“ভালোই চাল দিয়েছেন জব্বার সাহেব। ফাইজান তো কুপোকাত। তবে আমার মনে হয় না এতো জলদি তাকে পরাস্থ করা যাবে। আমার কাছে একটা প্লান আছে। সামনাসামনি কথা বলা যাবে?”
ওপাশের মানুষটি কিছুসময় চুপ রইলো। হয়তো ভাবছে। ফরিদ শুষ্ক ঠোঁট ভেজালো। অপেক্ষা মানুষটির উত্তরের। কিছুক্ষণপর মানুষটি বললো,
“ঠিক আছে, আমি ঠিকানা দিতাছি। আসেন”
বলেই ফোনটা কেটে দিলো। ফরিদ কিছুসময় তাকিয়ে রইলো ফোনের স্ক্রিনের দিকে। জব্বার নামটি ভাসছে। ফরিদের চোয়াল স্থির। মুখোভাব স্বাভাবিক। ফোনটা পকেটে রেখে সে ভেতরে গেলো। ফাইজান তখন পুলিশ সুপারের সাথে কথা বলছিলো। তাকে খুব বিচলিত লাগছে। নিজের আয়ত্তের বাহিরে চলে গিয়েছে বোধ হয় অবস্থা। ফরিদ অপেক্ষা করলো তার কথা শেষ হবার। ফাইজান কথার মাঝেই দেখলো ফরিদ কঠিন মুখে দাঁড়িয়ে আছে। তাই সে নিজ থেকেই শুধালো,
“কিছু বলবে?”
ফরিদ স্বাভাবিক স্বরে বলল,
“আমি বেরচ্ছি”
“কোথায় যাচ্ছো?”
প্রায় সাথে সাথেই প্রশ্ন ছুড়লো ফাইজান। ফরিদ শান্ত গলায় উত্তর দিলো,
“নিজস্ব কাজ আছে”
*****
জব্বারের দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী একটা খুব নির্জন জায়গায় এসে পৌছালো ফরিদ। শহর থেকে প্রায় ১০০ কিলো দূরে একটি গ্রাম্য এলাকা। আশেপাশে জনমানবের কোনো অস্তিত্ব নেই। তার মাঝে সদর্পে দাঁড়িয়ে আছে একটি পুরানো বাড়ি। বাড়িটির বয়স অনুমান করতে পারলো না ফরিদ। তবে এখানে যে মানুষের বসতি বহু পূর্বেই উবে গেছে সেটা বুঝতে কষ্ট হলো না। দিবালোকে দেখা যেত বাড়িটির প্লাস্টার খসে পড়েছে। লাল ইট দেখা যাচ্ছে। তার মাঝে উঁকি দিয়ে মাথা উচু করে শাখা প্রশাখা মেলেছে গাছের শিকড়। গেট নেই। বাড়ির কাছে যেতেই গুমোট গন্ধ পেলো সে। দুজন চেঙড়া ছেলে এসে বললো,
“চলেন”
ফরিদ তাদের অনুসরণ করলো। একতালার ভাঙ্গা সিড়ি পাড় হয়ে পৌছালো দোতালার একটি ঘরে। জব্বার বসে আছেন একটি চেয়ারে। প্রহরী বেশ কড়া। ফরিদ আশপাশটা দেখলো। তারপর বসলো জব্বার সাহেবের মুখোমুখি। জব্বার সাহেব পানের পিক ফেলে শ্লেষ্মাজড়িত স্বরে বলল,
“আপনার মন্ত্রীর কি অবস্থা? ফরমান তো পেয়ে যাবার কথা”
“আপনার সত্যি মনে হয় এসব করে তাকে গদি থেকে সরানো সম্ভব? এত সহজে সে নিজের পদ ছেড়ে দিবে? আমার মনে হয় না। হুমায়রা নিখোঁজ ঘন্টা, অথচ ফাইজানের কোনোই হেলদোল নেই। উলটা আমার দুটো পেয়াদাকে জেলে পুরেছে। তারা স্বীকারোক্তি দিবে। এতো কিছু করেও কি লাভ হলো?”
ফরিদের শানিত কন্ঠে জব্বার সাহেবের কপালে তীক্ষ্ম ভাঁজ পড়লো। একটু নড়ে চড়ে উঠলো সে। ফরিদ তাচ্ছিল্যভরে বলল,
“প্রথমে মনে হয়েছিলো আপনার প্লান খুব ই তীক্ষ্ম কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সব ই মোটা মাথার কাজ। এসব বাচ্চামী করে কি করে রাজনীতি করেন আপনারা। আপনাদের সব পরিকল্পনাই তো জলে চলে গেলো”
“না না, হুনছি ও ওর বউয়ের প্রতি দূর্বল”
ফরিদের কথার সাথে সাথেই প্রতিবাদ করলো জব্বার সাহেব। ফরিদের হাসি বিস্তৃত হল। বিদ্রুপের টান অক্ষত রেখে বলল,
“এজন্যই তো এতোক্ষণ হাতে হাত রেখে বসে আছে। জব্বার সাহেব। আপনারা এই বুদ্ধি নিয়ে ওকে হারাবেন? এসব বাচ্চামিতে সময় নষ্ট ছাড়া আর কিছুই হবে না। আচ্ছা, আপনার কি গতবারের কথা মনে নেই? এমন চাল গতবারও চেলেছিলেন লাভ কি হয়েছিল? আমার বোনটা মাঝে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলো। অথচ ফাইজান ঠিক ই ওর জায়গাটা অক্ষত রেখেছে। ফাইজান একটা আগলি পিস অফ শিট। ওর কাছে সম্পর্কের কোনো দাম নেই। সম্পর্কগুলো শুধুমাত্র জড় একটা অনুভূতি। দশটা হুমায়রা চলে গেলেও ওর কিচ্ছু যায় আসবে না। আর এমন পদত্যাগে কি লাভ? জনপ্রিয়তা তো খোয়াবে না। এর চেয়ে বরং এমন কিছু করুন যেনো ওকে পার্টির লোকরাই ছুড়ে মারে। আমি সাহায্য করবো”
“আপনে আমারে সাহায্য করবেন?”
জব্বারের কন্ঠ সন্দিহান। সে নিশ্চিত হতে পারছে না ফরিদের কথায়। ফরিদ হেসে বলল,
“শত্রুর শত্রু বন্ধু হয়। এতোদিন সব খুইয়ে কিছু তো পেলাম না। তাই একটু ফাইজানকেও খোয়াতে দেখতে চাই। কিন্তু আমার শর্ত আছে”
“কি?”
“আমি হুমায়রাকে একবার দেখতে চাই”
“কেন? ওরে দেখে কি করবেন?”
জব্বারের প্রশ্নে ফরিদ হাসে। তাচ্ছিল্যভরে বলে,
“আপনারা আদোপি তাকে এনেছেন নাকি ফাঁকা আওয়াজ সেটা দেখা লাগবে না?”
****************
ঘড়ির কাটা দশটার ঘরে। নিষ্প্রাণ ইলহার নজর আটকে আছে ঘড়িতে। ফাইজান এখনো কিছু জানায় নি। ফলে চিন্তার গাঢ় কৃষ্ণ মেঘগুলো এখনো সরে নি। সকাল থেকে শুধু একের পর এক দূর্ঘটনা ঘটেই হচ্ছে। প্রথমে রাশাদকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেলো এরপর হুমায়রার সাথে হওয়া ঘটনা। সব কিছু মিলিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েছে সে। শরীরটাও যেনো মনের অসুখে তাল মিলিয়ে ঝিমিয়ে গেছে। বাড়ন্ত পেটে হাত রেখে শান্ত স্বরে বললো,
“তোরও কি অশান্তি লাগছে? চিন্তা হচ্ছে বাবা আর ফুপুর জন্য?”
ভেতরের ক্ষুদ্র প্রাণটিও বুঝি এই দমবন্ধ পরিস্থিতিটা অনুধাবন করতে পারছে। তাই তো মায়ের ডাকে নড়ে চড়ে উঠে। এর মাঝে খাবার নিয়ে প্রবেশ করে আতিয়া খাতুন। ইলহার পাসে বসেন তিনি। ভাঙ্গা স্বরে বলে,
“খাইয়া লও বউ, দুপুরে দুলা খাইছিলা; আর তো খাও নাই”
“খাবার যে গলা দিয়ে নামবে না দাদী”
“জানি, কিন্তু বাঁচন লাগদো না? তুমি তো একা না বউ। সাথে এককান মানুষ আছে। ওর জন্য খাইয়্যা লও”
ইলহা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। চোখ ভিজে এলো তার। ঘরে মাত্র দুজন মানুষ ই আছে। বাকি রয়েছে শুধু নিস্তব্ধতা আর কিছু চাপা দুঃখ। আতিয়া খাতুন সান্ত্বনা দিয়ে বললেন,
“কাইদো না বউ। আল্লায় এত্তো নিষ্ঠুর না”
*******
দেলোয়ার সাহেবের সামনে বসে আছে ফাইজান। নিস্তব্ধতার মাঝে তার শানিত দৃষ্টি, শান্ত কিন্তু শক্ত মুখশ্রীর দিকে তাকাতেও ভয় করছে দেলোয়ার সাহেবের। গলা শুকিয়ে আসছে অহেতুক কারণে। এমনটা কেনো হচ্ছে? কয়েক ঘন্টা পূর্বের ঘটনাগুলো এখনো স্বপ্নের মতো লাগছে। বিকালের চা খাচ্ছিলো সে আস্যেশ করে। হুট করেই সিভিল পোশাকধারী কিছু লোক ঢুকে পড়লো তাদের বাড়িতে। কঠিন স্বরে বললো,
“আপনাকে আমাদের সাথে যেতে হবে”
কোনো কথা বললেই একটি তাগড়া যুবক ঠাটিয়ে চড় বসালো তার গালে। কি অদ্ভুত? এখন বুঝতে পারলো কেনো। শুধু তাই নয়, আমানকে একটি অন্ধকার ঘরে আটকে রাখা হয়েছে। একটু পর পর শুধু তার ব্যথাতুর চিৎকার আর আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে। ফলে গায়ে হিমকাঁটা লাগছে দেলোয়ার সাহেবের। ফাইজান এখনো নিশ্চুপ। শুধু তাকিয়ে আছে। দেলোয়ার সাহেব আমতা আমতা করে বললেন,
“আমি সত্য কিছু জানি না। তোমার ভুল হইতেছে”
“মামা, শেষবারের মতো জিজ্ঞেস করছি আমার বউকে কোথায় নেওয়া হয়েছে?
“আরে আমি জানি না, তোমার বিশ্বাস হয় না?”
ফাইজানের দৃষ্টির ধার বাড়ল। শীতল কন্ঠে বললো,
“বারবার সুযোগ দিতে আমার ভালো লাগে না মামা, যদি আমি আজ রাতে আমার বউকে না পাই সহিসালামতে আমি আপনাকে এবং আপনার ছেলেকে জ্যন্ত পুড়িয়ে মারবো। কোন দেশের আইন বা** ও করতে পারবে না। তাই বাঁচতে হলে মুখটা খুলুন”
দেলোয়ার স্তব্ধ হয়ে গেল। তার সামনে যেন ফাইজান নয় কোন দয়ামায়াহীন দানব বসা। শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেলো শীতল স্রোত। শুকনো ঢোক গিলে বলল,
“আমি সত্যি জানি না, তবে এটুকু জানি এর পেছনে কে আছে?”
*******
ফাইজানের ঘরের বাহিরে চিৎকারের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। দরজার অপার থেকে শোনা যাচ্ছে রাশাদের ক্রোধিত স্বর। বডিগার্ড, পুলিশ সবাইকে অগ্রাহ্য করে সে অফিসে প্রবেশ করবে। মুখোমুখি হবে সে ফাইজানের। কিন্তু কেউ তাকে যেতে দিচ্ছে না। শুধু মেকি আশ্বাস দিয়ে বলছে,
“আপনি শান্ত হন”
কিন্তু রাশাদ তো শান্ত হবার পাত্রটি নয়। শান্ত তো ছিলো। যখন সেই রাতে কবরস্থানে ফাইজান এসে বলেছিলো,
“আপনি আজ দেরি করে বাড়ি যাবেন। খুব বড় একটা ষড়যন্ত্র হতে চলেছে। আজ রাতেই বাস্তবায়িত হবে। আমি ষড়যন্ত্রের মুলে যেতে চাই। আপনি শুধু আমাকে সহায়তা করবেন। আমি আপনাকে কিচ্ছু হতে দিবো না। শুধু একটু ধৈর্য্য ধরতে হবে।“
রাশাদ কি সব কিছু জেনে তার কথা মেনে নেয় নি। তবে আজ কেনো এই দশা হলো? কেনো তার প্রিয় বোনকে অপহরণ করা হলো? এতো রাত হবার পরও তার খোঁজ পাওয়া যায় নি? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর কি দিবে না ফাইজান?
অবশেষে ফাইজানের নির্দেশে প্রবেশ করতে দেওয়া হলো। রাশাদ প্রবেশ করতেই ফাইজানের কলার চেপে ধরলো, তীব্র রাগে ফেটে পড়া হৃদয় সংবরণের পরদে থাকলো না। ফাইজানকে প্রশ্নবিদ্ধ করলো,
“আমার বোন কোথায়? সব না আপনার নখদর্পনে?”
ফাইজানের কাছে উত্তর নেই। সে চুপ রইলো। রাশাদ শান্তমূর্তিতে অধিক ক্ষিপ্ত হলো। বিক্ষুদ্ধ হয়ে বললো,
“আমার আপনাকে কোনোদিনই পছন্দ নয়। আমি শুধু বাধ্য হয়ে আমার বোনকে আপনার সাথে বিয়ে দিয়েছি। সারাটাসময় আমি দুশ্চিন্তা করতাম, আমার ছোট বোনটা কি আদৌ সুখী হবে। আমার বোনটা যখন আমাকে বলেছিলো, “ভাইজান আমি তার সাথে সুখী”। আমি বিশ্বাস করেছিলাম। আজ সেই বিশ্বাস ই চুরমার হয়ে গেলো। আমার বোন কই? আপনি কি ভেবেছিলেন আমি জানবো না ওরা আপনার জন্য আমার বোনকে অপহরণ করবে? আমাকে সব কিছু থেকে সরিয়ে রাখলেই আমি টের পাবো না ভেবেছেন?”
রাশাদের সকল আরোপ মাথা নত করে শুনছে ফাইজান। কিন্তু মুখে তার রা নেই। রাশাদ তার নীরবতায় আরোও উন্মাদ হলো। রাগের সমস্ত শক্তি দিয়ে তাকে ঘুষি মেরে বসলো। ফলে ফাইজানের ঠোঁটের কিছু অংশ কেটে গলগলিয়ে বেরিয়ে এলো রক্ত। তাও রাশাদের রাগ কমলো না। ফাইজান তাকে বাঁধাও দিলো না। এটা তার প্রাপ্য কারণ সে হুমায়রাকে নিরাপদে রাখতে পারে নি। শেষমেশ রাশাদ ফাইজানকে ছেড়ে দিলো। হাটু গেড়ে তার সামনে বসে কাতর কন্ঠে বললো,
“আমার বোনটাকে ফিরিয়ে আনুন। আমার এই পৃথিবীতে আছেই হাতে গোনা তিনটে মানুষ। আমি ওকে হারাতে চাই না”
*******
ঘড়িতে সময় কত জানা নেই হুমায়রার। বদ্ধ অবস্থায় সে পড়ে রয়েছে বিকেল থেকে। ঘরটিতে বাহিরের পরিস্থিতি বোঝার উপর নেই। মাথার উপর বাল্বটির আলো ক্রমশ কমে আসছে। জানালাগুলো পেরেক দিয়ে আটকানো যেনো কেউ বুঝতেই না পারে এটা সকাল না রাত। এখানের পাহারা খুব কড়া। যুবাইদা এক মুহূর্তের জন্য তার সামনে থেকে সরে নি। বাহিরে তিনটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। যেনো হুমায়রা স্বপ্নেও পালাতে না পারে। হুমায়রা শরীর ঝিমিয়ে আসছে। হাতের বাঁধন এতো শক্ত যে ব্যাথায় টনটন করছে। ক্ষুধা, পিপাসা আরোও দূর্বল করে দিচ্ছে তনু, চোখ বুজে আসতে নিলে যুবাইদা হিনহিনে স্বরে বলল,
“আহারে খুদা লাগছে নি মন্ত্রীবউ এর? খাওন দিমু?”
যুবাইদার কন্ঠ কানে আসতেই মন বিষিয়ে আসলো। বিতৃষ্ণা আসলো কন্ঠে,
“আপনার হাত থেকে খাওয়ার থেকে মরণ ঢের ভালো। আপনি মা নামে কলঙ্ক”
যুবাইদা হাসে। তারপর চেপে ধরে হুমায়রার গাল। দাঁতে দাঁত পিষে বলে,
“তোর চোপা এতো চলে কে রে ছেরি, রাগাইস না আমারে। কি ভাবছোস? আমার ঠেহা পড়ছে তোর কতা হুনার?”
“এতো ঘৃণা? এতো? নিজের পেটের সন্তানের প্রতিও ঘৃণা হয় কারোর?”
হুমায়রার গাল ছেড়ে দিলো যুবাইদা। তাচ্ছিল্যভরে বলল,
“বাচ্চা কি সাদের নি? তোরা হইছোস ওই কু’ত্তা’র বা’চ্চার ভোগের ফল। আমি কেন ভালোবাসুম তোগোরে? রাশাদ তাও কামের ছেলো। পোলা, বুড়া বয়সে খাওয়াইতে পারবো। তুই কি কামের?”
“তাও সেই পোলার বিরুদ্ধেই ষড়যন্ত্র করলেন, তাকেই জেলের পেছনে পাঠালেন”
হুমায়রার কন্ঠে অসীম ঘৃণা। মুখ খিঁচে এলো। যুবাইদা হেসে বললো,
“ওই বাড়ির হগগলরে ঘেন্না করি আমি। পালাইছি তো ঐদিন কিন্তু পত্যেক সময় মরন জালা ভুগছি। কাওছার কি মানুষ আছিল? সুযোগ খুজিছি খালি। গেরামে তো সুযোগ পাওন যায় না। একদিন পাইলাম, চেয়ারম্যানের বাড়ি জব্বার সাহেবের লগে দেহা হইলো। বউ মরা ব্যাডার লোভ হইলো আমারে। আমিও তক্কে থাকলাম কহন এই জাহান্নাম ছাড়ুম। তোগর লগে সব সম্পর্ক তো বাড়ি ছাড়ার সময় ই চুকায় আইছি। পালাইছিলাম সোনার আসায়, সোনার খনি পাইছি। শহরে যাইয়া জব্বার সাহেবের বাড়িত কামে ঢুকলাম। ব্যাডার লগে হুইলাম। ব্যাডাও মজলো। ফাঁকে বিয়া করলাম। আমি জানতাম কাওছারের কিচ্ছু যায় আইবো না। জব্বার সাহেব এহন আমার সব। আমার সোনার খনি। তুই যদি ফাইজানের বউ না হইতি তাইলে আমি তোর মুখ ও দেখতাম না”
হুমায়রার মনে হলো যুবাইদা মানুষের পর্যায়েই পড়ে না। কেউ ঠিক বলেছিলো, নারী যখন নষ্ট হয়ে যায় তার থেকে ক্ষতিকারক বস্তু আর কিছুই হতে পারে না। না জানে এখন ভাইজানের কি অবস্থা? ফাইজান কি ওদের পাতানো ফাঁদে পা দিয়ে দিবে? চিন্তার ঘোর কাটতেই দরজা খোলার শব্দ এলো। যুবাইদা ঘটা করে মাথায় কাপড় দিলো। জব্বার সাহেব ঘরে প্রবেশ করলেন। সেই সাথে প্রবেশ করলো ফরিদ। ফরিদকে দেখেই হুমায়রার মুখখানা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। ফরিদ হুমায়রাকে একবার দেখেই চোখ সরিয়ে নিলো। যুবাইদাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“ইনি?”
“এ আমার বউ। সম্পর্কে ফাইজানের শ্বাশুড়ী। সেই সম্পর্কে আমিও ফাইজানের দ্বিতীয় শ্বশুর হই। হাহাহা”
বলেই কুৎসিতভাবে হাসলো জব্বার সাহেব। জব্বার সাহেব হাসি থামিয়ে বললো,
“এর জন্যই তো ফাইজানের মূল্যবান বউরে কবজা করলাম। তা এবার কন, আপনে আমারে সাহায্য কেমনে করবেন?”
হুমায়রা ফরিদের দিকে চেয়ে আছে। সে জব্বারকে সাহায্য করবে? ফাইজানের ক্ষতি করবে? কাতর স্বরে বলল,
“ফরিদ ভাই, আপনি উনাকে ঠকাবেন? উনি আপনাকে অনেক বিশ্বাস করে। আপনি উনার অনের ভরসার জায়গা।“
“হুমায়রা, তুমি ছোট মানুষ। এসবে পড়ো না। রাজনীতিতে কেউ আপন না”
খুব শান্ত স্বরে কথাটা বললো ফরিদ। এর মাঝেই নাদিম ছুটে এলো। মোবাইল এগিয়ে দিলো জব্বার সাহেবের কাছে। মোবাইলটি হাতে নিতেই চোখ বড় বড় হলো জব্বারের। দেলোয়ার সাংবাদিকদের সামনে বসা। দরাজ স্বরে সে স্বীকারক্তি দিচ্ছে, “কেতাব চৌধুরীর ভাই তার ভাইয়ের গ্রেফতারির প্রতিশোধ নিতেই ফাইজানের উপর আক্রমণ করেছে। আজও সেকারণেই তার স্ত্রীকে অপহরণ করেছে। ফাইজানের শ্বশুরকেও সে মারিয়েছে”
সংবাদটি শুনতেই মুখের রঙ বদলে গেল জব্বারের। ফরিদ তখন বললো,
“বলেছিলাম, ও অনেক ধূর্ত”
“তাইলে এখন?”
“ওর দাদাবাড়ি আছে। ওখানে কিছু টাকা রেখে দুদকে ফোন দিন। ওখানের চাবি আমি দিচ্ছি। কালোটাকা লুকানোর জন্য সেটা খুব ভালো জিনিস। শুধু তাই নয়। ওর সব সম্পত্তি ওর মার নামে করা হয়। যেনো মনোনয়ন পেতে ঝামেলা না হয়। শুধু তাই নয়, ভোটের দিন ও ইচ্ছে করে ব্যালট পরিবর্তন করতে সুযোগ দিয়েছিলো যেনো কেতাব সাহেবকে ফাসাতে পারে। এগুলো যথেষ্ট ওকে ট্রাপ করার জন্য। দেরি করবেন না।”
ফরিদের কথায় তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে যান জব্বার সাহেব। তার পেছনে যুবাইদাও বেরিয়ে যায়। সেই সুযোগে ফরিদ হুমায়রার কাছে এসে বলে,
“চিন্তা করো না, তোমার কিচ্ছু হবে না”
“ফরিদ ভাই আপনি উনার ক্ষতি কইরেন না”
ফরিদ উত্তর দিলো না। সে বিনা উত্তর দিয়েই বেরিয়ে গেলো।
***********
আধা ঘন্টার মধ্যেই ফরিদের কথামত সব কাজ করলো জব্বার। পুলিশকে জানালে তারা রেইড দিলো। কিন্তু সেটা নিয়ে খুব একটা হুল্লোড় নজর এলো না। ফলে জব্বার অস্থির হলো। বিচলিত গলায় বললো,
“কিছু হইলো না তো”
“হবে সময় দিন”
“আর কত সময়?”
“আজিব, সময় তো লাগবে নাকি। সব কি আর সাথে সাথে হয়”
ফরিদের দায়সারা কথায় বিরক্ত হলো জব্বার। সে উঠে দাঁড়ালো। ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললো,
“আমার কাছে তো সময় নাই ভাই, ওরে টেকনিক দিয়া না পারলে মনের দিক দিয়া ভাইঙ্গে দিমু”
“মানে?”
“বউ এর লাশ দেখলি পরে কি শান্ত বইবো ফাইজান?”
জব্বার সাহেব বেশ দৃঢ় কন্ঠে কথাটা বললো। ফলে ফরিদের কপালে তীক্ষ্ণ ভাঁজ পড়লো। সে সাথে সাথেই বললো,
“বাজে ফাঁসবেন কিন্তু জব্বার সাহেব”
“কত খু’ন করছি। একবারো কি ফাঁসছি। আপনার বোনের খু’নডাও তো করিছি? আপনেও ধরতে পারেন নি”
কথাটা শুনতেই স্তব্ধ হলো ফরিদ। গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেলো। ছাই চাঁপা ক্রোধ, রাগ, কষ্ট মস্তিষ্কে এসে ভর করলো। জব্বার আগাতে গেলেই সজোরে তাকে প্রহার করে ফরিদ। নিজেকে আর শান্ত রাখতে পারলো না ফরিদ। সাথে সাথেই জব্বারের লোকেরা তাকে ঘিরে ধরলো। ইচ্ছেমত তাকে মারলো তারা। এলোপাথাড়ি মারে রক্তে ভিজে গেলো শরীর। এই গোলযোগে ফরিদের মোবাইলটা পরে গেলো। সেটা পেলো নাদিম। সেখানে দেখতে পেলো ফরিদ এখানের লোকেশন শেয়ার করে রেখেছে ফাইজানকে। যা ইতিমধ্যে ফাইজান দেখেছেও। সাথে সাথেই সে বলে উঠলো,
“জব্বার মামা, ফরিদ ভাই ফাইজানরে আমাদের ঠিকানা দিয়েছে”
জব্বারের মুখোভাব বদলে গেলো। কঠিন স্বরে বলল,
“মাইরা লা এইডারে। আর আগুন লাগায়ে দে”
ঠিক তখন ই পুলিশের সাইরেন শোনা গেলো। ফলে ধরা পড়ার ভয়ে জব্বার সহ ফরিদকে রেখেই তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে গেলো। স্টোর থেকে কেরোসিন বের করে যারা বাড়িতে ছিটিয়ে দিতে থাকলো এবং আগুন ধরিয়ে দিলো বাড়িটায়। এর মাঝেই ফোর্স এসে তাদের ধরলো। জব্বার, নাদিম, যুবাইদা কেউ পার পেলো না। ফাইজানের গাড়ি যখন পৌছালো, তখন দাউ দাউ করে জ্বলছে পুরানো বাড়ির একাংশ………………
.
.
.
চলবে.......................................................................