নীরবে নিভৃতে - পর্ব ২৪ - তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া - ধারাবাহিক গল্প


তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে রোশান মেহেকের কথায় ফিক করে হেসে উঠলো। 
" কেয়ার করলে! খেয়ে আসতে বললে সুন্দরী? "
চোখেমুখে দুষ্ট হাসির ঝিলিক ফুটিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বললো রোশন। মেহেক চেহারায় বিরসভাব ফুটিয়ে অন্য দিকে দৃষ্টিপাত করে। 
" মোটেও না! এখান থেকে সরানোর জন্য বলছি। "
" তাহলে ঠিক আছে। আমিও ভাবছিলাম, ভুতের মুখে রামনাম! "
মেহেক চুপ করে রইলো। এরসাথে অহেতুক কথা বলার মতো এনার্জি নেই এখন। কথায় কথা বাড়বে। তারচেয়ে একা একা বকে খেতে চলে যাক বরং হুহ!

বিকেলে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হলো মেহেককে। রোশন অবশ্য সাথে গেলেও একটা নির্দিষ্ট জায়গায় অপেক্ষা করছে। চেহারা ঢাকার জন্য মুখে অবশ্যই মাস্ক পরে নিয়েছে লোকটা। মেহেক বাড়িতে এসেছে দেখে এমনিতেই আশেপাশের লোকজন রোশনের কথা বলাবলি করছিল দুপুরে। প্রতিবেশীরা তো মিষ্টির কাছে বারকয়েক জিজ্ঞেসও করেছিলো,
 " তোর ডাকাত দুলাভাই এসেছে? "

মিষ্টি অবশ্য কৌশলে কথা এড়িয়ে গেছে। তবুও সাবধানে থাকতে হয়। জীবনে এই প্রথম নিজের এই কাজকর্মের জন্য বিরক্ত লাগছে রোশনের। নিজের স্ত্রী অসুস্থ অথচ সাথে হসপিটালের ভেতর যেতে পারছে না। এরচেয়ে অশান্তির কি আরকিছু আছে? নাহ! রোশনের কাছে এরচেয়ে অশান্তির কিচ্ছু নেই আপাতত । মিষ্টি আর সিদ্দিক আহমেদ সাথে আছে মেহেকের। তবুও অস্থিরতা কমছে না রোশনের। অপেক্ষা করা কতটা তিক্ত তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছো। প্রায় একঘন্টা পরে মেহেককে দেখতে পেলো রোশন। বাবা ও বোন মিলে মেহেককে ধরে ধরে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে আসছে। রোশন আর নিজের জায়গায় স্থির থাকতে পারলোনা। পকেট থেকে কালো রঙের সানগ্লাসটি চোখে পরে হনহনিয়ে এগিয়ে গেলো সামনে। মিনিট দুয়েকের মধ্যে মেহেকের সামনে গিয়ে দাঁড়াল রোশন। জ্বর বেড়েছে বলে ভালো খেয়াল নেই ওর। একটু পর জ্বর আরো বাড়বে বৈ কমবে না। 
" আমি দেখছি। "

শ্বশুর আর শ্যালিকাকে ইশারায় মেহেককে ছাড়তে বলে, কোলে তুলে নিলো বউকে। সিদ্দিক আহমেদ দ্রুত পা চালিয়ে অটোরিকশা ঠিক করতে এগোলেন। মিষ্টি রোশনের সাথে সাথে হাঁটছে। 
" কী বললেন ডাক্তার? আর ঔষধ নিতে হবে না? "
ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেছে রোশন। মিষ্টি ধীরস্থিরভাবে বলে,
" টাইফয়েড হয়েছে। ঔষধে কাজ হবে না এখন, ইনজেকশন দিয়েছে। তবে সাথে আনুষঙ্গিক কিছু ঔষধ আছে। বাবা গাড়ি ঠিক করে আমাদের আগে পাঠিয়ে দিয়ে তারপর হয়তো ঔষধ কিনবে। বুঝতেই পারছেন, আপনাকে কেউ চিনে ফেললে মহা ঝামেলা হবে। "
মিষ্টির কথায় কোন ভুল নেই। সবকিছুই বুঝতে পারছে রোশন। তাই মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে চুপচাপ হাঁটতে লাগলো। এরমধ্যে সিদ্দিক আহমেদ ইশারায় একটা অটোরিকশার দিকে এগোতে বললেন মিষ্টিকে। মিষ্টি রোশনকে ইশারা করতে মেহেককে নিয়ে সেদিকে এগোলো। 

আজকের ইনজেকশন করে দিয়েছে ডাক্তার। সাতদিন ইনজেকশন নিতে হবে, পাশাপাশি নিয়মমাফিক চলাফেরা করতে হবে। আনজুম বেগমের সহায়তায় মিষ্টি মেহেকের শরীর মুছিয়ে দিয়েছে। ঘেমে-নেয়ে থাকলে সমস্যা। রাতের খাওয়াদাওয়া শেষে ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে রোশন। আজকে থেকে গেলেও কালকে অবশ্যই জঙ্গলে ফিরে যেতে হবে তাকে। কিন্তু কীভাবে কথা না বলে, দেখা না করে থাকবে? এমন একটা অবস্থা জঙ্গলে নেটওয়ার্কও খুব স্লো! বিরক্ত লাগছে সবকিছু। 

" কই! কই? "
মেহেকের দিকে দৃষ্টিপাত করতেই অস্থির হয়ে উঠলো রোশন। মেয়েটা জ্বরের ঘোরে কিছু একটা বলছে। রোশন দ্রুত এগিয়ে মেহেকের পাশে বসলো। মেয়েটার চোখমুখ এই কয়দিনে কেমন হয়ে গেছে! ঠোঁটগুলো কেমন ফ্যাকাসে, চোখের নিচে কালচে দাগ, শুকিয়ে গেছে শরীরও। 
" কী খুঁজছ সুন্দরী? কী লাগবে বলো!"
মেহেক পিটপিট করে রোশনের দিকে তাকিয়ে আছে। ম্লান হেসে একটা হাত রোশনের গালে রাখলো। চমকাল রোশন। পরক্ষণেই মনে হলো সবকিছুই তো ঘোর! 
" এ তো খে..য়াল কেনো রাখো বজ্জাত লোক?"

থেমে থেমে শুধালো মেহেক। রোশন ঠোঁট কামড়ে মুচকি হাসলো। এবার সত্যি সত্যি তার ডাকাত রাণী তার সাথে কথা বলছে। তবে স্বাভাবিক থাকলে এসব কখনোই বলতো না সে বিষয় নিশ্চিত। প্রিয়তমার পাশে বালিশে মাথা রেখে শুয়ে বললো রোশন,
" বজ্জাত লোক সেজন্য। "
" বদের হাড্ডি একটা! "
" আর কোনো কিছু আছে? অসভ্য, লুচ্চা? "
" আছে...এ তো। দূরে সরররো।"
রোশনকে হাত দিয়ে দূরে সরিয়ে দিতে চাইলেও ক্লান্ত শরীরে সেটা মেহেকের পক্ষে সম্ভব হলো না। রোশন মেহেকের মাথা তুলে নিজের বুকের উপর রাখল। 
" সকালেই চলে যাবো। তারপর চাইলেও কিছুদিন কাছাকাছি থাকতে পারবোনা তোমার। তাই আজকের রাতটা আর হাতছাড়া করবোনা। সারারাত বুকে জড়িয়ে ধরে রাখবো। "
রোশনের কথায় একটু নড়েচড়ে উঠলো মেহেক। কিন্তু কিছু বললো না। চুপ করে গেছে। কী বুঝলো মেয়েটা কে জানে! রোশন ঘাড়ে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিতেই নড়েচড়ে উঠলো সে। আবেশে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল রোশনকে। লোকটা মৃদু হেসে আর কিছু না বলে চোখ বন্ধ করে ফেললো। 

পরের দিন সকালে আচমকা লোকজনের চেঁচামেচির আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেলো মেহেকের। সকালবেলা জ্বর কম আজ। তবে শরীর দূর্বল। বাইরে কী হচ্ছে দেখার জন্য শোয়া থেকে উঠে বসলো সে। কিন্তু হাঁটার মতো শক্তি শরীরে নেই মনে হওয়াতে মিষ্টিকে ডাক দিলো কয়েকবার। মিনিট পাঁচেক পরে মিষ্টি এলো মেহেকের ডাকে। 

" আপু তুমি ঠিক আছো? কিছু লাগবে? "
" ঠিক আছি রে। বাইরে কী হচ্ছে? "
" ভাইয়াকে খুঁজতে পুলিশ এসেছে, সাথে পাশের বাড়ির লোকজন আর গ্রামের লোকজন। "
মিষ্টির কথায় আঁতকে উঠল মেহেক। আশেপাশে নজর বুলিয়ে কোথাও রোশনকে না দেখে আতংক বাড়লো বৈ কমলো না। 
" উনি কোথায়? "
" ভাইয়া ফজরের নামাজের পরেই চলে গেছে। তুমি ঘুমিয়ে ছিলে বলে ডাকেনি।"
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো মেহেক। যাইহোক, পুলিশ এসে রোশনকে নিয়ে গেলে সিদ্দিক আহমেদের বদনাম হতো। 

ভরসন্ধ্যা! টিপটিপ বৃষ্টি হচ্ছে। আজ দু'দিন পর আহনাফ এসেছে মিষ্টিকে পড়াতে। ঘরে ঢুকে ছাতা পাশে রেখে নির্দিষ্ট চেয়ারে বসেছে আহনাফ। মিষ্টিও নিজের জন্য বরাদ্দকৃত চেয়ারে বসে আছে। পরীক্ষা প্রায় শেষের পথে। আহনাফের মুখাবয়ব দেখে ভাবনার অতলে হারিয়েছে মেয়েটা। চেহারা কেমন উষ্কখুষ্ক লাগছে, মলিনও! 
" কী দেখছ! আসলে আমি দুঃখিত মিষ্টি। অসুস্থ থাকায় এই দুই দিন আসতে পারিনি। "
আহনাফের কথায় নড়েচড়ে উঠলো মিষ্টি। কী অদ্ভুত! জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল আগে ওর, স্যার কেনো আসেনি কিংবা অসুস্থ ছিলেন কি-না! অথচ বেচারা নিজে থেকেই সবকিছু বলে যাচ্ছে। 
" ব্যাপার না স্যার। আসলে আপু এসেছে তো সেজন্য আপনার খোঁজ নেওয়া হয়নি। নয়তো বাবা গিয়ে জেনে আসতেন, আপনার কী হয়েছে! "
" হ্যাঁ শুনেছি। মেহেকের কী অবস্থা এখন?"
" আগের থেকে একটু ভালো। "
" ঠিক হয়ে যাবে। আচ্ছা তুমি বরং পড়া শুরু করো। "
" জি।"

মিষ্টি বাধ্য ছাত্রীর মতো পড়ায় মনোযোগ দিলো। তিন দিন আগে জ্বর এসেছিল আহনাফের। এখন অবশ্য নেই। পেটে ঔষধ পড়ায় কমে গেছে। সেজন্য যে পড়ানো রেখে ঘরে বসেছিল বিষয়টা তেমনও নয়! মন খারাপের অসুখে ভুগছিল এ ক'দিন। একটা মানুষ কীভাবে আরেকটা মানুষকে তিলে তিলে শেষ করে দিতে পারে নিজের সাথে তেমন ঘটনা না ঘটলে কেউই হয়তো বুঝতে পারে না। আয়েশা! এই মেয়েটা গ্রামে এসেছে, বাবার বাড়ি। সাথে স্বামী ও সন্তানও এসেছে বটে। সেটা স্বাভাবিক কিন্তু তার সুখের সংসারের গল্প আহনাফকে শোনানো অস্বাভাবিক। একটা সময় যে মানুষটার পাশে অন্য কারো নামও সহ্য করতে পারতোনা আহনাফ, আজ সেই মানুষটির সাথে অন্য কাউকে দেখতে হয়! এ যে কী ভীষণ যন্ত্রণা তা কাউকে বোঝাতে পারে না আহনাফ। ভালোই থাকে তারপর মাঝে মধ্যে আয়েশার হুটহাট কল এলোমেলো করে দেয় ওকে। এমনটা নয় যে আয়েশার নম্বর রেখে দিয়েছে আহনাফ, কিন্তু আয়েশা মাঝে মধ্যে নতুন নতুন সিম দিয়ে কল করে। কী শান্তি পায় আহনাফকে কষ্ট দিয়ে তা বুঝতে পারে না ভুক্তভোগী আহনাফ! যে মানুষটার সাথে দীর্ঘ সময় আমরা অতিবাহিত করি, ভবিষ্যতে ঘর বাঁধবো বলে স্বপ্ন বুনি হুট করে সেই মানুষের বদল ভীষণ বিশ্রী। আর এই বিশ্রী ব্যাপারটা কাটিয়েই আমাদের চলার পথে এগোতে হয়। আহনাফও আপ্রাণ চেষ্টা করছে এগিয়ে যাওয়ার। তবে এই এগোনোর পথটা বড্ড অমসৃণ ওর জন্য। 



চলবে..........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন