#আরোরা (ফ্যান্টাসি, হরর, রোমান্টিক)
#পর্ব_৮
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
নিশুতি রাত! চাঁদের আলোতে ভীষণ সুন্দর লাগছে মিচবা গ্রামটা। এমনিতে কতো শান্ত এই জায়গা অথচ পিশাচ এবং উলফের আনাগোনায় শান্তি অশান্তিতে রূপ নিতে সময় লাগে না। ঘড়িতে এখন সময় রাত দুটো বেজে পাঁচ মিনিট। তিনতলা বাড়ির উত্তর দিকের ঘরে সাঁচি থাকে। ম্যাক সেই ঘরের জানালার পাশে স্থির হয়ে ভেসে আছে ডানার সাহায্যে। সাঁচি আরামসে ঘুমাচ্ছে দেখে ম্যাকের ঠোঁটের কোণে প্রশান্তির হাসি ফুটেছে। মেয়েটা যে কবে জেগে জেগে ওর সাথে কথা বলবে সেসব নিয়ে জল্পনাকল্পনাও করছে ম্যাক। এই রসুনগুলো না ছড়িয়ে রাখলেই তো সে অনায়াসে সাঁচিকে গিয়ে বুকে জড়িয়ে নিতে পারতো! এই মেয়েটাকে ছাড়া যে একটা দিন পার করাও ভীষণ মুশকিল হয়ে যাচ্ছে ম্যাকের। কতদিন কাছ থেকে দেখেনি সাঁচিকে! ইশ সে-ও যদি এডওয়ার্ডের মতো খুব শক্তিশালী হতো? তবে এসব রসুন পেরিয়ে তবে তার প্রিয়তমার কাছে যেতে পারতো। ম্যাক নিজের ভাবনায় নিজেই অবাক হচ্ছে। এডওয়ার্ডের মতো কখনো সে শক্তিশালী হতে পারবে না তবুও সেই অলীক চিন্তাভাবনা করতেই তার ভালো লাগছে। আচ্ছা এডওয়ার্ডের কাছে একবার বলে দেখলে কেমন হয়? কিন্তু সারা সন্ধ্যা রাজ্যাভিষেক নিয়ে ব্যস্ত থাকার পরে এই মাঝরাতে কি রাজা আসবে ম্যাককে সাহায্য করতে? নাহ! তারচে বরং আগামীকাল বলবে। ম্যাক আরেকবার সাঁচির ঘুমন্ত মুখাবয়বের দিকে তাকিয়ে দূরের আকাশে ডানাঝাপটে উড়তে লাগলো।
ভোরের আলো ফুটেছে হলিথান শহরে। শীতের সকালের রোদ যেনো মিষ্টি রোদ। গায়ে লাগলে বেশ ভালো লাগে। এনারও তেমনি রোদ গায়ে মাখতে বেশ ভালো লাগছে। আরোরা আজকে স্কুলে যাবে। এনা এরমধ্যেই চেম্বারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছে। বাসায় আরোরা একা। ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেছে ওর। নেহাৎ বড়ো বোনটা আছে বলে কাজকর্ম না করেই পার পেয়ে যায় সে। নয়তো নিজের রান্নাবান্না তো নিজেকেই করতে হতো। ঘুম ঘুম চোখে আরোরা দেয়ালঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ন'টা ছাড়িয়ে গেছে। এতক্ষণ ঘুমিয়েছিল ভাবতেই হুড়োহুড়ি করে সব কাজ গোছাতে শুরু করেছে সে। প্রথমে হাতমুখ ধুয়ে তারপর দু-এক লোকমা রুটি খেয়ে রেডি হতে লাগলো। বেগুনি রঙের গাউনের সাথে সাদা রঙের একটা ওড়না গলায় পেঁচিয়ে নিয়েছে আরোরা৷ চুলগুলো দ্রুত ফ্রেঞ্চ বেণী করে কিছু হলদে রঙের বুনোফুল গুঁজে নিলো তাতে। গতকাল আরোরার এক ছাত্রী ফুলগুলো বাসায় দিয়ে গিয়েছিল। হলিথান শহরে বুনোফুল পাওয়া যায় না। মিচবায় হরেকরকম বুনোফুল আছে। বাসা থেকে বেরিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে আরোরা। তাড়াতাড়ির সময়ই ক্যারিজ পেতে হিমসিম খেতে হয়। মিনিট পাঁচেক পরেও যখন ক্যারিজের দেখা মিললো না তখন আরোরা হাঁটতে শুরু করেছে। কিন্তু কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে হাঁটতে হাঁটতে। মনে হচ্ছে কেউ হয়তো আড়াল থেকে আরোরার উপর নজর রাখছে। আরোরা কিছুদূর যেতে যেতে পেছন তো ফিরছে কিন্তু কাউকে দেখতে পাচ্ছে না।
" কাউকে খুঁজছেন আপু?"
আচমকা সামনে এসে কথা বলায় চমকাল আরোরা। সমবয়সী একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওর সামনে। দেখতে বেশ সুন্দরী, চোখগুলো আরোরার মতোই নীলাভ সবুজ! আরোরা বিস্ময় প্রকাশ করে শুধালো,
" না,আপনি? আপনি কে! আগে তো দেখেছি বলে মনে হচ্ছে না। "
" আমার নাম সেলিন। আগে মিচবায় থাকতাম। ক'দিন হলো এখানে এসেছি। "
" ও আচ্ছা। "
" জি আপু। ডাক্তার আপুর বোন আপনি তাই একটু কথা বললাম। কিছু মনে করবেন না যেনো! "
এতক্ষণে অচেনা মেয়েটির কথা বলার কারণ বুঝতে পারলো আরোরা।
" ঠিক আছে, আপু সমস্যা নেই। আমি আসছি আজকে। একটু তাড়া আছে। "
" আচ্ছা আপু।"
আরোরা সেলিনকে বিদায় জানিয়ে দ্রুত হাঁটতে শুরু করেছে আবার। আরোরা কিছুটা দূরে চলে যেতে আলেক্সা এসে দাঁড়িয়েছে সেলিনের পাশে।
" সেলিন মনে হচ্ছে এই মেয়েটার উপর কোনো নেকড়ের নজর পড়েছে। আমি নিশ্চিত আশেপাশে আমাদের কেউ ছিলো। কিন্তু কে হতে পারে? আমাদের প্রাসাদ থেকে তো আমরা ছাড়া আর কেউ আসেনি এখানে! "
" তুমি বলেছিলে অন্য গোত্রের মায়ানেকড়ে আছে এবং ওরা মানুষ শিকার করে? "
সেলিনের কথায় হুঁশ ফিরলো আলেক্সার। আসলেই তো ঠিক বলেছে সেলিন। এই যে শহরে এতগুলো খুন হয় তার নব্বই শতাংশ খুন করে তাদের গোত্র বহির্ভূত মায়ানেকড়েরা।
" ঠিক বলেছো তুমি। চলো আমরা আমাদের কাজ করি। পূর্ণিমা রাতের বাকি আছে মাত্র তিনদিন। এরমধ্যেই আমাদের তাকে খুঁজে বের করতে হবে। "
" চলে আলেক্সা।"
সেলিন ও আলেক্সা মানবী রূপে শহরে আবারও খোঁজ শুরু করলো। এনাদের বাড়ির থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে হিংস্র দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে লিও। কিন্তু সেলিন কিংবা আলেক্সা কেউই লিওকে দেখতে পায়নি।
মেঘমুক্ত আকাশে তীব্র রোদে বাজারে লোকজনের সমাগম। কেউ মাছ কিনছে তো কেউ মাংস। ভেড়ার মাংসের কদর বেশি এখানে। পাশাপাশি কবুতরের মাংশও বেশ চলে। বিভিন্ন রকমের মাশরুম পাওয়া যায় হলিথানে। চাল পাওয়া যায় খুব কম।
পড়ন্ত বিকেলে প্রাসাদের মূল ফটকে দাঁড়িয়ে আছে এডওয়ার্ড। সূর্যের তেজ কমে এসেছে। পাখিরা ঝাঁকে ঝাঁকে তাদের গন্তব্যে ফিরতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। গত দুই দিন বিভিন্ন ব্যস্ততার কারণে হলিথান যেতে পারেনি এডওয়ার্ড। আরোরার জন্য ভীষণ মন কেমন করছে ওর। লিও তো বাসায় ঢুকতে পারবে না। কিন্তু যদি দিনের বেলা বাইরে বসে আক্রমণ করে বসে? আচমকা এসব ভাবতেই দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো এডওয়ার্ডের। কিন্তু এখনও তো সন্ধ্যা নামেনি! তবে রোদের তেজও নেই খুব একটা। শহরে পৌঁছাতে পৌঁছাতে নিশ্চিত সূর্য অস্ত যাবে। এডওয়ার্ড আর ভাবলো না, তার বিশাল ডানা ঝাপটে হলিথান শহরের উদ্দেশ্য বেরিয়ে পড়লো প্রাসাদ থেকে। দূর থেকে অসময়ে এডওয়ার্ডের রাজ্যের বাইরে যাওয়া খেয়াল করেছে ম্যাক। কী মনে করে সে-ও এডওয়ার্ডের পিছু নিল।
" আরোরা তুই কি সত্যি এডওয়ার্ডের বিষয় কিছু জানিস না?"
লন্ঠন জ্বেলে বোনের পাশে বসে শুধালো এনা।বাইরে হালকা ঠান্ডা পড়েছে। কম্বল মুড়ি দিয়ে বসে আছে আরোরা। এনার আবার ঠান্ডা কম লাগে। আচমকা এডওয়ার্ডের কথায় ভড়কে গেছে আরোরা। কী মনে করে তার বোন আবার এডওয়ার্ডকে নিয়ে পড়লো? এমনিতেই লোকটাকে ক'দিন ধরে না দেখতে পেয়ে মনটা বড্ড অশান্ত হয়ে গেছে আরোরার।
" না আপা। তোমার কেনো মনে হচ্ছে আমি তোমার থেকে কিছু লুকচ্ছি? "
" মনে হয়েছে কারণ অচেনা একটা ছেলের জন্য আমার বোন কেনো ভাবছে দেখে। আমি কী কিছু বুঝি না? তোর চোখমুখ কি খেয়াল করি না? "
" আপা!"
" কী?"
" তুমি যা ভাবছ তেমন কিছু না। "
" বল তাহলে কেমন। "
আচমকা দরজায় ঠকঠক শব্দে চুপ করে গেলো দু'জন। এই সাঁঝের বেলা কে এলো?
" আরো তুই থাক আমি দেখি কে এসেছে। "
" আমার ভয় করছে আপা। দরজা খোলার আগে জিজ্ঞেস করে দেখো কে এসেছে! "
আরোরার ভয়ের কারণ অমূলক নয়। এমনিতে ভ্যাম্পায়ারদের হাত থেকে বাঁচার জন্য রসুন রাখা আছে সব জায়গায় কিন্তু নেকড়ের হাত থেকে বাঁচার কোনো পদ্ধতি তাদের জানা নেই। তাই কে এসেছে কথা বললে তবেই দরজা খুলবে বলে ঠিক করেছে এনা।
" ঠিক আছে আরো। "
এনা হাতে লন্ঠন নিয়ে দরজার দিকে এগোলো। আরোরাও এসেছে পিছুপিছু। শীতে ঠকঠক করে কাঁপছে শীতকাতুরে মেয়েটা।
" কে এসেছেন বাইরে? "
" আমি এডওয়ার্ড বলছি এনা। আরোরার সাথে একবার দেখা করা যাবে? "
এডওয়ার্ডের কণ্ঠস্বর শুনে দু'বোন মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো একবার। এনা দরজা খুলে দিলো। আরোরাকে দেখে এডওয়ার্ড যেনো প্রাণ ফিরে পেলো শরীরে। বরাবরের মতোই একটা ভুবন ভোলানো মুচকি হাসি দিলো এডওয়ার্ড।
" ভেতর এসো এডওয়ার্ড। "
এনার কথায় বাড়ির ভেতর প্রবেশ করেছে এডওয়ার্ড । এনা দরজা আঁটকে দিলো। মাঝে মধ্যে এনার ভীষণ কৌতূহল হয়। যেমন এখনও হচ্ছে। এডওয়ার্ড কেনো সব সময় রাতের বেলা আসে সেটা একটা বড়সড় খটকা এনার কাছে। প্রাণের ভয়ডর কি ওর নেই? তা-ও যদি ঘরের ভেতরে না এসে কেবল বাইরে ঘুরঘুর করতো তাহলে না হয় পিশাচ ভাবা যেতো কিন্তু রসুনেও তো কিছু হয় না এই লোকের। হঠাৎ এনার মনে পড়লো মায়া নেকড়েরা মানুষের রূপও ধারণ করতে পারে। তাহলে কি এডওয়ার্ড নেকড়ে? সহসাই পিলে চমকে উঠলো এনার। কী ভয়ংকর চিন্তাভাবনা করছে সে! আরোরার ঘরে গিয়ে বসলো তিনজন। এডওয়ার্ডকে দেখে ভীষণ শান্তি শান্তি অনুভব হচ্ছে আরোরার। কিন্তু চেহারায় সেসব মোটেও ফুটিয়ে তুলতে চায় না সে। এনা এমনিতেই ক্ষেপে আছে এ নিয়ে।
" তারপর এডওয়ার্ড এই রাতে কীভাবে বাইরে বের হও তুমি? ভয়ডর নেই? "
এনার প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেছে এডওয়ার্ড। তাকে কি সন্দেহ করছে এনা?
" মৃত্যু তো সুনিশ্চিত এনা। যখন সময় হবে সবাইকে যেতে হবে। তার থেকে পালিয়ে তো লাভ নেই। "
" তা ঠিক। আচ্ছা তোমরা বসো, আমি তোমার জন্য নাস্তা নিয়ে আসছি।"
" দরকার নেই এনা। আমি এ সময় কিছু আহার করি না।"
" তবুও আমাদের বাড়িতে প্রথম এলে তুমি। "
এনা এডওয়ার্ডের কথায় কর্ণপাত না করে সোজা রান্নাঘরের দিকে গেলো। আরোরা আর এডওয়ার্ড বসে আছে কিছুটা দূরত্বে। রান্নাঘরের দিকে একটু উঁকি দিয়ে আরোরাকে অবাক করে দিয়ে এডওয়ার্ড জড়িয়ে ধরলো তাকে।
" কী করছেন? আপা এসে যাবে তো!"
" আসার আগেই ছেড়ে দিবো। শোনো আমি রাতে অপেক্ষা করবো বাইরে। এখন চলে যাবো। আসবে তো?"
" না এসে উপায় আছে? কী করে যেনো আমার আমিকে আপনি নিজের করে নিয়েছেন! "
চলবে..............................