শাহজাহান তন্ময় - পর্ব ৫৫ - নাবিলা ইষ্ক - ধারাবাহিক গল্প


মাগরিবের আজান পড়েছে। হাওয়ার বেগ কমেছে। ঝমঝমিয়ে নামা বৃষ্টি রূপান্তরিত হয়েছে রিমঝিম বৃষ্টির ধারাতে। এযাত্রায় কাচটা পরিপূর্ণভাবে নামিয়েছে অরু। সহাস্যমুখে উপভোগ করছে মেঘলা রাতের লং ড্রাইভ। অদূরেই মেইনরোডে একজোড়া কপোত-কপোতী দেখা গেল। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে হাতে-হাত রেখে হাঁটছে –হাসছে, দুলছে আর আলাপে মগ্ন। অরু মুগ্ধ হলো। একচিত্তে খানিকক্ষণ দেখল। ড্রাইভিংয়ে ব্যস্ত তন্ময়কেও ডেকে দেখাল। তন্ময় আড়চোখে পূর্বেই দেখেছে। তবুও অরু দেখাতে চাইতেই সে কপোরেট করল। বেশ আগ্রহী চোখেই দেখে মন্তব্য করল,

‘অসময়ের বৃষ্টিতে ভেজা ভালো না।’

অরু চটে গেল মুহূর্তেই। ভেংচি কাটল, ‘আপনি ভিজবেন না ভালো কথা। এরজন্য কী অন্যরাও ভিজবে না? একই রসকষহীন কথা! কেইবা ভেবেচিন্তে ভিজে?’

তন্ময়ের সাবলীল জবাব, ‘আমরা।’
‘আমরা নই। বলুন আপনি। আমি তো ভিজতে চাই। আপনি দেন না ভিজতে।’

তন্ময় ডান ভ্রু তুলল, ‘কী যেন বলেছিলি? লং ড্রাইভিংয়ে নিলেই হবে। একদম বৃষ্টিতে ভিজতে চাইব না।’

অরুর মুখাবয়ব জুড়ে অমাবস্যা নামে। আহত চোখে চায়। বিড়বিড় করে বলে, ‘আমি কি বলেছি ভিজব? আমি শুধু ট্রুথ গুলো বলছিলাম।’
‘বড্ড উপকার হয়েছে আমার।’

অরু গাল ফোলাল। মাথা ঘুরিয়ে পুনরায় বাইরে নজর ফেলল। তবে অভিমান স্থায়ী রইল না। একপর্যায়ে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ছুঁয়ে আবদার ছুঁড়ল,

 ‘চা খাব। বৃষ্টিতে চা খেতে দারুণ লাগে।’

এই আবদারটুকু তন্ময় মানল। সামনেই পেয়ে বসল একটি টং-এর দোকান। আধো খোলা। সেখানেই থামাল গাড়িটা। অরুকে ভেতরে বসতে বলে নিজেই গেল চা আনতে। ওয়ান টাইম কাপগুলোতে দু'কাপ চা নিয়ে ফিরল। গাড়িতে ঢুকতে-ঢুকতে ভালোরকমের ভিজল। মাথার চুলগুলো, মুখমণ্ডল আর্দ্র। পরনের টি-শার্টের অনেকাংশ ভিজেছে। সিটে বসেই অরুর হাতে চায়ের কাপ দুটো ধরিয়ে দিয়েছে। বাম হাতে ওর গায়ের ওড়নার একাংশ টেনে নিয়ে– মাথা, মুখ দেদারসে মুছে ফেলল। অরু ফ্যালফ্যাল চোখে শুধু দেখল। শুকনো ওড়নাটা মুহূর্তেই ভিজে গেল।
ঘুরেফিরে বাড়ি ফিরতে সেদিন রাতের বারোটা বেজেছিল।

————

সেদিন ছিল রোববার। তন্ময় অফিস থেকে বাড়ি ফিরেছে আটটা পঞ্চান্নতে। প্রায় নয়টা ছুঁইছুঁই। দোরগোড়া পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই আশ্চর্যান্বিত হয়। লিভিংরুমে বসে সবাই সিলেট ট্যুর সম্পর্কিত আলাপ-আলোচনা করছে। সিলেট ট্যুর সম্পর্কে বাড়ির মানুষ জানল কীভাবে? প্রশ্নের উত্তর সে দু'মিনিটের মাথাতেই পেলো। বাসায় তার বেয়ারা বন্ধুদলবল এসেছিল সন্ধ্যায়। তার পুরো পরিবারের একেকটি সদস্যকে রাজি করিয়ে তবেই বিদায় হয়েছে। পাষাণহৃদয়ের মোস্তফা সাহেব অবদি সমর্থন হতে বাধ্য হয়েছেন। হবেন নাইবা কেন? তার বন্ধুরা একেকটা শয় তানের চাচাতো ভাই। দারুণরকমের পণ্ডিত। তন্ময়কেই ছাড়ে না। প্রত্যেক সপ্তাহে তিনবেলা হাঁটে তুলে বিক্রি করে টাকা গোনে। সেখানে তার পরিবারকে কনভিন্স করানো ওদের হাতের ময়লা মাত্র। তবে তন্ময়ের জন্য বিষয়টা চমৎকার লাভজনক হলো বটে। দু’দিন ধরেই বেশ চিন্তায় পড়েছিল—অরুকে সাথে নেবার বিষয়টা বাড়িতে কীভাবে বলবে! যেহেতু সে নিজেও চাচ্ছে অরুকে নিতে। এখন আর সেধেপড়ে বলাবলির ঝামেলা করতে হবে না। অরুকে চূড়ান্ত উৎফুল্ল দেখা গেল। আসমানের চাঁদটা যেন ওর আঁচলে এসে পড়েছে। খুশিতে মুক্তোর মত চিকচিক করছে ওর মুখমণ্ডল। তন্ময়কে দেখতে পেতেই দু’লাফে সোফা ছেড়ে চলে এলো কাছাকাছি। গদগদ কণ্ঠে শুধাতেই থাকল ট্যুর সম্পর্কে তথ্যসূত্র। কখন যাবে? কে, কে যাবে! কী দিয়ে যাবে.. ইত্যাদি! তন্ময় সিঁড়ি বেয়ে উঠছে। অরু ব্র‍্যিফকেসটা উতলা হয়ে স্বেচ্ছায় নিজ হাতে নিয়েছে। পিছু-পিছু সিঁড়ি বাইছে তন্ময়ের পদচারণের সঙ্গে চরণ মিলিয়ে। মুখ দিয়ে বেরুচ্ছে একেরপর এক প্রশ্ন। তন্ময় প্রত্যুত্তর করছে না। তার সত্যিকারঅর্থে জবাব দিতে মন চাইছে না। ওর তোতাপাখির মতন পকরপকর করতে থাকা ওষ্ঠদ্বয়ে চুমু খেয়ে মুখটা বন্ধ করে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। পরিবারের সম্মুখে তো তা আর সম্ভব না। বসবার ঘরে উপস্থিত সকলের আকাঙ্ক্ষিত দৃষ্টি আপাতত তাদের ওপর। তন্ময় অনুভব করতে পারছে। এইতো আড়চোখে একটিবার তাকিয়েছেও। আনোয়ার সাহেব কেমন মিটিমিটি হাসছেন। কণ্ঠ খাদে নামিয়ে ‘মাশাআল্লাহ্, মাশাআল্লাহ্’ আওড়াচ্ছেন। মোস্তফা সাহেবের মুখমণ্ডলের অবস্থাও আজ অসন্তোষজনক নয়। যা বেশ সারপ্রাইজিং। সুমিতা বেগম দোয়াদরুদ পড়ছেন নজর না লাগার। সেদিকে শেষবার চেয়ে কক্ষে ঢুকল। অরুও সঙ্গেসঙ্গে ঢুকল। তিমিরাচ্ছন্ন ভেতরটা। সে অপেক্ষাকৃত বাতি জ্বলে ওঠার। যা কিয়ৎক্ষণের ব্যবধানেও জ্বলল না। আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠ তুলে ডাকার সময়টুকুও পেলো না। তন্ময়ের শক্তপোক্ত বাহুবন্ধনে আবদ্ধ হলো। তন্ময়ের রীতিমত ক্রমান্বয়ে এগুনোতে —তার পিঠ গিয়ে ঠেকল বন্ধ হয়ে যাওয়া দরজায়। শীতল ওষ্ঠদ্বয় ছুঁলো তার গাল দুটো। পরপর আধবোঁচা নাকটা। অরুর ছটফটে হাতজোড়াতে থাকা ব্র‍্যিফকেস পড়ে গেল ফ্লোরে। ফাঁকা হাতদুটো মুহূর্তেই মুষ্টিবদ্ধ করে ধরেছে তন্ময়ের মেরুন রঙের শার্ট। তন্ময় শুধাল আঁধারে, 

‘যাবি সিলেট?’

অরুর জবাবটি যেন ঠোঁটের মাথাতে রাখা। সাথে সাথেই সে ত্বরান্বিত ভঙ্গিতে জানায়, ‘হুঁ। আমি ভীষণভাবে যেতে চাই। অত্যধিক যেতে চাই।’

তন্ময় শব্দহীন হাসল। অরুর মুখের ভীষণ কাছে থেকে পুনরায় শুধাল, ‘কতটা?’

অরু যেন আঁধারে হিসেবনিকেশ করে ভাবল। কিয়ৎক্ষণের মধ্যেই আচমকা শব্দ করে চুমু খেলো তন্ময়ের শীতল ওষ্ঠজোড়ায়। মুহূর্তেই তন্ময়ও সুযোগের সৎ ব্যবহার করে বসল। স্বেচ্ছায় আসা ঠোঁটদুটো আর ছাড়ল না ততক্ষণাৎ। লম্বা এক শক্তপোক্ত চুমুতে মেতে উঠল। অরুটা বড্ড চঞ্চল। দুরন্তপনায় ফার্স্টক্লাস।
ঘনিষ্ঠ হলেই ওর নড়ানড়ির শেষ থাকে না। বাহুতে জাপ্টে রাখতে হয়। একটু ছাড় দিলেই হাঁসফাঁস করে পালাই-পালাই করে বেড়ায়। না চাইতেও ঠোঁটদুটো ছাড়ল সে। বাতি জ্বালাল। অরু অন্যদিকে ফিরে দাঁড়াল ততক্ষণাৎ। তন্ময় একপল দেখেছে ওর লাল টকটকে ঠোঁটজোড়া। গালদুটোও রক্তিম। সে হাসিটুকু গিলে ফেলল। শার্ট খুলতে নিয়েই গম্ভীরকণ্ঠে বলল,

‘তোকে নেয়ার ইচ্ছে নেই।’

অরু নিজের ক্ষণিকের লাজলজ্জা, চুমুর ব্যাপারটা মুহূর্তেই ভুলে বসল। আহত চোখে ফিরে চাইল। ত্বরিত পদচারণে কাছাকাছি গিয়েই শুধাল,

‘কেন? কেন? বললাম না, আমি জ্বালাব না। যেভাবে বলবেন সেভাবেই চলব। সারাক্ষণ আপনার সাথে সাথেই থাকব। যা বলবেন আমি তাই করব। তবুও নিয়ে চলেন, প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ।’

তন্ময় ভ্রু দুটো নাচাল, ‘যা বলব তাই করবি?’

অরুর চোখদুটি পিটপিট করল, ‘হুঁ।’

তন্ময়ের চোখমুখে এবারে দুষ্টুমি খেলা করল,
‘ইউ শিয়র?’

অরু ভ্যাবাচেকা খেলো যেন, ‘হুঁ। কিন্তুউউ..’

ওয়াশরুম যেতে যেতে তন্ময় সতর্কীকৃত ভঙ্গিতে বলে গেল, ‘মনে থাকে যেন।’

অরু কী খুশি হবে নাকি ভয় পাবে? তন্ময় ভাই তাকে এমন সতর্ক করল কেন? ভাবনায় বিভোর সে দরজার ওখানটায় পড়ে থাকা ব্র‍্যিফকেস তুলল। সেটি টেবিলের ওপর রেখে বারান্দার স্লাইডিংডোর সরাল। আজকের চাঁদটা দারুণ সুন্দর তো! ঠিক তার তন্ময় ভাইয়ের মতন।

————

মঙ্গলবার রাতে বন্ধুবান্ধব সব কফিশপে একত্রিত হলো। ভার্সিটির দুই বন্ধুও এই ট্যুরে জয়েন হচ্ছে। এক্সাইটমেন্ট সবগুলোর হাই লেভেলে। আলোচনা হচ্ছে সিলেট ট্যুরের আসল ব্যাপারস্যাপার নিয়ে। বেশ কষাকষির পর ট্যুরের তারিখ ভেবেচিন্তে ফেলা হলো চৌদ্দতে। ঠিক বৃহস্পতিবার। আজ থেকে তিনদিন পর। তবে কীসে করে যাবে? স্লিপিং বাস, গাড়ি নাকি প্লেন? সচরাচর ব্যবসায়ীক কাজে প্লেনেই যাওয়া-আসা হয় সকলের। তাই প্লেনের অপশন ক্যান্সেল। দ্বিতীয়টি স্লিপিং বাস। তবে মাহিনের কাছে সেসব ঝামেলাপূর্ণ মনে হলো। তার মতে মাইক্রো গাড়ি করে গেলে ভালো হবে। সকলে নিজেদের মতন আনন্দ আহ্লাদ করতে পারবে। শেষমেশ মাহিনের কথামত ডিসিশন নেওয়া হলো। তারা চৌদ্দ তারিখ বৃহস্পতিবার দুপুর বেলাতে বেরুবে সিলেটের উদ্দেশ্যে। রুস্তমদের একটি বাগানবাড়ি আছে। ওখানেই উঠবে। অবশ্য সিলেট তন্ময় সহস্র বার গিয়েছে। নানাবাড়ির উদ্দেশ্যে। তবে এবারেরটা ভিন্ন। এবার একান্তগত ভাবে যাচ্ছে অরুকে নিয়ে। বন্ধুবান্ধব তো ছুঁতো মাত্র! 
.
.
.
চলবে.............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন