উন্মুক্ত লাইব্রেরী - পর্ব ০১ - আয্যাহ সূচনা - ধারাবাহিক গল্প


উন্মুক্ত লাইব্রেরী
পর্ব ০১
আয্যাহ সূচনা



গ্রীষ্মের খরতাপে অতিষ্ট মায়া নগরী।এই নগরী জঞ্জালপূর্ণ; তারে মোড়ানো।এক দালানের দিকে চেয়ে নিঃশ্বাস ফেলে দ্বিতীয় নিঃশ্বাস টেনে নেওয়ার পূর্বেই দেখা যায় আরো একটি খুপড়ি দালান। ঘেঁষে দাঁড়িয়ে।এক আঙ্গুল পরিমাণ জায়গা নেই।তবে কতই না ইতিহাস জুড়ে এই নগরীতে।এই ব্যস্ত নগরীতে গতি মেলানো দুঃসাধ্য সঙ্গে বেঁচে থাকাও। জাদুর নগরীতে টিকে থাকা প্রতিটি মানুষের জীবনের একটি করে গল্প আছে।নয়তো বিশাল কোনো উপন্যাস।

উন্মুক্ত লাইব্রেরীর সবুজ রাঙ্গা বেঞ্চিতে সুতির সেলোয়ার কামিজ পরিহিত এক মেয়ে বসে আছে।চারিদিকে হইচই।পাখি,যানবাহন মানুষের গল্পে কোলাহলপূর্ণ পরিবেশ। লাইব্রেরীতে উপস্থিত সকলের দৃষ্টি বইয়ে।তবে অন্বেষার নেই কোনো মনোযোগ।হাতে বই দৃষ্টি তার বরাবর ঘটে যাওয়া কান্ড কলাপে।জনসম্মুখে একটি ছেলে অন্য ছেলের কলার চেপে থাপড়ে যাচ্ছে।কেউ চেয়ে দেখছে আবার কেউ ছাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে।তাতে কোনো লাভ নেই।মার দেওয়া ছেলেটির যেনো মনে কোনো ডর ভয় নেই।সবাইকে উপেক্ষা করে একের পর থাপ্পড় দিচ্ছে গালে।এক সময় ক্লান্ত হয়ে পড়লো।যাকে মারা হচ্ছিলো সে পকেট থেকে কিছু একটা বের করে তার হাতে দিলো।পরপরই ছেড়ে দেওয়া হয় তাকে। অন্বেষা চোখ নামায় বিরক্ত হয়ে।আজকালের সমাজ আর সমাজের ছেলেপেলেগুলো উচ্ছন্নে যাচ্ছে।কোনো নীতিবোধ নেই।শরীরের শক্তি আর ক্রোধ দেখায় যেখানে সেখানে। সভ্যতা বলে কিছুই নেই।

মুখ হতে বেরিয়ে এলো, “যত্তসব ফাউল উশৃঙ্খল কোথাকার!”

বইয়ের শেষ পাতায় মনোযোগী হলো।তিনদিনে এই বইটি শেষ করতে পেরেছে পড়ে। ভাগ্যিস কেউ নিয়ে যায়নি।নাহয় পড়াই হতো না।দুই লাইন পড়ে পাশে অনুভব করলো কারো উপস্থিতি।মাথা তুলে চায় অন্বেষা।আচমকা সেই উশৃঙ্খল ছেলেকে পাশে বসে থাকতে দেখে ভড়কে উঠলো।কি অদ্ভুত!এইতো মারামারি করে এলো এখন আবার বই পড়ছে?নিজেকে গুটিয়ে বসলো সে।কিছু বলাও যাবেনা।এখানে সবার অধিকার আছে।

আকস্মিক প্রশ্ন এলো, “পানির বোতলটা কি আপনার?”

অন্বেষা চোখ তুলে পুনর্বার।ছেলেটি তাকে প্রশ্ন করছে।লম্বা বেঞ্চির মধ্যখানে একটি আধ খাওয়া পানির বোতল।কে রেখেছে জানে না।অন্বেষা জবাব দিলো,

“না আমার না”

বোতল হাতে তুলে গটগট করে পান করে নিলো সবটুকু পানি।অন্বেষা চেয়ে দেখছে।কালচে দেহের রং।পরণের কাপড়ের অবস্থা নাজেহাল।কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে।পানি শেষ করে দুমড়ে মুচড়ে ফেললো বোতলটি। উড়িয়ে ফেললো দূরে থাকা ডাস্টবিন এর দিকে।কিন্তু নিশানা চুকে যায়।তাতে কি?বেয়াদব এর মতন সেখানে গুরুত্ব না দিয়েই বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছে।ভারী অদ্ভুততো বাপু!

অন্বেষা গলার আওয়াজে বিরক্তি নিয়ে বললো,

“পানিটা অন্য মানুষের হতে পারতো।”

“জানি আমি।পানি মানুষই খায়।জ্বিন পরী খায় না।”

তেরছা জবাবে অন্বেষার মেজাজ খারাপ হয় কিছুটা।বললো,

“আপনি অনুমতি না নিয়ে খেয়েছেন।তাছাড়াও বোতল এদিক সেদিক ফেলে লাইব্রেরীর পরিবেশ নষ্ট করছেন।”

“পানির কাজ তেষ্টা মেটানো কার তেষ্টা মিটিয়েছে সেটা মুখ্য না।পানির বোতলটা দরকারি হলে ফেলে রেখে যেতো না।আমার কপালে ছিলো আমি পেয়েছি এবং খেয়েছি।এতে আপনার কোনো সমস্যা হওয়ার কথা না”

“আপনি….”

“এত নীতিবাক্য ঝাইরেন না বইন। বই পড়তে আসছেন বই পড়েন।গায়ে পইড়া তর্ক করার মতন সময় আমার নাই।”

অন্বেষা বইটা বন্ধ করে দিলো।এই অসভ্য ছেলের পাশে বসে থাকার চেয়ে উপন্যাস এর শেষাংশ না জানা বহু অংশে ভালো।উঠে দাঁড়ালো।বিড়বিড় করে বললো,

“মারামারি করার সময় আছে ঠিকই।”

গুরুত্ব পায়নি তার এই কথাটি।ছেলেটি একবার চেয়েছে।আবার চোখ নামিয়ে নেয়।অন্বেষা ব্যাগ পত্র গুছিয়ে চলে যাওয়ার পথে পা বাড়ালে ছেলেটি বলে উঠে,

“বোতলটা তুইলা ডাস্টবিনে ফালায় দিয়া যান।পরিবেশের খেদমত কইরা সোয়াব কামান।”

পায়ে পাড়া দিয়ে ঝগড়া করার মতন মন মেজাজ অন্বেষার।যেতে চেয়েও ফিরে এলো।কটমট করে চেয়ে বললো,

“ভুল আপনি করেছেন। শুধরেও আপনিও নিবেন।অন্যকে আদেশ করেন কোন সাহসে?”

ছেলেটি হাসলো। বাঁকা চাঁদের ন্যায়।এসব বহুত দেখেছে।ঝাঁঝালো কণ্ঠে তার তেমন কিছু আসে যায়না।জবাবে পায়ের উপর পা তুলে বললো,

“কাম চোর!”

“আপনি ভারী অভদ্র-তো”

“এক দেখায় চিনা ফেললেন।আপনার নজরের তারিফ না করলেই না।”

“ভদ্রতা শিখুন।কথা আর কাজে ভদ্রতা বজায় রাখুন।”

“এসব নীতিবাজি আমার সামনে চলে না। আস্তে ধীরে পা বাড়ায় প্রস্থান করেন।আপনার এই সুন্দর চেহারা দেখতে আর ভালো লাগতেছে না।”

অন্বেষা অতিরিক্ত উত্তেজিত হয়ে পড়লো। রাগে- ক্ষোভে!কথা বেরোলো না আর মুখ থেকে।এমনি হয়।রেগে গেলে আর কিছু বলতে পারেনা।বললেও ভুলভাল বলে হাসির পাত্র হয়।চোখ গরম করে চেয়ে চলে গেলো অন্বেষা।ছেলেটি আবার হাসে।ভীষণ মজা পেয়েছে রাগিয়ে।মাথা দুলিয়ে আবার ঘাড় বেঁকিয়ে বইয়ে মনোযোগী হলো।

_____

চানখাঁরপুল মোড়ে ভাতের হোটেল আছে।ঢাকা মেডিক্যালের চতুর্থ শ্রেনীর কর্মচারী থেকে শুরু করে নিম্নবিত্ত সকলের ক্ষুদা নিবারণের স্থান এগুলোই।স্বল্প দামে খাবারসহ মাছির মধুর কণ্ঠে ভনভন শোনা যায়।তাতে কি? খাবারের সাথে বিনোদন দরকার আছেতো? বাঙালির আবার হাইজিন মেইনটেইন করতে হয়না। এরা ভেজাল খেয়ে অভ্যস্ত। শরীরও সেটাই মানিয়ে নিয়েছে।হুট করে সুস্বাস্থ্যকর খাবার পেলেই বরং সিস্টেমে গ্যাঞ্জাম শুরু হয়।

শতাব্দীর নগরী- ইতিহাসে ভরা তার প্রতিটি গলি।নানা রঙের গল্পে রূপকথা সাজানো মানুষের ভিড়ে সেখানে স্মৃতিরা ভেসে বেড়ায়।পুরোনো বাড়িগুলি সোনালী আহ্বান জানায়।বৈঠকখানায় জমে পুরোনো দিনের সুর।বুড়িগঙ্গার ঢেউয়ে ঢেউয়ে জাগে নতুন কোনো এক দিন,নতুন কোনো গাঁথা। কখনো কখনো কৃষ্ণচূড়া ফুলে ঢেকে থাকে পথ।কি যেন আছে এই সরু অলিগলিতে?পুরান ঢাকার মাঝে লুকিয়ে ইতিহাসের অমৃত।রাতের বেলায় বাতি জ্বলে আকাশে,ক্লান্ত স্বপ্নেরা উড়ে চলে নীলিমার পাশে।প্রাণের নগরে সবার আছে ভিন্নরকম মুগ্ধতা আবার বিতৃষ্ণা। অন্যরকম ভালোবাসার ব্যাকরণ।

    পলিথিনে নিজের প্রয়োজন মোতাবেক ভাত, আলুর ভর্তা আর ডাল নিয়ে হাঁটছে বর্ণ। তারে পেঁচানো গলিতে প্রবেশ করতেই ভেসে এসে বিরিয়ানির ঘ্রাণ। ‘আহা!’ শব্দ উচ্চারণ করে ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো বর্ণ।এই ঘ্রাণ মেস অব্দি যাবে সাথে।দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাবে।ঘ্রাণ বিরিয়ানির পাবে নাক আর মুখ স্বাদ পাবে ভাতের।পেট প্রতিদিনের ন্যায় বিভ্রান্ত হবে।কি শুঁকলো আর কি ঢুকলো!হাঁটতে হাঁটতে বর্ণ থামে। ছয় তলা বিল্ডিংয়ের দিকে চাইলো ত্যাড়া চোখে।বাম হাতে ছোট্ট একটা ইট তুলে নিয়ে ছুঁড়ে মারলো দোতলার বারান্দায়।মুখ ফুটে বেরিয়ে এলো,

“বাটপারের বাটপার!”

ইট সরাসরি নিশানায় লেগেছে।উল্টোপাল্টা কাজে বর্ণের নিশানা চুকে না কখনো।শৈশবে মার্বেল খেলায় সেই ছিলো সেরা।আজও রাজত্ব বজায় আছে।যার বারান্দায় ইট ছুঁড়েছে সেই বাড়ির মালিক তেড়ে এলেম। ঢাকাইয়া ভাষায় খ্যাঁক খ্যাঁক করে বলে উঠলেন,

“ঐ কেঠা রে! কেঠায় ইট মারলো, হ্যাঁ!একবার আয় চক্ষের সামনে হাড্ডি পাশলি গুড়া কইরা লামু”

বর্ণ উপর দিকে চেয়ে বলে, “কেঠা আবার কেঠা।আমি আপনার জেঠা।”

বলে চেঁচামেচিতে গুরুত্ব না দিয়ে নিজের রাস্তা মাপে।তার ইচ্ছের পূর্ণতা সে দিয়েছে।বিনিময়ে গালিতো খেতেই হবে।এমন গালি জীবনে বহুবার গিলা হয়েছে।বরং এখন অপমান নয় প্রশংসা মনে হয়
অবলীলায় হেলেদুলে হাঁটতে হাঁটতে শুনতে পেলো,

“তোরে একবার হাতের কাছে পায়া লই! ঘেটি মোটকায় ধরমু!”

আরো কয়েক অলিগলি পেরিয়ে কাঙ্ক্ষিত জায়গায় এসে হাজির। পুরোনো আমলের এক বাড়ির নিচ তলায় থাকে বর্ণ। সর্বখানে ঐতিহ্যের ছোঁয়া।কোনো এক কালে কোনো রাজা বাদশা বোধহয় বসবাস করতেন এখানে।নকশা আর কারুকার্যে পরিপূর্ণ বাড়িতে এখন বর্ণ নামক বাদশার বসবাস।তার সাথে রয়েছে সেনাপতি আর সৈন্যদল।ঘরে প্রবেশ করেই হাত মুখ ধুয়ে নেয় বর্ণ।গামছা ভিজিয়ে ঘাড়ে পেঁচিয়েছে।এই জায়গায় তার গরম বেশি।ঘরের ফ্যান আধমরা চলে তো চলে না। শার্ট খুলে শুকাতে দিলো জং ধরা গ্রিলে।জমিনে পা ভাঁজ করে খেতে বসেছে। গপাগপ করে গিলে খাওয়ার অভ্যাস তার।ভাত,আলুর ভর্তা আর ডাল শেষ করতে সময় লাগলো না পাঁচ মিনিটের বেশি।খাওয়ার কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই ঢেঁকুর তোলে।আরাম করে শুয়ে পড়লো মাটিতে বিছানো তোষকে।

      নাইট ডিউটি।প্রতিদিনই থাকে।দুপুরের খাবার খেয়ে এক ঘন্টার ঘুম হয়। বড়জোর দুই আড়াই ঘন্টা।এর ঊর্ধ্বে নয়।ভেঙে তছনছ হওয়া ফোনের স্ক্রিনে এলার্ম বাজলো।বিরক্তির ‘চ’ উচ্চারণ করে উঠে বসে বর্ণ।চোখ মলে উঠে যায়।পানির নল ঘোরাতেই পানি আসার কথা।এলো না।আরো বিরক্ত হচ্ছে সে।হাত মুখ না ধুয়েই বেরিয়ে পড়লো।যাওয়ার পথে পা বাড়িয়ে দু কদম পেছায়।জানালার দ্বারে বাড়ি ওয়ালা বসে আছেন। টিভিতে পুরোনো বাংলা সিনেমা দেখছেন।দিনের বেলায় এই গলিতে আধাঁর থাকে।সন্ধ্যা নামতেই বিদঘুটে অন্ধকার।তালে তাল মিলিয়ে ল্যাম্পপোস্টের আলো জ্বলছে নিভছে।বর্ণ ইচ্ছেকৃত আধাঁরে দাঁড়ালো।জানালার কাছে মুখ এনে চেয়ে রয়।মিনিট দুয়েক পরে ভারী কণ্ঠে বাড়িওয়ালাকে ডাকে,

“চাচ্চাআআআ…”

ভয়ানক ভূতুড়ে আওয়াজে আফজাল মিয়া লাফিয়ে উঠেন।বুকে থুথু ছিটিয়ে চাইলেন জানালার দিকে। দাঁতের পাটি বের করে ভয়ঙ্কর হাসির সহিত দাঁড়িয়ে এক অসভ্য ছেলে।রেগে মেগে আগুন হয়ে এগিয়ে এসে বলেন,

“এই হারামজাদা!হেনে কি করস?ডরায় গেছি আমি।”

“ওমা! আপনেই না ভাড়া চাইলেন কালকে। দিবার আইছি।”

“ওরে রে! তিন মাসের ভাড়া এহন দিবার আইছো?”

বর্ণ হাসলো। ব্যাঙ্গ করে বললো,

“জ্বে নাহ এক মাসের ভাড়া।”

বলে তিন হাজার টাকা এগিয়ে দেন আফজাল মিয়ার হাতে।আফজাল মিয়া একমাসের ভাড়া দেখেই অবাক।বাকি মাসের টাকা কোথায় আর প্রশ্ন করেননি।বললেন,

“এই তিন হাজার টেকাই কই পাইলি?”

“চুরি করছি চাচা। পেটে ছুরি ধরছিলাম।শালার ব্যাটা নিজেও ফইন্নি আছিলো।মাত্র তিন হাজার আছিলো পকেটে।যা পাইলাম শুকরিয়া আদায় কইরা নিয়া আইলাম।অত লোভ করিনা আমি।”

আফজাল মিয়া ভনিতা করে জবাব দেন, “তোরে দিয়া এগুলিই সম্ভব।সামনের মাসে বড়লোক দেইখা কেউরে ছিনতাই করিস।যা ফুট!”

“তার আগে একটা কথা কন।আপনি ডরাইছেন?”

“রাইতের আন্ধারে এমনে চায়া থাকলে ডরামু না?” 

কর্কশ গলায় জবাব দেন আফজাল মিয়া।দেখেই বোঝা যাচ্ছে তিনি কতোটা ভীতু। শয়তানী বুদ্ধি খেলে কথায়।বর্ণ বলে,

“তাইলে সামনের মাস থিকা ভাড়া চাইবেন না।”

কপাল কুঁচকে আফজাল মিয়া প্রশ্ন করেন, “ক্যা?”

“এমনেই চাচা…..আর শুনেন নিজের দুর্বলতা সবার সামনে জাহির কইরেন না।সবাই সুযোগ নিবো। যেমন সামনের মাসে আপনি আমার কাছে ভাড়া চাইতে আইলে আমি নিমু”

চলে গেলো বর্ণ।যাওয়ার পূর্বে তার কথার অর্থ বুঝতে চেয়ে অবাক চাহনিতে তাকিয়ে থাকা আফজাল মিয়ার হাত থেকে এক হাজার টাকার একটি নোট আলতো হাতে টেনে নিয়ে গেছে সেদিকে তার ইয়াত্তা নেই।বর্ণ বেরিয়ে এসেছে।কাজে যাওয়ার পূর্বে চা দরকার।চায়ের দোকানে বসে চা আর বাকরখানি নিয়ে পাঁচ মিনিটে খেয়ে উঠে।পরপর বেরিয়ে যায় কাজে।

________

“রান্না কতদূর আম্মা?”

ঘামর্ত বদন।ওড়না বেঁধে দুইহাতে কাজ করছে অন্বেষা।এতটাই প্রকৃতি আর চুলোর তাপে চোখের পাপড়ি বেয়েও ঘাম ঝরতে শুরু করেছে।পাশেই একটা সবুজ রঙের রুমাল। ঘাড় চেহারা মুছে খাবার বক্সে রাখতে রাখতে অন্বেষা বললো,

“এইতো চাচা।হয়ে গেছে”

পিয়নের পোশাকে জব্বারের বেশ মায়া হলো মেয়েটিকে দেখে।সারাদিন খাটুনির উপরে যায়।নিঃশ্বাস নেওয়ার সময় আছে তার?এদিক ওদিক দৌঁড়ে বেড়ায়।বাড়ি ফিরেও স্বস্তি নেই।রান্নার কাজে হামলে পড়তে হয়।

তিনি বললেন, “একটা ঠান্ডা পানির বোতল আইনা দেই আম্মা? ঘাইমাতো নাজেহাল অবস্থা।”

অন্বেষা মাথা দুদিকে দোলায়।হাত চলছে এখনও।বলে,

“না চাচা।এইতো শেষ কাজ।একটু ফ্যানের নিচে বসলেই ঠিক হয়ে যাবে।আমার পরীক্ষা তো পড়ছিলাম তাই দেরি হয়ে গেছে আজ রান্না করতে।”

জব্বার আর কিছু বললেন না।এক এক করে সাতটি টিফিন ক্যারিয়ার রেডি।ব্যাগে করে তুলে দিলেন জব্বার চাচার হাতে। আরেকটি বক্সে আলাদা করে তুলে রেখে রান্নাঘর পরিষ্কার করতে করতে বললো,

“চাচা যাওয়ার পথে আপনার খাবার নিয়ে যাবেন।”

জব্বার চাচা চলে যাচ্ছিলেন।ফিরে চেয়ে বললেন,

“আমার খাওয়ন দেওয়ার কি দরকার?তোমার আলগা খরচ।”

অন্বেষা হাসলো।চোখ নামিয়ে থালা বাসন মাজতে মাজতে বললো,

“উপর ওয়ালা অনেক দিয়েছে চাচা। সব-তো আমি একা গিলতে পারবো না।সবাই মিলে মিশে গিলি” বলে আরেক দফা হেসে উঠে।

পাতে খাবার নিয়ে আরাম করে বসে অন্বেষা।তার দুজন রুমমেট রুম্পা আর ঝুমা।তারা গ্রামে গিয়েছে।আজ সে একাই আছে।সাথে থাকলেও তাদের মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক।কেনো যেনো অন্বেষাকে সহ্য করতে চায় না তারা।এক প্রকার বৈষম্যের শিকার সে।কেনো সেটা আজও জানতে পারেনি।আজ দুজন নেই।অযথা তাদের চাপা ফিসফিসানি শুনতে হবে না।রাতের ঘুমটাও বেশ হবে।কিন্তু ঘুম?মনে পড়লো আগামীকাল পরীক্ষা তার।নিজের মাথায় আলতো চাপড় দিয়ে বললো,

“আন্না তোর পরীক্ষা।ভুলে যাস না”

______

আজ অন্বেষার অফিস নেই।দিনের একটা লম্বা সময়ের জন্য সে অবসর। পরীক্ষাটা আজ খুবই বাজে হয়েছে। কোথায় অবসর কাটাবে স্বাধীনভাবে। তা না উল্টো খারাপ পরীক্ষা নিজে অতিরিক্ত চিন্তা কথার আনাচে কানাচে ঘুরপাক খেয়ে চলেছে।মন মেজাজ শান্ত করার জন্য চিরাচরিত স্থানে যাওয়া উচিত।উন্মুক্ত লাইব্রেরি।আজ থেকে তিন বছর পূর্বে শওকত ভাইয়ের উদ্যোগে শুরু হয়েছিলো এই লাইব্রেরির যাত্রা। পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে এর প্রচলন থাকলেও বাংলাদেশে নেই বললেই চলে।তবে বাংলাদেশে আছে ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরী।সেটি আরো একটি আকর্ষনের বস্তু।আপাতত ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরী থেকে সকলের জন্য উন্মুক্ত লাইব্রেরীতে ফিরে এলো অন্বেষা।গতকাল উপন্যাস এর শেষ দুই পাতা বাকি রয়ে গেছে সেই অসভ্য ছেলেটার কারণে। আজ সুযোগ বুঝে শেষ করে যাবে।নয়তো শান্তি পাবে না এই মন।

নিজের পছন্দের জায়গা খালি পেয়ে হাসলো অন্বেষা আনমনে।এভাবেই সবটা পেয়ে গেলে বোধহয় ভালোই হয়।দ্রুত গিয়ে ব্যাগ রেখে বই নিয়ে আসে।পড়তে লাগলো মনোযোগী হয়ে।প্রতিটি শব্দ যেনো একটি একটি করে অর্থ বহন করছে।খালি চোখে দেখা যায় না,বোঝা যায় না। মস্তিষ্ক খাটিয়ে অনুভব করতে হয়।শেষ প্যারায় এসে ঘাড় তুলে ডানে চাইলো অন্বেষা। বিরক্তির রেশ ফুটে উঠে সাথে সাথে।আবারো সেই ছেলেটা!বর্ণ মুখ ফিরিয়ে চাইলো।ভনিতা করে হেসে বললো,

“হ্যালো….. সমাজ সেবিকা।” 

শেষের কথাটি অত্যন্ত নিচু গলায় বলেছে বর্ণ।শুনতে পেলেও বুঝতে পারেনি অন্বেষা।চোখ ফিরিয়ে নিতে চাইলে অদ্ভুত একটি বিষয় লক্ষ্য করে।নবম দশম শ্রেণীর বই পড়ছে এই লোক! অন্বেষাকে চেয়ে থাকতে দেখে বর্ণ প্রশ্ন করে,

“কি সমস্যা?”

অপ্রস্তুত অন্বেষা দ্রুততম গতিতে মাথা দুলিয়ে জবাব দেয়,

“নাহ কিছুনা”

এতবড় একটা ছেলে নবম দশম শ্রেনীর বই পড়ছে কোন দুঃখে।না চাইতেও আবার চোখ যায়।বর্ণ আবারো প্রশ্ন করে,

“মনের মধ্যে প্রশ্ন উকি ঝুঁকি দিলে করেন।আমি মাইন্ড ফাইন্ড করিনা।”

বাচনভঙ্গিটাও কেমন যেনো।বর্ণ ঠোঁটের উপরে ঘন গোঁফে আঙ্গুল চালিয়ে অপেক্ষা করতে লাগে অন্বেষার প্রশ্নের।অনেক ভাবনা চিন্তার পর শব্দ যোগায় সে।প্রশ্ন করেই ফেলে।বলে,

“নবম শ্রেণীর বই পড়ার কারণ?তাও এখানে বসে?”

বর্ণ ফটাফট জবাব দেয়, “সাধে পড়ি নাকি?একটু পর একটা টিউশন আছে।স্টুডেন্ট ক্লাস নাইনে পড়ে। ওরে পড়ানোর আগে একটু নিজে পইড়া নিতাছি।স্টুডেন্ট সামনে টিচার পড়া না পারলে কেমন না?মান ইজ্জত নিয়া টানাটানি”

গলার স্বর বলছে লোকটা খাস ঢাকাইয়া।টান আছে ঢাকাইয়া ভাষার। শুদ্ধ ভাষা বলতে চেয়েও পুরোপুরি পারছে না।তাছাড়া তার দর্শানো কারণটাও আজগুবি বটে।আজ কেনো যেনো তাদের মধ্যে ঝামেলা হলো না। বর্ণ উল্টোপাল্টা কোনো কথা বলেনি। চুপচাপ নবম শ্রেনীর শিক্ষার্থীর মতো করে পড়া মুখস্ত করে যাচ্ছে। ঠোঁট টিপে স্বল্প হাসে অন্বেষা। বাঁকা চোখে তার হাসি দেখে বর্ণ বলে,

“পাগল হইয়া গেছেন?”

“কিহ!” অবাক সুরে বলে উঠলো অন্বেষা।

“একলা একলা পাগলে হাসে।”

অন্বেষা গুরুত্ব না দিয়ে গতকালকের প্রসঙ্গ তুলে আনলো।প্রশ্ন করে,

“গতকাল ছেলেটাকে মারলেন কেন?”

বর্ণের ডিস্টার্ব হচ্ছে।মনে মনে ইতিমধ্যে বলে ফেলেছে বেশি কথা বলে এই মেয়েটা।কি করার প্রশ্ন যেহেতু করেছে জবাব দিতেই হবে।বই বন্ধ করলো ধপ করে।জবাবে বললো,

“আমরা ঢাকাইয়ারা আবার দিল দরিয়া মানুষ।নিজের ছিঁড়া লুঙ্গি পইরা ঘুরলেও অন্যরে নতুন লুঙ্গি কিনা দেই।”

অন্বেষা মুখ কুচকে বললো, “ওওওও….লুঙ্গি কিনে দেওয়ার আগে স্টাটার হিসেবে মার খাওয়ান বুঝি?”

“আরেহ মিয়া বেশি বুঝেন কেন?কথা শেষ করবার দেন।ওই পোলা…..”

“ছেলে” 

বর্ণের কথায় বাঁধা হয়ে শুধরে দিলো তাকে।বর্ণ উক্ত বলে উঠলো,

“আরেহ ধুরো!পোলা ছেলে সবার সবকিছু এক। যার উপর কালকে হাত ঝাড়লাম ওই ছয়মাস আগে আমার কান্ধে হাত রাইখা কয় বড় ভাই কয়টা টাকা লাগবো।এদিকে আমি ভাত খাইতে ভাত পাই না।তারপরও দিলাম টাকা। যাহ! মজমাস্তি কর।এরপর একমাস যায় দুইমাস যায়।টাকা ফেরত দেওয়ার কোনো নাম গন্ধ নাই।এরপর দুইমাস আমার ফোন ধরেনা।এরপর লাপাত্তা!গতকালকে ওরে হাতেনাতে পাইয়া ধোলাই দিলাম ইচ্ছামত।শান্তি লাগতাছে!”

“তা টাকাটা কি ফেরত পেলেন?”

“হুম” 

এত কথা বলে শেষমেশ ছোট্ট জবাব দেয় বর্ণ।অবশেষে উপন্যাসটি শেষ।উঠে বই রেখে এলো অন্বেষা।ফিরে এসে ব্যাগ কাঁধে তুলে সৌজন্যতা দেখিয়ে বললো,

“আসি”

“না আসার দরকার নাই”



চলবে….........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন