নজর - পর্ব ০২ - তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া - ধারাবাহিক গল্প


নিশিতা মাগরিবের নামাজ শেষে পড়তে বসেছে। নিশিতার রুম খুব গোছানো পরিপাটি। রুমের এক পাশে খাট তার পাশে জামাকাপড় রাখবার জন্য সুন্দর একটা আলমারি। আলমারির পর দক্ষিণে জানালা। ইচ্ছে হলেই সেখানে দাঁড়িয়ে দক্ষিণা বাতাস অনুভব করতে পারে নিশিতা। জানালার পরেই একটা ছোটো বইয়ের টেবিল। সেখানে সব বই গুছিয়ে রাখা। তবে কবিতা কিংবা গল্পের বই সব। সেখানে কোনো পাঠ্যবই নেই। এই টেবিলের পর দরজা আর দরজার অন্য পাশে পড়ার টেবিল। সামনে তার ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা। সারাবছর লেখাপড়া না করলেও পরীক্ষার আগে পড়া যেনো তার কাছে একটা আর্ট! নিশিতা বই হাতে নিয়ে কয়েক পৃষ্ঠা পড়তেই লোডশেডিং হয়ে গেলো। এই এক বিদ্যুৎ হয়েছে! সারাদিন এতো লোডশেডিং দেওয়ার পরেও সন্ধ্যার পর কেন লোডশেডিং দিতে হবে? মনে মনে নিশিতা বিদ্যুৎ অফিসারদের গুষ্টি উদ্ধার করছে। ফোনের ফ্লাশ জ্বালিয়ে মেয়েটা উঠে দাঁড়িয়ে জানালার দিকে এগিয়ে দেখে, বাইরে অন্যান্য বাড়িতে দিব্যি লাইট জ্বলছে। তাহলে নিশিতার রুমেের লাইটের কী হলো! নিশিতা এসব ভাবতে ভাবতেই দরজার দিকে অগ্রসর হয়। কিন্তু তখনই সেই বিশ্রী গন্ধ তার নাকে ঠেকে। আর মুহূর্তেই একটা কালো অবয়ব নিশিতাকে ধাক্কা দিয়ে খাটে ফেলে দেয়। নিশিতা ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেছে। কী হচ্ছে ঠিক বুঝতে পারছে না বেচারি। বিছানা থেকে উঠে বসতেই দেখে তার সামনে দাঁড়িয়ে অস্পষ্ট কোনো অবয়ব। আর সেই সাথে তীব্র থেকে তীব্র দুর্গন্ধ! নিশিতার পেটের ভিতরের সবকিছু বমির আকারে বের হয়ে আসতে চাইছে। কিন্তু খুব কষ্ট করে সে নিজেকে আটকে রাখে। নিশিতার মেরুদণ্ড দিয়ে ভয়ের একটা শীতল স্রোত বয়ে যাচ্ছে বলে অনুভব হচ্ছে তার।

 হৃদপিণ্ডের গতি স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় তিনগুণ বেড়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে নিশিতার। মনে হচ্ছে এক্ষুনি বুঝি হার্ট অ্যাটাক করে মারা যাবে সে! মুখ থেকে কোনো আওয়াজও বের করতে পারছে না মেয়েটা। এরমধ্যেই সেই কালো অবয়ব নিশিতাকে আবারও ঠেলে বিছানায় ফেলে দেয়। তারপর নিশিতার বুকের উপর বসে গলা চেপে ধরে। নিশিতার বুকের উপর এত ভারী অনুভব করে যেন এক্ষুনি দম আটকে মারা যাবে সে। আর গলায় তো অস্বাভাবিক গতিতে বল প্রয়োগ করা হচ্ছে! নিশিতা প্রাণপণে চেষ্টা করে অবয়বের হাত তার গলা থেকে সরাতে। কিন্তু তার শক্তির কাছে নিশিতার শক্তি তুচ্ছ। 

রুম জুড়ে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে। রনির বাবা-মা মোহাম্মদ নাসিম আর পারুল আক্তার) দুজনেই রনির উত্তর শোনার অপেক্ষায় বসে আছেন। উনারা দুজনেই চান রনি এখন বিয়ে করুক। দেখতে দেখতে রনির বয়স প্রায় আটাশ ছুঁইছুঁই। ভালো চাকরি করে উপযুক্ত বয়স হয়েছে। তাহলে কীসের জন্য অপেক্ষা? আর যেখানে বলতে গেলে নিশিতারও প্রায় অনার্স কমপ্লিট! রনি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর তার বাবা-মা'কে বলে সামনে নিশিতার ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা। এখন নিশ্চয়ই ওর পরিবার বিয়ের ব্যাপারে এগোবেন না। 
" রনি তারপরও আমরা না হয় উনাদের সাথে একবার কথা বলে দেখি? দরকার হলে এখন শুধু কথা বলে সব ঠিকঠাক করে রাখবো। তারপর নিশিতার পরীক্ষার শেষে বিয়ে! "
" উফ মা! এত তারাহুরোর কী হয়েছে? "
" হয়েছে। আমাদের বয়স হচ্ছে রনি। বিশেষ করে তোমার মায়ের। "
রনি তার বাবার মুখের উপর কখনো কোন কথা বলে না। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। শেষমেশ রনি বলে তাদের যা ইচ্ছে করতে তবে নিশিতার যেন কোন সমস্যা না হয়। এই কথা বলে রনি রুম থেকে বেরিয়ে সামনের রুমে গিয়ে খেলার সংবাদ শুনতে বসে।

নিশিতার দম প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। হয়তো কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই প্রাণ পাখি বেরিয়ে যাবে তার! গলা কাটা মুরগির মতো শুধু ছটফটিয়ে যাচ্ছে মেয়েটা। দু-চোখ বন্ধ হয়ে আসছে নিশিতার। কিন্তু বন্ধ হতে হতে সে অনুভব করে তার শরীর কেমন হালকা লাগছে। আর গলায়ও কারো হাতের চাপ অনুভূত হচ্ছে না। নিশিতা ইচ্ছে করেও চোখ খুলে রাখতে পারছে না। একটা অদ্ভুত সুন্দর মিষ্টি ঘ্রাণে তার চোখ যেন আরও দ্রুত বুঁজে যাচ্ছিল। 

পরের দিন, 
কালকের ঘটনার কোন কথাই যেন নিশিতা মনে করতে পারছে না। চোখ বন্ধ হবার পর কি হয়েছিল? এসব ভাবতে ভাবতে নিশিতা ঢুলু ঢুলু চোখে ক্লাসে এসে বসেছে। বাকিরা নিজেদের মতো করে আড্ডা দিচ্ছে। কিন্তু নিশিতা চুপচাপ। নিশিতাকে এরকম নিশ্চুপ দেখে মিলা বলে উঠে, 
" এই নিশিতা এভাবে মশগুল হয়ে কী ভাবছিস? ওহ তোর তো জামাই আছে! "
মিলার কথায় আশেপাশে বসে থাকা নিশিতার আরও তিন/চারজন বন্ধু হো হো করে হেসে উঠে। নিশিতা একটু রাগ করে বলে তাতে কী হয়েছে? মিলা একটা চোখে টিপুনি দিয়ে বলে,
" আরে আমাদের নতুন স্যার কিন্তু জোশ!"
" ছিঃ উনি আমাদের শিক্ষক। এসব বলিস না তো।"
" আরে ধুরর এত ন্যাকামি করিস না তো। আহনাফ স্যারের বিয়ে হয়নি এখনো। "
নিশিতা ঠিক কী বলবে তাদের বুঝতে পারছে না। এগুলো কী মেয়ে? এতটা নির্লজ্জ! নিশিতা আর কথা বাড়ায় না তাদের সাথে। এরমধ্যেই আহনাফ স্যারও ক্লাসে প্রবেশ করেন। সবাই একেবারে চুপ হয়ে গেছে। তিনি সবার সাথে হাসি মুখে কথা বলে ক্লাস শুরু করেন। নিশিতা আজ একটু আহনাফ স্যারের দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখে। আসলে কী এমন মহাপুরুষ যে মেয়েগুলো এমন বেহায়াপনা করছে? তেমন কিছু স্পেশাল দেখলো না নিশিতা। আসলে দুনিয়ার সবার দেখার ভঙ্গি তো এক নয়। তাহলে এক জিনিস নিয়ে খুনাখুনি হয়ে যেতো! নিশিতার এসব ভাবনার ছেদ ঘটে তার ফোনের ভাইব্রেটের শব্দে। বাসা থেকে কল করেছে মাইশা ইসলাম। নিশিতা হালকা করে কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে উনি বলে উঠেন বিকেলে পাত্র পক্ষ না-কি তাকে দেখতে আসবে তাই পার্লার থেকে একেবারে সেজেগুজে আসতে। নিশিতার মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে মহিলার কথা শুনে। ক্লাসের সময় কল! তার ওপর কী না-কি সংবাদ? পাত্রপক্ষ আসবে তাদের জন্য পার্লারে গিয়ে সং সাজতে হবে। "যাদের ভালো লাগার এমনি লাগবে এত আটা ময়দা লাগিয়ে সুন্দরী হওয়ার কোন দরকার নেই।"
নিশিতা বিড়বিড় করে এসব বলছে। এমন সময় আহনাফ তাকে দমক দিয়ে বলে ক্লাসে বসে কী মন্ত্র আওড়াচ্ছে? নিশিতা ঠিক এর জবাবে কী বলবে বুঝতে পারছে। 
" তোমার সমস্যা কী? কালকে আসলে ক্লাসে দেরি করে? আজ আবার একা একা কথা বলছো? হোয়াট ইজ দিস নিশিতা?"
" স্যার আই এম স্যরি। পরবর্তীতে আর এমন কিছু হবে না। "
আহনাফ আর কিছু বলে না। লেকচার শেষে নিশিতার দিকে তাকাতে তাকাতে ক্লাস থেকে বের হোন। নিশিতা বেশ বুঝতে পারছে উনি যথেষ্ট রেগে গেছেন ওর উপরে । তাই এরপর থেকে স্যার যখনি ওর দিকে তাকাবে ও একেবারে চোখে চোখ রাখবে না বলে চিন্তা করে। ক্লাস শেষে নিশিতা কলেজ থেকে বের হওয়ার সময় আবারও সেই মিষ্টি সুগন্ধি অনুভব করে। তবে সেটা ওর মনের ভুল না-কি বাস্তব সেই নিয়ে তার সন্দেহ আছে। 

বিকেল বেলা,

বসার রুমে ইতোমধ্যে রনির পরিবারের সবাই বসে আছেন। সাথে নিশিতার বাবা ও ভাই রেহানও আছে। গতকাল রাতেই রনির বাবা সরাসরি নিশিতার বাবার সাথে কথা বলেন। নিশিতার পছন্দ জেনে জহিরুল ইসলাম আর দ্বিমত পোষণ করেননি। তাই আজ বিকেলেই নিশিতাকে আনুষ্ঠানিক ভাবে দেখতে এসেছেন উনারা। নিশিতা বেশি সাজগোছ পছন্দ করে না। তাও একটু তো সাজতে হয়! রনির পছন্দ মতো একটা নীল শাড়ির সাথে লাল রঙের ম্যাচিং ব্লাউজ পড়েছে। সাথে খোঁপায় লাল গোলাপ! চোখে গাঢ় কালো কাজলের সাথে সরু করে আইলাইনার ব্যবহার করেছে। লাল রঙের চওড়া লিপস্টিক যেন ঠোঁটের কোণের তিলের সৌন্দর্য দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। নিশিতা রেডি হয়ে নাস্তা নিয়ে বসার ঘরে পৌঁছায়। রনির বাবা-মা'কে সালাম করে। রনির মা নিশিতাকে রনির পাশের চেয়ারে বসতে বলে। নিশিতা মাথা নিচু করে গিয়ে রনির পাশের চেয়ারে বসে। 



চলবে.........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন