খাবার টেবিলে সবাই বসে। খাওয়াদাওয়ার পর্বটি বেশ আনন্দের সহিত চলছে বলে মনে হচ্ছে। দেয়াল ঘড়িতে তখনো দুটো বাজতে বারো মিনিট। বজ্রপাতের ধ্বনি ভেসে বেড়াচ্ছে। বৃষ্টি হবে শীঘ্রই।
খাওয়াদাওয়ার ফাঁকফোকরে মিটিমিটি হাসছে শাবিহা, রুবি– আকাশ। ওদের এহেন রঙ্গতামাশার সম্মুখে অরু লজ্জায় মাথা নুইয়ে রাখলেও; তন্ময় বড়ো সাবলীল ভঙ্গিতেই আছে। যেন ওদের হাসাহাসি তাদের দুজনকে ঘিরে না। নিজের মতন খেতে ব্যস্ত। এমনকি আহামরি পাত্তা দিচ্ছে না নিজের পিতা মহাশয় —শাহজাহান মোস্তফাকেও। মোস্তফা সাহেবের মুখমণ্ডলের অবস্থা বেশ একটা সুখকর নয়। গুরুগম্ভীর তার মুখশ্রীর হাবভাব। তেরছাভাবে ছেলেকে পরখ করে নিচ্ছেন ক্ষণেক্ষণে। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টির প্রভাবটুকু তন্ময় অনুভব করেও; অবুঝের ভাণ ধরে আছে। সংকোচনীয় ব্যাপারটি ঘটে গেছে তো গেছে। এখন আর কী করার? নিজের বউকে চুমুটুকুর বদলে কামড় নাহয় খেয়েছে। তাতে কী এমন হয়েছে? তার বউকে সে চুমু খাবে নাকি কামড়– তারও কি কৈফিয়ত দিতে হবে নাকি? একফাঁকে বাঁকাচোখেতে একবার অরুকেও দেখে নিয়েছে। অপদার্থটা মাথা নুইয়ে হাঁসফাঁস করছে। এত লজ্জাই যদি পাবে তাহলে নেমেছিল কেন নিচে? কে জোর করেছে ওকে? ড্যাংড্যাং করে সেধেপড়ে লজ্জা মাথায় নিলে এখানে তার কী করার? ওর মাথার ভেতরে আসলে কিছুই নেই। গাধা একটা!
খাওয়া শেষে তন্ময় যেতে নিয়েও আরেকটিবার ফিরে চায়। অরু এখনো বলদের মতন খাবার প্লেটে নিয়ে বসে আছে। দু-লোকমা কোনোরকমে হয়তোবা মুখে তুলেছিল। বাদবাকি খাবারগুলো মনোযোগ সহকারে আঙুল দিয়ে বুনছে। আশ্চর্য! খেয়েদেয়ে ঘরে যাবে– তা না করে ঠোঁট কাঁটা মুখ নিয়ে আমোদে বসে থাকার মানে আছে?বতন্ময় একপ্রকার বাধ্য হয়েই ধমকে ওঠে,
‘এভাবে খাবার নিয়ে বসে আছিস কেন? খেয়েদেয়ে ওঠ!’
অরু চমকে ওঠে। মুহূর্তেই চোখ তুলে চায়। দৃষ্টিতে দৃষ্টির মিলন ঘটে সেকেন্ডের। পরমুহূর্তেই মুখ বাঁকিয়ে সে নিজের খাবার বুনতে শুরু করে পূর্বের ন্যায়। অনাগ্রহী তন্ময়ের আদেশ শুনতে। তন্ময় আর একমুহূর্ত দাঁড়ায় না। ত্বরান্বিত পদচারণে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠে আসে। সুযোগ পেলেই দেখা যাবে তার ঘাড় ধরে বসেছে মোস্তফা সাহেব। তার সম্মুখীন না হওয়াই উত্তম। রুমে ফিরে আধপড়া ফর্মটা পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তখনই নামল ঝুম বৃষ্টি। তার ইজি চেয়ারটা বারান্দার ঠিক কাছেতেই। সুস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে বৃষ্টির উদাসীনতা– বিশালতা। উদার হাওয়াতে বসে ভেসে ভেতরে প্রবেশ করছে বৃষ্টির জল। বারান্দার ফ্লোর ভিজিয়ে দিয়েছে ইতোমধ্যে। গ্রিলে ঝুলানো ছোটো-ছোটো ফুলের টবগুলোতে থাকা কয়েকধরণের ফুলেরা ভিজছে, দুলছে–হাসছে। তন্ময়ের মনে পড়ল অরুর সকালের কথাগুলো। ঘুরতে যেতে চেয়েছিল মেয়েটা! অনেকদিন ধরেই ওকে নিয়ে বেরোনো হচ্ছে না। অরুর ভার্সিটিতে গিয়ে একদিন ওকে পিক করা প্রয়োজন। বিষয়টা খুব পছন্দ করে ও। বিশেষ করে তন্ময় একান্তভাবে গিয়ে ওকে পিক করবে, এই বিষয়টা খুব এঞ্জয় করে। তন্ময় বুঝে সবই। সেবার হঠাৎ করেই দুপুরের দিক সে অরুর ভার্সিটিতে পৌঁছেছিল। ক্লাস শেষ করে বেরিয়ে তাকে দেখতে পেতেই কী খুশিই না হয়েছিলো মেয়েটা! পাশে দাঁড়ানো বন্ধুবান্ধব গুলো কেউই যেন তখন আর ওর চোখের দৃষ্টিতে নেই। শুধুই তন্ময় বসবাস করছিল ওই মণি দুটোতে। সেই হাস্যজ্জ্বল মুখটার কথা ভাবলে এখনো আনন্দে জোয়ার বয় তার হৃদয়ে। অথচ কাজের চাপে আজকাল সময় দিতে পারছে না। ভেবেই তন্ময় দীর্ঘশ্বাস ফেলে। দেয়াল ঘড়িতে দৃষ্টি বুলিয়ে নেয় একটিবার। এখনো আসছে না যে! বৃষ্টি নেমেছে মিনিট পাঁচেক হলো বলে। ও কী দেখেনি? তন্ময় গুণে-গুণে আরও মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করল। তবুও অরুর দেখা পাওয়া গেল না। অবশেষে সে নিজেই উঠে দাঁড়াল। নিশ্চয়ই অভিমান ধরে বসে আছে। ও অভিমান ছাড়া আর কী-বা পারে করতে! ওয়ালেট, ফোন —গাড়ির চাবি হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। অরুর রুমের দরজা খোলা। ভেতরে কেউই নেই। তন্ময় সিঁড়ি ভেঙে নিচতলায় নেমে আসে। ড্রয়িংরুমে বসে মোস্তফা সাহেব, আনোয়ার সাহেব এবং ওহী সাহেব। সাপ-লুডু খেলছেন তিন ভাই। চা খাচ্ছেন আর সাথে আলাপ জুড়েছেন ব্যবসায়ীক কর্মকাণ্ড নিয়ে। অরুকে কোথাও দেখা গেল না। তন্ময় ভ্রুদ্বয় কুঁচকে দীপ্তকে ডাকল গলা তুলে। দীপ্ত রান্নাঘর থেকে ছুটে এলো। মুখে তখনো ঠাঁসা মিটবল। জবেদা বেগম আজ মিটবল বানাচ্ছেন। তার হাতের সবই কমবেশ সুস্বাদু হয়। তার হাতে বানানো এই মিটবলও অসাধারণ হয়েছে খেতে। দীপ্তই সর্বপ্রথম খেয়ে টেস্ট করছিল রান্নাঘরের বেসিনের ওপর বসে। তন্ময় অরুর সম্পর্কে শুধাতেই দীপ্ত হাত উঠিয়ে ওপরে দেখায়। শাবিহার রুমের দিকটায়। তন্ময় পুনরায় সিঁড়ি ধরে ওপরে ওঠে আসে। শাবিহার রুমের কাছাকাছি গিয়েই তার পা’জোড়া থেমে আসে। রুবি দুষ্টুমির সুরে রঙ্গ করে বলছে,
‘কীরে—চুপ আছিস কেন, বল, বল! আমাদের খুলে বল হয়েছে কী! আমরা যা ভাবছি তাই বুঝি? তন্ময় ভাইকে দেখে কিন্তু রোমান্টিক বলে মনে হয় না। ভাই তোকে ধরে চড়িয়ে পড়াচ্ছে এতটুকুতেই আমার চিন্তাভাবনা সীমাবদ্ধ। এরথেকে বেশি ভাবা সম্ভব হচ্ছে না।’
হাসাহাসির একটি ঝড় বইল রুবির বাক্যগুলো শেষ হতেই। সেখানে আকাশের কণ্ঠের হাসির ধ্বনিও মিশ্রিত। তন্ময়ের কপালের ভাঁজ দৃঢ় হলো। সে পদচারণ ফেলে এগুব তখনই অরুর অসন্তুষ্ট গলার স্বর শোনা গেল। বড্ড বিরক্তি মিশে তার বচনের ভঙ্গিতে,
‘তোমরা কী কখনো পড়নি —‘ডু নট জাজ আ বুক বায় ইট’স কভার?’ আমার তন্ময় ভাই কেমন তা আমি জানলেই হবে। তোমাদের তো জানার প্রয়োজন নেই।’
শাবিহা সহমত পোষণ করল ততক্ষণাৎ, ‘সহমত। আমি ভাবির সঙ্গে একমত।’
এবারো হাসল সকলে। অরুকে ভাবি ডাকাটা যেন অন্যতম হাস্যকর ব্যাপারস্যাপার। এইযে রুবি হাসতে হাসতেই বলে ফেলল, ‘ভাবি-টা আমাদের খুব ছোটো হয়ে গেল।’
অরুর কণ্ঠজুড়ে রাগের বহিঃপ্রকাশ, ‘তোমরা ভীষণ খারাপ আর দুমুখো। তোমরা দুর্বলকে পিষে মারো আর শক্তিশালীকে ভয় করো। যাও না —গিয়ে তন্ময় ভাইয়ের সামনে রঙ্গতামাশা করো। দেখি তোমাদের কত সাহস।’
আকাশ হেসে রসিকতার সুরে বলল, ‘কীরে অরু! এখনো তন্ময় ভাই বলছিস? তোর কী আর ভাই হয়?’
‘কেন হবে না?’
তন্ময় এবারে দরজার সম্মুখে এসে দাঁড়াল। দরজাটা সটানভাবে খোলাই ছিলো। তাকে দেখেই পিনপতন নীরবতা বইল সেকেন্ডের জন্য। শাবিহা ত্বরিত পেছনে ঘুরে ইতোমধ্যে টেবিল গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। রুবি মাথানিচু করে বাথরুমে ঢুকে গিয়েছে। ধমক সে খেতে চায় না। আকাশ ফোন টিপছে বিছানায় বসে। মুখে তখনো তার দুষ্টু হাসি। অরু সবগুলো দু'মুখোদের কর্মকাণ্ড দেখে ভেংচি কাটে। কতবড় দুমুখো সাপ সবগুলো। এখন তন্ময়ের সামনে কেন ওসব দুষ্টু কথাবার্তা বলতে পারে না? ভালো সাজবার মানে কী? তন্ময় সরু চোখে দেখছে অরুর ভোঁতা মুখটা। ও অসন্তুষ্ট ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে ঠাঁই। যেন তন্ময় না ডাকলে এক'পা নড়বে না। তন্ময় অসহায় কণ্ঠে ডাকে,
‘দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আয়।’
অরু এবারে মাথা তুলে চায়। মুখ বাঁকায়। তবে কথা শোনে। হনহনিয়ে বেরিয়ে আসে রুম থেকে। সিঁড়ি বেয়ে আগেই নেমে যাচ্ছে। আনোয়ার সাহেব মেয়ের তাড়াহুড়ো দেখেই গলা তুলে সাবধান করলেন। ওহী সাহেব শুধালেন,
‘বাইরে বৃষ্টি, মামণি! কই যাচ্ছো তুমি?’
তিন ভাইয়ের প্রশ্নবোধক দৃষ্টিই আপাতত অরুর পানে। তন্ময়ও পিছু পিছু নেমে এসেছে। অরুর হয়ে জবাব সেই দেয়,
‘একটু বেরোচ্ছি ওকে নিয়ে।’
আনোয়ার সাহেবকে দারুণ খুশি দেখাল, ‘তাই বুঝি! বেরিয়ে পড়ো তাহলে। ঘুরেফিরে বৃষ্টিবিলাস করে এসো। তবে বৃষ্টিতে ভেজো না যেন!’
মোস্তফা সাহেব মুখে কিছু বললেন না। শক্ত, দৃঢ় চোখে শুধু ছেলের পানে চেয়ে। পিতা-পুত্রের দৃষ্টির মিলন ঘটল। একজনের সূক্ষ্ম দৃষ্টি আর অন্যজনের সাবলীল। এযাত্রায় তন্ময় ডান ভ্রু তুলে নাচাল। যেন অবলিত প্রশ্নবোধক ‘কী’ উচ্চারণ করছে সে। মোস্তফা সাহেব মুখ ফিরিয়ে নিলেন। থমথমে গলায় বললেন,
‘তাড়াতাড়ি ফিরে এসো।’
তন্ময় হাসে। মুখে বলে, ‘জি।’
—————
আঁধারছন্ন ঝুম বৃষ্টি। বাতাসের তোড়জোড়ে কঠিন প্রভাব বিস্তর করছে। সড়কপথে মানুষজন নেই। গাড়িঘোড়া হাতেগোনা কিছু বায়-পাস করছে তাদের। গাড়ির স্পিড মাঝামাঝিতে। অরু জানালার কাঁচ অর্ধেক নামিয়েছে। অত্যন্ত ধারালো, প্রখর বৃষ্টির সম্মুখে সম্পূর্ণ নামানো যাচ্ছে না। সুযোগ পেতেই বৃষ্টি পোঁটলাপুটলি বেঁধে তার কোলে বাসা বাঁধতে উদ্যত। তন্ময় আড়চোখে দোটানায় ভোগা অরুকেই দেখছিল। এযাত্রায় মুখ খুলল সে,
‘কাঁচ নামাতেই হবে কেন? ভেতর থেকে কি দেখা যাচ্ছে না?’
অরুর কণ্ঠজুড়ে আশ্চর্যতা, ‘এক বিষয় হলো নাকি? বৃষ্টি ছুঁয়ে, সরাসরি না দেখে কি উপভোগ করা যায়?’
‘না যাওয়ার তো কারণ দেখছি না।’
অরুর ক্ষোভযুক্ত নয়নযুগল সূক্ষ্মভাবে তন্ময়কে পরখ করে নিচ্ছে, ‘আপনি চাচ্ছেন আমি যেন রেগে বাসায় চলে যেতে চাই। তাহলে আর আমায় ঘুরতে নিতে হবে না। আপনি বেঁচে যাবেন।’
তন্ময়ের চোখমুখ জুড়ে প্রাণোচ্ছল হাসি ফুটে ওঠে, ‘পণ্ডিত কোথাকার।’
অরুর ঝগড়াটে কণ্ঠ আসমান চড়ে বসে,
‘আমি কি ভুল কিছু বলছি? তাহলে অস্বীকার করুন! বলুন মুখে।’
তন্ময় দৃষ্টি রাস্তাতেই রাখে। ঠোঁট জুড়ে চওড়া হাসি, ‘অস্বীকার করছি না। তুই বাসায় যেতে চাইলে বেঁচে যাব।’
অরু চমকাল। বিমূঢ় হলো দৃষ্টি। ছোটো-ছোটো ছলছল অভিমানী চোখে চেয়েই রইল তন্ময়ের মুখপানে। ভোঁতা হয়ে থাকা আদুরে মুখটা দেখে– নিজের হাতটা আর সামলে রাখতে পারল না তন্ময়। ডান হাতে স্টিয়ারিং সামলে বাম হাতটা বাড়িয়ে অরুর গাল দুটো চেপে ধরল,
‘কী? দিয়ে আসি বাসায়?’
‘আমি চাচ্চুকে বিচার দিব।’
তন্ময় সামান্য ভয় পাবার ভাণ ধরে জানাল, ‘ওহ্, ভীষণ ভয় পেয়েছি। এখন তো বাধ্যহয়ে তোকে নিয়ে ঘুরতেই হবে।’
অরুর ঠুনকো অভিমান এবং ভোঁতা মুখ, দুটোর একটাও বেশিক্ষণ স্থায়িত্ব পেলো না। বৃষ্টি যেন সব অভিমান গুলো মুছে দিলো। ঠিক সড়কপথটির মতন। পরিষ্কার, ঝকঝকে।
.
.
.
চলবে..............................