ধূসর দিগন্তে সূর্য নিভু নিভু। ধোঁয়ার মতো আবছা কালো মেঘমালা ছড়িয়ে আছে সেথায়। দীঘল দিগন্তের দিকে চোখ মেলে চাইলে মনে হবে যেন বিষাদে ঘেরা! অরুণ সরকার গাড়ির জানালার কাচে মাথা ঠেকিয়ে গালে হাত রেখে সেদিকেই চেয়ে আছে। পাশে পাতার কোলে ভোর বসে আছে। এখন পাতাকে জড়িয়ে নেই জোঁকের মতো। ভদ্র বাচ্চার মতো বসে আছে গালে হাত দিয়ে। পাতা বাবা ছেলের কান্ড কারখানা দেখছে। স্বভাবে মনে হচ্ছে দুজন একই গোছের। দুজনে একে অপরের উপর অভিমান করে গাল ফুলিয়ে বসে। কেউ কারো সাথে কথা বলছে না। সামনে ড্রাইভার গাড়ি চালানোতে ব্যস্ত। আভারি ঝিমুচ্ছে একটু পর পর। খানিকক্ষণ আগের অরুণ পাতার ঝগড়ার এরা ছিল নীরব দর্শক।
পাতা অরুনের দিকে আড়চোখে চাইছে বারবার। তার মস্তিষ্কে একটা কথা ঘুরপাক খাচ্ছে। জিজ্ঞেস করবে কি না দোনামোনায় আছে। যদি তার কথায় কিছু মনে করে! আবার প্রশ্ন না করেও মনে শান্তি পাচ্ছে না। তার একটা সমস্যা হলো মনে যদি কোন প্রশ্ন উদয় হয় সারাক্ষণ সেটা নিয়েই পড়ে থাকবে। অন্য চিন্তা ভাবনা মাথায় আসে না। শুধু ওটাই মাথায় ঘুরপাক খাবে! শান্তি নেই! পাতা হাবিজাবি চিন্তা করে মাথা আউলিয়ে ফেললো একেবারে।
-" ওভাবে আড়চোখে চাইছেন কেন মিস পাতাবাহার? আপনার চাহনি কিছু ঠিক লাগছে না আমার!"
পাতা অরুণের দিকে সরাসরি চায়। ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-" আপনি কি বুঝাতে চাইছেন? আমার চাহনি কেমন?"
অরুণ সরকার পাতার দিকে চায় শান্ত চোখে। ভোর দুজনের দিকেই খেয়াল রাখছে। আভারির ঝিমানো থেকে সজাগ হয়েছে। মুখশ্রী সামনের দিকে স্থির থাকলেও কানটা এদিকেই ! ড্রাইভারেরও সেম অবস্থা।
অরুণ জানালার পাশ থেকে সরে পাতার দিকে খানিকটা এগিয়ে আসে। পাতা সেটা দেখে জানালার দিকে সেটে যায়। অরুণ সেটা লক্ষ্য করে। পাতার দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে বলে,
-" কিছু বলতে চান?"
পাতা মন বলে দে পাতু বলে দে! আবার খানিকটা ইতস্তত বোধও করে! অন্যের পার্সোনাল ব্যাপারে নাক না গলানোর কি দরকার। সে দোনামোনা মনে বলেই ফেলে,
-" মি. ভোরের বাবা? আপনি তখন ওই লোকটাকে থাপ্পড় মারলেন কেন? না মানে এখানে ওনার তো দোষ দেখলাম না। আর ওনার কথাগুলোও যুক্তি.."
আর বলে না অরুণকে চুপ শান্ত হয়ে যেতে দেখে। তবে পাতা সহ সবাইকে অবাক করে দিয়ে অরুণ ফিক করে হেসে দেয়। আভারি চোখ রসগোল্লার রূপ করে পিছনে চেয়ে। ড্রাইভারের নজরও ভিউ মিররে অরুনের দিকে। অরুণ সরকারকে তারা এভাবে হাসতে দেখে নি। গাম্ভীর্যে ভরপুর অরুণ সরকারের মুখশ্রীতে শুধু মুচকি হাসি দেখা যায় মাঝে মাঝে তাও সেটা ভোরের উপস্থিতিতে! এভাবে হাসতে দেখে তারা বেশ আশ্চর্যান্বিত হয়ে গেছে। ভোর ভ্রু কুঁচকে বাবার দিকে তাকিয়ে।
পাতা চোখ মুখ কুঁচকে নেয়। সে শুনেছে যারা আগা গোড়া গাম্ভীর্যে ভরপুর ,হাসে কম তাদের হাসি সুন্দর হয়। কিন্তু এই লোকটার হাসি সুন্দর তো নয়ই বরং কেমন বিদঘুটে লাগছে। মুচকি হাসলে খারাপ লাগে না। বেশ ভালোই লাগে কিন্তু উচ্চ হাসি এমন কেন? মনে হচ্ছে অটোরিকশা প্যা পু করছে! হুহ! অরুণ হাসি থামিয়ে নেয় সবার চাহনি দেখে। গলা ঝেড়ে পাতার দিকে চায়। পাতার কুঁচকানো মুখ ও প্রশ্নবিদ্ধ চাহনি দেখে মুখে গাম্ভীর্য ভাব ফুটিয়ে তোলে। দৃষ্টি স্থির রেখে জবাব দেয়,
-" এমনি! "
পাতা ভেংচি কাটলো মনে মনে। হুহ এমনি!
-" আশ্চর্য এমনি এমনি কেউ কাউকে মারে নাকি! নিশ্চয়ই কোনো কারন আছে? আর আপনি হাসলেন কেন প্রশ্ন শুনে?"
অরুণ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে,
-" কি জানি! ওই শুঁয়া পোকা যখন সামনে এলো হাত নিশপিশ করছিল! ভিতর থেকে আওয়াজ আসছিল অরুণ হি ডিজার্ভড আ স্ল্যাপ ফ্রম ইউ! দেন আই স্ল্যাপ্ড।!"
পাতা বিরক্তিকর শ্বাস ছাড়ে।
-" সত্যি বললেই হয় আপনি আপনার প্রাক্তন ওয়াইফের প্রেজেন্ট হ্যান্ডসাম হাসব্যান্ড দেখে জেলাসির ঠেলা না সামলাতে পেরে কসিয়ে দিয়েছেন!"
অরুণের ভ্রু যুগল কুঁচকে যায়। কৌতুকের ভঙ্গিতে ঠোঁট নাড়িয়ে বলে,
-" মিস পাতাবাহার? ডু ইউ থিংক হি ইজ হ্যান্ডসাম? দেন ট্রাস্ট মি! ইউর চয়েস ইজ সো ওওফুল!"
পাতা চুটকি বাজিয়ে বলে,
-" নাও আই এম হান্ড্রেড পার্সেন্ট সিউর ইউ আর জেলাস! আর আমার চয়েস মোটেও বাজে না। হি লুকস গুড !"
অরুণের চোয়াল শক্ত হয়। গাম্ভীর্য ভরা ফর্সা মুখশ্রীতে নীল শিরা দৃশ্যমান।
-" ইউ ক্রাশড ওন হিম?"
পাতা হেসে উঠলো। হাসতে হাসতেই জবাব দিল,
-" আরে না! হি লুকস গুড তার মানে এই না যে ক্রাশ খেয়ে বসে আছি! আমার ক্রাশকে দেখলে বলবেন হ্যা পছন্দ আছে!"
-" কে আপনার ক্রাশ?"
-" আপনাকে কেন বলবো? আপনি আমার বন্ধু লাগেন?"
পাতার ত্যারা জবাবে অরুণ দৃষ্টি সামনে রাখে। আর পাশে চায় না। পাতা অরুণের দিকে একবার চেয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে রয়। ভোর এখনো গাল ফুলিয়ে বসে আছে।
পাতা হঠাৎ গাড়ি থামাতে বললে অরুণ প্রশ্নবিদ্ধ নজরে চায়। পাতা বলে,
-" এখানেই নামিয়ে দিন। বাকিটুকু আমি হেঁটে যাব!"
ড্রাইভার ব্রেক কষে থামায় গাড়ি। অরুণ সরকার গম্ভীর গলায় বলে,
-" বাড়ির সামনেই গাড়ি নামিয়ে দিবে। চুপচাপ বসুন?"
পাতা ভোরকে কোল থেকে নামিয়ে সিটে বসিয়ে দিল। ভোর তার আঁচল ধরে আবদার করে ,
-" মিস আমাকে তোমার বাড়িতে রাখবে? আমি গুড বয় হয়ে থাকবো!"
কি সুন্দর আদুরে আবদার! মনে হচ্ছে পছন্দের আইসক্রিম আবদার করছে আসো আমায় টেস্ট করো? পাতা দরজা খুলে বেরিয়ে আড়চোখে অরুণের দিকে চায়। যার মুখটা দেখার মতো! সে হেসে ভোরের দিকে ঝুঁকে গালে মুখে বেশ কয়েকটা চুমু দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
-" তোমার মতো সুইট বয় কে কে না রাখতে চাবে? আমার তো ইচ্ছে করছে ঘরে নিয়ে অনেক আদর করতে! কিন্তু কেউ একজন তো নিঃশ্বাস নিতেই ভুলে যাবে! গলা কাটা মুরগীর মতো ছটফট করবে। তুমি এমনি ঘুরতে এসো কেমন সোনা? সামনেই তো ঈদ। বেড়াতে আসবে ? ওকে?"
ভোর কিছু বলে না। মুখ ফিরিয়ে সিটে মাথা এলিয়ে দিল। পাতা খানিক হেসে দরজা বন্ধ করে দিল। তার হাত নাড়িয়ে টাটা দিয়ে সামনে হাঁটতে থাকে। অরুণ পাতার প্রস্থান দেখে। কাঁধে বড় একটা কাপড়ের ব্যাগ ,হ্যান্ড পেইন্টেড। মাথায় ছোট স্কার্ফ পেঁচিয়ে হিজাবের মতো পড়েছে।কনুই সমান হাতার বড় ব্লাউজে পিঠ কোমর ঢাকা, গাঢ় ব্লু স্কাই শাড়ি পড়নে। স্লিপার পায়ে ছোট ছোট পায়ে হাঁটছে হালকা কোমড় দুলিয়ে। অরুণ তীক্ষ্ণ নজরে চায়। আশেপাশে কিছু মধ্যবয়স্ক পুরুষ নজরে আসে। হঠাৎ গাড়ি থেকে বের হয়ে পাতাকে ডাক দেয়।
-" মিস পাতাবাহার?"
পাতার পদযুগল থেমে যায়। পিছন ফিরে চায়। অরুণ এগিয়ে যায়। পাতা ভদ্রতার সাথে বলে,
-" আমার নাম পাতা! পাতাবাহার না মি. ভোরের বাবা!"
-" কিসের পাতা? আমের পাতা না জামের পাতা? নাকি ব্যাঙের ছাতা!!"
পাতা চোখ রাঙিয়ে আঙ্গুল তুলে বলে,
-" আপনি মাঝরাস্তায় ডেকে আমার সাথে মজা করছেন?"
অরুণ হালকা হেসে বলে,
-" ওকে মিস নিমের পাতা! নাহ পাতাবাহারই ঠিক আছে। সাউন্ডস গুড! শুনুন? আমার নজর আবার খারাপ ভাববেন না! যে কারোই নজরে আসতে পারে!"
পাতা রেগে যায়। আঁচল ঠিক করে। অরুণ বিরক্ত হয়। মেয়েদের এই এক সমস্যা ছেলে মানুষ দেখলেই ওড়না টানাটানি! আঁচল ঠিক করে কি বুঝাতে চাইলো?
পাতা রেগে কটমট করে বলে,
-" কি আবোল তাবোল বলছেন?"
অরুণ সিরিয়াস হয়ে বলে,
-" আপনার ব্যাক সাইডে কিছু লেগে আছে! আপনি ছোট নন।আই থিংক বুঝতে পারবেন।আমি ডাকতাম না বাট সামনে অনেক মানুষ আছে!"
পাতা শান্ত হয়ে যায়।ঘার ঘুরিয়ে পিছনে দেখার চেষ্টা করে। অরুণ আশেপাশে তাকিয়ে বলে,
-" ডোন্ট সি লাইক দ্যাট! ইটস লুক উইয়ার্ড! সোজা হন!"
পাতা সোজা হয়। লজ্জা অস্বস্তিতে চোখ টলমল হয়ে আসে। মুখশ্রী লালিমায় ঘিরে যায়। এখন তার পিরিয়ড টাইম তো নয়! সেটার এখনো সময় আছে! আর সে বুঝতেও পারে নি! কেমন একটা বিদঘুটে পরিস্থিতি!সে আশেপাশে তাকায়। একটু দূরত্বেই শুকলা মন্ডল সহ বেশ কয়েকজন দাঁড়িয়ে। আড়চোখে এদিকেই তাকিয়ে।
অরুণ পাতার নাকে টোকা দিয়ে বলে,
-" হয়েছে আর প্যানিক হতে হবে না।"
বলে পড়নের শার্টের বোতাম খুলতে শুরু করে। পাতা আশেপাশে তাকায়। শুকলা সহ লোকগুলো এদিকেই আসছে! অরুণ শার্টের নিচে আরেকটা টি শার্ট থাকায় সমস্যা হয় না। শার্ট খুলে বিনা স্পর্শে পাতার কোমড়ে বেঁধে দিল।
-" মিস পাতাবাহার? আপনি ছোট নন। সাবধানে থাকবেন না? যান!"
পাতা কিছু বলে না। চটজলদি সেখান থেকে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। কিন্তু যেতে পারে না।
.
.
.
চলবে.....................................................................