পাতা বাহার - পর্ব ২০ - বেলা শেখ - ধারাবাহিক গল্প


আইসক্রিম ছোট বড় প্রায় সকলেই পছন্দ করে।‌ আইসক্রিম পছন্দ না এমন মানুষ কমই আছে। বাচ্চাদের আইসক্রিম সবচেয়ে পছন্দনীয় খাবার। যতই দাও না নেই এক্ষেত্রে! ভোরেরও আইসক্রিম বেশ পছন্দ। তাই তো বর্ষা ভোরকে নিয়ে একটা আইসক্রিম পার্লারে এসেছে। এটা স্কুল থেকে একেবারে কাছে ‌। অপরাহ্নের দিকে হওয়ায় ভিড় তেমন নেই। হাতে গোনা কয়েকজন। তার অধিকাংশই বাচ্চারা। আর তাদের গার্জিয়ান। বর্ষা ভোরের পাশ ঘেঁষে বসে। কখনো কখনো মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ভোর আইসক্রিম মুখে পুরে তার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে দিচ্ছে আর এটা ওটা জিজ্ঞেস করছে। তার মায়ের সাথে বসে আইসক্রিম খেতে খুব ভালো লাগছে। মায়ের অল্প আদর পেয়ে তার মনে হচ্ছে খুশিতে নাচতে! বর্ষার সামনে তার বর্তমান স্বামী শোয়াইব বসে। শোয়াইবের কোলে সাত মাসের ছেলে বাদল। ভোর তাদের সাথেও কথা বলছে মাঝে মাঝে। শোয়াইবের কোলের ছোট্ট বাচ্চার দিকে কুটুর কুটুর তাকিয়েও থাকে। শোয়াইব সেটা লক্ষ করে বলে,

-" বরুণ কি দেখছো ওমন করে? কোলে নেবে?"

ভোর মিষ্টি হেসে মাথা নাড়লো।

-" না না! ও তো এইটুকুন। আমি নিলে পড়ে যাবে। আঙ্কেল ওর নাম কি?"

বর্ষা ভোরের গাল টিপে বলে,

-" ওর নাম বাদল। তোমার ছোট্ট ভাই হয় সে!"

ভোরের কপাল কুঞ্চিত হয়। তার ভাই কিভাবে হবে? তবে সে জিজ্ঞেস করে না। 

-" মা আমার সাথে বাড়িতে যাবে? চলো না মা? অনেক মজা হবে! আঙ্কেল আপনিও যেতে পারেন!"

বর্ষা ও শোয়াইবের চোখাচোখি হয়। শোয়াইব জানে বর্ষা ও অরুণের সম্পর্কে। বর্ষা বেশ কিছু দিন হলো ভোরের সাথে দেখা করার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েছিলো। একদম নাছোড়বান্দা টাইপ। সে মানা করে নি! করুক দেখা! তার প্রথম সন্তান! টান তো থাকবেই! সেও তো জেনেশুনে ভালোবেসেই বিয়েটা করেছে। তার কাছে পাস্ট ম্যাটার করে না। পাস্ট সবারই থাকে। সে ভোরের স্কুলের খোঁজ নিয়ে দেখা করতে আনে বর্ষাকে।

-" ভোর যাবো তো! তোমার আব্বু বকবে না ?"

ভোর মিষ্টি হেসে আইসক্রিম মুখে পুরে মাথা নাড়ে। বকবে না। শোয়াইব হাসে। বর্ষা ভোরের মাথায় পুনরায় হাত বুলিয়ে আইসক্রিম পার্লারের ফ্রন্ট সাইডে তাকায়। কেউ একজন হন্তদন্ত হয়ে আসছে।তার চিনতে অসুবিধা হয় নি। অরুণ সরকার! একটু আগেই তো কল করে আসছে বললো। এতো জলদি আসবে ভাবে নি সে!

অরুণ আইসক্রিম পার্লারের ভেতরে প্রবেশ করে। পাতা তার পিছনে। সে হাঁপিয়ে গেছে। এই লম্বা উঁচু আঁটসাঁট ষাঁড় হাটে তো না, মনে হয় দৌড়ের প্রতিযোগিতা দিচ্ছে। সে বড় বড় পা ফেলেও ধরতে পারে না। একপ্রকার দৌড়েই এসেছে। কাঁধ মনে হয় ভেঙে গেল ভারি ব্যাগে। অরুণ ছেলেকে দেখতে পেয়েই সেদিকে এগিয়ে গিয়ে 'ভোর' বলে ডাক দিলো। ভোর বাবার আওয়াজ পেয়ে খুশি হয়ে পিছনে ফিরে । বাবাকে দেখে চটজলদি চেয়ার থেকে নেমে বাবার দিকে খানিক এগিয়ে হাসিমুখে বলে,
-" আব্বু দেখ মা আম.."

আর বলতে পারল না। অরুণ ঠাস করে তার নরম গালে শক্ত চড় বসিয়ে দিলো। পাতা কেঁপে উঠল চরের শব্দে। শোয়াইব নীরব দর্শক।ভোরের গাল মনে হয় জ্বলে গেল। বর্ষা এগিয়ে এসে ভোরকে জড়িয়ে ধরে‌ ‌।ভোর শব্দ করে কেঁদে দিলো। ভোরকে বর্ষাকে জড়িয়ে ধরতে দেখে অরুণ আরো রেগে গেল। ভোরকে উদ্দেশ্য করে ধমকে বললো,

-" তোমাকে খুঁজে খুঁজে হয়রান আমরা! কোথায় না খুঁজেছি! স্কুলের প্রত্যকটা আনাচে কানাচে! দম বন্ধ হয়ে আসছিলো আমার! আর তুমি এখানে বসে আইসক্রিম খাচ্ছিলে?

বলেই আবার ভোরকে ধরতে নিলে পাতা তার বাহু ধরে আটকায়।

-" ছোট বাচ্চা! ওত বুঝ আছে নাকি ওদের।"

অরুণ সরকার দমে না। বড় বড় শ্বাস নিয়ে রাগি চোখে বর্ষার দিকে চায়‌। বর্ষা ভোরকে কোলে তুলে চোখ মুছে দিয়ে অরুণকে বলে,

-" অরুণ পাগল হয়ে গেছ? ছোট বাচ্চাটাকে মারলে কেন?"

অরুণ হাতের মুঠি শক্ত করে। পাতা এখনো তার বাহু ধরে আছে। এই লোকটার এটা হাত নাকি সিমেন্টের খুঁটি! কি শক্ত রে বাবা! অরুণ ভোরের ক্রন্দনরত মুখের দিকে চেয়ে বলে,

-" আমার ছেলে আমি মারবো কাটবো যা খুশি করবো! তার কৈফিয়ত নিশ্চয়ই তোমাকে দেবো না? যাস্ট লিভ মায় চাইল্ড!"

ভোর ভয় পেয়ে মায়ের ঘারে মুখ লুকিয়ে রাখে। বর্ষাও দমে না। চিল্লিয়ে বলে,

-" ছেলে তোমার একার না! আই এম ওলসো হিস মাদার!"

-" শুধু জন্ম দিলেই মা হওয়া যায় না। ভোর কাম ট্যু মি রাইট নাও!"

শক্ত গম্ভীর কণ্ঠে বলে ওঠে অরুণ। ভোর কেঁদে কেঁদে বলে,

-" মা আমি তোমার সাথে থাকবো।আব্বুর কাছে যাবো না!"

অরুণের বুকটা যেন খালি হয়ে গেল। হৃদস্পন্দন থেমে গেলো কি? কি বললো ভোর? বর্ষা ছেলেকে জড়িয়ে অরুণকে বলল,

-" অরুণ তুমি বসো! রাগারাগী করো না। আমরা বসে কথা বলি কেমন? ছেলেটা ভয় পাচ্ছে তোমাকে!"

অরুণ পাতার দিকে চায়! পাতা কি বলবে? পাতা ইশারা করে শান্ত হয়ে বসতে। অরুণ শান্ত হয় না। ঘার ফিরাতেই টেবিলের ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা শোয়াইবের দিকে নজর যায়। যার কোলে একটা বাচ্চা। অরুণের ভ্রুযুগল কুঁচকে যায়। এই মালটা আবার কে? অরুণের মনে উদয় হওয়ার প্রশ্নের জবাব দেওয়ার জন্য শোয়াইব এগিয়ে আসে। 

-" আমি শোয়াইব। বর্ষার হাসবেন্ড।আর এটা আমাদের ছেলে বাদল! আপনি বসুন? আপনার রেগে যাওয়ার যথার্থ কারণ আছে। আমাদের ইনফর্ম করে ভোরকে আনার দরকার ছিলো! উই আর স্যরি! এন্ড হু ইজি সি?"

পাতাকে ইশারা করে বলে শোয়াইব। অরুণ পাতার হাত থেকে নিজের বাহু ছাড়িয়ে নেয়‌।একবার বর্ষার দিকে তাকিয়ে শোয়াইবের গালে ঠাস করে থাপ্পড় বসিয়ে বলে,

-" আপনার স্ত্রীকে বলবেন আমার বাচ্চার থেকে দূরে থাকতে। এতেই তার মঙ্গল!"

বলে ভোরের দিকে তাকিয়ে পাতার উদ্দেশ্যে বলে,
-" মিস পাতাবাহার? ভোরকে নিয়ে আসুন জলদি! আমি বাইরে ওয়েট করছি! ফাস্ট!"

বলেই পা বাড়ায়। শোয়াইব আহম্মক হয়ে দাঁড়িয়ে। তাকে মারলো কেন? ছোট বাচ্চা বাদল পিট পিট করে চেয়ে হেসে দিলো।

বর্ষার রাগ তরতর করে বেড়ে গেল। সে চিল্লিয়ে বললো,

-" অরুণ হাউ ডেয়ার ইউ? শোয়াইবকে মারলে কেন তুমি? দাঁড়াও বলছি অরুণ?"

অরুণ দাঁড়ায় না‌‌ আইসক্রিম পার্লার থেকে হন হন করে বেড়িয়ে যায়। পাতা চোখ বড়বড় করে চেয়ে আছে এখনো! এই ক্ষ্যাপাটে ষাঁড় মারলো কেন এই লোকটাকে? তারপর ভাবে প্রাক্তন প্রেমিকা প্লাস স্ত্রীর বর্তমান হ্যান্ডসাম হাসবেন্ড দেখে হয়তোবা জেলাসির ঠেলায় মেরে দিয়েছে! কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো তাকে ফাঁসিয়ে গেলো কেন? সে কিভাবে ভোরকে নিয়ে যাবে? তাকে না আবার এই মহিলা লাগিয়ে দেয় ঠাস ঠাস! কেমন করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। পাতা হে হে করে হাসি দিলো তার উদ্দেশ্যে। বর্ষা চোখ রাঙিয়ে বলে,

-" হাসছো কেন? জোকস চলছে? কে তুমি? অরুণের কি হও?"

ভোর এতক্ষনে মাথা তুলে। দু হাতে চোখ মুছে বলে,

-" মা উনি মিস পাতা। আমার টিচার!"

বর্ষা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে চায়। পাতা কি বলবে বুঝতে পারে না। তবে এর মধ্যে আরেক কান্ড ঘটে যায়‌। শোয়াইব ছেলেকে কোলে নিয়ে হন হন করে বেরিয়ে যায়। বর্ষা তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে। ভোরকে টেবিলে বসিয়ে দিয়ে তার পিছু যেতে নিলে ভোর মায়ের হাত টেনে ধরে।

-" মা আমিও যাবো তোমার সাথে?"

বর্ষা তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

-" সেটা তো হয় না বাবা! তুমি তোমার আব্বুর কাছে যাও! যখনই আমার কথা মনে পড়বে! কল দিও!ভালো থেকো সোনা! "

বলে গালে চুমু দিয়ে চলে যায়। ভোর তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলে। তার ছোট মনে বুঝতে বাকি থাকে না মা তাকে সাথে নিতে চায় না! তার চোখ পুনরায় ভরে ওঠে অশ্রুতে। বর্ষা চলে গেলে পাতা ভোরের কাছে আসে। আঁচল দিয়ে চোখ মুখ মুছে দিলো। ভোর কিছু বলে না। পাতা তার মাথার চুল গুলো ঠিক করে দিয়ে বলে,

-" চল? তোমার আব্বু ওয়েট করছে তোমার জন্য!"

ভোর তার দিকে চায়।

-" আমি যাবো না আব্বুর কাছে। আব্বু শুধু মারে আর বকা দেয়! থাকবো না তার সাথে। তুমিও চলে যাও ?"

পাতা ভোরের গালে হাত দেয়, যেখানে তার বাবা চড় মেরেছে। গালটা লাল টকটকে হয়ে আছে। ফুলে গেছে খানিকটা।বেশ জোরেই লাগিয়েছে। 

-" তোমার আব্বু তোমাকে খুঁজে না পেয়ে অস্থির হয়ে পড়েছিলো। পারে না কেঁদে দেয়! তাই রাগের মাথায় মেরেছে! একটু পরে আদরো করবে!"

ভোর আবার কেঁদে দিলো।

-" লাগবে না আদর আমার। তুমি যাও তো এখান থেকে! ভালো লাগে না। সরো!"

বলেই ঠেলে দেয় পাতাকে। পাতা অসহায় বোধ করে। ইশ ছেলেটা কত কষ্ট পেয়েছে? 

এতক্ষণ আইসক্রিম খেতে আসা কাস্টমার , ম্যানেজার,ওয়েটার সহ সকলেই হা করে তামাশা দেখছিল ফ্রিতে। ফ্রিতে এরকম এন্টারটেইনমেন্ট কয়জনই বা দেয়। সবাই চলে গেলে ম্যানেজার ওয়েটারকে ইশারায় বলে বিলের কথা। ওয়েটার মাথা নেড়ে টেবিলে যায়‌, পাতার দিকে বিল বাড়িয়ে দিলো। পাতার কপালে ভাঁজ পড়ে। বিল পেপার হাতে নিয়ে তার চোখ কপালে। হাজার বারোশো টাকা। কেউ বিল পে করে যায় নি? আইসক্রিম খেয়েছে হাপুস হুপুস ওথচ বিল পে করার কথা মনে নেই ? এখন কি তাকে পে করতে হবে? সে অসহায় চোখে ওয়েটারের দিকে চায়। ওয়েটার তার দিকেই চেয়ে। তার চাহনি বলছে বিল তাকেই পে করতে হবে! পাতা ব্যাগ হাতরে বারোশো টাকা বের করে তাকে দিলো। ওয়েটার ' থ্যাংক ইয়ু ম্যাম' বলে চলে গেলো। পাতা কাঁদো কাঁদো চাহনিতে ভোরের দিকে চায়। তার বারোশো টা জলে চলে গেল! টেবিলে পড়ে থাকা আইসক্রিমের দিকে একনজর দেখে ভোরকে কোলে তুলে নিলো। ভোর চুপচাপ তার গলা জড়িয়ে। কোনো বাহানা করলো না। এতো বড় বাচ্চাকে কোলে নিয়ে হাঁটা যায়! পাতা অনেক কষ্টে হেঁটে বেরিয়ে আসে। অরুণের গাড়ি রাস্তার পাশেই পার্ক করা। পাতা সেখানে গেলেই অরুণ পেছনের দরজা খুলে দিলো। পাতা এক পা গাড়িতে রেখে ভোরকে বসাতে চায়‌। ভোর পাতাকে ছাড়ে না‌। আষ্টে পিষ্টে জড়িয়ে ধরে। পাতা ছাড়াতে নিলেও পারে না। অরুণ ব্যাপারটা লক্ষ্য করে পাতাকে উদ্দেশ্য করে গম্ভীর মুখে বলে,

-" মিস পাতাবাহার? আপনিও উঠে বসুন? আপনার স্কুটার আছে সাথে?"

-" না! ওটা তো সার্ভিসিং -এ! আপনি ভোরকে নিন আমি সি এন জি নেবো!"

-" উঠতে বলেছি আমি!"

একপ্রকার ধমকেই বলে। পাতা আশ্চর্য বনে যায়। এই লোক কি দিয়ে তৈরি!

-" দেখুন আমি আপনার হুকুমের গোলাম নই যে আপনার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবো। আর এভাবে ধমকে কথা বলবেন না খবরদার! আমি যাবো না! আপনি ভোরকে নিন?"

অরুণ চশমাটা খুলে রাখে‌ পাতার দিকে কটমট চোখে তাকিয়ে বলে,

-" চুপচাপ উঠুন নইলে নেক্সট থাপ্পড় আপনার গালে! এমনিতেই আমার হাত একটু স্পিডেই চলে! এক্সামপল পেয়েছেন নিশ্চয়ই?"

পাতা ভোরকে ছাড়াতে চেষ্টা করে । ভোর আরো শক্ত করে চেপে ধরে।

-" মিস আমি তোমার সাথে যাবো। আব্বুর কাছে যাবো না!"

ভোরের মিনমিনে গলা পাতার কানে আসে‌। সে কি করবে? এদিকে এই গরমে ভোরকে কোলেও রাখা যাচ্ছে না। পাঁচ বছরের বাচ্চার ওজন আছে না? আর সে তো চুনোপুঁটির মতো! ফিট না খেয়ে বসে। দোনামোনা মনেই গাড়িতে উঠে বসে দরজা লাগিয়ে দেয়। অরুণ আড়চোখে তার দিকে চেয়ে। পাতা সেটা লক্ষ্য করে ফুঁসে ওঠে।

-" মি. ভোরের আব্বু আমি মোটেও আপনার হুমকিতে ভয় পাই নি! নেহাতই ভোর ছাড়ছে না তাই! নইলে আপনার মতো নাক উঁচু লোকের পাশে বসার কোনো ইচ্ছা নেই আমার!"

অরুণ সিটে গা এলিয়ে দেয়। সামনে ড্রাইভার ও ফ্রন্ট সিটে আভারি। পিছনে সে , পাতা ও ভোর। ভোর পাতাবাহারকে জড়িয়ে মুখ লুকিয়ে আছে এখনো। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,

-" বেশি বোঝেন আপনি!"

পাতা কিছু বলে না। জানালার পাশে আরেকটু ছেঁটে যায়। তার বেশ অস্বস্তি হচ্ছে। এভাবে অপরিচিত বড় লোকের গাড়িতে ওঠায়! অপরিচিতই তো মি. অরুণ সরকার!

গাড়ি চলমান। বেশ বেগেই চলছে। জানালার কাচ আধ খোলা থাকায় হাওয়া আসছে শা শা শব্দে! পাতা সিটে গা এলিয়ে সেদিকে চেয়ে আছে। ভোর এখনো তাকে জড়িয়ে জোঁকের মতোন একটুও ছাড়ছে না‌। ছাড়তে চাইলে আরো জাপটে ধরে। মাঝে মাঝে অস্পষ্ট স্বরে কিছু বিড়বিড় করছে। পাতা বা অরুণ কিছু বুঝতে পারে না। পাতার এবার খানিকটা বিরক্ত লাগে। আরে এভাবে কে ধরে!

অরুণ সামনে তাকিয়ে। মাঝে মাঝে আড়চোখে পাতা ও ভোরকে পর্যবেক্ষণ করতে ভুলে না।সে সামনে বসা আভারিকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-" বুঝলে আভারি ভাই? ছেলে কোলে পিঠে করে মানুষ করলাম আমি! আদর যত্নের কমতি রাখিনি এক ফোঁটাও অথচ মায়েকে দেখেই বাপকে ভুলে গেলো! এতো আদর করি মনে পড়ে না তার অথচ মারি বকি এটা মনে থাকে। আসবে না আমার কাছে! মায়ের সাথেই থাকবে সে! তো মা নিলো না তাকে সাথে? নিবে কি ! তার ভরা সংসার! স্বামী ছেলে!"

ভোর মাথা তুলে একবার বাবার দিকে চায়। অরুণের নজর সামনে। আভারি ভোরের দিকে চেয়ে। পাতার অরুণের জন্য খানিকটা খারাপ লাগে। সে বোঝানোর সুরে বলে,

-" ভোর ছোট! বুঝলে এমন করতো নাকি!"

অরুণ তার দিকে চায় শান্ত চোখে।

-" ছোটই তো! কিছু বোঝে না। তবে বাইরের মানুষকে বুঝাতে পারে যে আমি তাকে সবসময় মারি বকি!"

পাতা চোখ ছোট ছোট করে চায় তার দিকে।

-" আশ্চর্য! আপনি বাচ্চার বাবা হয়ে বাচ্চাদের মতো বিহেভ কেন করছেন? মাথা গেছে নাকি?"

অরুণ হাসে খানিক।

-" যায় নি মিস পাতাবাহার! আমি ঠিকই বলছি!"

-" আপনি বলেছেন ভোরকে মারেন না? বকেন না?"

অরুণ ভোরের দিকে তাকিয়ে বলে,

-" তাকেই জিজ্ঞেস করুন?"

পাতা ভোরের মাথাটা আজলায় ভরে মুখোমুখি আনে। কপালে চুমু দিয়ে বলে,

-" তোমাকে বকে? মারে তোমার আব্বু?"

ভোর আড় চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ে।

-" হুম"

পাতা অরুণের দিকে চোখ রাঙিয়ে বলে,

-" এতো সুন্দর সুইট কিউট বাচ্চাকে কেউ কিভাবে বকতে পারে? আপনি আবার মারেনও? এতো নিষ্ঠুর হৃদয়ের কেউ হয় নাকি! আপনার নামে শিশু নির্যাতনের কেস ঠুকে দিব বলে দিলাম?"

অরুণের ভ্রু যুগলের মাঝে রসিকতার ঢেউ খেলা করে। খেয়াল করে ভোর তার দিকেই চেয়ে।সে মুখ ফিরিয়ে জানালার বাইরে চায়।

-" তাই করুন। কেস করলে তো পুলিশ আমায় ধরে নিয়ে যাবে। সেখানে নিয়ে অনেক মারবেও! তখন ভালোই হবে!"

পাতার হাসি পায় অরুণের কথা শুনে। কেমন বাচ্চাদের মতো করে বললো। এখন কথাবার্তায় অহংকারের ছিটেফোঁটাও নেই। একদম নির্ভেজাল। ছেলের কথায় কষ্ট পেলেও রাগে তখন ছেলের গায়ে হাত তোলার জন্য যে বেশ অনুতপ্ত তার চেহারায় ভাসছে। ছেলের সাথে কথা বলার ছুতো খুঁজছে নাক উঁচু লোকটা।

ভোর মারের কথা শুনে পাতার কানে কানে মিনমিন করে বলে,

-" কেস করবে না মিস! ওরা আব্বুকে মারবে অনেক!"

পাতা ঠোঁট কামড়ে হাসি আটকিয়ে অরুণের দিকে চায়। অরুণ তার দিকেই কৌতুহল দৃষ্টিতে তাকিয়ে। সেও শুনেছে কিছুটা। পাতা তাকে ভেংচি কাটে।

-" তো ভালো হবে না? তোমার আব্বু তোমাকে মারে বকে ওরাও তোমার আব্বুকে বকবে মারবে! আমি তো অনেক খুশি হবো! তোমার তো খুশি হওয়ার কথা।"

অরুণ চোখ ছোট ছোট করে চায়। ভোর বাবার দিকে এক নজর তাকিয়ে পাতাকে ধীমে বলে,

-" আব্বুকে মারলো আব্বু কষ্ট পাবে। আব্বু কষ্ট পেলে আমারও কষ্ট হবে!"

অরুণের কানেও যায় কথাটা। প্রশান্তিতে ভরে যায় বিষাদগ্রস্ত হৃদয়। পাতা অরুণের দিকে আঙুল তাক করে বলে,

-" শুনেছেন ছেলের কথা! আপনার কষ্ট হলে সেও কষ্ট পায়। আর ছেলের কষ্টে আপনার হৃদয় কাঁপে না? শুনুন আর কখনো ছেলের গায়ে হাত তুললে আপনার হাত খানা ভেঙ্গে গলায় ঝুলিয়ে দিব!"

ভোর পাতার দিকে ড্যাবড্যাব করে চায়। অরুণের দৃষ্টি পাতার তাক করে রাখা আঙ্গুলের দিকে।

-" মিস পাতাবাহার! আঙুল নিচে!একটু আগের ঘটনার কথা নিশ্চয়ই আপনার মনে আছে? আমার হাতটা কিন্তু ফাস্ট চলে! কখন কার গালে‌পড়ে সাবধান!"

পাতা চোখ বড় বড় করে চেয়ে আঙ্গুল নামিয়ে নেয়।

-'' আপনি আমাকে মারার হুমকি দিচ্ছেন?"

-" নাহ সাবধান করছি!"

চটজলদি উত্তর। পাতা বিরক্তিকর শ্বাস ফেলে বিড়বিড় করে বলে,

-" নাক উঁচু ম্যানারলেস লোক কোথাকার!"
.
.
.
চলবে........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp