ফাইজানের গাড়ি যখন পৌছালো, তখন দাউ দাউ করে জ্বলছে পুরানো বাড়ির একাংশ। জ্বলন্ত অগ্নিশিখার দাপট ক্রমশ প্রবল বেগে বাড়ছে। তার শক্ত থাবা ধীরে ধীরে বিস্তার করছে বাড়ির বাকি অংশে। ফাইজান এবং রাশাদ স্তব্ধ তাকিয়ে রইলো জ্বলন্ত অগ্নিকান্ড দেখে। কিছু না বলেই উন্মাদের মতো তারা ছুটলো সেই কুন্ডে। গলা ছেড়ে ডাকলো,
“হুমায়রা, হুমায়রা”…
তাদের সাথে আসা ফাইজানের সচিব তানভীর এবং পুলিশ তাদের সাথে সাথেই তাকে বাধা দিলো। রাশাদ উগ্র হয়ে গেলো। ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললো,
“ছাড়ুন আমাকে। ভেতরে আমার বোন”
“স্যার ফোর্স ভেতরে গেছে। আপনারা একটু ধৈর্য্য ধরুন প্লিজ”
ফাইজানের অস্থিরতা বাড়লো। পুরানো কিছু বাজে স্মৃতি মুহূর্তের মাঝে জীবন্ত হয়ে গেলো যেনো। তানভীরের উদ্দেশ্যে বললো,
“আমার হাত ছাড়ো তানভীর। দেখতে পারছো না আগুন লেগেছে”
“জি স্যার, দেখছি আগুন জ্বলছে। তাই আপনাকে যেতে দিচ্ছি না। আমরা খবর দিয়েছি ফায়ারব্রিগেড। তারা এসে পড়বে। এখানে পুলিশ আছে। প্লিজ স্যার। আপনার সিকুরিটি নিয়ে ছেলেখেলা করতে পারবো না আমরা”
“রাখো তোমার সিকুরিটি। ছাড়ো আমাকে। হুমায়রা ভেতরে। নিকুচি করি সিকুরিটি”
ফাইজানের উচাটন ক্রমশ বাড়ে কিন্তু তবুও তাকে যেতে দেওয়া হয় না। দমবন্ধ লাগছে। বারবার মনে হতে লাগলো আবার হেরে গেলো। আবার হারিয়ে ফেললো সে। নিজের সর্বস্ব দিয়ে তানভীর থেকে নিজেকে ছাড়ালো সে। ছুটে গেলো জ্বলতে থাকা লেলিহান শিখাময় প্রাসাদে। কিন্তু চার পাঁচজন পুলিশ তাকে ঝাপটে ধরলো। কারণ প্রতিমন্ত্রীকে তো আর আগুনে ঝাপ দিতে দেওয়া যায় না। ফাইজান ছোটার চেষ্টা করলো কিন্তু ব্যর্থ হলো পুলিশগুলোর চাপে।
***********
ফরিদের সর্বাঙ্গে ব্যাথা, অবশ হয়ে আসছে শরীর। দাঁড়ানোও কঠিন হয়ে পড়লো যেন। সুযোগ বুঝে কেউ পেটের কাছটায় ছুরি বসিয়েছে। গলগল করে রক্ত পড়ছে। হাত দিয়ে জায়গাটা চেপে ধরলো কিছু সময়। তবুও রক্ত থামছে না। হয়তো এজন্য নিস্তেজ লাগছে সারা শরীর। কিন্তু সময় নষ্ট করার সময় নেই। পোড়া ধোঁয়া নাকে আসছে। পালিয়েছে সব ক’টা জানোয়ার। হয়তো মেয়েটিকে এখনো বেঁধে রেখেছে। মেয়েটিকে বাঁচাতে না পারলে সবকিছু বৃথা। সব পরিকল্পনা বৃথা। এখানে আসার লক্ষ হুমায়রার লোকেশন জানা। ফাইজানের সুক্ষ্ণ পরিকল্পনা, নির্লিপ্ততা কখনোই বোধগম্য হয় না ফরিদের। ফাইজান যে হুমায়রাকে ভালোবাসে এতে তাতে কোনো সন্দেহ নেই তার। কিন্তু কোথাও যেনো একটা ভয় গিলে খাচ্ছিলো তাকে। পাঁচ বছর আগে তো এমন ই এক সকালে তার বোনটা গায়েব হয়ে গেলো। পাওয়া তো গিয়েছিলো নর্দমায় দ্বিখন্ডিত। সেই স্মৃতি কি ভুলে গেছে ফরিদ। সে কখনো চায় না একই পরিণতি হুমায়রার সাথে হোক। মেয়েটির নিষ্পাপ মুখে হাফসার প্রতিচ্ছবি দেখে সে। তাই তো সুযোগটা কাছে লাগাতে চেয়েছে। ফাইজানের সাথে তার ঝামেলার অনেক আগ থেকেই কেতাব চৌধুরী তাকে হাত করতে চেয়েছিলো। প্রথমে অর্থের মোহ দিয়েছে। তারপর ক্ষমতার লোভ। কিন্তু কিছুতেই তাকে বশ করতে পারে নি। কারণ ফরিদের ভাতৃত্ববোধ ছিলো সবার উপরে। সে ফাইজানকে প্রচুর স্নেহ করে। তাই তারা নাদিমের সহায়তায় ফাইজান এবং ফরিদের মাঝে ফাটল ধরাতে চেয়েছিলো। ফরিদের বুদ্ধি তীক্ষ্ণ নয়, কিন্তু সে বুঝছিলো তাদের বিশ্বাসের মানুষের মাঝেই খুত আছে। উপর থেকে ফাইজানের জীবনের উপরও বিপদ ঘুরঘুর করছিলো। সেজন্য জব্বার সাহেবের সাথে সে সখ্যতা করে যেনো কিছুটা হলেও তাদের পরিকল্পনা বুঝতে পারে। তার পরিকল্পনা ছিলো ধরি মাছ না ছুই পানি। কিন্তু সবকিছু এলোমেলো হলো গত কিছুদিনের ঘটনায়। আজ হুমায়রার অপহরণে ফরিদের মাথা নষ্ট হয়ে গেলো। উপর থেকে ফাইজান কি চিন্তা করে শান্ত ছিলো সেটাও বুঝতে পারছিলো না ফরিদ। সে জানে হুমায়রার কিছু হলে ফাইজান আবার রোবট হয়ে যাবে। অনুভূতিশুন্য একটা জড় পদার্থের মতো শুধু নিঃশ্বাস ফেলবে। যতই হোক, মেয়েটি তাকে মানুষের মত বাঁচতে শিখিয়েছিলো। তাই নিজের জীবনের ঝুকি নিয়ে সে এখানে এসেছে। টোপ দিয়েছে জব্বারকে। যখন নিশ্চিত হলো হুমায়রাকে এখানে আটকে রেখেছে। সুযোগ বুঝে সে ফাইজানকে লোকেশন পাঠিয়েছে। আর জব্বারকে এমন কিছু তথ্য দিয়েছে যা সম্পূর্ণ বানোয়াট। যেনো জব্বার সময় নষ্ট করে এবং ফাইজান ফোর্স নিয়ে এখানে আসতে পারে। এখন যদি সে এভাবে বসে থাকে নিজের শরীরের কথা চিন্তা করে এতো কিছু সব বৃথা হয়ে যাবে। তাই শত কষ্টের পরও উঠে দাঁড়াল ফরিদ। পা বাড়ালো হুমায়রার ঘরের দিকে।
****
বদ্ধ ঘরের প্রতিটি অংশ ধোঁয়ায় ভরে গেছে। ধীরে ধীরে আগুনের তাপ বাড়ছে। দেয়াল দরজা সবকিছু জ্বলছে। একটা চেয়ারে বাঁধা হুমায়রা। নিজের সর্বস্ব চেষ্টার পরও নিজেকে ছাড়াতে পারছে না সে। ভাঙ্গা স্বরে চিৎকার করছে,
“কেউ আছো? কেউ আছো?”
কিন্তু কেউ সাড়া দিচ্ছে না। সবাই পালিয়েছে। ধীরে ধীরে আগুন ছড়িয়ে যাচ্ছে ঘরে। হুমায়রার মনে হলো আজ বোধ তার আর ফেরা হবে না। এটাই তার শেষ দিন। চিৎকার করতে করতে কন্ঠ শুকিয়ে এলো। অষ্টাদশী এবার ভেঙ্গে পড়লো, ঠোঁট ভেঙ্গে কান্না এলো। বুকখানায় আতঙ্ক, ভয় চেপে ধরলো। বাঁচার ইচ্ছেতে ছটফট করতে থাকলো সে। চিৎকার করে কাঁদার শক্তিটুকু নেই। চোখের সামনে ভেসে উঠলো প্রিয়মুখগুলো। দাদী, ভাইজান, ইলহা, শরীফা, চামেলী আর ফাইজান। ফাইজানের কথাটা মনে হতেই বাঁচার ইচ্ছে যেনো দ্বিগুন হল। মানুষটি তাকে ছাড়া কি করে থাকবে! এখনো মনে আছে ফাইজান তাকে বলেছিলো,
“তোমার কিছু হয়ে গেলে আমি হয়তো পাগল হয়ে যাবো”
ফাইজানের কথাটা স্মৃতিতে উন্মোচিত হতেই অস্থিরতা বাড়ে। ছটফট করতে থাকে সে বাঁচার জন্য। গলা ছেড়ে চিৎকার করে সাহায্যের জন্য। চেয়ার নাড়াতে থাকে বাধন থেকে মুক্তির জন্য। একটা সময় চেয়ার কাত হয়ে যায়। ফলে চেয়ারসহ সে মাটিতে পড়ে যায়। আগুনের তাপ বাড়ছে। চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরে। কাতর স্বরে ডাকে,
"কেউ আছো? আমাকে মুক্তি দাও। আমি বাড়ি যাব"
জীবন মৃত্যু এই দুটো ব্যাপার সৃষ্টিকর্তার পরিকল্পিত থাকে। সেই পরিকল্পনার এক ইঞ্চি বহির্ভূত কিছুই ঘটে না। তাই তো শত কষ্ট হলেও ফরিদ ঠিক পৌছালো হুমায়রার কাছে। রক্তাক্ত ফরিদকে দেখে হুমায়রার উৎকুন্ঠা বাড়লো,
"ফরিদ ভাই আপনার এই অবস্থা কেনো?"
ফরিদ দড়ি খুলতে খুলতে খুব কষ্টে বললো,
"সময়.. নেই বোন। তুমি এ...ক দৌ..ড়ে বের হয়ে.. যাবা। ফাইজান.. বোধ হয়... চলে এসেছে"
কথাটা শেষ করতে পারলো না সে। তার পূর্বেই দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আস্তে শুরু করলো। শরীর অসার হতে শুরু করলো। হুমায়রার বাঁধন কেবল কিছুটাই খোলা হয়েছে। তার আগেই ফরিদ ঢলে পড়লো মাটিতে। হুমায়রা তাকে কান্নামিশ্রিত ভাঙ্গা স্বরে ডাকলো,
"ফরিদ ভাই, ফরিদ ভাই উঠেন"
কিন্তু ফরিদ ভাই সাড়া দিলেন না। হুমায়রার কাতর কন্ঠ পৌছালো না তার কানে। সে ডুবে গেলো যেনো চিরনিদ্রায়। হুমায়রা আবারোও বাঁচার আশায় চিৎকার করলো,
"কেউ আছো? ফরিদ ভাইকে বাঁচাও। উনি মরে যাবেন"
জ্বলছে ঘর। জ্বলছে বাঁচার ইচ্ছে। ধোঁয়ার আচ্ছাদনে নিঃশ্বাস নেওয়াও দায়। ফরিদ জ্ঞানশূন্য হয়ে মাটিতে পড়ে রয়েছে। হুমায়রাও মাটিতে চেয়ারে বাধা অবস্থায় পড়ে রয়েছে। ধোঁয়ায় কাশছে সে। ঘামছে। কষ্ট হচ্ছে। তবুও চোখ দরজায়। এই বুঝি ফাইজান এলো। শেষ রক্ষে হলো অবশ্য। ফায়ার ব্রিগেডের দামালেরা চলে এলো এক বুক সাহস নিয়ে। ঘর এবং মানুষগুলো গ্রাস করতে পারলো না। জানালা ভেঙ্গে অবশেষে দুজনকেই বের করা হলো। হুমায়রা বারবার তাদের একটা কথাই বলছিলো,
"ফরিদ ভাইকে... হাসপাতালে নিতে হবে"
ফুসফুসে ধোঁয়া যাওয়ায় কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছে। অবশেষে অগ্নিকুন্ড থেকে দুজনকেই বের করা হলো। হুমায়রা বের হতেই ফাইজানের কলিজায় যেনো পানি এলো। তাকে ঝাপটে ধরে থাকা মানুষদের ছিটকে সরিয়ে ছুটে এলো সে। বুক অবধি আসা ক্ষুদ্র মেয়েটিকে জরিয়ে ধরলো সে। এতোটা শক্ত করে ধরলো যেনো কেউ তাকে ছিনিয়ে না নিতে পারে। ফাইজানের বাড়ন্ত হৃদস্পন্দন কানে আসছে হুমায়রার৷ বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলো সে। ফাইজান অজস্র চুমোতে ভরিয়ে দিলো তার মুখশ্রী। মানুষটি কাঁপছে। রাশাদ বোনকে দেখেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো যেনো। বোনকে জড়িয়ে ধরে বললো,
"ক্ষমা করে দিস, তোকে নিরাপদে রাখতে পারি নি। তোর ভাইজান আসলেই ব্যর্থ"
বুক এখনো কাঁপছে রাশাদের। মনে মনে হাজারবার আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলো সে। অপরদিকে স্ট্রেচারে করে অগ্নিকুন্ড থেকে বের হলো ফরিদ। তাকে দেখতেই আনন্দগুলো মিয়ে গেলো। রক্তাক্ত ফরিদভাইকে দেখেই রক্তশূন্য হলো ভাইজানের মুখশ্রী। ঠিক কি প্রতিক্রিয়া দিবে বুঝে উঠলো না মস্তিষ্ক। শুধু স্তম্ভিত, ব্যথিত নয়ন তাকিয়ে রইলো ফরিদের নিথর শরীরের দিকে।
*****
হাসপাতালের করিডোরে বসে রয়েছে রাশাদ, হুমায়রা এবং ফাইজান। অপারেশন থিয়েটারে ফরিদের অপারেশন চলছে। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। অবস্থা ভালো নেই। ডাক্তাররা কিছুই জানাচ্ছে না। রাত তখন গভীর। অথচ হাসপাতালের বাহিরে সাংবাদিকের ভিড় বাহিরে। সবাই একবার ফাইজান এবং হুমায়রার সাথে কথা বলার জন্য উৎসুক হয়ে আছে। জব্বার, নাদিম, যুবাইদা এবং তাদের সাঙ্গপাঙ্গ এখন জেলে। এটাই তাদের আগামী সকালের হেডলাইন। সিকিউরিটি কড়া করে দেওয়া হয়েছে। ফলে কেউ ফাইজানের সাথে কথা বলার সুযোগ পেলো না। হুমায়রাকেও অনেকক্ষণ অক্সিজেন দিতে হয়েছে। তার স্যাচুরেশন ড্রপ করেছিলো। এক বোতল স্যালাইনও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখন মোটামোটি স্বাভাবিক। রাশাদ খুঁজে খুঁজে একটা বিস্কিটের প্যাকেট আর পানি নিয়ে এলো। হুমায়রা তা গোগ্রাসে তা মুখে দিলো। সেই দুপুর থেকে কিছু খাওয়া হয় নি। এই শুকনো বিস্কিট তার কাছে অমৃতের মতো লাগলো। কিন্তু একটি বিস্কিটের উপর খেতে পারলো না। গলা থেকে নামলো না। ফরিদ ভাইয়ের কথা মনে পড়তেই দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো নোনাজলে। আজ মানুষটির এই অবস্থা শুধু তার জন্য। সে যদি এতো বড় রিস্ক না নিতো তাহলে বোধ হয় তার বাঁচা অসম্ভব ছিলো। অপরদিকে ফাইজান বসে রয়েছে প্লাস্টিকের চেয়ারে। মুখখানা শান্ত। চোখ শুকনো। অথচ বুকে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। কাঁদতে ইচ্ছে করলেও অশ্রুরা হরতাল করে। অনুভূতিগুলো অবশ হয়ে আছে। শুধু বারবার হাফসার মৃত্যুর দৃশ্যটি চোখে ভাসছে। আজ ফরিদ ভাইকে হারালে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না ফাইজান। হাফসার মৃত্যু প্রতিনিয়ত চাবুকের মত তাকে প্রহার করে। অনুভূতিহীনের খোলস পড়ে সেই প্রহার সহ্য করে এসেছে সে। প্রত্যেক মুহূর্তে নিজের অপারগতাকে অচিন প্রকোষ্ঠতে লুকিয়ে তাকে বাঁচতে হয়েছে। কিন্তু ফরিদ ভাইয়ের বেলাতেও কি সে এমন করতে পারবে? ফরিদ ভাই শুধু তার সহকর্মী ছিলো তা নয়। একজন বন্ধু ছিলো, মেন্টর ছিলো। তাদের স্বভাব আলাদা ছিলো, চিন্তাধারা আলাদা ছিলো। কিন্তু তারা একে অপরের ঢাল ছিলো। বিশ্বস্ত সহযাত্রী পাওয়ার মতো সৌভাগ্য সবার হয় না। কিন্তু সব হারিয়েও ফরিদ ভাই ছিলো ফাইজানের সাথে। হাফসার মৃত্যুর পর মানুষটি তার সব হারায়। তবুও কোনো কাঠগড়াতে দাড় করায় নি ফাইজানকে। কখনো তাকে ছেড়ে যায় নি। নিষ্ঠার সাথে তার পাশে থেকেছে প্রতিমুহূর্তে। ফাইজানের মনে হলো তার বুকের পাশে যখন বুলেট চিরে গিয়েছিলো তখনও এতটা যন্ত্রণা হয় নি যতটা আজ হচ্ছে। একটাবার ফরিদভাইকে জড়িয়ে বলতে ইচ্ছে করছে,
“ফরিদ ভাই, তুমি আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিও না। শাস্তি দিতে হলে আমার সাথে থেকে দাও। আমাকে ফেলে যেয়ে শাস্তি দিও না”
ফাইজানের চিন্তার মেঘ কাটতেই ডাক্তার বের হয়ে এলো। তার মুখখানা শুকনো। তাকে দেখেই ফাইজান এগিয়ে গেলো, জড়ানো গলায় বললো,
“ভাই কেমন আছে?”
“আই এম সরি, উই ট্রাইড আওয়ার বেস্ট। কিন্তু প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। একেই লিভারে ছুরিঘাত, ক্ষত গভীর, প্রচুর রক্তপাত হয়েছে। উপর থেকে উনাকে মারার কারণে ইন্টার্নাল ব্লিডিংও হয়েছে। তাই সম্ভব হলো না তাকে বাঁচানো"
ডাক্তার কথাগুলো কেমন ভাসমান শোনালো। ফাইজান তার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুসময় কিন্তু তার কাছে সবটাই দুঃস্বপ্ন মনে হতে লাগলো। এই ঘুম ভাঙ্গলেই আবার রোদেলা সকাল দেখবে সে। কিন্তু তেমনটা হলো না। ফাইজান দাঁড়িয়ে রইলো ঠাঁয়। কিন্তু ফরিদ ভাই ফিরলেন না। তাকে কঠিন শাস্তি দিলেন। যে শাস্তি চিরটাকাল তাকেই বয়ে চলতে হবে।
******
জুম্মা বাদে ফরিদের জানাযা হলো। শরীফা ছেলেটার লাশ ধরে খুব কাঁদলেন। কাঁদলো হুমায়রাও। কোথাও কোথাও নিজেকেও যেনো দোষের ভাগিদার মনে হলো। কাঁদলো না শুধু ফাইজান। তার মুখখানা শক্ত হয়ে রইলো। চোখজোড়া নিষ্প্রাণ, শুষ্ক। ফরিদের আপনজন বলতে তার ফুপু আর ফাইজান। আর কেউ নেই তার। তাই ফাইজান তাকে কবরে নামালো। দাফনকার্য সমাপ্তির পর বাড়ি এলো ফাইজান। কাওকে কিছু না বলেই নিজ ঘরের দরজা দিলো। গতকাল রাত থেকে সে কারোর সাথে কথা বলে নি। এমন কি হুমায়রার সাথেও না। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিলো ফরিদের লাশের দিকে। হুমায়রা পুরোটা সময় তার পাশে বসেছিলো হাতটা ধরে। সে জানে মানুষটি কষ্ট পাচ্ছে, ভেতরটা ছিড়ে যাচ্ছে কিন্তু প্রকাশ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। এর মাঝেই রাশাদ বললো,
"আমার যাওয়া লাগবে হুমায়রা। ইলহার সাথে কথা বলেছি। উনি বারবার ফোন করছেন। অস্থির হয়ে গেছেন। বুঝিস ই তো শরীরের যা অবস্থা। তুই কি আমার সাথে যাবি!"
হুমায়রা শান্ত গলায় বললো,
"উনার অবস্থা তো দেখছোই ভাইজান। উনাকে ছেড়ে কি করে যাই"
রাশাদ কিছু বললো না। তার বাস সন্ধ্যায়। সে চেয়েছিলো বোনটাকে নিয়ে যাবে। কিন্তু ফাইজানের মানসিক অবস্থায় তাকে নিয়ে যেতে বিবেকে বাধছে।
বিকালের অরুনছটা শুষে ধীর পায়ে নেমে এলো ছাইরঙ্গা সন্ধ্যা। সেই সন্ধ্যার গন্ধ্যে মিশে আছে প্রিয়জন হারানোর বেদনা। ফাইজান তখনো নিজ ঘরের দরজা খুলে নি। সে গতকাল বিকেল থেকে না খাওয়া। হুমায়রা দরজা ধাক্কালেও সে দরজা খুলে নি। রাশাদের সময় হয়ে এসেছে। ঠিক তখন ই দরজা খুললো ফাইজান। ঘুমিয়ে ছিলো হয়তো। চোখজোড়া কেমন ছোট ছোট হয়ে আছে। সে রাশাদের সম্মুখে দাঁড়িয়ে বললো,
"আপনি আপনার সাথে হুমায়রাকেও নিয়ে যান, রাশাদ সাহেব"
কথাটা হুট করেই নিস্তব্ধতা সন্ধ্যার পরিবেশে চির ধরালো। শরীফা বলে উঠলো,
"কোথায় নিয়ে যাবে হুমায়রাকে?"
ফাইজান নিষ্প্রাণস্বরে বললো,
"আমার সাথে হুমায়রা থাকা মানেই ওর জীবনের ঝুকি। হাফসা মারা গেলো, ফরিদ ভাই মারা গেলেন, হুমায়রার উপর দুবার আক্রমণ হলো। আমি এই পেশা ছেড়ে দিলেও আমার শত্রুরা আমাকে ছাড়বে না। তাই আমি চাই না হুমায়রা আমার সাথে থাকুক। আপনি বরং ওকে নিয়ে যান। দরকার হলে আমি ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিবো"..........
.
.
.
চলবে.......................................................................