#আরোরা (ফ্যান্টাসি, রোমান্টিক)
#পর্ব_১৫
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
মায়ের কথায় নিজেকে ভীষণ অপরাধী লাগছে সাঁচির। মা কতটা ভালোবাসেন, বিশ্বাস করেন অথচ সে প্রতিনিয়ত ম্যাকের বিষয় লুকিয়ে যাচ্ছে। অবশ্য কী বা বলবে মা'কে? একজন রক্তচোষা পিশাচের সাথে সম্পর্কে আছে তার মেয়ে? উঁহু! এসব বলা যাবে না। সেদিন রাতে ম্যাক চলে যাওয়ার পরেই ধীরে ধীরে দূর্বল হয়ে পড়ে সাঁচি। আর সকাল হতেই ভীষণ জ্বরে আক্রান্ত হয়। তারপর আর ম্যাক দুই রাতে আসেনি এদিকে। সাঁচির খুব খারাপ লাগে তাতে। লোকটা একবার খোঁজ নিতেও এলোনা !বজ্জাত পিশাচ একটা সে। তার অত্যাচারে যে এতটা অসুস্থ হয়ে গেছে সেটা তো একবার দেখতেও এলোনা।
" সাঁচি? একটু ঘুমানোর চেষ্টা কর মা।"
মায়ের কথায় সাঁচির ভাবনায় ছেদ ঘটলো। ম্যাকের বিষয়টা আপাতত চিন্তাভাবনার বাইরে রেখে মায়ের দিকে মনোযোগ দিলো।
" আচ্ছা মা। তুমিও ঘরে যাও। আমি ঘুমিয়ে যাচ্ছি। "
" তুই ঘুমা তারপর যাবো না হয়।"
সাঁচি মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। মেরিনা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। সাঁচি আবেশে চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করছে।
পূর্ব আকাশে সূর্যোদয় হয়েছে। মেঘমুক্ত সকালের আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে এডওয়ার্ড। নিজের কক্ষের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে। আরোরাকে নিয়ে গভীর ভাবনায় নিমজ্জিত সে। আজ রাতে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটা করতে চলেছে সে। হ্যাঁ বিয়ে করবে আরোরাকে। আরোরা যে আর পাঁচটা সাধারণ নেকড়ের মতো নয় সেটুকু এডওয়ার্ড বুঝতে পারছে। কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে তাদের সম্পর্কের পরিণতি কী হবে সেই নিয়ে মস্তিষ্ক বিক্ষিপ্ত হয়ে গেছে এডওয়ার্ডের। বিয়ে করে নিলেও আরোরা যদি কখনো এডওয়ার্ডকে অস্বীকার করে? কিংবা ছেড়ে দেয়! উফ আর ভাবতে পারছে না এডওয়ার্ড। ভবিষ্যতে কী হবে সেসব ভেবে আর মাথা খারাপ করতে চায় না সে। কিন্তু জীবনের এতো বড়ো একটা মুহুর্তের কথা নিজের পরিবারের কাউকে জানাতে পারবেনা ভাবতেই মনটা আরো খারাপ লাগছে এডওয়ার্ডের। কিছু তো করবার নেই আর। সময় হলে সবাই সবকিছুই জানবে। যেমন আরোরাও সঠিক সময়ে এডওয়ার্ডের পরিচয় জানবে, এখন নয়।
সন্ধ্যা নেমেছে হলিথান শহরের বুকে। পাখিরা ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে নিজেদের গন্তব্যে ফিরছে। বিকেল থেকে বাসা গোছগাছ করতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে এনা। সাথে গুলিনও আছে। গুলিন ওদের শুভাকাঙ্ক্ষী। তাছাড়া সবকিছু একা সামলানো এনার পক্ষে সম্ভব না। সবমিলিয়ে একজনকে সাহায্যের জন্য দরকার ছিল। এখন সবকিছুই গোছানো হয়ে গেছে অবশ্য। ছিমছাম সুন্দর করে পুরো ঘরটা সাজিয়েছে দু'জন। সাদা গোলাপ দিয়ে সাজিয়েছে সাঁচির কক্ষ। আরোরার সবকিছু কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে আজ। সত্যি এডওয়ার্ড ওকে নিজের করে নিচ্ছে? কিন্তু এডওয়ার্ডের পরিবারের কেউ কেনো আসছে না! না-কি এডওয়ার্ড পৃথিবীতে একা? প্রশ্নগুলো করার সময় এখন আর নেই। বিয়ের কিছুক্ষণ আগে এসব জানতে চাওয়া বোকামি ছাড়া আরকিছুই নয়।
" আরো হলো তোর?"
এনার ডাকে নড়েচড়ে উঠলো আরোরা। সাদা রঙের সুন্দর একটা গাউন পরেছে আরোরা। মাথায় একটা ফুলের ব্যান্ড, চুলগুলো খোলা,চোখে গাঢ় কাজল। গোলাপি ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা লেপ্টে আছে ওর।
" হ্যাঁ আপা হয়েছে। "
এনা বোনের কক্ষে প্রবেশ করে ছলছল নয়নে দাঁড়িয়ে আছে। ইশ কী সুন্দর লাগছে তার ছোট্ট বোনটাকে!
" সুখে থাকিস বোন।"
আরোরা বসা থেকে উঠে এনাকে জড়িয়ে ধরে।
" কোথায় গিয়ে থাকবো আপা তুমি কি জানো? এডওয়ার্ডের সাথে কথা হয়েছে? "
" হ্যাঁ হয়েছে। আপাতত এখানেই থাকবি তুই দু'দিন। তারপর ওদের বাড়ি সবকিছু বলেকয়ে তোকেও নিয়ে যাবে।"
আরোরা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে এনার দিকে তাকিয়ে আছে। কী জানি এই সময় এই কথাগুলো কেনো মনে আসছে ওর।
" আচ্ছা। "
" এসব নিয়ে তুই এখন আর ভাবিস না আরো।"
" হুম আপা। "
এনা নিজেও আরোরার পরিবর্তনের বিষয় জানে না। এডওয়ার্ড নিজেই আরোরাকে বলতে নিষেধ করেছিল।
" এনা আপা? এডওয়ার্ড এসেছে! "
গুলিনের শোরগোলে দুই বোনই হেসে উঠলো!
" কিং আমাদের ক্ষমা করবেন। আমরা পারিনি তাকে খুঁজে বের করতে। আপনি চাইলে আমাদের শাস্তি দিতে পারেন এরজন্য। "
আলেক্সার মলিন মুখ দেখে মায়া হচ্ছে সেলিনের। নিক বসে আছে পায়ের উপর পা তুলে। আলেক্সার কথাবার্তায় একটুও প্রভাবিত হননি তিনি।
" তোমাদের কোনো দোষ নেই আলেক্সা। আর মাত্র দুই প্রহর পরে এমনিতেই সে আসবে এখানে। তাকে আসতেই হবে নিজের ঠিকানায়। আমরা শত খুঁজেও ওকে পাবো না যতক্ষণ ও নিজে থেকে না আসে। "
নিকের কথায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো আলেক্সা ও সেলিন।
" তাহলে আর মাত্র কিছুক্ষণের অপেক্ষা! "
সেলিন উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে উঠলো। আলেক্সার মাথা নেড়ে ইশারা করলো হেসে।
" হ্যাঁ সেলিন। তোমরা এখন নিজেদের কক্ষে যাও। আর বাইরে বাইরে ঘুরতে হবে না। "
" ঠিক আছে। ”
রাজার কথায় ওরা দু'জন নিজেদের কক্ষের দিকে এগোলো। বহুদিন পর নিজেদের ঘরে যাচ্ছে। ডেবিটের সাথে কতো দিন পর দেখা হবে ভাবতেই আলেক্সার ভীষণ ভালো লাগছে।
ঘড়িতে সময় রাত এগারোটা। নিজের স্বামী গ্যালির হাতে মারধর খেয়ে ক্লান্ত শরীরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে লিজা। ত্রিশ বছর বয়সী লিজা ভালোবেসে গ্যালির সাথে ঘর বেঁধেছিল বছর পাঁচেক আগে। প্রথম প্রথম ভালোবাসার ঘাটতি ছিলো না দুজনের মধ্যে, কিন্তু সময় গড়াতেই কেমন জানি পানসে হয়ে গেছে সব। গ্যালির কাছে লিজাকে আর ভালো লাগে না। সেজন্য সামান্য সামান্য বিষয় নিয়েও ঝামেলা করে লিজার গায়ে হাত তোলে সে। বেচারি লিজা নিজের বাবা-মায়ের সাথেও কিছু বলতে পারে না। আজকে সবকিছু সহ্যের বাইরে চলে যাওয়ায় এই রাতেই বাসা থেকে বেরিয়ে এসেছে মেয়েটা। কিন্তু রাস্তায় নামতেই ভয়েরা এসে জেঁকে বসেছে। দূরে দূরে নেকড়ে আর কুকুরের ডাক ভেসে আসছে। কখন জানি প্রাণ নিতে চলে আসে জন্তুগুলো। লিজা আশেপাশে নজর বুলিয়ে আবছা অন্ধকারে হাঁটছে। আচমকা কালো রঙের একটা বাদুড় উড়ে আসাতে লাফিয়ে উঠে সে। কিছু বোঝার আগেই বাদুড়টা মানব রূপে এসে লিজার ঘাড়ে সুচালো দাঁত বসিয়ে দিলো। ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠলো মেয়েটা। দু-চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে ওর। এটাই ছিলো ওর জীবনের সমাপ্তি? ভালোবাসার মানুষের সাথে ঘর থেকে পালিয়ে এসে সংসার বাঁধার প্রতিদান? লিজার মনে থাকা সব প্রশ্ন আস্তে আস্তে উবে যাচ্ছে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। সবকিছু অন্ধকার! অন্ধকার...............
লণ্ঠনের আলোতে আরোরার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে এডওয়ার্ড। সাদা গোলাপে সজ্জিত বিছানায় মুখোমুখি বসে আছে দু'জন। কক্ষে আজ একাধিক লন্ডন জ্বলছে। চারদিকে শুভ্রতার ছড়াছড়ি। আরোরা লজ্জায় মাথা নুইয়ে আছে মেয়েটা।
" আরোরা?"
" জি।"
" বউ বলে ডাকি? না-কি অর্ধাঙ্গিনী? "
" তোমার যা ইচ্ছে। আমিই তো তোমার, যে নামেই ডাকো সাড়া দিবো।"
এডওয়ার্ডর ঠোঁটের কোণে দুষ্ট হাসির ঝিলিক।
" বেশ বউ।"
এডওয়ার্ড আলতো করে আরোরার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। অনুভূতির দোলা লাগছে তার হৃদয়ে। তবে এতো প্রাপ্তির মাঝেও মনটা কেমন খচখচ করছে আরোরার। নতুন শক্তি লাভ করায় মাঝে মধ্যে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে সে। যদি এখন হুট করে নিজের স্বরূপে ফিরে আসে তখন? এডওয়ার্ড তো ভয় পাবে! আরোরার নীরবতার কারণে এডওয়ার্ড আদর করা থামিয়ে দিলো। আরোরা বিষয়টা খেয়াল করে বললো,
" কী হলো?"
" তোমার কী হয়েছে? তোমার শরীর আমার কাছে কিন্তু মন তো অন্য কোথাও। তাহলে সেই শরীর দিয়ে কী করবো আমি? একটু জড়িয়ে পর্যন্ত ধরছো না। এমন হটসট বরকে আদর না করে কীভাবে দূরে বসে আছো?"
এডওয়ার্ডের মুখে এই অদ্ভুত শব্দ শুনে হাসলো মেয়েটা।
" হটসট মানে? কোথায় শুনলে এসব?"
" ইংরেজি শব্দ ' হট' এর সাথে সট লাগিয়ে নিয়েছি। সেদিন বাইরের শহরে গিয়েছিলাম তখনই শব্দটা রপ্ত করলাম। এর অর্থ কামুক,আকর্ষণীয় এরকম কিছু। "
" নির্লজ্জ তো তুমি! "
" তা একটু। এখন থেকে বুঝবে সেটা। বিয়ের আগে নেহাৎ ভদ্রলোক হয়ে ছিলাম।"
আরোরা বড়ো বড়ো চোখ করে এডওয়ার্ডের দিকে তাকিয়ে আছে। লোকটা কী বলছে?
চলবে..................................