্ষা পেলো। মনটা খারাপ লাগছে ম্যাকের। কতদিন সাঁচিকে কাছ থেকে দেখা হয়নি তার। সাঁচির অমতে তাকে স্পর্শ করা অপরাধ বুঝেও ম্যাকের ভীষণ ইচ্ছে করে ওকে একটু ছুঁয়ে দিতে। 

" সেলিন তোমাকে একটা কাজ করতে হবে। "
নিকের কথায় সেলিন ভাবনায় পড়ে গেল। তার মতো নগন্য নব্য ওয়ারউলফের কী কাজ থাকতে পারে রাজার জন্য? তবুও কৌতূহল সংবরণ করে শুধালো সেলিন।
" কী কাজ কিং?"
" আগামী পূর্ণমায় হলিথান শহরে কিংবা আশেপাশের অন্য শহরে এক নতুন শক্তির আবির্ভাব ঘটবে। আমাদের ভবিষ্যত সেই শক্তির সাথে জড়িয়ে। "
" আমাকে কী করতে কিং?"
" তুমি আর আলেক্সা যাবে খোঁজ নিতে। আলেক্সার সাথে তোমাকে পাঠানোর কারণ হলো তুমি হলিথান শহরের সবকিছু চেনো। তাছাড়া তোমার কার্যক্রমে আমি মুগ্ধ। তুমি একজন ভালো মনের মানুষ ছিলে।"
" ঠিক আছে কিং। আপনি যা চান তাই হবে। আমি আসছি এখন।"
" ঠিক আছে যাও।"
সেলিন চলে যেতেই নিক ভাবনার অতলে হারালো। তার মায়াবিদ্যা যদি ভুল না হয় আগামী পূর্ণিমায় সে আসবে তার আসল ঠিকানায়। এবং জেনে নিবে ভ্যাম্পায়ারদের নিষ্ঠুরতার কথা।

মিলাকে বাসায় পেয়ে সাঁচি ভীষণ খুশি হয়েছে। রাতে খাওয়াদাওয়ার পরে অনেকক্ষণ দু'জনে আড্ডা দিয়েছে। সাঁচি বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে। সাঁচির বাবা নেই, বছর চারেক আগে এক কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি। সেই থেকে সাঁচি আর সাঁচির মা একসাথে থাকে। মিলা আসাতে সাঁচির মা সবচেয়ে বেশি খুশি। কারণ মিলা এ বাসায় এলেই উনার সাথে ঘুমায়। 

নিশুতি রাত। চারদিকে নির্জনতা। বৃষ্টির পর কেমন শীতল হয়ে গেছে আবহাওয়া। কোনো বাতাস নেই শুধু কেমন একটা ভেজা ভেজা ভাব সবকিছুতে। সাঁচি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। হঠাৎ বন্ধ জানালা আস্তে আস্তে খুলতে শুরু করলো ওর কক্ষের। কপাট খুলে ভেতরে ঢুকলো বাদুড় রূপী ম্যাক। সাঁচির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো সে। আশেপাশে নজর বুলিয়ে নিলো একবার। না কোথাও কোনো রসুন নেই এখন। ম্যাক সময় নষ্ট করলো না। সাঁচির পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো আস্তে ধীরে। মেয়েটা ঘুমোচ্ছে বলে কতটা নিষ্পাপ লাগছে সেটা দেখে ম্যাকের ভীষণ ভালো লাগছে। ম্যাক কখনো সাঁচিকে সজাগ অবস্থায় দেখেনি। ইশ যদি মেয়েটার সাথে একটু কথা বলতে পারতো! ম্যাক আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো সাঁচির কপালে। কেমন নেশা নেশা লাগছে ম্যাকের। রক্তের নেশার চেয়েও যেনো বড়ো কোনো নেশা টানছে তাকে। সাদা রঙের পাতলা ঢিলেঢালা পোষাকে ভীষণ আকর্ষণীয় লাগছে সাঁচিকে। বুকের গঠন স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে বলে ম্যাকের কেমন হাসফাস লাগছে। এতদিন কোনো কিছু না ভেবেই অযাচিতভাবে ছুঁয়ে দিলেও আজকে সেটা পারছে না সে। কিন্তু নিজেকে নিয়ন্ত্রণও যে অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে। ম্যাক যখন আকাশপাতাল ভাবনার বিভোর তার মধ্যে ঘুম ভেঙে গেলো সাঁচির। মস্তিষ্ক সচল হতেই মাথায় কারো হাতের আলতো ছোঁয়ায় চমকাল সে। ঘুম ঘুম চোখে পাশে তাকাতেই অচেনা এক সুদর্শন যুবককে দেখলো। বিস্ময় যেনো সপ্তম আসমানে সাঁচির। কিছু না বলেই দ্রুত উঠে বসলো সে। ঘটনার আকস্মিকতায় ম্যাক নিজেও চমকে গেছে। 
" আপনি আপনি কে? এখানে কীভাবে এলেন?"
সাঁচির কন্ঠে ভীতি, চোখে বিস্ময়। ম্যাক কী করবে ভেবে না পেয়ে দ্রুত সাঁচিকে সম্মোহন করতে লাগলো। সাঁচি কিছু বোঝার আগেই ম্যাকের নিয়ন্ত্রণে চলে গেলো। হাঁপ ছেড়ে বাঁচল ম্যাক। সাঁচি নির্ভীক হয়ে বসে আছে। কপালে তার বিন্দু বিন্দু ঘাম। গলা বেয়ে ঘামের বিন্দু বক্ষ বিভাজনের দিকে গড়িয়ে পড়ছে। সাঁচি আসলে সবকিছু বুঝতে পারছে কিন্তু কিছু করতে পারছে না। ম্যাক তাকে পুরোপুরি সম্মোহন করেনি কারণ সে চায় সাঁচির কিছু কিছু মুহুর্ত মনে থাকুক। 
" সাঁচি আমি তোমাকে হয়তো ভালোবাসি। একটা অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছে তোমার জন্য ঠিক এখানে। অথচ আমরা হৃদয়হীন প্রাণী! "
নিজের বুকের বামপাশে ইশারা করে দেখাল ম্যাক। সাঁচি তাকিয়ে আছে শুধু। ম্যাক আবারও বললো,
" আমি তোমার কাছাকাছি যেতে চাই সাঁচি। আমি কিছুতেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিনা। জানো তো আমি ভালো নই, প্রেমে পড়লেও নিজেকে সংযত করার ক্ষমতা খুব কম।"
সাঁচি ভয়ে কেঁপে উঠল। তার চোখগুলো জানালার দিকে কিছু একটা খুঁজছে। না সমস্ত কক্ষে কোথাও রসুন নেই বলেই এই ভ্যাম্পায়ার প্রবেশ করতে পেরেছে। কে করলো এসব? নিশ্চয়ই অবুঝ মিলার কাজ এটা। ম্যাক সাঁচির চুলগুলো একহাতে আলতো করে খামচে ধরে ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো। সাঁচি চোখ বন্ধ করতে চাইলেও পারছে না। অসহ্য লাগছে তার। ম্যাক ধীরে ধীরে সাঁচিকে জড়িয়ে নিলো বুকে। সাঁচির ভয় করছে। কিন্তু কিছু করতে পারছে না। আজকে নিশ্চিত তার প্রাণ যাবে সাথে সতীত্বও! 



চলবে...........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন