নজর - অন্তিম পর্ব ০৭ - তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া - ধারাবাহিক গল্প


শান্তিতে ঘুমাতে পারেনি নিশিতা। চোখ বন্ধ করলেই রনি রূপী সেই উদ্ভট জন্তুর প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠে নিশিতার চোখের সামনে। পরেরদিন নিশিতা ওর বাবা-মাকে দেখতে যায়। বিয়ের পর আর বাবার বাড়ি যাওয়া হয়নি নিশিতার। আহনাফকে বলে আসার কোন সুযোগ তার হাতে ছিল না। কারণ আহনাফের ফোন অফ করে রেখেছিল। নিশিতাকে দেখে সবাই খুশি হন। তবে রেহান ইতোমধ্যে ঢাকা চলে গেছে। বোনের বিয়ের জন্য বাড়িতে এসেছিল সে। সারাদিন বাবা-মায়ের সাথে কাটিয়ে সন্ধ্যার আগেই বাসায় চলে যায় মেয়েটা।

এদিকে খুব ধুমধামে যুবরাজ মেহেরাবের অভিষেক হয়েছে জ্বীন রাজ্যে। সবাই নতুন রাজাকে পেয়ে বেজায় খুশি। কিন্তু মেহেরাবের মন খচখচ করছে নিশিতার জন্য। তবে তাকে অন্তত আজ রাত বারোটা পর্যন্ত জ্বীন রাজ্যেই থাকতে হবে। কারণ রাত বারোটার সময় তার বাবা তাকে সমস্ত শক্তি অর্পণ করবে। তারপরই মেহেরাব জানতে পারবে ঠিক কী কারণে হুজায়ফা নিশিতার জীবনকে বরবাদ করার চেষ্টা করছে! আর কে সেই মানুষ যে নিচিতার ক্ষতি চায়? সবকিছু জানতে হলে তাকে অবশ্যই আর কয়েক ঘন্টা সময় কাটাতে হবে জ্বীন রাজ্যে।

রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা,
নিশিতা খাওয়া শেষে শামসুল চাচার সাথে টুকটাক কথা বলছে। একা একা বিরক্ত লাগছিল নিশিতার। তাই বসার ঘরে এসে দেখলো বসে চাচা টিভিতে নিউজ দেখছেন। তারপর বর্তমানে ঘটে যাওয়া কিছু টপিকেই কথা চলছে দুজনের মধ্যে। 
" আচ্ছা চাচা আপনি কী পারফিউম ব্যবহার করেন? না-কি কোন আতর!"
নিশিতার এহেন প্রশ্নে শামসুল আলম হো হো করে হেসে উঠে। হেতু জানতে চাইলে তিনি বলেন না সে কোন সুগন্ধি এই মুহূর্তে ব্যবহার করেননি। আর কখনোই ব্যবহার করেননি। তার জবাবে নিশিতা ঠিক কী বলবে বুঝতে পারছে না। তাহলে সেদিন আহনাফ কেন বললো তিনি নয় মনে হয় চাচা ব্যবহার করেন? না-কি দুজনের কেউই কোন সুগন্ধি ব্যবহার করেননা! বরং ওই কালো অবয়বের বিরুদ্ধে লড়াই করা শুভশক্তির উপস্থিতির প্রতীক ওই সুগন্ধি! হ্যাঁ। তাই হবে হয়তো সব। 
" বুঝলন ম্যাডাম?"
" হ্যাঁ। আসলে আমি মাঝে মধ্যে একটা সুগন্ধি অনুভব করি। তাই সেদিন উনাকে জিজ্ঞেস করলাম বললেন, হয়তো আপনি ব্যবহার করেন!"
" স্যার আন্দাজে বলেছেন হয়তো। "
নিশিতা আরকিছুই বলে না চাচাকে। তার জীবনের রহস্য তাকে এত ভাবাচ্ছে যে আহনাফকেও আজকাল খুব সন্দেহ হয় তার। সারাক্ষণ কোথায় থাকেন উনি! এসব ভাবনা প্রায়শই ঘুরাঘুরি করে মেয়েটার মাথায়। নিশিতা শামসুল চাচাকে বিদায় জানিয়ে নিজের রুমে ঘুমানোর জন্য যায়। অবশ্য নিশিতার কাছে এটা রুম নয় হলরুম বটে! বাড়ির সব ঘরগুলো অনেক বড় বড়। একেবারে রাজকীয় বাড়ি। ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে দেখে বারোটা বেজে গেছে। সময় যে কোথা থেকে যায় টেরই পায়নি সে। আসলেই সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না। আচ্ছা মানুষও যদি সময়ের মতো হতে পারতো? কিসব ভুলভাল ভাবছে? নিজেই নিজেকে পাগল বললো মেয়েটা। রনির কথা ভাবতে না চাইলেও কিছু ভাবনা মাথায় এসে পড়ে। 
জানালার দিকে নজর যেতেই মনটা কেমন খচখচ করে উঠলো নিশিতার।
" নিশিতা!"
নিশিতা দ্রুত বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখে সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত একজন যুবক বসে আছেন। নিশিতার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে উঠে দাঁড়িয়ে সামনে অগ্রসর হন। চমৎকার তার চেহারা। মুখের হাসিতে যেন তার মুক্ত ঝরে পড়ছে! সেই সাথে তার শরীর থেকে অসম্ভব সুন্দর সুগন্ধি নিঃসৃত হচ্ছে। নিশিতা নিজেকে সামলে দ্রুত তাকে জিজ্ঞেস করে সে কে? জবাবে মেহেরাব তার পরিচয় বলে।
" আপনি জ্বীন রাজা!"
" হ্যাঁ। "
" তাহলে আপনি কী সেই যে আমাকে বারবার বিপদ থেকে রক্ষা করেছেন?"
" জি জনাবা।"
" কিন্তু কেন? আর আপনি কীভাবে আমাকে চেনেন! আর আপনার কী-বা আপনার স্বার্থ? "
" এতগুলো প্রশ্নের উত্তর যে দিতে হবে তা আমি জানি। তাই সবটা শুরু থেকেই বলি?"
নিশিতা সম্মতি জানায় মেহেরাব ধীর পায়ে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলতে শুরু করে। 
" আজ থেকে বেশি দিন নয়। এই বছর দুয়েক আগে, তুমি তোমার বান্ধবীদের সাথে তোমার দাদু বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলে।ফোনের নেটওয়ার্ক খুঁজতে খুঁজতে যখন তুমি গভীর রাতে চার রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়ালে! তখনি প্রথম দেখি আমি তোমাকে। প্রথম দেখায় বলতে গেলে ভালোবেসে ফেলি তোমাকে। আমি জানি এটা ঠিক ছিল না। তুমি মানুষ আর আমি জ্বীন। তাও আবার জ্বীন রাজ্যের ভবিষ্যত রাজা! তবুও মনটাকে বুঝাতে পারিনি। তারপর থেকে সব সময় তোমার উপর নজর রেখেছি। তোমার ঘরে বাইরে সর্বত্র খেয়াল রেখেছি। "
" আমার বিয়ে হয়ে গেছে এখন। সেটা জেনেও আমাকে কোন বাঁচাচ্ছেন? "
" ভালোবাসা তো ভালোবাসাই! তাতে বিয়ে হওয়া না হওয়ার কি আছে? যাইহোক এরপর আরও ঘটনা আছে। শোনো,তারপর প্রায় ছয় মাস আগে যখন প্রথম তোমার উপর হুজায়ফা আক্রমণ করতে শুরু করে। তখন আমি হুজায়ফাকে অনেক বার বারণ করেছি। কিন্তু ওই বদ জ্বীন আমার কোন কথা শুনতে নারাজ ছিল। আর এইকয়দিনে আমি কিছু করতে পারিনি কারণ, সামনে আমার অভিষেক ছিল। রাজা হওয়ার আগে কোনভাবেই তাকে খুন করা কিংবা শাস্তি দেওয়া সম্ভব ছিল না। মানুষের জন্য স্বজাতিকে হত্যা করা আমাদের নিয়ম বহির্ভূত। তাই শুধু এত কয়দিন তোমাকে ঢালের মতো রক্ষাই করে গেছি। কিন্তু এখন আমি পূর্ণ শক্তি পেয়ে গেছি। আর সেই সাথে যে সত্যি জানতে পেরেছি তা শুনলে তুমি অবাক হয়ে যাবে। "
" কী সেই সত্যি? আমি জানতে চাই।"
" হুজায়ফা যা করেছে এবং করছে সব নিজের ইচ্ছেতে করেনি। তাকে কেউ বাধ্য করে এসব করাচ্ছে। তাদের উদ্দেশ্য তোমাকে মানসিক ভারসাম্যহীন প্রমাণ করে অর্থসম্পদ লুট করা।"
" এত হেয়ালি না করে স্পষ্ট করে বলুন। কে সে? রনি!"
" আরে না। রনি তো কেবল তাদের খেলার গুটি মাত্র! তোমার মা। মানে সৎ মা। তিনি এক হুজুরের সাহায্যে হুজায়ফাকে তোমাকে জ্বালাতন করার ব্যবস্থা করে। আর হুজায়ফা রনির শরীর কবজা করে আজ তোমাকে হত্যা করতে এসেছিলো। "

নিশিতা মেহেরাবের কথা বিশ্বাস করতে পারছে না। আবার অবিশ্বাস করতেও পারছে না। কারণ মেহেরাব যেভাবে সব সময় তাকে প্রাণে বাঁচিয়েছে তাতে সে মিথ্যা বলবে বলে মনে হয় না। 
" আমার মাথা কাজ করছে না। আমি তো কখনো টাকা পয়সা নিয়ে কিছু বলিনি মা'কে। আর বাবা যে তার সব সম্পত্তি আমাকে দিয়ে দিয়েছেন এমনও নয়!"
" হ্যাঁ তবে তুমি তো অর্ধেক মালিকানা পেয়েছো। তিনি প্রথমে তোমাকে তারপর রেহানকে টার্গেট করবেন ভেবেছেন। "

নিশিতা কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মেহেরাবের পিছনে। একটা মানুষ এত ছলনা করতে পারে? এমন ভাব করেন যে তাদের দুই ভাইবোনকে তিনি নিজের সন্তানের মতোই ভালোবাসেন। নারী আসলেই প্রখর ছলনাময়ী! 
" বুঝতে পেরেছি সবকিছু। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। "
মেহেরাব নিশিতার কথায় না হেসে পারলো না। জবাবে হেসে বললো,
" ধন্যবাদ নয় একটু ভালোবাসা চাই!"
" আমি বিবা..."
নিশিতার কথা শেষ হওয়ার আগেই মেহেরাব নিজের রূপ পরিবর্তন করে। আসলে আহনাফই মেহেরাব। পৃথিবীতে মানুষের মতো বেশভূষা ধরে ছিল বিধায় চিনতে পারেনি নিশিতা। সে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আহনাফের দিকে। 
" আপনি! "
" হুম আমি। আমিই তোমার স্বামী আবার আমিই জ্বীন রাজ্যের বর্তমান রাজা। তোমাকে পাওয়ার জন্য এই মানব রূপ ধারণ করা। "
" তার মানে আমি এতদিন জ্বীন-ভূতের সাথে থেকেছি!"
" হাহা এভাবে বলো না। বাই দ্য ওয়ে,আমি কিন্তু তোমার শিক্ষক! "
নিশিতা এবার আর না হেসে পারলো না। দুজনেই একসাথে হো হো করে হেসে উঠে। 

পরের দিন আহনাফকে সাথে নিয়ে সেই হুজুরের কাছে যায় নিশিতা। তারপর হুজায়ফাকে মুক্ত করে। আর সেই সাথে রনির শরীরও মুক্তি পায়। সেখান থেকে সোজা দুজনে চলে যায় নিশিতার বাবার বাড়ি। নিশিতাকে জামাই সমেত দেখে খুব একটা খুশি হয় না মাইশা ইসলাম। তবুও মুখে মেকি হাসি ফুটিয়ে মোটামুটি আপ্যায়ন করে আহনাফকে। বিকেলে নিশিতা বাবা বাসায় ফেরার পরে নিশিতা মাইশা ইসলামকে জিজ্ঞেস করে কেন সে এসব করলো! কিন্তু তিনি সবকিছু অস্বীকার করায় সেই হুজুরকে গিয়ে সাথে নিয়ে আসে আহনাফ। তারপর নিশিতার বাবার সামনে মাইশা ইসলামের মুখোশ উন্মোচন হয়। জহিরুল ইসলাম ভাবতেও পারেননি তার স্ত্রী এরকম ধরনের মানুষ। 
" এটা কীভাবে করলে তুমি? যেখানে নিজে সন্তান পর্যন্ত নাওনি!"
" করেছি কারণ তুমি সব সম্পত্তির মালিকানা ওদের দুই ভাইবোনকে দিয়ে রেখেছো। তাহলে তোমার মৃত্যুর পর আমার কী হবে? ওদের কাছে হাত পেতে চলতাম? আর সন্তান! চেষ্টা করেছি কিন্তু সফল হইনি।"
" আমার ভাবতেও ঘৃণা করে তোমার সাথে এতদিন সংসার করেছি। "
জহিরুল ইসলাম রেগে মাইশা ইসলামকে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বলেন। নয়তো পুলিশের সাহায্যে বের করবেন বলে। কিন্তু মাইশা ইসলাম অনেক কান্নাকাটি ও অনুনয় বিনয় করে। ফলে নিশিতাই তার বাবাকে বলে একটা সুযোগ দিতে তাকে। কারণ সে চাইলেও আর কোন ক্ষতি তিনি নিশিতার করতে পারবেন না। জহিরুল ইসলাম মেয়ের কথায় তাকে বাড়ি থেকে বের করা থেকে বিরত থাকেন। রাতে খাওয়া দাওয়া শেষে আহনাফ ও নিশিতা তাদের বাড়ি ফিরে আসে। 
নিশিতা নিজের রুমে লাইট অফ করে বসে আছে। আহনাফ রুমের বাতি অন করতেই চমকে উঠে। নিশিতা বউ সেজে বসে আছে। মুখে তার লাজুক হাসি। এই হাসির অর্থ বুঝতে বাকি নেই আহনাফের। আহনাফ দরজা আটকে নিশিতার পাশে গিয়ে চুপচাপ বসে। নিশিতা একটা দুষ্ট হাসি দিয়ে বলে,
"এই ছেলে এভাবে বসে আছি আধঘন্টা ওভার! এত দেরি করে এলে কেন? "
" হাহা তা আমি কী ক্লাসে এসেছি না-কি? "
নিশিতা আহনাফকে সালাম করতে করতে বলে, " হ্যাঁ প্রেমের ক্লাস এটা!"

এভাবেই শুরু হয় দুটি জীবনের নতুন করে পথ চলা,একটি ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠার গল্প। সারাজীবন নিশিতা আহনাফের ভালোবাসার নজরেই আবদ্ধ থাকুক।



সমাপ্ত........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন