#আরোরা (সিজন ২)
#পর্ব_৫
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
দু'দিন কেটে গেছে এরমধ্যে। আজ পূর্ণিমা! অথচ আরোরাকে সবকিছু জানাতে পারেনি সেলিন। এই দু'টো দিন কীভাবে যে নিক আর আলেক্সাকে সহ্য করেছে সেলিন তা কেবল ও জানে। ভয় লাগছিল, ঘৃণা হচ্ছিল। তবুও হাসি মুখে কথা বলতে হয়েছে।
এডওয়ার্ডের পাশেই সারা রাত বসেছিল। খাবারে বিষক্রিয়া হওয়ার ফলেই আজ এই অবস্থা ওর। কিন্তু কে খাবারে বিশ মেশালো সেই নিয়ে পুরো প্রাসাদে গুঞ্জন ভেসে বেড়াচ্ছে। সবাই আরোরাকেই দোষারোপ করছে। শুধুমাত্র ম্যাক, সাঁচি আর জোহানসন আরোরার পক্ষে। এডওয়ার্ডের মা ছেলের এই পরিণতির জন্য আরোরাকে অনেক কথাও শুনিয়েছেন। কিন্তু আরোরা কিছু বলেনি, শুধু এডওয়ার্ডের সুস্থ হওয়ার অপেক্ষা করছে। যদিও এই বিষক্রিয়ায় এডওয়ার্ড মারাও যেতে পারে। এমনকি অচেতন থাকবে মৃত্যুর আগপর্যন্ত । কারণ এটা কোনো সাধারণ বিশ নয়। রসুনের তরল মিশ্রিত ছিলো বিষের সাথে। ভ্যাম্পায়ারদের জন্য রসুন খুবই ক্ষতিকর।
" তুমি এখনো এখানে বসে থাকবে আরোরা? আমার পুত্রকে আধমরা করেও শান্তি হয়নি তোমার? পুরোপুরি প্রাণে মারতে চাইছো এখন? "
আচমকা হেলগার আগমনে হকচকিয়ে গেল আরোরা। এই নিয়ে চারবার এককথা শুনলো। সারা রাতে আরো তিনবার এসেছিলেন আরোরাকে ঘর থেকে বের করে দিবেন বলে। কিন্তু আরোরা যায়নি, জেদ করে বসে ছিলো। কিন্তু এখন যাওয়ার সময় হয়েছে। আজ পূর্ণিমা! আজই পাতালপুরীতে সেই সঞ্জীবনী প্রকট হবে। সেখান থেকে একফোঁটা সঞ্জীবনী এডওয়ার্ডকে খাইয়ে দিতে পারলে ও নিশ্চিত ভালো হয়ে যাবে।
" আমি যতক্ষণ ফিরে না আসছি মা, ততক্ষণে আপনি আপনার ছেলের সাথে থাকুন।"
বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো আরোরা। চমকাল হেলগা। কী বলছে মেয়েটা এসব? মাথা গেছে না-কি সব অভিনয়! হেলগা কিছু বলার আগেই আরোরা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। একটু ভাবলেন তিনি আরোরার কথা। কিন্তু পরমুহূর্তে এডওয়ার্ডের পাশে বসলেন। সুস্থ সবল ছেলের এমন শয্যাশায়ী অবস্থা দেখে দু-চোখ ছলছল করছে হেলগার।
বিকেলের ম্লান রোদে নিজ কক্ষের বারান্দায় দাঁড়িয়ে পায়চারি করছে সেলিন। আজ কী হবে সেই নিয়ে নানান চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে মস্তিষ্কে। ওদিকে নিক আর আলেক্সা পরিকল্পনা করেছে কীভাবে নিজেরা অমৃত দখল করবে। আরোরাকে গুটি করে নিজেরাই দখল করে নিবে সেই সঞ্জীবনী। হঠাৎ ভাবনার ছেদ ঘটলো সেলিনের। দূর থেকে ধূলো উড়িয়ে দ্রুতবেগে ছুটে আসছে শুভ্র রঙের নেকড়ে। সেলিন উত্তেজিত হয়ে উঠলো। দ্রুত দৌড়ে প্রাসাদের মূল ফটকের দিকে এগোতে লাগলো। যে করে হোক এখুনি আরোরাকে সবকিছু বলতে হবে। এই শয়তানেরা বিশ্বাসকে পুঁজি করে আরোরাকে ঠকাচ্ছে এসব কিছু, সবকিছুই জানাতে হবে।
সন্ধ্যাবেলা গুলিন ঘরের সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। না ঠিক দাঁড়িয়ে নয় মাঝে মধ্যে পায়চারি করছে। এনার সন্তান প্রসবের সময় হয়ে গেছে। ঘরে ধাইমা ফ্লিজা আছেন। স্ত্রী'র কষ্ট সহ্য হচ্ছে না গুলিনের। ভীষণ ভালোবাসে যে! তাই বারবার ঘরের দরজায় টোকা দিয়ে কী অবস্থা খোঁজ নিচ্ছে। কিন্তু মেয়েটার এই কঠিন সময় ওর বোন পাশে নেই ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে গুলিনের। কিন্তু আরোরার কী হলো? সপ্তাহখানেক আগেও তো এসেছিল। তখুনি তো এনা বলেছিল সময় হয়ে এসেছে। তবুও কেনো এলোনা!
" গুলিন বেটা ঘরে এসো। "
ফ্লিজার কণ্ঠে নড়েচড়ে উঠলো গুলিন। মাঝবয়েসী ফ্লিজার তিনকুলে কেউ নেই। একমাত্র বোনের মেয়েকে নিয়ে তার সংসার। বোন অনেক আগেই পরলোকগমন করেছেন।
" ধাইমা কী হয়েছে? এনা ঠিক আছে? "
ব্যতিব্যস্ত হয়ে শুধালো গুলিন। ধাইমা হেসে বললেন,
" তোমাদের পুত্র সন্তান হয়েছে গুলিন। এনা সুস্থ আছে। ভেতরে এসো এখন।"
গুলিন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। এতো খুশি লাগছে যা গুলিনের চোখেমুখেই প্রকাশ পাচ্ছে।
" চলুন, চলুন।"
এনা চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। ভালো চেতনা নেই। তবে সব কথা শুনতে পাচ্ছে। পাশেই শুইয়ে রাখা হয়েছে সদ্যজাত শিশুটিকে। ধাইমা তাকে বুকের দুধ খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়ে গিয়েছিল সে আপাতত খেতে ব্যস্ত। পৃথিবীতে ভূমিষ্ট হতেই এতো কান্নাকাটি করছিল সে অথচ মায়ের পাশে শুয়ে মুখে খাবার দিতেই একেবারে চুপটি হয়ে গেছে। গুলিন জোরেশোরে পা চালিয়ে ওদের কক্ষের এসেছে। ধাইমা ধীরপায়ে আসছে। এনার পাশে ছোট্ট প্রাণটিকে দেখে ঠোঁটের কোণের হাসি প্রসস্থ হলো গুলিনের।
“ এনা তুমি ঠিক আছো?"
স্ত্রীর পাশে বসে জিজ্ঞেস করলো গুলিন। এনা চোখ বন্ধ করেই মাথা নাড়লো। নবজাতকের দিকে তাকিয়ে গুলিনের চোখ ছলছল করছে আনন্দে। ধাইমা এসে দাঁড়িয়েছেন।
" এখুনি কোলে নিবে না ছেলেকে। আগে ভালো করে হাত ধুয়ে এসো। বাইরে ছিলে। "
" ঠিক আছে, আমি এখুনি আসছি।"
গুলিন তাড়াতাড়ি গিয়ে একেবারে গোসল সেড়ে নতুন পোশাক পরে আসলো ছেলেকে কোলে তুলে নেওয়ার জন্য। অবশেষ নিজের অংশকে কোলে তুলে নিলো গুলিন। ছোটো ছোটো চোখগুলো দিয়ে পিচ্চি তার বাবাকে দেখছে। গুলিন ছেলের হাতে হাত রেখে হাসছে শুধু।
উলফ প্রাসাদ থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে আরোরা, নিক, আলেক্সা, হেক্সা। আর মাত্র কিছু সময়ের অপেক্ষা। একটু পরেই পাতালপুরীর দরজা খুলবে। আরোরার স্পর্শে মৃত্তিকা ভাগ হয়ে সেই রাস্তা তৈরি হবে।
" আর কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে রাজা নিক?"
আরোরা নিককে জিজ্ঞেস করে। নেহাৎ সম্মানের জন্য এখনো রাজা বলেই সম্মোধন করে ও।
" চাঁদ তো বলছে সময় এসে গেছে। তুমি মাটি স্পর্শ করো।"
আরোরা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে নিচু হয়ে বসে ডানহাত দিয়ে মৃত্তিকা স্পর্শ করে। কিয়ৎক্ষণ অতিবাহিত হতেই ধরণী যেনো কেঁপে উঠল। জায়গা চ্যুত হয়ে মাটিতে ছিটকে পড়লো আলেক্সা। পাতালপুরী যাওয়ার রাস্তা দৃশ্যমান হয়েছে সবার সামনে। আরোরা হাসলো। আজ এই সঞ্জীবনী এডওয়ার্ডের প্রাণ বাঁচাতে খুব খুব দরকার ওর।
" হয়ে গেছে! "
" হ্যাঁ। এবার তুমি প্রবেশ করো। সোজা রাস্তায় চলে যাবে। একটা অশ্বত্থ গাছ দেখতে পাবে সেখানে। সেই গাছের নিচেই সোনার কলসিতে দৃশ্যমান হবে সঞ্জীবনী। "
" ঠিক আছে রাণী হেক্সা। আমি যাচ্ছি। "
" এসো আরোরা।"
সবাইকে বিদায় জানিয়ে আরোরা ধীরপায়ে পাতালে প্রবেশ করতে লাগলো। ধীরে ধীরে মাটির নিচে অদৃশ্য হয়ে যেতে লাগলো মেয়েটা। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। তবুও সামনে এগিয়ে যাচ্ছে আরোরা। কারণ অন্ধকারেও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সবকিছু। কেমন ভ্যাপসা গন্ধ এসে ঠেকছে নাকে। সূর্যের আলো পৌঁছে না এখানে। তাছাড়া বহুযুগ আগেই রাক্ষসদের বিনাশ হওয়াতে এখন এই পাতালপুরী পরিত্যক্ত।
" আর কিছু সময়ের অপেক্ষা হেক্সা! "
উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললো নিক। আলেক্সার ঠোঁটের কোণেও হাসি ফুটে উঠেছে। হেক্সা নিককে বলে,
" হ্যাঁ! আরোরা তো জানেই না আমরা কী মতলব এঁটেছি ! "
" একদম। বেচারিকে বলেছি পাতালে বসে সঞ্জীবনী পান করা যাবে না। সেজন্য বাইরে আসার আগ পর্যন্ত নিশ্চিত ও পান করবে না।"
" এতটা বিশ্বাস করে আপনাকে। আপনি কীভাবে পারছেন এসব?"
হেক্সা কথাটা শেষ করতেই সবাই একসাথে হো হো করে হেসে উঠলো। আলেক্সা বিদ্রুপের হাসি হেসে বলে,
" বেচারি আরোরা!"
চলবে..........................