তোমায় যত গল্প বলার ছিলো - পর্ব ০৮ - মিশু মনি - ধারাবাহিক গল্প


রৈনীলের ভাবান্তর নেই। জিজ্ঞেস করলো, 'কি অবস্থা বিজয়ী সরণী?'
'হা হা হা। বিজয়ী বটে। আগেও যে বিজয় সরণী ছিলাম তা কিন্তু নয়। আগে ছিলাম ফেইলর সরণী।'

হাসলো রৈনীল। আমি চলে যাবো কিনা বুঝে ওঠার আগেই স্বাগতা আপু এসে আমার এলোমেলো চুল ঠিক করে দিয়ে বললো, 'রৈনীল এসেছে তোকে শুভেচ্ছা জানাতে।'

আমি রৈনীলের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললাম, 'থ্যাংকিউ।'
'আমি মোটেও তোমাকে শুভেচ্ছা জানাতে আসিনি। তুমি এসেছো জানতামই না। আমি একটা কাজে যাচ্ছি। জুবায়েরকে সঙ্গে নিয়ে যাবো। তাই এত সকাল সকাল আসা।'
'আমি কিছু মনে করিনি। অবশ্য শুভেচ্ছা জানাতে এসেছেন শুনেও যে নিজেকে খুব স্পেশাল মনে হয়েছে তাও না।' 

রৈনীল মুচকি হেসে বলল, 'চান্স হওয়ার পর তুমি খুব কনফিডেন্ট হয়ে গেছো দেখছি।'

আমি খানিকটা লজ্জামিশ্রিত গলায় হাসলাম। ভদ্রভাবে চলে এলাম মুখ ধোয়ার জন্য। হাতমুখ না ধুয়ে এসে কথা বলার মতো ভুলটার জন্য আমার মন উশখুশ করছিলো। বেসিনের আয়নার তাকিয়ে দেখি রৈনীলের দৃষ্টি আমার দিকে। আমি থতমত খেয়ে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইলাম। কি ভাবছে সে? সে কি ভাবছে আমি দুদিনেই হুট করে কেমন বড় হয়ে গেলাম? সত্যিই তো! নিজেকে আজ আগের চাইতে বেশ বড় মনে হচ্ছে। যেন ভার্সিটিতে ওঠার আনন্দেই আমি রাতারাতি কয়েক ধাপ বড় হয়ে গিয়েছি।

যখন চা খেতে এলাম রৈনীল তখন জুবায়ের ভাইয়াকে তাড়া দিচ্ছে দ্রুত তৈরি হবার জন্য। স্বাগতা আপু বলল, ' একবার সময় করে চলে আসবেন ভাইয়া। আপনি তো আসেনই না।'
'আচ্ছা আসবো।'
'ঘুরতে যাওয়ার ব্যাপারটা মাথায় রাখবেন। আমরা এই পাঁচ ছয় জন মিলেই যাবো।'
'তোমরা ডেট ফিক্সড করো।'

রৈনীল বেরিয়ে যাওয়ার সময় আমাকে বললো, 'অভিনন্দন। তোমার নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা।'
'অনেক ধন্যবাদ। বইগুলোর জন্যও।'

ওনারা চলে যাওয়ার পর আপুকে জিজ্ঞেস করলাম, 'কোথাও ঘুরতে যাচ্ছো আপু?'
'একটা ডে ট্যুরের প্লান করছি। ঢাকার আশেপাশে কোথাও। পাঁচ ছয় জন মিলে গাড়ি নিয়ে যাবো। সারাদিন ঘুরে রাতের মধ্যে আবার ঢাকায় ফিরবো।'
'তোমরা কত মজা করো আপু!'

স্বাগতা আপু ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে কয়েক সেকেন্ড চেয়ে রইলো। যেন আমাকে খুবই অসহায় দেখাচ্ছিল কথাটি বলার সময়। আমি নিজের অসহায়ত্ব ঢাকতে অন্য প্রসঙ্গে কথা বলা শুরু করলাম।

স্বপ্নের মতো সুন্দর করে আরো একটা দিন কাটলো আমার। কখনো বারান্দায়, কখনো ছাদে, কখনোবা বাগানে নিজের মতো হাঁটাহাঁটি করে। একগুচ্ছ বইয়ের ভেতর ডুবে, দু একটা মন ভালো করা গান শুনে, আবার কখনো আপুর সঙ্গে বসে গল্প করেই কেটে গেলো চমৎকার দিনটি। 
পরদিন বিকেলেই আরো একটা চমক হাজির হলো আমার সামনে। আপু জানালো, আগামীকাল সকালেই আমরা দলবেঁধে ঘুরতে যাচ্ছি। ডে ট্রিপে। আমরা তিন জন আর আপুর তিন জন বন্ধুবান্ধব। আমি কোনোমত নিজেকে সামলে নিয়ে রুমে আসলাম। লজ্জায় আপুর সামনে খুশিতে চিৎকার করতে পারিনি। ইচ্ছে করছে মুখ চেপে ধরে একটা চিৎকার দিই। 

খুব সকাল সকাল উঠে তৈরি হয়ে নিলাম। যদিও রাতেও ঠিকমতো ঘুম হয়নি আমার। সারা রাত উত্তেজনায় এপাশ ওপাশ করে কাটিয়েছি। 

রেডি হবার প্রায় ঘন্টা দুয়েক পরে ভাইয়া ও আপু ঘুম থেকে উঠলো। আমি ততক্ষণে অস্থির হয়ে এদিক সেদিক হাঁটাহাঁটি করছি। এই প্রথম আমার কোথাও ঘুরতে যাওয়া। ওরা কি আর আমার উত্তেজনার উত্তাপ টের পাবে! কতক্ষণে গাড়িতে চেপে বসবো, সেই ভাবনায় আমি অস্থির। 

সাজগোজ খুব একটা করতে পারিনি। যাই করতে যাই, গা কাঁপে আমার। এত বেশী উত্তেজিত কখনোই বোধ করিনি আগে। এদিকে সকাল নয়টা বেজে গেলো। ক্ষুধায় মরে যাচ্ছি আমি। তখন আপু জানালো, 'কিছুক্ষণের মধ্যেই বেরিয়ে পড়বো আমরা।'

লজ্জায় জিজ্ঞেস করতে পারছিলাম না, 'না খেয়েই বের হবো?'

গাড়ির পেছন সাড়িতে বসলাম আমরা। খানিক দূর এসে দুজন উঠে পড়লো। সবার শেষে উঠলো রৈনীল। ঠিক আমার সামনের আসনেই বসলো সে। একবার পেছন ফিরে বলল, 'হাই বিজয়ী সরণী।'
আমি কিঞ্চিৎ হেসে উত্তর দিলাম, 'গুড মর্নিং।' 

এরপর আর তেমন কথা হয়নি। দ্রুতই ঢাকার বাইরে চলে এলাম আমরা। রাস্তার পাশের একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকলাম নাস্তা খেতে। আমার পেটে দারুণ খিদে। 
গরম গরম পরোটা ভাজা হচ্ছে। ডিম ভাজি ও বুটের ডাল দিয়ে পরিবেশন করা হলো। যতটুকু পারি খেয়ে নিলাম। খাওয়া শেষে এক কাপ দুধ চা। আমি আজীবন বাসায় মায়ের হাতে বানানো সুস্বাদু নাস্তা খেয়েছি। তবুও এই নাস্তাটুকু আমার আজীবন মনে থাকবে। 

রেস্তোরাঁর বাইরে এসে দাঁড়িয়েছি, এমন সময় খেয়াল হলো পাশে রৈনীল দাঁড়িয়ে। আমাকে বলল, 'রাতে ঠিকমতো ঘুম হয়নি তাই না?'
'উহু। আপনারও হয়নি?'
'আমি তো ঘুমিয়েছি ঠিকমতো।'
'তাহলে'
'তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে রাতে ঘুমাতে পারোনি।'
'আমাকে শুধু এটুকু বলুন, এটা কি শুধু আপনারই মনে হচ্ছে নাকি সবাই বুঝতে পারছে?'
'শুধু আমি বুঝতে পারছি। সবাই সবকিছু বুঝতে পারে না।'
'সেদিন যে আমি অনেক কান্না করেছিলাম, বুঝতে পেরেছিলেন?'
'হুম।'
'সত্যি!'
'হুম।'
'একবারও বলেননি কেন?'
'কি বলবো?'
'এইযে, সরণী, তোমার কিসের এত দুঃখ?'

রৈনীল হাসতে হাসতে বলল, 'কাউকে বুঝি এভাবে তার দুঃখের কথা জিজ্ঞেস করতে হয়?'
'তাহলে কিভাবে করতে হয়?'
'তার দুঃখ কমাতে তাকে একটু সঙ্গ দিতে হয়।'
'ওহ আচ্ছা। তাই বুঝি আমাকে খুব সঙ্গ দেয়া হয়েছিল সেদিন?'
'তা খানিকটা বলতেই পারো।'
'আমি আজকেও কি দুঃখী দুঃখী চেহারা করে রাখবো?'

রৈনীল মুচকি হেসে বলল, 'তার দরকার নেই। আমি এমনিতেও সঙ্গ দেবো।' 

আমার মুখ দিয়ে একটা আওয়াজও বের হয় না। আমি হা করে তাকিয়ে থাকি ওর দিকে। রৈনীল মিটিমিটি করে হাসতে হাসতে গাড়িতে গিয়ে উঠলো। আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়েই আছি। এদিকে স্বাগতা আপু ডাকছে, 'এই সরণী এই, দাঁড়িয়ে আছিস কেন? চলে আয়। গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে তো।'

আমি হতভম্ব ভাব কাটিয়ে গাড়িতে এসে চড়ে বসি। আমার ঊনিশ বছরের জীবনে এমনটা কক্ষনো হয়নি। 

সকলে মিলে গান, হাসাহাসি করতে করতে কখন যেন পথ ফুরিয়ে গেলো। আমি জানালার পাশে বসে বাইরের গ্রাম্য পরিবেশ উপভোগ করছিলাম। ওদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে গান গাইতে আমার লজ্জা লাগছিল। শুধু হাসি চলে আসছিল আমার মুখে। তবুও আজ নিজের মনটাকে একটুও দমে যেতে দিলাম না। পূর্ণ উদ্যমে ওদের সঙ্গে মিশতে চেষ্টা করলাম। যদিও জানি, এ আমার দ্বারা হবে না। তবুও চেষ্টা করতে তো ক্ষতি নেই!
.
.
.
চলবে.........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp