সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। নিশিতা ছাঁদের এক পাশে দাঁড়িয়ে দূরের গ্রাম দেখছে। কালকের পর থেকে এখনো পর্যন্ত আহনাফ বাসায় ফিরেনি। এ-নিয়ে নিশিতা একটু বিচলিত। যদিও আহনাফ কল করে শামসুল চাচাকে জানিয়েছেন দুই দিন পর বাড়ি ফিরবেন তিনি। তবুও! আজকাল নিশিতার সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে গেছে। এখন আর সেই কালো অবয়বের কবলে তাকে পড়তে হয়না। এজন্যই সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলেও মেয়েটা একা ছাঁদে দাঁড়িয়ে থাকার সাহস পাচ্ছে। মাঝে মধ্যে দক্ষিণা বাতাস এসে নিশিতার সামনের চুলগুলোকে এলোমেলো করে দিচ্ছে। সবকিছুই কেমন বিষাদে ছেয়ে গেছে নিশিতার। রনির কথা শত ভুলতে চাইলেও ঠিক ভুলতে পারছে না মেয়েটা। সবকিছু কী এত সহজে ভোলা যায়? না! আসলেই যায় না। তবুও ভুলতে চেষ্টা করতে হয়। সেই চেষ্টায় আছে নিশিতা। তবে হুট করে কেমন একটা ভ্যাপসা গন্ধ পাচ্ছে সে। সৃতিচারণে এত ব্যস্ত যে সেটা বেখেয়ালে রইলো তার। কিন্তু রনির কথা ভাবতে ভাবতেই চোখদুটো কেমন ঝাপসা হয়ে উঠলো নিশিতার। সহসাই চোখের কার্নিশ বেয়ে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো। মেয়েটা ডান হাত দিয়ে সেই পড়ে যাওয়া অশ্রুজল মুছে পেছন ফিরে তাকাতেই বড়সড় একটা শক খেলো । জলজ্যান্ত রনি দাঁড়িয়ে আছে তার পিছনে! কিন্তু? কিন্তু রনি কীভাবে আসবে ভাবতেই নিশিতা বেশ বুঝে গেছে তার মনস্তাত্ত্বিকের উদ্ভট চিন্তা ভাবনা সবটা। তাই নিশিতা রনিকে উপেক্ষা করে ছাঁদ থেকে নামতে চাইলো। কিন্তু তখনই রনি ক্ষপ করে তার হাত ধরে ফেলে। নিশিতা তখন বিস্ময়ের চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।
" কথা না বলেই চলে যাবে?"
নিশিতা কিছু বুঝতে পারছে না। স্বপ্ন না-কি সত্যি!
" তুমি এখানে কী করে এসেছো?"
রনি নিশিতাকে হ্যাঁচকা টানে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে ধরে। রনির স্পর্শে নিশিতার শরীর কেমন গুলিয়ে উঠে। নিশিতা নিজেকে ছাড়াতে চাইলেও রনির বাহুবলের সাথে ঠিক পেরে উঠলো না।
" আমাকে ছেড়ে কীভাবে ওই লোকটাকে বিয়ে করলে? আমি কী এখন অচ্ছুৎ হয়ে গেছি?"
" কিসব বলছো তুমি? ছাড়ো আমাকে। আমি এখন অন্য কারো বিবাহিতা স্ত্রী। "
রনি নিশিতার কাঁধে শক্ত করে চেপে ধরে থুতনি উঁচিয়ে ধরে তাকিয়ে কেমন বিদঘুটে একটা হাসি দেয়।
" স্ত্রী? "
" রনি! প্লীজ ছেড়ে দাও। অসহ্য লাগছে।"
রনি নিশিতাকে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিলো।তারপর পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করলো। কিন্তু পরমুহূর্তেই আবার কি ভেবে যেন সেটা ফেলে দিলো। নিশিতা অবাক হয়ে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আছে। এটা আসলেই কী রনি? রনি আর সিগারেট? অসম্ভব! তবে হয়তো ভালোবাসা হারানোর কষ্টেই এই নেশা করার চেষ্টা করলো সে। নিশতার দু-চোখ ছলছল করছে। কিন্তু সেটা মোটেও রনির সামনে প্রকাশ করতে ইচ্ছুক নয় সে। নিজেকে শক্ত করে রনির দিকে কঠিন দৃষ্টিতে বললো,
" তুমি চলে যাও এখান থেকে। আমি আহনাফকে ঠকাতে পারবোনা। বিয়ে একটা পবিত্র বন্ধন। যা হাজারো হারাম প্রেমের উর্ধ্বে! "
" হা হা। প্রেম হারাম! এটা এখন মনে পড়েছে? "
নিশিতা সবকিছু রনিকে আঘাত করতে বলছে। রনি যতটা আঘাত পাচ্ছে তার তিনগুণ আঘাত গিয়ে লাগছে নিশিতার হৃদয়ে। নিশিতা কিছু বলতে যাওয়ার আগেই রনি আবারও তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। এই স্পর্শ অচেনা নিশিতার। সাথে উদ্ভট একটা ভ্যাপসা গন্ধ!
" রনি? নাহ তুমি রনি নয়! "
নিশিতার কথায় রনি তাকে ছেড়ে দিয়ে একটা শয়তানি হাসি দিয়ে বিকটাকার দানবে পরিনত হয়। দানবটার শরীরের অর্ধেক রনির মানে মাথাটা রনির। আর হাত দুটো অদ্ভুত দেখতে। ঠিক হাতির শুঁড়ের মতো। তাতে কোন আঙুল নেই। বুক থেকে পেট পর্যন্ত বিড়াল আকৃতির। আর নিচের অংশ হায়েনার। নিশিতার মাথা ঘুরছে। এরকম উদ্ভট জন্তু কখনো দেখেনি। জন্তু রূপী রনি নিশিতাকে ধরতে সামনে এগুতেই সেখানে উপস্থিত হয় মেহেরাব। সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত ছায়ার মতো অবয়ব হিসেবে দেখা যাচ্ছে তাকে। রনি তাকে দেখেই কিঞ্চিৎ বিচলিত হলো মনে হয়।
অন্যদিকে,
জ্বীন যুবরাজ মেহেরাব রাজ্যে ফিরে তার বাবাকে পৃথিবীতে থাকার যাবতীয় কারণ বললেও মানুষের সাথে এত সংখ্যাতা তিনি ভালো মনে নিতে পারেননি। পাশাপাশি হুজায়ফার সাথে বিরোধিতা করার জন্যও যুবরাজকে কিছু কথা শোনান তিনি। যুবরাজ ঠিক বুঝতে পারছে না তার বাবা এরকম কথা কেন বললেন? যেখানে তিনি নিজেই মানুষের সাথে বসবাস করেন! হ্যাঁ জ্বীন রাজার স্ত্রী অর্থাৎ রাণী মায়া বর্তমানে পরী হলেও সে মানবী ছিল। পরবর্তীতে বদ জ্বীনের আক্রমনের কারণে রাণীর আত্মরক্ষার জন্য তাকেও পরী বানিয়ে দেন তিনি। যুবরাজ মেহেরাব বেশি সময় এখানে থাকতে পারবে না বললে রাজা একটু ভেবে বলেন আগামীকাল ছাড়া পৃথিবীতে ফিরতে পারবে না সে। রাজার এরকম কথা শুনে মেহেরাব হতভম্ব প্রায়। ওদিকে যে হুজায়ফা তার খারাপ শক্তি কাজে লাগিয়ে রনির শরীরটাকে কবজা করে ফেলেছে! আর এই মুহূর্তে নিশিতাকে আক্রমণ করতে চেষ্টা করছে সেটাও জানে মেহেরার। ওখানে যে মেহেরাব আছে সে কেবল ছায়ামানবের মতো। মানে শুধু মেহেরাবের অস্তিত্ব হুজায়ফাকে দেখানোর জন্যই এই ব্যবস্থা করা।
" কিন্তু বাবা আমাকে যে এক্ষুনি যেতে হবে। নিশিতা.."
মেহেরাবের কথা শেষ করতে পারলো না। রাজা বললেন,
" হুজায়ফাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। ও নিজের স্বার্থে কিছু করছে না। এর পিছনেও রয়েছে ওই পৃথিবীর কোন অসাধু মানুষ। "
" এর মানে কী বাবা? আমি কবে ভবিষ্যত দেখার শক্তি পাবো!"
" সময় হলে পাবে। আর সবকিছু জানার সঠিক সময় থাকে। আপাতত আজ তোমার সাথে কিছু জরুরি কথা আছে। শীগ্রই তোমার অভিষেক। "
মেহেরাব শুধু বাবার কথায় মাথা নেড়ে সায় দিল। কি করবে বুঝতে পারছে না। হুজায়ফা যদি বারাবাড়ি রকমের কিছু করে? নিশিতার কোন ক্ষতি করবে না তো!
জ্ঞান ফিরতেই নিশিতা নিজেকে বেডরুমে আবিষ্কার করে। চোখ মেলে তাকাতেই মনে পড়ে যায় একটু আগে ঘটে যাওয়া বিভৎস ঘটনার কথা। নিশিতা বিছানা থেকে উঠে বসে। এরমধ্যেই রুমের দরজায় শামসুল আলম নক করেন।
" ম্যাডাম আসবো?"
" হ্যাঁ অবশ্যই। আচ্ছা চাচা আমি এখানে কি করে এলাম? আপনি কী কিছু জানেন!"
" আগে এই গরম দুধের গ্লাস চুমুকে সাবাড় করুন তো। শরীর এত দূর্বল ছাঁদে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে ছিলেন। সারা বাড়িতে খুঁজে না পেয়ে শেষে আমি ছাঁদে গিয়েছিলাম।"
" ওহ। তাহলে আপনি নিয়ে এসেছেন। আচ্ছা ওখানে আর কেউ ছিলেন? "
কথাটা বলার সময় নিশিতার চোখে মুখে ভয়ের ছাপ লক্ষ্য করে শামসুল। তিনি আশ্বস্ত করে বলেন সেখানে কেউ ছিলেন না। নিশিতা গভীর ভাবনায় পড়ে যায়। তাহলে কী সব তার মনের ভুল ছিল? না-কি সত্যি!
" কি হলো?খেয়ে নেন। স্যার এসে শুনলে আমাকে বকবেন খুব। "
শামসুলের কথায় অনুনয়ের সুর পেলো নিশিতা। সে লক্ষ্মী মেয়ের মতো গ্লাসটা নিয়ে তাকে যেতে বলে। নিশিতা বুঝতে পারছে না। এই সাদা লোকটা কে ছিল? মেয়েটা আগেও দেখেছে কোন শুভ শক্তি তাকে বারবার বাঁচানোর জন্য আসে। কিন্তু কেন এইসব ঘটছে তার জীবনে? কই তার সব বান্ধবীদের জীবন তো দিব্যি স্বাভাবিক ভাবে চলছে। তাহলে তার জীবনেই বা কেন? এসব ভাবতে ভাবতে নিশিতা তার কাঁধে খুব ব্যথা অনুভব করে। হাতের গ্লাসটা পাশের টেবিলের উপর রেখে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় সে। শাড়ির আঁচল সরাতেই চমকে উঠে নিশিতা। নখের স্পষ্ট দাগ বসে আছে কাঁধে! তার মানে একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা সত্যি। নিশিতা আবারও এক ভয়ংকর আতংকে আঁতকে উঠে।
চলবে...........................