শাহজাহান তন্ময় - পর্ব ৫৩ - নাবিলা ইষ্ক - ধারাবাহিক গল্প


অরু এসছে গুণে-গুণে তিন মিনিট পর। দরজার সম্মুখে দাঁড়িয়ে। হাতে শরবতের গ্লাস। তন্ময় তখনো ল্যাপটপ স্ক্রিনেতেই নজর রেখে। মাথা তুলে তাকায় না। তবে অনুভব করতে পারছে, না চেয়েও। অরু তার চেয়ারটির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সজোরে শরবতের গ্লাসটা টেবিলের ওপর রেখেছে। এতে শরবতের জল উপচে বেরোয় ছিটেফোঁটা হয়ে। তন্ময় এবারে চোখ উঠিয়ে চায়। ভ্রু তুলতেই অরু গমগমে গলায় শুধায়,

‘আপনি কী চোখ গরম করে চাইছেন?'

তন্ময় সাবলীল ভাবেই বলে, ‘তোর কি তাই মনে হচ্ছে?’

অরু জবাব দেয় না। শুধু থমথমে মুখে চেয়ে রয়। তার নয়নযুগল চিৎকার করে জানান দিচ্ছে তারা অভিমানে জর্জরিত। দুটো কারণে তার অভিমান জমেছে। প্রথমত তাকে না বলেই, না জানিয়েই –চলে গিয়েছিল। আর দ্বিতীয়ত তখন তাকে নিয়ে ওভাবে রঙ্গতামাশা করেছে। তন্ময় প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তখনো চেয়ে জবাবের আশায়। জবাব না দিয়ে অরু আশ্চর্যজনক এক কাণ্ড ঘটিয়ে বসে। চট করে তন্ময়ের কোলে বসে পড়ে। দিন-দুপুরে এহেন কাণ্ডে শুধু হতবাক নয় – তন্ময় কিংকর্তব্যবিমূঢ়! অরুর হাত দুটো আমোদে তার গলা জড়িয়ে ধরেছে। রিনরিনে মিনমিনে মেয়েলি কণ্ঠজুড়ে অভিমান,

‘আমাকে সকালে ডাকেননি কেন?’

তন্ময় দরজার দিক তাকায়। দরজাটা পরিপূর্ণ ভাবে খোলা। এই দিন-দুপুর বেলাতে যেকেউ যখনতখন চলে আসবে। এসে তাদের এই অবস্থায় দেখে ফেললে এক বিশ্রী পরিস্থিতি দাঁড়াবে। তা কী আর বুঝবে এই অবুঝ মেয়ে? কাণ্ডজ্ঞানহীন অপদার্থ একটা। সে ত্বরিত স্বরে তাড়া দেবার ভঙ্গিতে বলে,

‘ওঠ আগে। ওখানে বোস। তারপর বলছি।’

অরু যেন শোনেও শোনেনি। তার লাজুক মুখাবয়ব জুড়ে সরলতা। যেন এই দুনিয়ার কিচ্ছুটি সে বোঝে না; শোনে না। তন্ময় পূর্বেই আন্দাজ করে নিয়েছিল –তার গতকালকের আগবাড়ানোর পরিণাম কী হবে, মাশুল কী দাঁড়াবে! তারপরও স্বেচ্ছায় এই মসিবত সে বড়ো আমোদেই কাঁধে এনেছে। অবশ্য মসিবত হলেও উপভোগ তো করছে! তন্ময় ঢোক গিলে অবলীলায়। মুখে এক বললেও তার পুরুষালি বেহায়াপনায় সুউচ্চ হাত দুটো ইতোমধ্যে অরুর পাতলা কোমর খানা জড়িয়ে নিয়েছে। মুখে সে পুনরায় বলে অসহায় গলায়,

‘কেউ চলে আসবে।’

অরু আজ বড়ো নির্ভীক। সে আরেকটু নিবিড়ভাবে বসে। দৃঢ় হাতে জড়িয়ে ধরে। তন্ময়ের চোয়াল শক্ত হয়। চোখদুটো অশান্ত ভঙ্গিতে সেকেন্ডের জন্য বন্ধ হয়। অরুর প্রাণোচ্ছল কণ্ঠে গদগদ ভাব, 

‘দীপ্ত বাবার সঙ্গে বেরিয়েছে। শাবিহা আপু অয়ন ভাইয়ার সাথে প্রেম করছে। রুবি আপু বাগানে। বড়ো মা, চাচি– মা সব্বাই রান্নাঘরে। দুপুরের আয়োজন করছে। বড়ো চাচ্চু গাড়ি পরিষ্কার করাচ্ছে দারোয়ান চাচাকে দিয়ে। আপাতত কেউই আসবে না।’

তন্ময়ের গলাটা শুঁকিয়ে চৌচির। মরুভূমির মতন খাঁখাঁ করছে। অনুভূতির জোয়ারে ভেতরটা আন্দোলন করছে। ধকধক করে চলেছে। ইচ্ছে তো করছে অরুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে গভীর চুম্বনে লিপ্ত হতে। তবে সব ইচ্ছেদের কী পূর্ণতা দিতে হয়? বাড়িতে আজ সবাই উপস্থিত। কেউ দেখে ফেললে বড্ড লজ্জাজনক ব্যাপারস্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। অরু এযাত্রায় মুখ বাড়িয়ে চুমু বসাল তন্ময়ের চাপদাড়ির ওপর। তন্ময় চোখ বন্ধ করে ফেলে। সে কেন পারছে না অরুকে জোরপূর্বক সরাতে? কেন ওর বাচ্চামিতে আস্কারা দিয়ে চলেছে? ‘ওয়েক আপ, তন্ময়! ইট'স ডেঞ্জারাস।’ নিজেকে নিজে সাবধান করেও লাভের লাভ কিছু হলো না। তার কণ্ঠে মিনতির আভাস, 

‘নিচে যা। আমি আসছি।’

অরু এযাত্রাতেও নিরুত্তর তার মিনতির নিকট। সে উল্টো নিজের মতন বলে ওঠে,

‘আজকের ওয়েদার অধিদপ্তর কি জানাচ্ছে জানেন?’

তন্ময় নিরুপায়, ‘কী?’
‘আজ প্রেমের বৃষ্টি হবে। বিকেল বেলায়।’

অরু ঠিক কীসের বরশী ফেলছে তন্ময় বুঝে ওঠেনি। অবুঝ জিজ্ঞাসু চোখে চেয়ে শুধায়, 

‘প্রেমের বৃষ্টি?’
‘হুঁ। যেই বৃষ্টিতে আপনি আমায় ঘুরতে নিয়ে যাবেন, ওটাই প্রেমের বৃষ্টি।’

তন্ময় ওর লজিক শুনে আশ্চর্য না হয়ে পারে না। পৃথিবীর সব অদ্ভুত যুক্তি ওর কাছে থাকে। সে অতিষ্ঠ ভঙ্গিতে ভ্রু তুলে,

‘কখন বলেছি ঘুরতে নেব? আমার তো মনে পড়ছে না।’

 অরুকে বেশ নিরীহ দেখাল, ‘আপনি তো জানেন আমি বৃষ্টি কত্ত ভালোবাসি। তাই না?’
‘হুঁ।’
‘আজ ঘুরতে নিয়ে যাবেন না?’

তন্ময় দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বিরক্তির হাবভাবের ভঙ্গিমা ধরে ওকে আগাগোড়া দেখল। চোখ রাঙানো ছুঁতোতে বলল,

‘নেব। ওঠ।’

অরু উঠল না। ঠোঁটে ঠোঁট টিপে রেখেছে। যেন এখনো কিছু বলার আছে। তন্ময় নিবিড়ভাবে ওই গোলাপি ওষ্ঠদ্বয় দেখে আওড়াল,

‘কী বলবি?’

অরুকে ভীষণ লজ্জিত দেখাল। পাপড়িযুগল সমানে পলক ফেলছে। ঠোঁট দুটো নিষ্ঠুরভাবে দাঁতে পিষছে। সময় নিয়ে নিচুস্বরে ফিসফিসানির সুরে কোনোরকমে বলে,

'আ– আমরা কবে থেকে একসাথে থাকব?’

তন্ময়ের কান দুটো ঝাঁঝাঁ করে উঠল। অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ইলেক্ট্রিক শক লাগল যেন। দৃষ্টি প্রখর হলো। গেল, গেল— গেল। তার দেহে থাকা বিন্দুমাত্র হতভাগা ধৈর্য উবে গেল। মুহূর্তেই অরুর কোমরে থাকা তার দুটো হাত দৃঢ়তর হলো। খামচে ধরল সেথায়। চোখের পলকে মুখ বাড়িয়ে অরুর ওষ্ঠদ্বয়ে শক্তপোক্ত কামড় বসাল। দাঁতে দাঁত পিষে শাসানো গলায় বলে উঠল,

'এক্ষণ তুই এখান থেকে রফাদফা না হলে– তোর কপালে দুঃখ আছে।'

অরু আতঙ্কে দু'হাতে মুখ চেপে ধরেছে। নয়নযুগল ততক্ষণাৎ আর্দ্র হয়ে এসেছে ব্যথায়। ভীত সে তক্ষুনি লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। তন্ময়কে দ্রুত গতিতে উঠতে দেখেই এক দৌড় লাগাল। এক দৌড়ে বেরিয়ে গেছে রুম থেকে। তন্ময় উপলব্ধি করল তার শরীর গরম। মনে হচ্ছে, আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। দাউদাউ করে জ্বলছে। সে জানালা বন্ধ করে দিলো। বারান্দার দরজা লাগাল। মূল দরজা লাগিয়ে এসি ছাড়ল। কী সাংঘাতিক পেকেছে এই মেয়ে! তন্ময়কে দমবন্ধ করে না মে রে শান্ত হবে না। ওকে শায়েস্তা না করলেই না! 

সেলফোনটা বাজছে। তন্ময় এগিয়ে হাতে নিতেই দেখে, রিয়ানের কল। রিসিভ করে কানে ধরতেই– রিয়ান বড়ো চমৎকৃত গলায় ডেকে ওঠে,

‘দোস্ত!’

ফোনটা তক্ষুনি কানের কাছ থেকে ছিটকে সরিয়ে আনে তন্ময়। রাগ সংবরণ করে গম্ভীর গলায় শুধায়,

‘কী?’

রিয়ান ওপাশে চিৎকার করে বলে, ‘মামা তো সেই ক্ষ্যাপা! কথাবার্তা আগামু নাকি কাটমু?’

মাহিনের কণ্ঠ ভেসে এলো তখনই, ‘কেটে দে। ওর বউয়ের রাগ আমাগো ওপর ঝেড়ে দেবে।’

কলটা ঝটপট কেটে গেল। তন্ময় ছুঁড়ে মারল ফোনটা বিছানায়। সব ফাজিল তার গলায় ঝুলেছে। টি-শার্ট খুলতে খুলতে সে ওয়াশরুমের দিক হাঁটা ধরল। তার এখন গোসল নেয়াই উত্তম। মাথা ঠাণ্ডা হওয়া প্রয়োজন।

————

ঘরের ভেতর অরু মাস্ক পরে ঘুরছে। এই নিয়ে বাড়ির সকলের অভিযোগ। অভিযোগটি তন্ময়ের ঘরেতেও চলে এসেছে। এনেছে দীপ্ত। সে বিচিত্র ভঙ্গিতেই নাকমুখ কুঁচকে বলে,

‘ভাইয়া, দেখেছ অরুপির কাণ্ড? সে বাসায় মাস্ক পরে ঘুরছে। হাও ফানি!’

দীপ্তর কাছে যা মজার লাগছে; তা তন্ময়ের কাছে মোটেও লাগছে না। এই মেয়ে তার মানইজ্জত ধুলোয় মিশিয়েই ছাড়বে। কেন মাস্ক পরে ঘুরতে হবে? ঘন্টাখানেক ঘরে থাক। ফোলা ভাবটা নাহয় খানিক কমে যেতো। অবশ্য তন্ময়েরও দোষ। কী দরকার ছিলো কামড় দেবার? সে অশান্ত ভাবে উঠে দাঁড়াল। দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। পেছনে দীপ্তও ছোটোছোটো পায়তাকে অনুসরণ করছে। সিঁড়িপথ ধরতেই দেখল অরুর পেছনে রুবি দৌড়াচ্ছে। মাস্ক খুলবে বলে। তন্ময়ের হার্ট ব্লক খায়। সে উচ্চকণ্ঠে ধমকাবে, পূর্বেই যা ঘটার ঘটে গেছে। রুবি মাস্ক খুলে অরুর মুখ নিবিড়ভাবে দেখছে। লিভিংরুমে তখন স্বয়ং তার পিতা শাহ্জাহান মোস্তফা বসে। বড়ো বিনয়ী, উৎসুক এবং চিন্তিত গলায় জিজ্ঞেস করছে,

‘কী হয়েছে, মামণি? কোনো সমস্যা?’

তন্ময়ের ইচ্ছে করছে উদাস গলায় বলতে, 

‘তোমার মামণিকে আমি শাহ্জাহান তন্ময় কামড়ে দিয়েছি। এখন আমার কী করবে করো!’
.
.
.
চলবে..............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন