অর্ধখণ্ডিত জ্বলজ্বলন্ত চাঁদটি সুদূর আসমানে বসেছে। চাঁদের চারিপাশ জুড়ে ছোটোবড়ো অজস্র নক্ষত্র। আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ। মৃদু ঠান্ডা হাওয়ার এসে আরামকরেই গা-টা ছুঁয়ে যাচ্ছে। মাত্রই গোসল সেরে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে তন্ময়। এতদূরের রাস্তা পেরিয়ে বাসায় ফিরে সর্বপ্রথম গোসল নেয়াটা বাধ্যতামূলকই বটে। এভাবেও নিজের বাড়িটাই তার কাছে স্বস্তির, শান্তির জায়গা। দু'দিন ধরে হোটেলে থেকে বিষাক্ততায় জর্জরিত তার অন্তর। ব্যবসায়ীক কাজকর্মে বেরোলে ঠিকঠাক খাওয়াদাওয়াটুকুও হয় না। তার ওপর আবার এবারে বন্ধুবান্ধবদের একের পর এক কল-ম্যাসেজেস তো আছেই। নিজেরা মিলে ট্যুর প্ল্যানিং কর; তা না করে তাকে বারংবার বিরক্ত করে যাচ্ছে সমানতালে। ওদের একটাই আবদার অরুকে সঙ্গে নিতে হবে। অরুকে না নিলে নাকি এত বছরের বন্ধুত্বের ইতি ঘটাবে! আরেহ্, ভারি আশ্চর্যজনক তো! ওদের বন্ধু সে নাকি অরু? তন্ময় ওদের কাণ্ডকারখানা দেখে বিস্মিত না হয়ে পারছে না। এতো পৈশাচিক উত্তেজনা– আগ্রহবোধ ঠিক কই থেকে আসছে ওদের, সে জানে না। ওদের এত ব্যাকুলতা-আকুলতা তার ঠিকঠাক হজম হচ্ছে না। কোথাও কিছু একটা ঝোল ওরা পাকাচ্ছে, এই বিষয়ে শতভাগ নিশ্চিত সে। বন্ধুদের ক্ষেত্রে তার সিক্সথ সেন্স কখনো ভুল হয়নি। আর এদিকে আরেক মাথা যন্ত্রণাদায়ক ব্যাপারস্যাপার হচ্ছে অরু। ব্যবসায়ীক ট্যুরে গিয়ে ভীষণ ব্যস্ত ছিল সে। অরুকে সময় দিতে পারেনি। ভালোভাবে ফোনে কথাবার্তাটুকুও হয়নি। চোখমুখ বন্ধ করে তিনদিনের কাজ দু'দিনে করে ফিরেছে বলেই এই দুর্গতি তার। তবে কী লাভ হলো? যার জন্য সে করল চুরি– সেই অভিমানী নারীই বলছে সে চোর। এতো তাড়াহুড়োয়, এতটা ডেস্পারেটলি সে কার জন্য বাড়ি ফিরেছে? সেটা বুঝলে কী আর অভিমান ধরে পালাই-পালাই করে? এইযে সে বাসায় এসেও পরিপূর্ণ নজরে দেখতে পেলো না মহারাণী ভিক্টোরিয়াকে। অভিমান করে তার সামনেই আসছে না। এমন করলে কী করে হয়? এইযে সে নিশাচর প্রাণীর মত ছটফট করে ম র ছে। অরু কী তা বুঝে? আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, আজকাল তার রাতে ভালো ঘুম হয় না। ঘুমের পেছনে খরচ করা ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা বিফলতায় নাম লেখালে, সে আলগোছে মাঝরাতেই ল্যাপটপের সম্মুখে বসে পড়ে কাজ করতে। মাইন্ড ডাইভার্ট করার সামান্য চেষ্টা। তবে আজ কাজেও মন বসাতে পারছে না। তার দ্বারা হচ্ছেই না। তীব্রতর শূন্যতায় বক্ষঃস্থল জুড়ে বিদ্রোহ চলছে। গভীর রাতের প্রহর জানান দিচ্ছে–কিছু একটা তার কাছে নেই, যা থাকবার কথা ছিল। কী নেই? কী থাকার কথা ছিল? এই প্রশ্ন দুটোর জবাব সে জানে। জানে বলেই কুণ্ঠিত। অরুটার ক্ষেত্রে বড্ড ভীত সে। সাহসী সে বরাবরই তুচ্ছাতিতুচ্ছ ওর সামনে। যেকোনো পদক্ষেপ নেয়ার পূর্বেই দু'বার তাকে ভাবতে হয়। সহস্র বার নিজেকে সংবরণ করতে হয়। তবে আজকাল আর নিজেকে সামাল দিতে ইচ্ছে হয় না। বারংবার ভেবে সিদ্ধান্ত নেয়া ধৈর্যতে কুলোয় না। ভেতরের পৈশাচিক আত্মাটা তার নিশাচরী হৃদয়কে বিদ্রূপ স্বরে বলে ওঠে এসময়,
‘এত-এত অপেক্ষা কেন তবে? কীসের জন্যে? ভেঙে ফেলো ধৈর্য। যা তুমি চাও তা তো কাছেই। ঠিক তোমার পাশেই। তোমার অপেক্ষায়। যাও ছিনিয়ে নাও– আদায় করে নাও। শিলমোহর দেয়া ওই নারী তো তোমারই।’
তন্ময় বারান্দা ছেড়ে বেডরুমে প্রবেশ করে। এসি বন্ধ। সিলিং ফ্যান চলছে। বাতাসে দুলছে সাদা পর্দাগুলো। ইজিচেয়ারে বসল হেলান দিয়ে। একটা সিগারেট ধরাল। সিগারেট সে একান্তভাবে খুব একটা খায় না। হঠাৎ করে বন্ধুবান্ধবদের পাল্লাতে পড়েই খায়। তবে আজকাল একাই দু-একটা খাচ্ছে অতিষ্ঠ হয়ে। চোখদুটো বুজে ইজিচেয়ার হেলান দিলো। অদেখা কী হিসেবনিকেশ কষছে মস্তিষ্ক তাও সে বুঝতে পারল না। সব শূন্য! চোখদুটো খুলে দেখল সামনেই ল্যাপটপ। গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ স্ক্রিনে। সেটি পড়ার ক্ষুদ্র চেষ্টা করল এযাত্রায়। তবে বিফলে গেল চেষ্টা। কনসেন্ট্রেশন নেই। মিনিটখানেটের মধ্যেই চোয়াল শক্ত করে, হঠাৎ করেই সজোরে ল্যাপটপ বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল। অধৈর্য দৃষ্টি দেয়াল ঘড়িতে ফেলল। তিনটা নয়। তন্ময় ভাবে আর ভাবে তবে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারছে না। সে যদি আজ, এক্ষণ– এইমুহূর্তে পা বাড়ায়; অরুটা এরপর থেকে আস্কারা পেয়ে মাথায় চড়ে বসবে। বানরের মতন চুল টেনে মাথায় বসে ফুটবল খেলবে। নিজেকে আর দমিয়ে রাখবে না ও। তাকে পাগল করেই দম ফেলবে। জেনেও তন্ময় নিজ থেকেই পাগল হতে ইচ্ছুক। মনপ্রাণ চাচ্ছে স্বেচ্ছায় পাগল হতে। মনস্থির হতেই তার মুষ্টিবদ্ধ হাত দুটো শান্ত হয়। ভারিক্কি পদক্ষেপ সহিত এগোয় দরজার দিক। দরজাটা খোলাই ছিল। সে বেরিয়ে আসে। দরজাটা পুনরায় ভালোভাবে লাগিয়ে দেয়। অরুর রুমের দরজা সবসময় খোলা থাকে। আজও খোলা। তন্ময় ইতস্তত করে একপলক। পরমুহূর্তেই দরজাটা খুলে ভেতরে পা বাড়ায়। ভেতরে ঢুকে দরজাটা বিনাশব্দে লক করে দেয়। রুমটা প্রচণ্ড শীতল এবং বড্ড আঁধারে। এই মেয়ের বদ-অভ্যাস এসির টেম্প্রেচার কমিয়ে রাখা। ওকে সে বারংবার করে বলেছে ষোলো এর নিচে যেতে না। কে শোনে কার কথা! তন্ময় বাতি জ্বালাল অনুমান ধরে। অরু বিছানায় আমোদে ঘুমুচ্ছে। একটা সাদা কম্বল গায়ে টানা বুক পর্যন্ত। পশ্চিমে মাথা উত্তরদিকে ওর পাজোড়া। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে বার্ড নেস্টের মতন। মুখটা সামান্য হা করে রেখেছে। খুব সুন্দর স্বপ্ন দেখছে হয়তোবা। মিটিমিটি হাসছে একটু পরপর। এই দৃশ্যে তন্ময়ের সুগভীর চোখদুটো হেসে ওঠে। পাল্লা দিয়ে ঠোঁটের দীর্ঘতা প্রসারিত হয়। সে ধীর পায়ে এগোয় বিছানার দিক। হঠাৎ করেই চোখে পড়ে অরুর পিঠের নিচের টি-শার্টটায়। কালো রঙের একটা টি-শার্ট। টি-শার্টটা অবশ্যই তার। কখন এনেছে কে জানে! তাকে এতই মিস করলে এমন আরামদায়ক ঘুম কীভাবে দিচ্ছে, হ্যাঁ? নাক টেনে, মুখ খুলে হেসে হেসে দিবাস্বপ্ন দেখা হচ্ছে! অপদার্থ! তন্ময় বসল ওর মাথার কাছটায়। মাথার বালিশটা দক্ষিণে পড়ে আছে। প্রায়শই শাবিহা-রুবি বলতো অরুর ঘুমের নাজুক অবস্থা। ওর পাশে ঘুমানো অসম্ভব। আজ সে নিজ চোখেই দেখল মেয়েটার ঘুমের দুর্গতি কোন ল্যাভেলে পৌঁছেছে। একা যতদিন আছে ঘুমোক শান্তিমত। তন্ময়ের সাথে ঘুমোলে ওর ঘুমের ব্যালেন্স ঠিক করিয়ে ছাড়বে। সারারাত বুকের মধ্যে চেপে রাখবে। এমন ছোটাছুটি কীভাবে করবে, তাই দেখবে! এবেলায় হাত বাড়িয়ে ওর ফুলোফুলো গালটা ছুঁলো। ক্ষুদ্র শক্তি প্রয়োগ করে গাল টেনে ধরল। অরু ঘুমের ঘোরেতেই গোঙাল। কপালে বেশ কয়েকটি ভাঁজ পড়ল। মাথাটা ঘুরিয়ে অন্যপাশ ফিরে গেল। তন্ময় হেসে তক্ষণ ঝুঁকল ওর দিক। ওর কানের কাছের চুলগুলো সরাল নরম হাতে। কানের লতিতে ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো। ডাকল মৃদু স্বরে,
‘অরু!’
তার ডাকের জবাব আসে না। নিস্তব্ধতা তখনো বিরাজমান। তন্ময় পুরুষালি স্বরে ধ্বনি তুলে হাসে। গভীর নিদ্রায় মনোনিবেশ প্রেয়সীর গালে আঙুল বোলাতে-বোলাতে একমনেই বলে,
‘তুই না উঠলেই বরং আমার জন্য মঙ্গল। বেঁচে যাব।’
একথা বলেই মুখটা নামিয়ে চটপট কিছু চুমু বসায় অরুর ঘুমন্ত স্নিগ্ধ মুখশ্রী জুড়ে। অরুর চোখের পাপড়িযুগল কাঁপে সামান্য। পরপর চমকে কাঁচা ঘুম ভাঙা চোখদুটো মেলে তাকায়। কয়েকবার সরলভাবে পলক ফেলে। চোখদুটো আলো সইতে খানিকক্ষণ সময় নেয়। তন্ময়ের হাসি হাসি মুখটা স্পষ্ট হতেই অরুর চেহারার রঙ দৃশ্যমান ভঙ্গিতে পাল্টে যায়। কেমন ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে। অবিশ্বাস্য চোখদুটো পলক ফেলতেও দ্বিধান্বিত যেন। তন্ময় ভ্রু তুলে শুধায়,
‘তোর সুইট ঘুমের ডিস্টার্ব করলাম, হুঁ?'
ওর নিভু-নিভু চোখ দুটো উৎসুক হয়ে চেয়ে আছে। আকুলতা —অধীর ব্যাকুলতা স্পষ্টত ওই দৃষ্টিতে। ওর ওই ব্যাকুল দৃষ্টি যেন তার নামে লেখা সর্বনাশী ভাতা। আশ্চর্য, তন্ময়ের শক্তপোক্ত হৃদয়টা ধকধক করল কেন? অরু এক ঝটকায় ওঠে বসে যখন বুঝতে পারে সামনের ব্যক্তি স্বয়ং তার তন্ময় ভাই, ভ্রম নয়। পরপরই একলাফে দু'হাত বাড়িয়ে তন্ময়ের গলা জড়িয়ে ধরে। তন্ময় কিছুটা সময়ের জন্য হতবাক হলেও, পরমুহূর্তেই দু'হাতে অরুকে জড়িয়ে নেয় বক্ষে। ডান হাতটা নিজের মতন অরুর মাথার পেছনটা বোলাতে থাকে আদুরে ভঙ্গিতে। শান্তিতে চোখ বুজে আসে তার। সবরকম শূন্যতা, ব্যাকুলতা উড়ে কই যেন পালিয়েছে। অরুর মিনমিনে কণ্ঠে অভিমান স্পষ্ট,
‘ফিরে আমাকে একটিবার খোঁজেননি।’
তন্ময়ের কণ্ঠ রাতের আঁধারের চেয়েও গভীর, নিভু– ‘খুঁজেছি।’
‘মিথ্যে। আপনি আমার থেকে দূরে গেলেই বাঁচেন। আমি সব বুঝি।’
তন্ময় ওর অভিমানের সম্মুখে অসহায়, ‘উঁহু, তুই কিছুই বুঝিস না।’
অরু একপ্রকার তন্ময়ের কোলে বসে। মাথাটা তন্ময়ের ঘাড়ে। এযাত্রায় মাথা সরিয়ে এনে মুখোমুখি হলো তন্ময়ের। ফোলাফোলা লালচে চোখদুটোতে যেন পৃথিবীর সব মায়া বিরাজ করছে। তন্ময় ডানে হাতের আঙুল দিয়ে অরুর চোখদুটো ছুঁয়ে দেয়। অরু অভিমানী গলায় প্রশ্ন করে,
‘তাহলে বলুন, আমাকে মিস করেছেন?’
তন্ময় মৃদু স্বর খাদে নামিয়ে নির্নিমেষ চেয়ে বলে ওঠে, ‘মুখে বলব নাকি করে দেখাব?’
অরু অবুঝের মতন চেয়েছিল। আগামাথা বোঝবার পুর্বেই এক অনাকাঙ্ক্ষিত কাণ্ড ঘটে গেল। নিজেকে আবিষ্কার করল বিছানায়। ধাক্কাটা সামলে ওঠার আগেই, পরপর যা ঘটেছে তা দেখার মত সাহস তার চোখদুটোর হলো না। শক্ত করে বুজে নিয়েছে আপন গতিতে। হাতদুটো তন্ময়ের গলা ছেড়ে কাঁধের শার্ট মুষ্টিবদ্ধ করে চেপে রেখেছে। থরথর করে কাঁপছে সর্বাঙ্গ। তার ওষ্ঠদ্বয়ে নিঠুরভাবে আক্রমণকারী ঠোঁটজোড়া অধৈর্য, অবিন্যস্ত– ব্যাকুল। নিবিড়ভাবে ছুঁয়েই খ্যান্ত নয়। হুটহাট কামড় বসিয়ে দিচ্ছে। কামড়ে দিয়ে পরপরই গভীর চুম্বনের স্পর্শে ব্যথাটুকুর নিবারণ করছে; তার মস্তিষ্ককে শূন্যে নিয়ে যাচ্ছে।
তন্ময়ের সুঠোম, বেখেয়ালি হাত দুটো স্থির নেই। চঞ্চল হাত দুটো অরুর পেটের দিকটা অশালীন ভাবে ছুঁয়ে যাচ্ছে। নরম তুলতুলে পেটে তার থাবা যেন হিংস্র বাঘের ন্যায়। অরু সেই স্পর্শ থেকে পালাতে উদ্যত। মুছড়ে ওঠে পালাতে চাওয়া ছোট্টখাট্টো দেহে খানা তন্ময় নিজের মধ্যে জাপ্টে নিলো। নিষ্ঠুরভাবে পালানোর সব সুযোগ বন্ধ করে দিলো। এক দীর্ঘ চুমুর সমাপ্তি ঘটিয়ে ঘনঘন শ্বাস ফেলছে এখন। অরুর বুকের ওঠানামার গতি দ্রুত। চোখদুটো খিঁচে বন্ধ করে রেখেছে এখনো। চুম্বিত লালিত ভেজা ঠোঁটে দৃষ্টি পড়তেই ফের চটপট চুমু খেলো তন্ময়। গভীর কণ্ঠ খানা নেশাক্ত শোনাল,
‘কতটা মিস করেছি বোঝা গেল?'
অরুর চোখদুটো আরও কুঁচকে গেল। কাঁপল ঠোঁটজোড়া। তন্ময় হাসে। লালচে ঠোঁটজোড়াতে বুড়ো আঙুল ছুঁইয়ে বলে,
'কথা যখন বলবি না তবে থাকার কী দরকার? চলে যাচ্ছি।'
তন্ময় ভাণ ধরে ওঠার। ম রার মতন পড়ে থাকা অরু মুহূর্তেই হকচকিয়ে ওঠে। দু'হাতে পুনরায় জড়িয়ে ধরে তন্ময়ের গলা। নিজের দিক টেনে এনে বুকে মুখ লুকোয়। লজ্জায় কুণ্ঠিত কণ্ঠে আওড়ায়,
‘যাবেন না। গেলে আর কখনো কথা বলব না।’
তন্ময় তাজ্জব হবার ভণিতা ধরে শুধায়, ‘পারবি তুই?’
অরু নিরুত্তর। শুধু তার হাতে বাঁধন দৃঢ় হলো। মুখটা গভীরভাবে বুকে ঢোকাল। তন্ময় ওকে বুকে নিয়েই শুয়ে পড়ল। ক'দিনের নির্ঘুম চোখজোড়া যেন ঘুমের সন্ধান খুঁজে পেলো। মিনিটের মধ্যেই গভীর ঘুমে বুঁদ হলো। অরু মাথাটা একফাঁকে উঁচিয়ে তাকাল। ফিসফিস করে ডাকল,
‘তন্ময় ভাই?’
ঘুমিয়েছে মানুষটা। কী ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। মায়ায় অরুর বুকের ভেতরে স্রোত বইছে। সে হাত উঁচিয়ে চুলগুলো টেনে দিলো। এতে যেন তন্ময় আরামবোধ করল। আরও নিবিড়ভাবে জড়িয়ে নিলো অরুর পাতলা কোমর। এতে অরু কেঁপে উঠলেও নড়বার সাহসটুকু করল না।
—————
দরজায় করাঘাতের ধ্বনি। দীপ্তর বাচ্চা বাচ্চা কণ্ঠের স্বর শোনা গেল,
’অরুপি, খেতে ডাকছে বড়োমা। তাড়াতাড়ি এসো।'
আজ শুক্রবার। সবাই বাসায়। তন্ময়ের ঘুম ভেঙেছে দীপ্তর কণ্ঠে। হাত ঘড়িতে সাতটা পনেরো। বাতি জ্বালানো। রাতে নেভানো হয়নি। অরু তাকে জাপ্টে শুয়ে আছে। মাথাটা তার বুকের মধ্যিখানে। কম্বল দুজনের গায়ের ওপর। এই দৃশ্য যেন তার স্বপ্নের একাংশ। কী সুন্দর ভাবে বাস্তবে রূপান্তরিত হলো। তন্ময় নির্নিমেষ দেখল অরুর ঘুমন্ত মুখটা। বাচ্চাদের মত ঘুমোয়। অবশ্য ও তো বাচ্চাই। হাত উঠিয়ে চুলগুলো ঠিক করে দিতে নিতেই শুনল দীপ্তর কণ্ঠ। তার ঘরের দরজায় করাঘাত করে ডাকছে তাকে। এবার বেরোনা দরকার। তার পিতা শাহজাহান মোস্তফা দেখে নিলে সর্বনাশ। মুখের ওপর অপমান করবে। এভাবেই কটাক্ষ করে বেড়ায়, চাচাতো বোনের ওপর কুনজর দেয়ার জন্যে। তন্ময় আলগোছে অরুকে নিজের বুক থেকে বালিশে শোয়াল। বিছানা থেকে নেমে এলো। ঝুঁকে ওর গায়ে কম্বলটা মেলে দিলো। কপালে চুমু খেয়ে নিলো ঝটপট। বাতি নিভিয়ে খুব ধীরেসুস্থে দরজা খুলল। একপলকেই নিজের রুমে চলে এলো চোরের মতন। বাহ্, বাহ্ কী অসাধারণ উন্নতি! দিনশেষের নিজ বাসায় চোরের মতন যাতায়াত করতে হচ্ছে!
বারান্দায় দাঁড়ানো তন্ময় একটা ইম্পরট্যান্ট কলে ছিল। বেডরুম থেকে চাপা গুঞ্জন শুনতে পেলো। কলে কথা শেষ করে ফিরতেই দেখল অরু এসছে। হাসি-হাসি মুখ। সাদা একটা কামিজ পরনে। সুন্দর করে কাজল পরেছে। সাতসকালে মিষ্টি লাগছে দেখতে। মুহূর্তেই তার পা দুটো– তার নামে বি দ্রোহ ঘোষণা দিলো। লিখিয়েছে বিপক্ষীয় দলে নাম। পা'জোড়া অরুর দিক মনের সুখে এগুচ্ছে একচিত্তে। অরুর কাছাকাছি এসে হাতটা ধরবে; কিছু বলবে তখনই হুড়মুড়িয়ে প্রবেশ করল শাবিহা, রুবি আর দীপ্ত মহাশয়। তিনজনের হাতেই শরবতের গ্লাস। তন্ময় এযাত্রায় খেয়াল করল অরুর ডান হাতেও শরবতের গ্লাস।
নিশ্চয়ই কোনো মতলব পাকিয়ে এসেছে তিনজন! তবে কী মতিগতি নিয়ে এসছে বুঝতে পারছে না সে। অরুর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে– চেয়ারে বসতে নিয়েই সন্দেহজনিত গলায় প্রশ্ন করে বসল,
‘ব্যাপার কী তোদের? কী পঁয়তারা করে এসছিস!’
অরুই অসন্তুষ্ট হয়ে গেল। চোখমুখ ছোটো ছোটো হয়ে এলো ওর। কপালে ভাঁজ ফেলে বিরক্ত কণ্ঠে জবাবে বলল,
‘কীসের পঁয়তারা? আপনার হালচাল জিজ্ঞেস করতে আসতে পারি না? আজকাল দেখি মানুষের ভালো চাইতে নেই।’
তন্ময় ডান ভ্রু তুলে অবাক হওয়ার ভান ধরল, ‘তাই বুঝি? উম, ওকে। জিজ্ঞেস কর। আমি শুনছি।’ তারপর বেশ আগ্রহের সাথে চেয়ে রইল মেরুদণ্ড সোজা করে।
শাবিহা ফিক করে হেসে ফেলল। তার হাসিতে যোগদান করল রুবিও। ওদের হাসির ধ্বনিতে অরুর অসন্তুষ্টি বাড়ল বলে। সবাই মিলেমিশে পঁয়তারা করে এসেছিল তন্ময়কে জব্দ করবে। অথচ এখন তাকে রেখে সবাই তন্ময়ের গাড়িতে চড়ে বসে, তাকেই জব্দ করছে। এইতো বেঈমানি! অরুর মুখটা অমাবস্যায় ডুব দিলো। অভিমানী চোখে সব কয়টায়কে দেখে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল। হাসতে-হাসতে পিছু ডাকল শাবিহা। কে শোনে কার কথা? রুবি হাসতে হাসতে ফট করে বলে ফেলল,
‘ভাইয়া, তোমার বউ তো রেগে চলে গেল।’
তন্ময় গম্ভীরমুখে রুবির দিক চাইতেই রুবি চুপসে গেল। শরবতের গ্লাস হাতেই পালাল। লবনাক্ত শরবত দেবার মত দুঃসাহস তার নেই। রুবির দেখাদেখি দীপ্তও লবণে গুলানো শরবতটি নিয়ে পালাল। শাবিহা ওদের কাণ্ড দেখে হাসল। মায়ের বানানো শরবতের গ্লাসটা এগিয়ে দিলো বড়ো ভাইয়ের দিক। তন্ময় গ্লাসটা নিয়ে ভ্রু তুলে প্রশ্ন করল,
‘কী হয়েছে?’
‘ওরা লবণের শরবতের এনেছে তোমাকে খাওয়াবে বলে। এখন দেবার সাহস নেই তাই পালিয়েছে।’
তন্ময় একটানে শরবতটা শেষ করল। শাবিহা গ্লাসটা নিয়ে বেরোতেই নিচ্ছিল–তন্ময় অপ্রস্তুত গলায় পিছু ডেকে বলল,
‘অরুকে পাঠিয়ে দিস তো।’
শাবিহা মিটিমিটি হেসে বেরিয়ে যায়। তন্ময় উঠে দাঁড়ায়। ল্যাপটপটা বিজনেস ব্যাগ থেকে বের করে ফের চেয়ারে এসে বসে।
.
.
.
চলবে.................................