শাহজাহান তন্ময় - পর্ব ৫৮ - নাবিলা ইষ্ক - ধারাবাহিক গল্প


কৃষ্ণচূড়া গাছটির মাথার ওপর ঠিক আসমানের বুকপকেটে জ্যোৎস্নাময়ী একটি চাঁদ বসেছে। চাঁদ জুড়ে আলোকবিন্দুর মতো জাজ্বল্যমান নক্ষত্রের নিবাস। ঝরঝরে হাওয়ার স্পর্শে দুলছে কৃষ্ণচূড়া গাছটি। এই বাগানবাড়িটি বেশ বিস্তৃত;খোলামেলা। দর্শন মাত্রই প্রশান্তি অনুভব হয় নয়নে। হৃদয়ের সব অবসাদ উড়োচিঠি বনে যায়। উঠোন খানা পরিপূর্ণ রূপে কৃষ্ণচূড়া ফুল দ্বারা আচ্ছাদিত। হাওয়ার স্পর্শে সেসব দিকভ্রান্ত, উৎকণ্ঠিত। একেকটি ফুলের ওপর পা ফেলতে দ্বিধাগ্রস্ত মন। ধীর গতিতে পদক্ষেপ ফেলতে হচ্ছে প্রাঙ্গণে। কৃষ্ণচূড়া গাছটির অদূরেই কয়েকটি চেয়ার পেতে দিয়েছেন বাবু মিঁয়া। তন্ময় বসেছে একটিতে, ঊরুর ওপর পা তুলে। পাশেই রিয়ান বসেছে মেরুদণ্ড এলিয়ে। শান্ত হাওয়ার স্পর্শে আমোদিত সবাই। আরামকরে হেলেদুলে বসেছে একেকজন। ইতোমধ্যে সংগৃহীত খাবারদাবার গরম করা হচ্ছে। খেয়েদেয়ে এক গভীর ঘুমে ঝাঁপানো হবে। এটিই তাদের গ্লানি দূর করার একটিমাত্র মাধ্যম। ঘুমকাতুরে মাহিন অবচেতন হবে-হবে ভাব। রিয়ানও বেশ তটস্থ। অন্যত্রে ইব্রাহিম অত্যন্ত চাঙ্গা। আজ সারারাত গল্পে মশগুল থাকতে পারবে। সারাদিনব্যাপি ঘুমিয়ে কেটেছে বলে কথা। সৈয়দের আঙুলের ভাঁজে একটি সিগারেট। ধরাতে গিয়েও ধরানো হচ্ছে না। অরুর বিদ্যমানতা তাকে নিষেধাত্মকের সম্মুখে ফেলেছে। বাঁদিকের আসনে বসা তন্ময়ও সতর্কবাণীময় সূক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়েছে দু’বার। উপায়ন্তর না পেয়ে সিগারেট বক্সে ভরে ফেলল। পকেটে ঢুকিয়ে নিলো আলগোছে। ভোঁতা মুখে বন্ধুর মুখশ্রী পানে চেয়ে তেরছাভাবে প্রশ্নাত্মক কণ্ঠে বলল,

‘রেখেছি। ইউ হ্যাপি, ব্রো?’

তন্ময়ের হাতে লেবু শরবত। কাচের গ্লাসে। ঠান্ডা। আইসকিউব দেয়া। কিয়ৎক্ষণ পূর্বেই দিয়ে গিয়েছেন বাবু মিঁয়া। ভদ্রলোক উল্লাসেই আছেন। অতিথি আপ্যায়নকারী আত্মভাব তার। একত্রে এতগুলো বন্ধুবান্ধব দেখে তিনি আপ্লুত। যেন নিজের শৈশব দেখছেন। গদগদ গলায় ক্ষণেক্ষণে এসে এঁকেবেঁকে প্রশ্ন করছেন, সবার পছন্দ-অপছন্দের। সেই মোতাবেক খাবার তালিকাকৃত করবেন। খাতা-কলমও তার হাতে ছিল। এইমুহূর্তে তন্ময়ের দৃষ্টি অদূরে। ঠিক সামনে। অরুর দিক। অরু কৃষ্ণচূড়া গাছটির নিচে দাঁড়িয়ে। শুহানির সঙ্গে। হাসছে, চাঁদের ছবি ক্যাপচার করছে। পাশাপাশি এলিজা, ঐশীও দাঁড়িয়ে। রমণীদের মধ্যে সখ্যতা গড়ে ওঠেছে। তন্ময় নিজের প্রগাঢ় চাহনি ফিরিয়ে আনে। সৈয়দের চোখে চেয়ে প্রশ্নের প্রত্যুত্তর করে,

‘ইয়েস, মাইন্ডব্লোয়িং। প্লিজ, বিহেভ ইওরসেল্ফ!’

রিয়ান উচ্চকণ্ঠে হেসে ওঠে। ভোঁতা মুখের একনিষ্ঠ মালিক– সৈয়দের পুরুষালি কাঁধ চাপড়ে সতর্ক করার তাগিদাতে বলে, 

‘মামা, সাবধান। বি সুপার কেয়ারফুল ফ্রম আওর তন্ময় চাচা। সে খাঁটি বউ পাগল। কোন ল্যাভেলের বউ পাগল সচক্ষে না দেখলে বুঝবি না। পুরাই প্রটেক্টিভ। আমি অরুকে বেবি ডাকছি দেখে, পারছিল না আমায় জিন্দা ক বর দিতে। চোখের চাহনি দিয়ে ভস্ম করতেছিল।’

তন্ময়ের ভ্রুদ্বয়ের মধ্যস্থানে গুটি কয়েক ভাঁজ পড়ে। ডান ভ্রু তুলে সে। চাপা স্বরে ধমকের সুরে বলে,

 ‘আমার বউকে আমিই এখনো বেবি ডাকিনি। শালা, তুই ডাকার সাহস পাস কই?’

এবার সৈয়দও ফিক করে হেসে ফেলে। রুস্তম দানবের মতন উচ্চকণ্ঠে হাসছে। তালে তাল মিলিয়ে হাসছে বাকিরাও। যেন পৃথিবীর অন্যতম কৌতুক শুনেছে। রিয়ান দু’হাত তুলে ফেলে সারেন্ডার হওয়ার ভঙ্গিমায়। ত্বরিত নিজের ভুলত্রুটি স্বীকার করে ফেলে,

‘অনেক বড়ো অন্যায় করে ফেলেছি। মাফ করে দেন জনাব। আমি কাল থেকে বেবি ডাকব। আজ রাতে তো তুই এভাবেও কয়েকশত বার জান, মাই বেবি, সোনামণি—ডাকতে থাকবি।’

রুস্তমের টনক নড়ে। উদগ্রীব হয় দৃষ্টি। কণ্ঠে উৎসুক ভাব,

 ‘এই আজ কী তাহলে তন্ময়ের মধুচন্দ্রিমা হতে যাচ্ছে?’

তন্ময় নির্বিকার ভঙ্গিতে শরবত খাচ্ছিল। পরোয়া করছিল না একটি বাক্যেরও। শেষমুহুর্ততে আকস্মিক এহেন বাক্য কানে প্রবেশেই, পিলে চমকে ওঠে। শিহরণ বয়ে যায় মেরুদণ্ড বেয়ে। হৃদয়ে উথালপাতাল বেগতিক ঢেউয়ের জোয়ার। এবেলায় খুকখুক করে কেশে ওঠে। ঢোক গিলতেই—শরবত মস্তকে ওঠে আসে। নিজেকে ধাতস্থ করে সম্মুখে চায়। কাশির ধ্বনি শুনে অরু বিচলিত চোখে ইতোমধ্যে চেয়ে আছে। আপাতত তন্ময়ের দিকেই দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসছে। তন্ময় শক্তপোক্ত দৃষ্টিতে চোখ রাঙায় বন্ধুদের। দাঁতে দাঁত চেপে নিচুস্বরে আওড়ায়,

‘শাট ইওর ডার্টি মাউথ।’

ভেঙাল ইব্রাহিম, ‘তুমি করলে ডার্টি না, আমরা বললেই ডার্টি।’

এবারে আর তন্ময়ের সতর্কতার বাণী ছুঁড়তে হয়নি। অরু কাছাকাছি আসতেই সবাই নীরব, স্থির—নিবৃত্ত বড্ড। মুখে মিঠাইয়ের মতন মিষ্টি স্মিত হাসি। অরু এসে বিহ্বল কণ্ঠে শুধায়,

‘কী হয়েছে? আপনি কাশছিলেন!’

তন্ময় মুখ খোলার সুযোগটুকু পেলো না। রুস্তম সুর তুলে প্রত্যুত্তরে বলল, ‘এই কাশি আসল কাশি নয়, মামণি। এই কাশির এক ভিন্ন অর্থ আছে।’

অরু বড়ো অস্থির হয়, ‘কাশির আবার অর্থ হয়?’

মাহিন অকপটে বলে, ‘আছে।’

‘কী অর্থ?’ অরুর ব্যাকুল প্রশ্ন।

তন্ময় চূড়ান্ত হতাশ। অনুরাগশূন্য মুখাবয়ব। অসহ্য চোখে চেয়ে। রুস্তম মাথা দুলিয়ে বলে, ‘অর্থ হচ্ছে, তন্ময় তোমায় মিস করছে।’

অরু আশ্চর্য হয়। কাশির যে এমন তাৎপর্য রয়েছে সে জানতো না। অবিশ্বাস্য দৃষ্টি তন্ময়ের ওপর পড়ে। তন্ময় এবারে ওঠে দাঁড়ায়। রুস্তমকে বাঁকাচোখেতে দেখে বলে,

‘জ্যোতিষী স্টিল সিঙ্গেল। স্যাড!’ বলে আর দাঁড়াল না। অবুঝ অরুর কাঁধ ধরে বাড়ির অন্দরে ঢুকে গেল। রুস্তম আহত চোখে চেয়ে। তার দুর্বল যায়গাতে প্রহার করেছে। গার্লফ্রেন্ড নেই বলে এভাবে কটাক্ষ করবে? ইব্রাহিম হেসে ওঠে। স্লোথ গলায় শুধায়, 

‘আমি বলেছিলাম না? বিশ্বাস হলো তবে?’ 

মাহিন যেন এখনো বিশ্বাস করতে অপারগ, 

‘ভাই, তন্ময়ের সেই ধৈর্য আছে। গাড়িতে অরু তোতাপাখির মতন বলেই যাচ্ছিল, বলেই যাচ্ছিল। আর তন্ময় স্থির ভঙ্গিতে শুনছিল। আবার সাবলীলভাবে জবাবও দিচ্ছিল। যেন এমনটা নিত্যদিন হয়।’

শুহানি এসে দাঁড়িয়েছে সবেমাত্র। এইকথা শুনেই চটে যায়,

 ‘এতে এতটা আশ্চর্য হওয়ার তো কিছু নেই।

তন্ময় বরাবরই অরুর সবকিছুতেই ধৈর্যবান। ওরা 

দুজন– মেইড ফর ইচ আদার। একজন বাঁচাল। অন্যজন পারতে একটি শব্দ উচ্চারণ করে না। অপজাইট এট্রাক্টস দ্য মোস্ট। আবারো প্রমাণিত।’

এসময় বাবু মিঁয়া ত্বরান্বিত পায়ে ছুটে এসেছেন। জানিয়েছেন খাবারদাবার গরম হয়েছে। যেকোনো সময় পরিবেশন করতে পারবে। এতে সবাই হৈচৈ করে ওঠল। ততক্ষণাৎ বাড়ির ভেতর রওনা হলো। ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নেয়া দরকার। পেটে ইঁদুর হাঁটছে।

 

————

উত্তরদিকের ঘরটি তন্ময় নিয়েছে। ঘরের পূর্বত্রে বারান্দার মতন আছে। সাথে প্রশস্ত একটি জানালা। লাগোয়া ওয়াশরুম। প্রকৃতপক্ষে অরুর পছন্দের ঘর এটি। ধীর গতিতে টুকটুক করে ঘুরে বেরিয়েছে পছন্দমত রুমের খোঁজে। পেতেই সে সন্তোষ বিড়াল। আরাম করে নরম গদিতে বসে আপাতত। পা দুটো নাচিয়ে ভেতরে চোখ ঘুরাচ্ছে। সাদা বাল্বের আলোতে চমৎকার লাগছে সবকিছু। বেশ সুশৃঙ্খলভাবে গোছানো। তন্ময় তাদের ল্যাগেজ দুটো প্রাচীর ঘেঁষে রাখল। উর্ধ্বদিকে তাকে অনুদ্ধত দেখালেও —হৃদয়ের ভেতরে সে আলোড়িত। বন্ধুদের তখনকার কথাটি এখনো কানে বেজে চলেছে। অপরদিক অরুর উদগ্রীব দৃষ্টি তাকে উত্তেজিত করছে। আপন সত্ত্বাকে নিয়ন্ত্রণ করা দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসময় রিয়ানের আহ্বান শোনা গেল দ্রুত বেরুনোর, 

‘রোমান্স পড়ে করিস। সারারাত বাকি আছে। অরুকে নিয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আয়। খাব। ক্ষুদায় মা রা যাচ্ছি, লিট্রেলি!’

অরুর সহাস্য চঞ্চল মুখটি ধুপ করে নিভে এলো। দৃশ্যমান রূপে রক্তিম হলো গাল দুটো। কাঁপল ঠোঁটজোড়া। চোখজোড়ার পাপড়িদ্বয় ক্রমান্বয়ে পলক ফেলছে। তন্ময় নিজেকে নির্বিকার রাখার প্রচেষ্টারত গলায় বলল,

‘যা –ফ্রেশ হয়ে আয়।’

অরু যেন আদেশের অপেক্ষাতেই ছিল। ততক্ষণাৎ ওঠে দাঁড়াল। নিজের ল্যাগেজ খুলল ব্যস্ত হাতে। প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নিয়ে ওয়াশরুম ঢুকল। ওয়াশরুমের দরজা লাগতেই, বড়ো করে শ্বাস টেনে ফেলল তন্ময়। শার্টের চারটে বোতাম খুলল ঝটপট। অত্যধিক গরম লাগছে। ঘেমে ওঠেছে ললাট। এত গরম লাগার কারণ কী? আর হার্টবিট তিনশো পঞ্চান্ন ডিগ্রীতে চলছে কেন? ধুকপুক.. ধুকপুক.. ধুকপুক। বক্ষস্থলে হাত চেপে বিছানায় বসল। নিরাশ্রয় দৃষ্টি ওয়াশরুমের দরজায়। এরপূর্বেও তো তারা একই কক্ষে থেকেছে। আজ প্রথম তো নয়! দৃষ্টি ফেলল দেয়াল ঘড়িতে। বারোটা বিশ। রাত হয়েছে বেশ। তন্ময় ফোন বের করল পকেট হতে। সাইলেন্ট করা ছিল। মোট নয়টি মিসড এসে রয়েছে। পাঁচটা মোস্তফা সাহেবের। চারটা আনোয়ার সাহেবের। তন্ময় আপন পিতাকেই কল ব্যাক করল সর্বপ্রথম। ভদ্রলোক যেন ফোন হাতেই বসেছিলেন। এক রিং হতেই ধরেছেন। কণ্ঠে গমগমে ভাব। প্রশ্নপত্র যেন তার হাতেই ছিল। একের পর এক প্রশ্ন ছুঁড়ে চলেছেন। তন্ময় আজ পিতার বাধ্যগত পুত্র। সাধারণ, সাবলীল গলায় প্রত্যুত্তর করছে। পিতার সঙ্গে কথা শেষ করে, চাচা নামক শ্বশুরকে কল করল। আনোয়ার সাহেবের কণ্ঠ তন্দ্রাচ্ছন্ন। ভদ্রলোক ঘুমুচ্ছিলেন। তন্ময় দু'চার বাক্যের কথা শেষ করে কল কাটল। ফোন বিছানায় ফেলে ওঠে দাঁড়াল। ল্যাগেজ থেকে ট্রাউজার, টি-শার্ট বের করে নিলো। অরুর তদ্রূপ সময় লাগেনি। মেয়েটা পাঁচ মিনিটের মাথায় বেরিয়ে এসেছে। জামাকাপড় বদলেছে। পরেছে কটনের পাতলা ফতুয়া সাথে বিস্তৃত প্লাজো। হাতে স্কার্ফ। জড়সড়ো পদচারণ ফেলে এগিয়ে আসছে। অপ্রস্তুত দেখাচ্ছে; সামান্য লাজুকও বটে। দৃষ্টিতে দৃষ্টি মেলাচ্ছে না। বরং চতুর্দিক ওর মনোবৃত্তি।

কাচের ডাইনিং টেবিল জুড়ে এরমধ্যে সকলে সমাগত। উৎকণ্ঠিত ভঙ্গিতে বসে তন্ময়-অরুর জন্য। ওরা দুজন আসতেই খাওয়াদাওয়ার পর্ব শুরু। কয়েকরকমের তরকারির বন্দোবস্ত করা হয়েছে ঝরঝরে সাদা ভাতের সাথে। ইত্যবসরে রয়েছে বড়ো ইলিশ মাছের ভাঁজা। অরুর ভাঁজা ইলিশ পছন্দের। তন্ময় সেটিই আগে তুলে দিলো ওর পাতে। এই দৃশ্যে ঐশী, এলিজা মূক। দুজনই শুনেছে, তবে শোনা এবং দেখার মধ্যে আসমান সমান পৃথকতা। এলিজা তো বলেই বসল,

‘আমাদের তন্ময় হাজবেন্ড ম্যাটারিয়াল। অরু ভাগ্যবতী!’

শুহানি নিজের একাগ্রতা প্রকাশে গর্দান দোলাল।

ঐশী আমোদেই শুধাল,

‘আমরা ঠিক বলছি তো, অরু?’

অরুর উদ্ধত প্রত্যুত্তর শুনতে তন্ময়ও আনমনেই মুখিয়ে। উর্ধ্বভাগে দেখানো, পরোয়ানাবিহীন খেতে থাকা তার কান দুটো উদগ্রীব। অরুর জবাবটি বেশ সময় নিয়ে এলো। মুখচোরা ভাব কণ্ঠে,

‘হুঁ। আমিও তাই মানি।’

অতি সাধারণ প্রত্যুত্তরটি– তন্ময়ের হৃদয়ে উত্তাল সমুদ্রঝড় সৃষ্টি করল। ভালো লাগায় দুলে ওঠল। ঠোঁটের কোণেতে ভিড় জমাল সূক্ষ্ণ হাসির রেখা। খাওয়ার পরের সময়টুকুতে বন্ধুদের মধ্যে আলাপ চলল জম্পেশ। তন্ময় প্রয়োজনে দু'চার বাক্য বলছে। ভোজন শেষ হয়েছে একে-একে সবার। শুহানি পূর্বেই ছুটেছে ঘুমুতে। চোখে শর্ষেফুল দেখছে সে। রিয়ানও আর রইল না। এলিজা, ঐশী একসাথে ঘুমোবে। নিজেদের রুমে চলে গিয়েছে। সম্মুখে দাঁড়িয়ে রুস্তম, মাহিন এবং ইব্রাহিম। তিনজনের মুখাবয়ব সুবিধার নয়। অরু তন্ময়ের পাশেই দাঁড়িয়ে। চারজনের চাওয়াচাওয়ি অবলোকন করছে অবুঝ দৃষ্টিতে। রুস্তম চোখ টিপে দুষ্টু হাসল। তন্ময় তা দেখেও যেন দেখল না। নির্বিকার। তন্ময়ের কানের কাছটায় বিড়বিড়িয়ে কিছু একটা বলে চলে যাচ্ছে মাহিন। তার পেছন-পেছন বাকি দুটোও চলে গেল। অরু শুধাল,

‘ভাইয়া, কী বললেন?’

প্রশ্নটি সন্তর্পণে এড়িয়ে গেল তন্ময়। অরুর হাতটি মুঠোভরতি নিজেদের ঘরের দিক হাঁটা ধরল।

————

বারান্দার দরজা খোলা। সিলিং ফ্যান ছাড়া। পাখাদুটো ঘুরছে অনবরত। কাঠের জানালা খানা মেলে আছে। মৃদু হাওয়া ভেসে ভেতরে প্রবেশ করছে। শীতল করে তুলেছে রুম। আকাশের চাঁদটি কালো মেঘেতে ডুবেছে। আবির্ভাব ঘটেছে গুমোট, প্রাকৃতিক পরিমন্ডলের। তন্ময় বিছানায় বসেছিল। কী করবে বুঝে পাচ্ছিল না! নিজেকে অন্যদিকে ব্যস্ত রাখতে ল্যাপটপ বের করেছে। ব্যস্ততা দেখাচ্ছে কাজে। অরু বাবু মিয়াঁর থেকে সরষের তেল এনেছে। কাচের বাটি হাতে তার। এসে দাঁড়িয়েছে তন্ময়ের কাছটায়। তন্ময় আকস্মিক চোখ তুলে চাইল। ওর হাতে তেল দেখে আশ্চর্য হলো। টনক নড়ল। মনে পড়ল তখনকার বিষয়টা। ওর এখনো মনে রেখেছে? অরু বেশ চিন্তিত,

‘ল্যাপটপ নিয়ে বসলেন যে? আজ এসব করার কী দরকার? বলেছিলেন পিঠ, কোমর ব্যথা করছে। মালিশ করে দিই।’

তন্ময় একপল চাইল অরুর মুখপানে। বেশ বাধ্যভাবেই ল্যাপটপ সরিয়ে রাখল। টি-শার্ট একটানে খুলে ফেলল। পেটানো দেহ দৃশ্যমান। মাংসপেশি গুলো ফুলেফেঁপে আছে। পেটের দিকটায় সিক্সপ্যাক। অরুর দু'গাল রক্তিম হচ্ছে। ছন্নছাড়া দৃষ্টি। তন্ময় শুলো পেটে ভর দিয়ে। অরু অন্যপাশ দিয়ে বিছানায় ওঠেছে। দু হাঁটু ভাঁজ করে বসেছে পাশেই। দু’হাতে তেল নিয়ে হাত দুটো রাব করল কিয়ৎক্ষণ। উষ্ণ ভাব আসতেই, হাত দুটো ছোঁয়াল তন্ময়ের শিরদাঁড়ায়। স্পর্শে যেন ইলেক্ট্রিক্যাল পাওয়ার স্থাপিত করা। ছুঁতেই তন্ময় বড়ো করে শ্বাস নিলো। তার এখন আর মালিশ নিতে ইচ্ছে করছে না। বরংচ মালিশ দিতে ইচ্ছে করছে। তন্ময় কপাল চাপড়ে ধরল। তখনো অরু ধীর গতিতে মালিশ করছে সর্বপিঠ। বাহিরে থেকে ধ্বনি ভেসে আসছে। কর্ণগোচর হচ্ছে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ধ্বনির। অরু বেশ শক্তি প্রয়োগ করছে। হাতের তালু দুটো টকটকে লাল হয়ে গিয়েছে। ব্যথাও হচ্ছে কবজিতে। তবে থামল না। এবারে ঝুঁকে কাঁধের দিকটায়ও মালিশ করছিল। কাঁধটা শক্ত। বেশ কসরত করতে হচ্ছিল। কোমল হাত দুটো অনবরত মালিশে ব্যস্ত। অরু ধ্যানমগ্নতায় আবদ্ধ। আকস্মিক তার চোখের সামনিটায় আকাশপাতাল নড়ে ওঠল যেন। বুঝে ওঠবার আগেই নিজেকে আবিষ্কার করল তন্ময়ের বুকের নিচে। অপ্রত্যাশিত ভাবে– শোয়া। তন্ময় ঠিক তার ওপরে। উদোম দেহে। গভীর চোখে চেয়ে। তার হাত অরুর মাথার কাছটায়। মুখটা অতি কাছে। নাকে নাক স্পর্শ করছে। অরুর বড়ো বড়ো চোখদুটো শক্তভাবে বুজে গিয়েছে। তিরতির করে কাঁপছে ঠোঁটজোড়া। তৈলাক্ত হাত দুটোয় আপন হাত ডুবাল তন্ময়। দুর্বোধ্য হাসল। হাত দুটোকে তেলে মাখিয়ে অরুর পাতলা নরম তুলতুলে কোমল ছুঁয়ে দিলো মালিশ করার তাগিদে। অরু চমকে চোখ মেলে চাইল। মুহূর্তেই দৃষ্টিতে দৃষ্টি নিবিষ্ট হলো। তন্ময় ততক্ষণাৎ মুখ নামিয়ে অরুর কোমল, গোলাপি ঠোঁটে মিশে গেল। যেন এটিই একমাত্র রাস্তা পালানোর। ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। তীব্র ধ্বনি চতুর্দিক হতে শ্রবণ হচ্ছে। ভেসে বেড়াচ্ছে বৃষ্টির জল। বারান্দা, জানালা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করছে। ভিজেয়েছে ফ্লোর। এযাত্রায় তন্ময় আপন সত্ত্বাকে থামাল। টেনেহিঁচড়ে চেতনা ফেরাল যেন। অরুর ঠোঁটজোড়া ছাড়ল। নিগূঢ়ভাবে অবলোকন করল সুশ্রী মুখ খানা। পাশেই শুয়ে —অরুর কম্পিত দেহ দু'হাতে আগলে নিলো বক্ষপিঞ্জরে। চুলের উর্ধ্বভাগে চুমু বসিয়ে, মাথা বুলিয়ে আওড়াল,

‘ঘুমা…’

অরু শান্ত হয়েছে। হৃদয়ে উথাল গতিবেগ কমে এসেছে। কম্পমান হাত দুটো তন্ময়ের কোমর জড়িয়ে নিয়েছে। কান উঁচু করে বৃষ্টির ধ্বনি শুনে বলে,

‘বৃষ্টি হচ্ছে।’

‘হুঁ।’
.
.
.
চলবে...........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন