" মেহেকের জ্বর তো কমছে না। মাঝে মধ্যে একটু কমে কিন্তু রাতে আবারো বেড়ে যায়। "
ঠোঁটে সিগারেট গুঁজে সুখটান দিয়ে বললো রোশন। সবুর হোসেন একটু ভেবে বললেন,
" ওকে বরং কিছুদিন ওর বাবার বাড়ি রেখে এসো। টাকাপয়সা যা লাগে তার থেকেও দ্বিগুণ দিয়ে আসবে। যাতে কোনো সমস্যা না হয়। "
" কিন্তু বাবা আমি তো আমার বউকে ছাড়া থাকতে পারবোনা। "
সবুর হোসেন কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলেন। রোশন বুঝেও না বোঝার ভান করে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে।
" বউয়ের সাথে গ্রামে গিয়ে থাকতেও পারবে না তুমি। বড়জোর কয়েকদিন পর গিয়ে রাতে দেখা করে আসতে পারবে। গ্রামের লোকজন পুলিশকে জানিয়ে দিলে জন্য হবে। সবই তো বোঝো তুমি। "
রোশন অবুঝ না। তবুও মনটা মানতে চাইছে না। কিন্তু মেহেকের সুস্থ হয়ে ওঠা জরুরি।
" ওকে বাবা। আমি কালকে সন্ধ্যায় দিয়ে আসবো মেহেককে। "
" এখনও তো পারো!"
" আজকে থাকুক বাবা।"
" কিচ্ছু বলার নেই। বাবার মতোই হয়েছ তুমি। কিন্তু পরিণতি বাবার মতো না....."
সবুর হোসেন কথা শেষ না করেই বসা থেকে উঠে চলে গেলেন। রোশনের মনটাও অশান্ত হয়ে গেছে।
তপ্ত দুপুর। রোদের তেজ ক্ষীণ হলেও আকাশে কালো মেঘের আনাগোনা। হয়তো বৃষ্টি হবে ভেবে স্কুল থেকে বের হয়ে তড়িঘড়ি করে বাড়ির দিকে এগোচ্ছে মিষ্টি। আজ মিষ্টির গণিত পরীক্ষা ছিলো। মোটামুটি ভালো হয়েছে পরীক্ষাটা। মনমতো প্রশ্ন আসেনি। তবুও আফসোস নেই মিষ্টির। হাঁটতে হাঁটতে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে এরমধ্যেই। বর্ষাকালে এই এক ঝামেলা। হুটহাট বৃষ্টি আসে। সকালে পইপই করে মা বলেছিলেন, ছাতা সাথে নিতে। কিন্তু মিষ্টি শুনলো কই মায়ের কথা? ছাতা হাতে চলাফেরা ভীষণ বিরক্তিকর লাগে ওর। স্কুল থেকে বাড়ির দূরত্ব প্রায় দেড় কিলোমিটার। হেঁটে গেলে আধঘন্টা থেকে চল্লিশ মিনিট লাগে মিষ্টির। স্কুল থেকে মেইন রোড পর্যন্ত সব সময় হেঁটে যেতে হয়। কারণ রাস্তাটা এতটাই কর্দমাক্ত হয়ে যায় যে রিকশাওয়ালারা ঢোকে না সহজে।
" মিষ্টি! "
আচমকা পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে থমকে দাঁড়ালো মিষ্টি। পেছন ফিরে তাকাল বৃষ্টি উপেক্ষা করে। মুষলধারে বৃষ্টি না নামলেও প্রায় আধা ভেজা হয়ে গেছে মিষ্টি।
" স্যার আপনি? "
আহনাফ ছাতা হাতে এগিয়ে আসে মিষ্টির দিকে।
" ছাতার নিচে এসো আগে বলছি। "
মিষ্টির অস্বস্তি লাগছে। এক ছাতার নিচে গা ঘেঁষে হাঁটার কথা মাথায় আসছে শুধু। কিন্তু আহনাফ স্যার তো ভালো। মনকে এসব বুঝিয়ে-সুঝিয়ে পাশাপাশি ছাতার নিচে দাঁড়াল মেয়েটা।
" আমি এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম। তোমাকে পেছন থেকে দেখেই চিনতে পেরে ডাক দিলাম আরকি। "
মিষ্টির কেমন হাসফাস লাগছে। আহনাফের কথাগুলো ঠিক মনোযোগ সহকারে শুনতেও পারেনি। মুহুর্তেই চোখের সামনে সেই ভয়ংকর দিনগুলোর স্মৃতি ভেসে উঠলো মিষ্টির। সেই সব পুরুষদের স্পর্শ, হাসি, কী বিশ্রী!
" নাহ! আমাকে ছোঁবেন না, না।"
আচমকা মিষ্টির এমন ব্যবহারে অবাক হলো আহনাফ। কিছুটা দূরে সরে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছে মিষ্টি। একটা ঘোরের মধ্যে আছে মেয়েটা। আহনাফের একটু সময় লাগলো বিষয়টা বুঝতে।
" মিষ্টি, কাম ডাউন মিষ্টি। আমি তোমার আহনাফ স্যার। শান্ত হও প্লিজ।"
আহনাফ শান্তস্বরে কথা বলতে বলতে মিষ্টির কাছে এগিয়ে গেলো। মিষ্টিও বিষয়টা বুঝতে পেরে ভীষণ বিব্রতবোধ করছে এখন।
" সরি স্যার। আসলে...."
" কিছু বলতে হবে না তোমাকে। এক কাজ করো, ছাতাটা নাও আর সোজা বাড়ি চলে যাও। আমি তোমাকে কিছুটা পথ এগিয়ে দিচ্ছি দূরে দূরে হেঁটে। "
" স্যার দরকার নেই। আমি চলে যাবো। একদিন ভিজলে কিচ্ছু হবে না। "
" চুপ করে মেয়ে। যা বলছি তাই করো। তুমি একাই যাও, আমি যাবো না তাহলে। তবুও ছাতা নাও!"
আহনাফের শীতল ধমকে চুপসে গেছে মিষ্টি। আহনাফের কথামতো ছাতা নিয়ে একাই বাড়ির দিকে এগোলো সে। আহনাফ চলে গেলো নিজের গন্তব্যে।
সন্ধ্যা হলেই মেহেকের জ্বর বাড়ে। আজও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। জ্বরের মাত্রা এতটাই বৃদ্ধি পায় যে হিতাহিত জ্ঞান লোপ পায়। ঘোরের মধ্যে চলে যায় মেহেক। বিছানায় শুয়ে অস্ফুটে স্বরে কিছু ফিসফিস করছে মেহেক। মীরা পাশে বসে কপালে জলপট্টি দিচ্ছে। রোশন একটু ওয়াশরুমে গেছে। তাই এই সময়টুকুও বউকে একা রাখবে না বলে মীরাকে ডাকা।
" মীরা তুমি যাও এখন৷ আর সাড়ে আটটার দিকে খাবার দিয়ে যেও।"
রোশনের আগমনে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো মীরা। আদেশ পালনের ভঙ্গিতে বললো,
" ঠিক আছে। "
মীরা চলে গেলো বাইরে। রোশন দরজা আঁটকে মেহেকের পাশে বিছানায় উঠে বসেছে। সালোয়ার, কামিজ পরে আছে মেহেক। চুলগুলো বিনুনি করা। চোখমুখ কেমন বসে গেছে, চোখের নিচে কালো দাগ, গোলাপি ঠোঁটগুলো কেমন কালচে লাগছে। রোশনের খুব খারাপ লাগছে ওর জন্য। আজকেই ওর বাবার বাড়িতে দিয়ে আসলে ভালো হতো। কিন্তু এতো জ্বর নিয়ে এখন নিয়ে যাওয়াও তো সম্ভব না!
" তুমি এসেছো? আমাকে একটু জড়িয়ে ধরো না? "
মেহেকের ক্ষীণ স্বরে বলা কথাগুলো বুঝতে অসুবিধা হলোনা রোশনের। কপালে জলপট্টি দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে রোশন। দু-চোখ বন্ধ করে রেখেছিল মেহেক। কিন্তু রোশনের স্পর্শে ঘোলাটে দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।
" তুমি শিওর? জড়িয়ে ধরবো?"
" অনেকককক.....শিউর।"
মৃদু হেসে বললো মেহেক। রোশন নিজে ঝুঁকে জড়িয়ে ধরে পাশে শুয়ে বললো,
" শরীর খুব খারাপ লাগছে সুন্দরী? খুব কষ্ট হচ্ছে? আজকের রাতটা একটু সহ্য করো। কালকে তোমার বাবার বাড়ি দিয়ে আসবো। ওখানে ঠিক ডাক্তার এসে তোমার চিকিৎসা করবে আর তুমি ভালো হয়ে যাবে। "
মেহেক দু'হাতে রোশনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,
" আমি তো তোমার কাছেই আছি আবার কোন বাবার বাড়ি যাবো ওওওও মা? ও বুঝতে পেরেছি, তুমি যে মরে গিয়ে কবরে আছো আমাকেও সেখানে নিয়ে যাবা?"
এতক্ষণে রোশন বুঝতে পারলো মেহেক জ্বরের ঘোরে ওর নিজের মা'কে মিস করছে। পাশাপাশি উনাকেই দেখতে পাচ্ছে রোশনের মধ্যে। রোশন মেহেকের ঠোঁটে আঙুল চেপে ধরে বলে,
" এসব কথা বলে না সুন্দরী। আমার বুকে ব্যথা লাগে, দম নিতে কষ্ট হয়। আমাকে রেখেও কোথাও যাবে না তুমি। "
" কষ্ট তো আমারও হয় মা! জানো বদ লোকটা আমাকে জোর করে আঁটকে রাখে। বাবার সাথে দেখা হয় না কত্ত দিন! "
মেহেকের ছলছল নয়ন দেখে রোশনের খারাপ লাগছে। আসলেই মেয়েটা ওর পরিবারকে খুব মিস করছে। আরো আগেই একবার ও বাড়িতে পাঠানো উচিত ছিলো ওকে।
" মা শোনে না, আমার না ইয়ে পেয়েছে। একটু ওয়াশরুমে নিয়ে যাও না!"
মেহেকের কথায় থতমত খেয়ে তাকিয়ে আছে রোশন। এই মেয়ে সজ্ঞানে থাকলে কিয়ামত হলেও তো এমন কথা ওকে বল তো না। জ্বরের ঘোরে শেষমেশ বরকে মা বলে ডাকছে মেয়েটা। কিন্তু ওয়াশরুমেও তো নিতে হবে! মীরাকে ডাকলেই ভালো হয়। হ্যাঁ তাই করবে।
" তুমি একটু থাকো আমি মীরাকে ডাকছি। ও তোমাকে ওয়াশরুমে নিয়ে যাবে।"
রোশন যেতে চাইলে মেহেক হাত ধরে কেঁদে উঠে।
" তুমি এমন করো কেন? আমার সাথে তো থাকো না, এতটুকু থাকতেই চলে গেছিলা। এখন ফিরে এসে আবার কেনো যাচ্ছ! এহে এহে...."
মেহেকের অদ্ভুত কান্না দেখে হাসি পাচ্ছে রোশনের। আবার চোখের জল দেখে বুকে চিনচিনও করছে। তাছাড়া এই অসহায় অবস্থায় বউয়ের অসহায়ত্ব দেখে হাসা অনুচিত বলে হাসি ঠোঁটের কোণে আঁটকে দিলো।
" আচ্ছা যাচ্ছি না। তবুও কেঁদো না। চলো আমি নিয়ে যাচ্ছি। "
মেহেক কাঁদতে কাঁদতে হাসলো একটু। ধরে ধরে ওয়াশরুমের সামনে পর্যন্ত নিয়ে গেলো ওকে। দরজা খুলে দিয়ে রোশন মেহেককে ভেতরে যেতে বললে মেহেক বলে,
" তুমিও চলো মা। আমি একা বসতে পার বো না...কেমন মাথা ঘুরছে । "
রোশন আর না বললো না। ওয়াশরুমের মধ্যে ঢুকে দরজা আঁটকে পেছন ফিরে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কাজ শেষে মেহেক পেছন থেকে পিঠে হাত দিলে রোশন ওর দিকে ফিরে তাকাল।
" হয়েছে? চলো এখন।"
" কিছু হয়নি! পায়জামার দড়ি বেঁধে দাও।"
রোশন মেহেকের পেটের দিকে তাকিয়ে দেখে দড়ি হাত সালোয়ার কোনো রকম ধরে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা। তবে চেহারা দেখে মনে হচ্ছে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না মেয়েটা। আজকাল সালোয়ারে কে দড়ি রাখে? মনে মনে অবাকই হলো রোশন। সব সালোয়ার তো নিজেই এনেছিল কিন্তু এটা আসলো কোথা থেকে! মেহেকের শরীর কাঁপছে। রোশন এক হাতে ওকে আগলে ধরে আরেক হাতে সালোয়ার ধরে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে বিছানায় নিয়ে শুইয়ে দিলো ওকে। তারপর সালোয়ারের দড়ি বেঁধে দিলো। সুস্থ হওয়ার পর যখন মেহেক এসব শুনবে তখন ওর প্রতিক্রিয়া কেমন হবে সেটা ভাবতেই ভীষণ হাসি পাচ্ছে রোশনের।
ফজরের আজান হচ্ছে চারদিকে। এখানে স্পষ্ট আজানের ধ্বনি না পৌঁছালেও ক্ষীণ আওয়াজ ভেসে আসে। সারা রাত মাথার পাশে বসেই কাটলো রোশনের। জ্বর কমলে শরীর ঘামিয়ে যায়। তখন শরীর মুছে দিতে হয়। আবার জ্বর উঠলে জলপট্টি! তাই ঘুমানো হয় না ওর। মেহেক এতটাই দূর্বল যে কিছু অনুভব করতে পারে না। প্রিয়তমা স্ত্রী'র এমন অবস্থা দেখে সকালেই গ্রামে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করবে বলে ঠিক করে রোশন। ইমার্জেন্সি ডাক্তার দেখাতে হবে মেহেককে।
চলবে...........................