আরোরা - পর্ব ০৬ - তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া - ধারাবাহিক গল্প


#আরোরা (ফ্যান্টাসি, হরর, রোমান্টিক) 
#পর্ব_৬
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া



 মেঘলা আকাশ, চারদিকে শীতল হাওয়া বইছে। আরোরা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে এডওয়ার্ড কখন আসবে বলে। এনা ঘুমিয়ে গেছে খানিকক্ষণ আগে। এডওয়ার্ডকে ঘিরে অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে আরোরার মস্তিষ্কে। কে এই এডওয়ার্ড? আর কোথা থেকে হুটহাট চলে আসে এই শহরে? 
" আরোরা!"
এডওয়ার্ডের কণ্ঠস্বর শুনে সচকিত দৃষ্টিতে তাকাল আরোরা। ইশারায় এডওয়ার্ডকে অপেক্ষা করতে বলে ধীরগতিতে বাসা থেকে বেরোলো সে। আরোরাকে সামনাসামনি দেখতেই মুচকি হাসলো এডওয়ার্ড। আরোরার কেমন নেশা নেশা লাগে এই হাসিতে। দু'জন চুপচাপ হাঁটতে শুরু করেছে। কী বলে কথা শুরু করবে কেউ বুঝতে পারছে না। সব কথা কেমন এলোমেলো হয়ে গেছে। হৃদকম্পন যেনো দ্বিগুণ গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কী এক অদ্ভুত অনুভূতি! 
" আচ্ছা এডওয়ার্ড আমরা কোথায় যাচ্ছি? "
" কোথায় যাচ্ছি আমিও জানি না। তবে হ্যাঁ তুমি চাইলে সামনে একটা পুকুর আছে। যদিও জায়গাটা একটু গাছপালায় ঘেরা কিন্তু সুন্দর। "
এডওয়ার্ডের কথা বিনাবাক্যে মেনে নিলো আরোরা। অথচ এই মেঘযুক্ত আকাশে, আবছা আলোতে কীভাবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করবে সেসব ভাবলো না। 
" ঠিক আছে চলুন।"
দু'জন আবারও চুপচাপ হাঁটতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। হাঁটতে হাঁটতে শানবাঁধানো ঘাঁট বিশিষ্ট একটা পুকুরের সামনে দাঁড়িয়ে গেলো দু'জন। এমনিতে ঠান্ডা আবহাওয়া এরমধ্যে বৃষ্টি হওয়ায় আরোরার বেশ শীত লাগছে। তবুও ঘাটে বসে পানিতে পা ডুবিয়ে দিলো সে। এডওয়ার্ড বসলো পাশে কিন্তু পানিতে পা দিলো না। 
" আরোরা তোমার তো ঠান্ডা লাগছে। পানিতে পা ডুবিয়ে রাখলে আরো ঠান্ডা লেগে যাবে। "
" আরে না ঠিক আছি আমি। এবার বলুন তো আপনার বাসা কোথায়? কী করেন? "
আরোরার প্রশ্নের উত্তরে কী বলবে বুঝতে পারছে না এডওয়ার্ড। সত্যি কথা বললে নিশ্চিত আরোরা আর কখনো ওর সাথে দেখা করবেনা, ভালোবাসা তো দূরের কথা। 
" আপাতত হলিথান শহরে একটি মেয়ের মনকে বশ করার চেষ্টা করছি, এটাই পেশা হিসেবে ভাবতে পারো।"
এডওয়ার্ডের উদ্ভট কথাবার্তা শুনে থমকে গেলো আরোরা। মানুষটা কি ওর কথাই বলছে? আবছা আলোতে এডওয়ার্ডের চেহারার অভিব্যক্তি বুঝতে পারছে না আরোরা। হঠাৎ করে মনে হলো এই তমসা আচ্ছন্ন জায়গায় একজন যুবকের সাথে বসে আছে সে! কী হয়েছে নিজের সেসব ভেবে অবাক হচ্ছে আরোরা। এডওয়ার্ড আরোরার মনের কথা বুঝতে পেরে চুপ হয়ে গেছে । তাকে নিয়ে সন্দেহ করছে আরোরা! অবশ্য করতেই পারে, স্বাভাবিক এটা।
" আচ্ছা। "
আরোরার সংক্ষিপ্ত উত্তর। এডওয়ার্ড এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে আরোরার খোলা সোনালী চুলগুলোর দিকে। মাঝে মধ্যে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সেই আলোতে আরোরা পুকুরের পানিতে নিজের পা ডোবানোর ফলে সৃষ্ট ঢেউ দেখতে ব্যস্ত। হঠাৎ বড়সড় আকারে বিদ্যুৎ চমকাল আকাশে। আরোরার দৃষ্টি এসে পড়লো এডওয়ার্ডের নিশ্চুপ মুখাবয়বের দিকে। থমকে গেল আরোরার দৃষ্টি। কেমন নেশালো দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে এডওয়ার্ড। কী তীক্ষ্ণ সেই চাহনি! আরোরার ভেতর পর্যন্ত যেনো এডওয়ার্ড দেখতে পাচ্ছে। এডওয়ার্ড আরোরার খোলা চুলে হাত ডুবিয়ে দিলো। বৃষ্টির ছোঁয়ায় চুলগুলোর উপর অদ্ভুত সৌন্দর্য খেলা করছে। কোনো এক অদৃশ্য টানে এডওয়ার্ডের খুব কাছে এগিয়ে এলো আরোরা। এডওয়ার্ড আরোরাকে বুকে জড়িয়ে নিলো। আরোরার কোনো হুঁশ নেই।এডওয়ার্ড আলতো করে ললাটে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে আরোরার পিঠে আর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। 

বাতাসের দাপটে জানালার কপাট গুলো নড়াচড়া করায় ঘুম ভেঙে গেলো এনার। ঘুম ঘুম চোখে আরোরাকে উদ্দেশ্য করে বললো সে,
" আরো জানালা খুলে রেখেছিস কেনো? যা জানালা আঁটকে দিয়ে আয়।"
বারকয়েক এককথা বলার পরেও যখন আরোরার কোনো সাড়াশব্দ পেলো না, তখন এনা ঘুম ঘুম চোখেই উঠে বসলো। বিছানার পাশে টেবিলের উপর রাখা লণ্ঠনে আগুন জ্বেলে বিছানা থেকে উঠে আরোরার ঘরের দিকে এগোলো এনা। কী হলো বোনটার? শরীর খারাপ করালো কি-না এসব ভাবতে ভাবতে সামনে এগোচ্ছে এনা।

এডওয়ার্ডের বক্ষে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে নিশ্চিতে বসে আছে আরোরা। এডওয়ার্ডেরও যেনো কোনো কিছু খেয়াল নেই। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। পুকুরের পানিতে বৃষ্টির ফোঁটার পতনের দৃশ্য ভীষণ সুন্দর লাগছে। শীতল হাওয়া এসে গা ছুঁইয়ে যাচ্ছে আরোরার। হঠাৎ আরোরার শরীরে ঠান্ডায় কাঁপা-কাঁপি শুরু হওয়ায় এডওয়ার্ড নড়েচড়ে উঠলো। পানিতে কতক্ষণ পা ডুবিয়ে আছে তার হিসাব কেউ রাখেনি। এডওয়ার্ড আরোরার হাত স্পর্শ করতেই চমকে উঠলো।

" আরোরা! তোমার শরীর তো ঠান্ডা হয়ে গেছে। "

এডওয়ার্ডের কথায় আরোরার হুঁশ ফিরলো। তড়িৎ বেগে এডওয়ার্ডের কাছ থেকে সরে বসলো সে। পানি থেকে পা তুলে উঠে দাঁড়ালো আরোরা। এতক্ষণে নিশ্চয়ই তার বোন তার অনুপস্থিতি টের পেয়ে গেছে ভাবতেই পিলে চমকে উঠলো তার। শরীরের শীতলতার কথা ভুলে গেছে বেমালুম। 

" এডওয়ার্ড বাসায় যেতে হবে আমাকে এক্ষুনি! আপা নিশ্চয়ই টের পেয়ে গেছে আমি বাসায় নেই। "

" আরোরা এতো ভয় পেও না। আপা তো বকবেই একটু মারবে তো না। চলো আমি এগিয়ে দিয়ে আসছি।"
আরোরা এডওয়ার্ডের মুখখানা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে না। আবছা আলোতে এডওয়ার্ড আরোরার হাত ধরে বাড়ির পথে হাঁটতে শুরু করেছে। আরোরা এতটাই চিন্তিত যে এটাও খেয়াল হচ্ছে না, এই অন্ধকারে কীভাবে এডওয়ার্ড তাকে নিয়ে অনায়াসে হেঁটে যাচ্ছে! 

আরোরার কক্ষে আসতেই চমকাল এনা। দেয়ালঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল রাত এগারোটা ছুঁইছুঁই। এতরাতে বোন ঘরে নেই ভাবতেই এনার চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। কোথায় গেলো আরোরা? এনার মাথা কাজ করছে না। দৌড়ে দরজার সামনে যেতেই দ্বিতীয় দফায় চমকাল। বাসার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে বিশালাকার এক বাদামী রঙের নেকড়ে। এনাকে দেখেই নেকড়েটা কেমন গরগর আওয়াজ করতে শুরু করেছে। নেকড়ের দাঁতগুলো লণ্ঠনের আলোতে এতটা ভয়ংকর লাগছে যে এনা জায়গা থেকে নড়তেও ভুলে গেছে। আচমকা এনার মনে হলো আরোরাকে এই নেকড়ে মেরে ফেলেনি তো? দপ করে আগুন জ্বলে উঠলো এনার মাথায়। বোনকে প্রাণের থেকেও বেশি ভালোবাসে সে। এরমধ্যে নেকড়েটাও বিকট শব্দে গর্জন করলো। আশেপাশের নিশাচর পাখিরাও হয়তো সেই আওয়াজে স্থান ত্যাগ করেছে। বাড়ির বাইরে আসতেই এরকম নেকড়ের হাউলিং শুনে পিলে চমকে উঠল আরোরার। এডওয়ার্ডকে কিছু বলার সময় না দিয়ে দৌড়ে বাড়ির ভেতরে গেলো আরোরা। এডওয়ার্ড যা বোঝার বুঝে গেছে। 

নেকড়েটা বাসার মধ্যে ঢুকতেই এনা দৌড়ে নিজের ঘরের দিকে যেতে লাগলো। এদিকে আরোরাও ঘরে ঢুকে অন্ধকারে এনাকে ডাকতে শুরু করেছে। শোয়ার ঘরের আগে রান্নাঘর হওয়ায় সেখান থেকে একটা লণ্ঠন নিয়ে এসে আপার ঘরের দিকে এগোচ্ছে আরোরা। নেকড়েরা গর্জনে কলিজা পর্যন্ত শুকিয়ে যাচ্ছে তার। এনা কোনোরকমে দৌড়ে টেবিলের নিচে ঢুকে বসেছে। অন্ধকারে ছেয়ে আছে এনার ঘর। লণ্ঠন নিভিয়ে মুখে হাত দিয়ে টেবিলের নিচে বসে আছে এনা। নেকড়েটা ঘরে এনাকে খুঁজছে। মানুষের গন্ধ পেলেও এনাকে দেখতে পাচ্ছে না। আরোরা ততক্ষণে লণ্ঠন নিয়ে বোনের ঘরে চলে এসেছে। নেকড়েটা এবার এনাকে খোঁজা বাদ দিয়ে আরোরার দিকে হিংস্র দৃষ্টিতে দাঁত বের করে তাকিয়ে আছে। এখুনি বুঝি ঝপাং করে লাফিয়ে পড়বে ওর গায়ের ওপর। কিন্তু না! নেকড়ে ঝাপ দেওয়ার আগেই আরোরা মাথার পেছন দিকে ব্যথা অনুভব করছে। ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে তার। সে বুঝতে পারছে জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে। এনার মুখটা মনে মনে করতে করতে জ্ঞান হারালো আরোরা। বোনকে আর বাঁচাতে পারলোনা সে!

এনা সবকিছু বুঝেও বের হতে পারছে না। নেকড়েটা তার বোনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তাকে কিছু একটা করতে হবে। না,নিজের প্রাণ বাঁচাতে বোনকে চোখের সামনে মরতে দেখতে পারবেনা সে। এনা দিকবিদিকশুন্য হয়ে হাতে নিভিয়ে রাখা লন্ঠন নিয়েই বের হতে যাবে তখুনি অন্য কারো উপস্থিতি টের পেলো সে। ঘর অন্ধকার হওয়ায় কাউকে দেখতে পাচ্ছে না কিন্তু সবকিছু শুনতে পাচ্ছে। 

" এক্ষুনি এখান থেকে বেরিয়ে যাও, নয়তো ভালো হবে না। "
নিজের সামনে হঠাৎ ভ্যাম্পায়ার রাজপুত্রকে দেখে অবাক হলো নেকড়ে রূপী লিও। কিন্তু দমল না সে। এডওয়ার্ডের কথায় কর্নপাত না করে আরোরার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। মুহুর্তেই ভয়ংকর রূপ ধারণ করলো এডওয়ার্ড। ঠোঁটের দু'পাশে বেরিয়ে এলো সুচালো দু'টি দাঁত, চোখগুলো রক্তবর্ণ হয়ে গেলো, পিঠ চিঁড়ে বেরিয়ে এসেছে দু'টো বিশাল ডানা। সুন্দর চেহারা রক্তশূন্য ফ্যাকাসে হয়ে ভয়ংকর লাগছে এখন। লিও কিছু বোঝার আগেই এডওয়ার্ড তার গলা ধরে উড়ে দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলো। লিও এত বড়ো আকারের নেকড়ে হওয়া স্বত্বেও এডওয়ার্ডের হাত থেকে নিজেকে ছাড়াতে পারছেনা। রাস্তায় এসে দাঁড়িয়ে লিওকে দূরে ছুঁড়ে ফেললো এডওয়ার্ড। লিও ব্যথায় গোঙানির মতো শব্দ করে উঠে দাঁড়িয়ে মানুষের রূপে ফিরে এসেছে। 
" তোরা আমাদের জাতশত্রু! তোর সাহস হয় কী করে আমার শিকারে বাঁধা দিস? "
লিও এর ফাঁকা আওয়াজে মুচকি হাসলো এডওয়ার্ড। ভয়ংকর এক সুন্দর হাসি! দু'হাত পেছনে রেখে লিও এর দিকে এগিয়ে এলো এডওয়ার্ড। 
" শোন,তুই সম্মানের যোগ্য না তাই আর তুমি করে বলছি না। আর রইলো কথা শত্রুতার? সেসব হাজার বছর আগের কথা, আমাদের পূর্বপুরুষদের কর্মকাণ্ডের উপর আমাদের কোনো হাত ছিলোনা। আর শোন ভবিষ্যতে এই বাড়ির আশেপাশে যদি তোদের জাতির কাউকে দেখি বিশ্বাস কর, কেউ প্রাণে বাঁচতে পারবি না।"
লিও এর কপালে ভাজ পড়লো এডওয়ার্ডের কথায়। এই মানুষদের সাথে ভ্যাম্পায়ার রাজপুত্রের কীসের এতো সখ্যতা? 
" মনে হচ্ছে এদের নিয়ে ভীষণ চিন্তা তোর। তাহলে তো এদেরকেই শেষ করতে হবে। "
লিও বিশ্রীভাবে হেসে বললো। এডওয়ার্ড নিজের কপালে হাত দিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। সে চায় না কোনো উলফকে মেরে আবারও তাদের পূর্বপুরুষদের কর্মকাণ্ডে শামিল হতে। কিন্তু লিও এর কথায় নিজেকে শান্ত রাখতে পারছে না সে। ফলশ্রুতিতে এডওয়ার্ড লিওর মধ্যে মুহুর্তেই এক ভয়াবহ যুদ্ধ লেগে গেছে। এডওয়ার্ডের সাথে শক্তিতে পেরে না উঠে এক পর্যায়ে লিও প্রাণ নিয়ে পালিয়ে গেল। সত্যি বলতে এডওয়ার্ড চেয়েছে বলেই লিও পালাতে পেরেছে। নয়তো আজ আবারও ভ্যাম্পায়ারের হাতে খুন হতো এক ওয়ারউলফ! লিও চলে যেতে এডওয়ার্ড আরোরার বাসার দিকে তাকালো। এবার নিশ্চয়ই আরো বেশি করে আরোরার ক্ষতি করতে আসবে শয়তান নেকড়েটা।



চলবে.............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন