নীরবে নিভৃতে - পর্ব ০৯ - তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া - ধারাবাহিক গল্প


রোশন মুচকি মুচকি হাসছে মেহেকের দিকে তাকিয়ে। মেহেক তো মাটিতে দৃষ্টি রেখে বোনের কথা ভাবছে। পল্লবের শাস্তির থেকেও নিজের বোনকে বাঁচানোর চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে মাথায় । 

" সুন্দরী? তুমি ঠিক আছো তো? কী ভাবছো?"

মেহেক ছলছল নয়নে রোশনের চোখে চোখ রাখলো। ওর অশ্রুসিক্ত চোখে দৃষ্টি মেলাতেই কেমন এলোমেলো হয়ে গেছে রোশন। সিগারেটের অবশিষ্ট অংশটুকু মাটিতে ফেলে দিয়ে গালে দু'হাত রেখে শুধালো রোশন,
" কী হয়েছে মেহেক? ঠিক আছো তো তুমি? কী কষ্ট হচ্ছে বলো আমাকে। "

রোশনের কোমলভাব দেখে মেহেক থেমে থেমে বললো,
" আমার বোন মিষ্টিকে ওই কুত্তারবাচ্চা পতিতালয়ে বিক্রি করে দিয়েছে। "
" কবে?"
" ও বলেছে সাত-আট দিন আগেই। "

রোশন দু-হাত দিয়ে মেহেকের চোখমুখ মুছে বললো,

" তুমি শান্ত হও। আমি দেখছি। কাঁদবে না একদম সুন্দরী, আমার অস্থির লাগে তুমি কাঁদলে। "

কথা শেষ হওয়া মাত্র রোশন পল্লবের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। অর্ক বললো,
" ভাই এইভাবেই কি ধইরা থাকুম? "
" না, ছেড়ে দে। জামাকাপড় পরতে দে ওকে।"

রোশনের কথামতো লিমন ও অর্ক পল্লবকে ছেড়ে দিলো। মুক্ত হতেই নিজের পোশাক পরে নিলো সে। কিছুটা অনুনয়-বিনয় করে বললো পল্লব,

" আমাকে যেতে দাও বস। আমি সত্যি বুঝতে পারিনি মেহেক তোমার এতটা কাছের। "

" এখন তো বুঝতে পেরেছিস? ওর বোন মিষ্টি কোন পাড়ায় আছে? "

" এখানেই আছে বস। "

" গুড। তুই এখন যাবি ভেতরে। তারপর মাসীকে বলবি তুই মিষ্টিকে নিয়ে একটু বাইরে সময় কাটাতে চাস। টাকাপয়সার দরকার হলে দিচ্ছি। "

রোশনের কথায় এই মুহুর্তে রাজি না হয়ে উপায় নেই ওর। এমনিতে শুধু মেয়ে বিক্রি করা পর্যন্ত পল্লবের ক্ষমতা। কোনো পোষা গুণ্ডা নেই। তবে কয়েকটা থাকলে আজ এই হাল হতো না। যারা আছে সব শহরের বিভিন্ন জায়গায় থাকে। এই মুহুর্তে কাউকে কল দিয়ে ডাকার সুযোগও নেই। অগত্যা ম্লান কন্ঠে বলে পল্লব, 
" ঠিক আছে বস।"
" মনে রাখিস চালাকি করলে গ্রামে তোর বাবা-মা শেষ! "
চমকে উঠলো পল্লব। এক মুহুর্ত দেরি না করে সামনের বিল্ডিং এ ঢুকলো। যতই নোংরা মানুষ হোক পল্লব বাবা-মাকে হারাতে চায় না। 

গতকাল রাত থেকে জঙ্গলের বাইরে পুলিশের আনাগোনা লেগেই আছে। মনে হচ্ছে সুযোগ বুঝে আক্রমণ করবে জঙ্গলে। কেউ একজন আছে যে প্রশাসনকে উস্কে দিয়েছে। সবুর হোসেন এরমধ্যেই সকল অস্ত্র নিয়ে বাকি সদস্যদের তৈরি করে রেখেছেন। পাহারায় আরো সদস্য যোগ করেছে, উন্নত অস্ত্র সরবরাহও করেছেন। তবুও ভয় একটা থেকেই যায়। রোশন এলাকার নেই। এখানে ফোনের নেটওয়ার্কও কাজ করে না। কীভাবে জানাবে এই বিপদের কথা? 
" রাতের খাওয়াদাওয়া শেষে একবার সবাই আসিস আমার কাছে। "
খোলা আকাশের নিচে টেবিলে বসে খাচ্ছে সবাই। পাশাপাশি তিনটে টেবিল এখানে, মোট বিশজন লোক। তবে টেবিলগুলো প্লাস্টিকের। তাই প্রয়োজন শেষে অন্যত্র রাখা যায়। মীরা সকলকে খাবার পরিবেশন করছে। ফয়সাল সবুর হোসেনের কথার পিঠে বলে,
" ঠিক আছে বস।"
সবুর হোসেন হাত ধুয়ে, মুখ মুছে নিজ ঘরের দিকে এগোলেন। 

“ রূপে আমার আগুন জ্বলে 
যৌবন ভরা অঙ্গে
প্রেমের সুধা পান করে নাও 
হায়রে আমার দিওয়ানা। ”

বসার ঘরে সোফায় পায়ের উপর পা রেখে বসে গান শুনছেন রীনা মাসি। লম্বা চুলগুলো বিনুনি করা, পরনে হাতাকাটা ব্লাউজের সাথে শাড়ি। কানে ঝুমকা, ঠোঁটে কড়া লাল লিপস্টিক, চেহারায় মেকআপ। বয়স তার আনুমানিক সাতচল্লিশ কিংবা আটচল্লিশ হবে। ঘরের অন্য দিকে দু'জন মেয়ে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। বাকিরা যে যার রুমে খদ্দের সামলাতে ব্যস্ত। হঠাৎ পল্লবকে দেখে মাসী হেসে বলে,
" কী হে পল্লব বাবু হঠাৎ! তা নতুন কোনো পাখি আছে নাকি?"
" আছে আছে মাসী। তবে দু'দিন পর নিয়ে আসবো। তার আগে শোনো!"
" হ্যাঁ বল।"
" মিষ্টিকে তো রেখেই গেলাম কিন্তু মিষ্টি মুখ তো আর করলাম না।"
পল্লবের কথায় হাসলো মাসি। সোফা থেকে পা নামিয়ে মেঝেতে রেখে বললো,
" তা এখন খেতে চাস?"
" হ্যাঁ মাসী। আজকের রাতের জন্য রুমে নিতে চাই। আরো পোলাপান আছে। একসাথে একটু মজা নিতাম। "

পল্লবের কথায় কিছুটা ভাবুক হয়ে গেছে রীনা। যদিও টাকাপয়সা ওয়ালা খদ্দেররা অনেক সময় মেয়েদের বাসায় নিয়ে গিয়েও ফুর্তি করে। তবে পল্লব আগে কখনো এমন প্রস্তাব দেয়নি। কিন্তু পল্লব যেহেতু এখানে অনেক মেয়েদের এনে দিয়েছে তাই মাসী ওকে কখনো সন্দেহের কাতারে ফেলবে না। 
" ঠিক আছে নিয়ে যাবি। কিন্তু এখন তো খেলায় ব্যস্ত মিষ্টি। খদ্দের সামলাচ্ছে।"
" কতক্ষণ লাগবে?"
" সেটা আমার থেকে তোর ভালো জানার কথা রে।"

মাসী নোংরা ইশারা করে হাসতে লাগলো। পল্লব হেসে বললো, 
" তাহলে আর কী অপেক্ষা করি। "
" হ্যাঁ বস।"

ঠিক পনেরো মিনিট পরে একজন বয়স্ক লোক বেরিয়ে এলেন মিষ্টির ঘর থেকে। পল্লব এক মুহুর্তের জন্য ভাবনায় পড়লো, এই বয়সে এসেও এই ধরণের পুরুষ মানুষের কচি মেয়ের সাথে শুতে ইচ্ছে করে! ভাবনায় রাশ টেনে রীনাকে বলে ও,

" আমি যাচ্ছি তাহলে, মিষ্টিকে নিয়ে আসি।"

" হ্যাঁ যা। শোন ক্লান্ত হওয়ার ঢং করলে একটু কড়া ডোজ দিবি। দেখবি চাঙা হয়ে গেছে। "

মাসীর হাসি হাসি মুখখানা দেখে পল্লব মিষ্টির ঘরের দিকে এগোলো। দরজা খুলতেই দেখলো বিছানায় অর্ধনগ্ন হয়ে পড়ে আছে মিষ্টি। কাজলকালো চোখ থেকে টুপটাপ জল চুইয়ে পড়ছে বিছানার চাদরে। 

" মিষ্টি! ওঠ আমার সাথে বাইরে যাবি।"

আচমকা পল্লবের গলা শুনে চমকাল মিষ্টি। ওকে দেখতেই উঠে বসলো মিষ্টি। পাশ থেকে ওড়না টেনে গায়ে জড়িয়ে নিলো। স্মৃতিপটে ভেসে উঠছে এই মানুষটা ওকে কীভাবে ঠকিয়ে এই রাস্তায় এনে ফেললো! মিষ্টি ঘৃণায় থুথু নিক্ষেপ করলো পল্লবের মুখে। তাতে পল্লব কিছুটা রেগে গেলো অবশ্য। চুলের মুঠো ধরে দাঁড় করিয়ে মিষ্টিকে দ্রুত তৈরি হতে বলে পল্লব। অসহায় মিষ্টি কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে তৈরি হয়ে নেয়। মাত্র ক্লান্ত শরীর নিয়ে বিশ্রাম নিবে ভাবছিল কিন্তু না বিশ্রাম নেওয়া এখন সম্ভব না। পল্লবের সাথে গুটিগুটি পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে বসার ঘরে এলো মিষ্টি। মাসী হেসে বলে, 

" সকাল সকাল দিয়ে যাস কিন্তু। ওর জন্য কিন্তু অলরেডি দু'জন অপেক্ষা করছে। কালকে তিনটা কাস্টমারকে সামলাতে হবে। "

মাসির কথায় বুকটা হুহু করে উঠে মিষ্টির। একদিনে এতকিছু আর সইবে না শরীরে। এরচেয়ে মৃত্যু হাজার গুণে ভালো। আজ কেনো জানি মেহেকের কথা খুব মনে পড়ছে মিষ্টির। মেহেককে যখন ডাকাতরা নিয়ে গেলো তখন একবারও ভাবেনি কেউ যে ওকেও ডাকাতরা অসম্মান করবে। একেবারে নিশ্চিন্তে বসে ছিলো আনজুম বেগম ও মিষ্টি। আজ বুঝি সৃষ্টিকর্তা সেসব ফিরিয়ে দিলেন।

" ঠিক আছে মাসী। গেলাম আমরা।"

রীনাকে বোকা বানিয়ে মিষ্টিকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো পল্লব। কিছুদূর আসতেই কাছাকাছি মেহেককে দেখে পিলে চমকে উঠে মিষ্টির। কোনো কিছু না ভেবে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বড়ো বোনকে। 
":আপা! আপা আমাকে মাফ কর....তুই...."

মিষ্টি কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকে। তবে রোশনের ইশারায় মেহেক শান্ত করে ওকে। জায়গাটা সুবিধার না। 
" এসব পরে হবে মিষ্টি। আগে এখান থেকে চল।"
" হ্যাঁ সুন্দরী। চলো আগে তারপর কথা!"

রোশন মেহেকের সাথে কথা বলা শেষে পল্লবের দিকে এগিয়ে বলে,
" তুই গ্রামে ঢুকলে প্রাণে মারা যাবি বলে দিলাম। "

পল্লব কিছু বলে না। চুপচাপ হাতজোড় করে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গি করে অন্য দিকে দ্রুত পা চালিয়ে চলে যায়। কিন্তু মেহেকের চোখে প্রতিশোধের আগুন জ্বলছে। 



চলবে............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন