রনির বাবা-মা নিশিতাকে আনুষ্ঠানিকভাবে দেখে এসে বিয়ের তারিখ ঠিক করেন। নিশিতার ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষার পর দুজনের শুভ পরিণয় ঘটবে। উভয় পরিবারের সবাই খুশি। মাইশা ইসলাম যদিও একটু বেখাপ্পা স্বভাবের মহিলা কিন্তু রেহান ও নিশিতাকে সব সময় নিজের ছেলে মেয়ের মতোই ভালোবাসেন। তাইতো নিজে কখনো সন্তান নেননি। নিশিতা আর রেহানও একইভাবে তাকে মায়ের জায়গায় বসিয়েছে। তবে সব সময় তো চোখের সামনে থাকা ব্যাপারগুলোও সত্যি হয় না! নিশিতার পরিবারকে হাসি মুখে বিদায় জানিয়ে সন্ধ্যার আগেই রনির বাবা-মা চলে যান।
গোধূলির লাল আভা এখনো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আকাশের বুকে। রনি গাড়ি ড্রাইভ করছে আর ওর বাবা-মা পেছনের সিটে বসে বিয়ে নিয়ে বিভিন্ন ধরনের আলাপ আলোচনা করছেন। রনি মনে মনে এত খুশি আগে কখনো হয়েছে বলে মনে হয় না তার। অবশেষে তার প্রেয়সীকে নিজের করে পাবে। ভাবতেই অন্য রকম ভালো লাগা কাজ করছে ছেলেটার মনে। এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ রনি অনুভব করে গাড়ি নিয়ন্ত্রণে নেই। মুহূর্তেই রনি ভয়ে তার বাবা-মা'কে শক্ত করে বসতে বলে। একটু সময়ের মধ্যেই প্রবল আতংকে গলা শুকিয়ে যাওয়ার অবস্থা হয় সবার। রনি কিছুতেই বুঝতে পারছে না কীভাবে গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারালো। কারণ রনি আসার আগে গাড়ির সবকিছু দেখেশুনেই নিয়ে এসেছিলো।
" কী হলো রনি? তোকে বলেছিলাম অনেক দূরের পথ,গাড়ি দেখেশুনে নিবি?"
" মা আমি তো দেখেই নিয়েছিলাম! "
" আমি তো সব দেখে এসেছিলাম। ভয় পেও না, আল্লাহকে স্মরণ করো। তকদিরে যা থাকে তাই হবে।"
রনি কোনোভাবেই গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। অবশেষে যখন বুঝলো আর বাঁচা সম্ভব না, তখন রনি গাড়ির স্টিয়ারিং ছেড়ে দোয়া-দুরুদ পড়তে শুরু করে। কিন্তু হঠাৎ করে অদ্ভুতভাবে গাড়ি আপনাআপনি থেমে যায়। ব্যাপারটা নিয়ে সবাই একটু অবাক হলেও বিপদের হাত থেকে বেঁচেছে সেই চিন্তা করে বাকিসবকে উপেক্ষা করে। রনির বাবা-মা ও রনি গাড়ি থেকে নেমে বাসে করে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। আর গাড়িটাকে রনি আসার আগে স্থানীয় একটা গ্যারেজে রেখে আসে।
শহর থেকে একটু দূরে হালকা জঙ্গলের মতো জায়গায় বসে আছে সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত এক যুবক। সম্ভবত তিনি জিকির-আসগর করেছেন। এমন সময় পেছন থেকে তাকে উদ্দেশ্য করে কেউ বলে উঠে,
" মেহেরাব কাজটা কিন্তু ঠিক করছেন না আপনি। "
সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত লোকটার নাম মেহেরাব। পেছনে থাকা ব্যক্তির কথার প্রত্যুত্তরে তিনি বলেন,
" আপনি কী ঠিক করছেন? আপনি কেনো মানুষের জীবনে গিয়ে এরকম বাঁধা সৃষ্টি করবেন! "
" সেটা আমার ইচ্ছে। আমি তো আপনাদের মতো উচ্চ বংশের কেউ নই।"
" দেখুন বংশ যাইহোক আমরা এক জাতি। আপনি যদি নিশিতাকে বিরক্ত করা বন্ধ না করেন তবে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না। "
" সেটা দেখা যাবে। "
হুজায়ফা আর কিছু না বলে কালো ধোঁয়ার কুন্ডলির মধ্যে উধাও হয়ে গেছে। মেহেরাব ঠিক বুঝতে পারছে না কেন হুট করে হুজায়ফা এমন করা শুরু করেছে! মেহেরাবও তার বিশাল ডানা মেলে আকাশে উড়ে যায়।
দেখতে দেখতে নিশিতার ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে। কলেজে বসেও নিশিতার উপর দুইবার আক্রমণ করেছিল কালো ছায়াটা। তবে যতবারই সে সমস্যার মধ্যে পড়ে কোনো এক শুভ শক্তি তাকে বাঁচিয়ে রাখে। এই কয়েকমাসে অনেক বাজে ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিল রনি ও নিশিতা। একদিন তো রনি প্রায় ছাদ থেকে পড়ে যাচ্ছিল! কিন্তু আল্লাহর কুদরতে কোনো শুভ শক্তি তাকে টেনে উপরে তুলে নিয়ে আসে। আর নিশিতার তো প্রায় রাতেই দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। এতকিছু ঘটার পর রনির মা নিশিতার সাথে বিয়ে দিতে অসম্মতি জানিয়েছেন। তিনি না-কি এক হুজুরের কাছে গিয়ে সমস্ত ঘটনার কথা খুলে বলেছিলেন। তিনি বলেছেন নিশিতার উপর বদ জ্বীনের নজর আছে। আর সে রনিকেও মারতে চায়। নিশিতার সাথে কোন পুরুষেরই সে বিয়ে হতে দিবে না। তবে রনি এসব শুনেও বিশ্বাস করেনি। তার মতে এসব কুসংস্কার ছাড়া আর কিছু নয়। যা ঘটছে সব কাকতালীয়। নিশিতা আগে অবিশ্বাস করলেও এখন আর অবিশ্বাস করতে পারছেনা সবকিছু। তাই নিজে থেকেই রনির থেকে দূরে সরে যাবার সিন্ধান্ত নিয়েছে মেয়েটা। কিন্তু রনি নিশিতাকে বারবার বুঝিয়েছে বিয়েটা হয়ে গেলে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।
নিশিতা আর রনি কফিশপে সামনাসামনি চেয়ারে বসে আছে। নিশিতা নিশ্চুপ! কেমন জানি চেহারা তার দিন দিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। রনি দুই কাপ কফি অর্ডার করে।
" নিশিতা এরকম পাগলামি করো কেন? বিয়ে হয়ে গেলে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। "
" রনি তুমি বুঝতে পারছো না! ওই কালো অবয়ব তোমাকে ছাড়বে না। না ছাড়বে তোমার পরিবারকে।"
ওদের দুজনের কথার মাঝেই ওয়েটার কফি দিয়ে গেছে। রনি নিশিতার দু'হাতে হাত রেখে বলে ওর চোখের দিকে তাকাতে। সমস্যা যখন আছে তার সমাধানও নিশ্চয়ই আছে। তাই বলে নিজেদের মধ্যে এরকম করলে কী চলে? রনি অনেক করে বুঝিয়ে বলে নিশিতাকে। শেষমেশ নিশিতাও রনির আকুতি ফেলতে পারে না। বিয়ের জন্য রাজি হয়ে যায়।
২৫ শে জুন,২০২১
আজ শুক্রবার, রনি ও নিশিতার বিয়ে। রনির মায়ের অমত থাকলেও বিয়ে বয়কট করতে পারেননি উনি। তবে মন থেকে কিছুতেই সবকিছু মেনে নিতে পারছেন না পারুল। সকাল থেকে অনেক কাজকর্ম সেরে পারুল রনিকে নিজের ঘরে ডেকে পাঠিয়েছেন। রনি একটু চিন্তায় পড়ে গেছে সেই নিয়ে। কি-না কী বলেন উনি!
সামনাসামনি বসে আছে রনি ও তার মা।
" রনি আমি চাই হুজুর আমাদের সাথে তোমার বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগদান করুন। আশা করি তুমি এটাকে কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দিবে না! "
অন্য সময় হলে হয়তো রনি ঠিকই একটা মাথা নাড়া দিয়ে বলতো এসব বুজরুগি। কিন্তু এখন যেভাবে বিয়েটা ভালোয় ভালোয় হবে এটাই মেইন পয়েন্ট। তাই রনি মায়ের কথায় লক্ষ্মী ছেলের মতো হ্যাঁ বলে রুম থেকে চলে আসে।
নিশিতার বাড়িতে এত হৈচৈ বিগত কয়েক বছরে আর হয়নি। রেহান বোনের বিয়েতে খুব ব্যস্ত। খাবার-দাবার, বাড়িঘর সাজানো সব দায়িত্ব একাই নিয়ে নিয়েছে। দুপুরে যোহরের নামাজ শেষে বিয়ের অনুষ্ঠান। মাত্র একঘন্টা বাকি! নিশিতাকে এরমধ্যেই ওর বান্ধবীরা সাজিয়ে দিয়েছে। বউয়ের বেশে বসে আছে বিছানায়। পাশে বান্ধবীরা অনেক গল্প গুজব করছে। তার মধ্যে একজন বলে উঠলো,
" এই নিশিতা আহনাফ স্যারকে ইনভাইট করেছিস তো?"
" হ্যাঁ। করবো না কেন? কলেজের সব টিচারদের-ই করেছি। "
" তবে একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছিস তোরা?"
আদ্রিতা সবার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো। নিশিতাসহ সবাই বললো, "কী? "
আদ্রিতা সবার উদ্দেশ্য বললো,
" গত কয়েকমাসে আহনাফ স্যারের হাবভাবে মনে হয়েছে উনি নিশিতাকে পছন্দ করেন।"
" হোয়াট! "
নিশিতা অবাক হয়ে বললো কথাটা। পাশ থেকে মিলা বলে উঠে,
" আরে আদ্রিতা ঠিক বলেছিস। অথচ নিশিতার সাথে তিনি তেমন কথা বলতেনও না।"
উপস্থিত সবাই মিলার কথায় সহমত পোষণ করে। নিশিতা সবাইকে একটা ঝাড়ি দিয়ে বলে কীসব আজেবাজে কথা বলছে ওরা? আজ ওর সাথে রনির বিয়ে! সবাই আবারও একসাথে হেসে উঠে।
" আরে আজকের পর তো পরের বউ হয়ে যাবি। তাই একটু মজা করে রাখলাম আমরা হিহিহি! "
" ধুরর পাগলের দল কোথাকার। আমার সাথে আজ স্যারের দেখা হলে বলবো তোদের মধ্যে একটাকে যেন বিয়ে করে নেয়।"
সবাই একসাথে বলে উঠে, "তাহলে হবে না, সবাইকে বিয়ে করতে হবে হাহা!"
নিশিতাও সবার সাথে হো হো করে হেসে উঠে।
বিয়ের সময় পেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ। নিশিতাসহ বাড়ির সবাই বেশ চিন্তিত। কেউ কল ধরছে না ছেলের বাড়ির। জহিরুল ইসলাম পায়চারি করছেন। রেহান বারবার রনিকে কল করে যাচ্ছে। নিশিতার শিক্ষিকা নুর জাহান ইসলাম খুব করে নিশিতার মা'কে সবাইকে ভরসা দেওয়ার জন্য বলছেন। বিপদে সব সময় মাথা ঠান্ডা রাখা উচিত। তারাহুরো করে কোনো কাজ করলে শেষে গন্ডগোল হওয়ার একটা রিস্ক থাকে। তাই ধৈর্য একমাত্র উপায়। অনেক সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর শেষে খবর আসে রনি গাড়ি এক্সিডেন্ট করেছে। অবস্থা খুব খারাপ। আর সাথের ড্রাইভার ঘটনা স্থলে মারা গেছেন। জহিরুল ইসলাম অসুস্থ হয়ে পড়েন। উনার হাই ব্লাড প্রেশার। এরকম খবর শুনে নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। রনির এরকম দূর অবস্থার কথা আর বাবার অসুস্থতার কথা শুনে নিশিতা জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।
চলবে.........................