মেঘমুক্ত আকাশে সাদা মেঘের ভেলা ভাসছে। রৌদ্রময় দিনেও ঘন গাছপালার কারণে একটু-আধটু অন্ধকার লাগছে জঙ্গলটা। হন্তদন্ত হয়ে অবশেষে কাঙ্খিত জায়গায় এসে স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছে মেহেক। ঘরের দরজা খোলা! বুকটা কেমন ধুকপুক করছে। অজানা আশংকায় ভেতরটা অস্থির লাগছে ওর। রোশন কি ঘরেই আছে? হ্যাঁ আছে তো! শান্ত তো তেমনটাই বললো। নাহ, এভাবে দাঁড়িয়ে থেকে কোনো লাভ নেই। মেহেক গুটি গুটি পায়ে ঘরের দিকে এগোলো। ঘরে প্রবেশ করেই দৃষ্টি বুলালো বিছানার দিকে। চোখের উপর হাত রেখে এক পা উঁচু করে শুয়ে আছে রোশন। রোশনকে এভাবে শুয়ে থাকতে দেখে মুহুর্তেই মেজাজ বিগড়ে গেলো মেহেকের। যার জন্য এতদূর ছুটে এলো, কোনো বিপদ হলো কিনা দেখতে সে এমন আরামসে শুয়ে আছে?
" বাহ! "
আচমকা মেহেকের কণ্ঠস্বর শুনে পিলে চমকে উঠেছে রোশনের। দ্রুত চোখের উপর থেকে হাত সরিয়ে সামনে দৃষ্টিপাত করতেই বিধ্বস্ত মুখখানা নজরে এলো। কিন্তু রোশনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মেহেক বলতে লাগলো,
" কী অবাক হলেন? না, না অবাক কেনো হবেন? আমার আসাতে আপনার তো কিছু যায় আসে না। কেনো আসবে যাবে! আমি তো আপনার খামখেয়ালিতে বিয়ে করা বউ। খেয়াল হতেই সেই বউও নাই করে দিয়েছেন। একটা মেয়ে আপনার চিন্তায় প্রতিদিন, প্রতি ঘন্টা তড়পাচ্ছিল আর আপনি? এখানে নিজের মতো করে আরামসে জীবন কাটাচ্ছেন? বাহ! সুন্দর, একেবারে চমৎকার। "
রোশন অবাক হয়ে মেহেকের বলা কথাগুলো কেবল শুনে যাচ্ছে। শোয়া থেকে উঠেনি পর্যন্ত। সেটা দেখে মেহেকের রাগ যেনো তরতর করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। মেয়েটা একটু দম নিয়ে ফের বলতে শুরু করলো,
" কী? কী দরকার ছিলো আমার বাড়িতে গিয়ে আজাইরা ঢং করার? সবাইকে এটা কেনো দেখিয়েছেন, আপনি আমার দিওয়ানা? আমি আপনার ভালোবাসা, প্রাণ আরো কতকিছু। ভোগ করার জন্য তো বিয়ে করেননি, চাইলে সেটা এমনি পারতেন। তাহলে কেনো? কেনো?"
মেহেকের চিৎকার চেঁচামেচিতে এরমধ্যে ঘরের বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে শান্ত, লিমনসহ কয়েকজন। মেয়েটার মাথায় যেনো আজ আগুন জ্বলছে। চোখ থেকে পানি পড়ছে অথচ রাগে ফুঁসছে! রোশন মৃদু হাসলো একবার। মেহেক এখনো দাঁড়িয়ে বকে যাচ্ছে । বাম কনুইতে ভর দিয়ে আস্তে আস্তে শোয়া থেকে উঠে বসলো রোশন। রাগের তীব্রতায় সেসব খেয়াল করছে না মেহেক। মেহেককে শান্ত করতে এগিয়ে যাচ্ছে রোশন। মুখোমুখি দাঁড়াতেই হুঁশ ফিরলো মেহেকের।
" সুন্দরী! তুমি তো বিতর্ক প্রতিযোগিতায় ফার্স্ট হওয়ার যোগ্যতা রাখো। এতো কথা একনাগাড়ে বলতে পারো আগে তো জানতামই না। "
রোশনের কথায় আগুনে যেনো ঘি ঢালাই হলো। রোশনের বুকে পেটে এলোপাতাড়ি ঘুষি মারতে মারতে কাঁদতে লাগলো মেহেক।
" আপনি ভীষণ খারাপ! খারাপ লোক একটা। "
" নতুন জানলে?"
আচমকা রোশন ব্যথায় "আহ" জাতীয় শব্দ করায় থামল মেহেক। একমুহূর্তে যেনো সব রাগ ভুলে গেছে।
" কী হয়েছে? ব্যথা পেলেন কোথায়? "
রোশন নিজেকে সামলে বিছানার একপাশে বসলো। মেহেক সাহায্য করেছে অবশ্য। এরমধ্যে দরজার বাইরে থেকে রোশনের বাবা বলে,
" ওর বুকে গুলি লেগেছিল মেহেক। "
মেহেক চমকাল, থমকাল সবুর হোসেনের কথায়। রোশনের দিকে দৃষ্টিপাত করলো ভালো করে। সত্যি তো চেহারা কেমন হয়ে গেছে রোশনের,শুকিয়েও গেছে বেশ। সবুর হোসেন ঘরে এসে দাঁড়িয়ে মেহেকের বিস্ময় কাটাতে ফের বলেন,
" বুকের ডান পাশে গুলি লেগেছিল। আমি ভাবিনি ওকে আর বাঁচাতে পারবো। কিন্তু কথায় আছে না রাখে আল্লাহ মারে কে? "
" কিন্তু বাবা কীভাবে হলো এসব? জঙ্গলে কি আবারো..."
" নাহ। জঙ্গলের অন্য দিকের গ্রামে ডাকাতি করার প্ল্যান ছিলো সেদিন। সবকিছুই প্ল্যানমতো হচ্ছিল। হাওলাদার বাড়ি থেকে লুট করার পরে রোশন একটু পেছন পেছন আসছিল৷ হয়তো অন্যমনস্ক ছিল ও। তখনই পল্লব ওর বন্ধু শিপনকে দিয়ে রোশনের উপর গুলি করায়। কাপুরুষের মতো আড়ালে লুকিয়ে গুলি মেরেছে। অবশ্য প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারেনি পল্লব। শিপন পালিয়ে গেছে। "
পল্লবের কথা শুনতেই অসহ্য লাগছে মেহেকের। জানোয়ারটা শেষমেশ এভাবে প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল! রোশন এতকিছু সহ্য করেছে এতদিন অথচ কতকিছুই না বললাম ভেবে অনুশোচনা হচ্ছে মেহেকের।
" আমাকে একবার জানাতেন বাবা? কাউকে পাঠাতেন একবার! যদি উনার কিছু হয়ে যেতো...."
মেহেক অশ্রুসিক্ত নয়নে মাথা নিচু করে বলে। সবুর হোসেন ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। রোশন এতক্ষণে নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়েছে। তার সুন্দরী কাঁদছে সেসব কি সহ্য করা যায়?
" বাবা তুমি এখন যাও। শ্বশুর আর পুত্রবধূর আলাপচারিতা পরে সারবে। এখন আমার পালা, যাওওও!"
রোশনের কথায় মেহেক হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছে না। কিন্তু শ্বশুরের সামনে স্বামীর এহেন কথায় লজ্জা পেলো একটু।
" যাচ্ছি। পাগল ছেলে!"
সবুর হোসেন হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। মজার কথা যাওয়ার সময় দরজা টেনে রেখেই গিয়েছেন।
মেহেক অপরাধীর মতো কাচুমাচু হয়ে বসে আছে। রোশন আস্তে করে জড়িয়ে নিলো ওকে। মেহেক ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো কিছুটা।
" আমাকে মাফ করে দিবেন। আমি বুঝতে পারিনি। আসলে আমি... "
" চুপ! শান্ত হও। "
চুপচাপ ফোঁপাতে লাগলো মেয়েটা। মিনিট পাঁচেক পরে থামলো। ততক্ষণ ওভাবেই জড়িয়ে ধরে বসে রইলো রোশন। কান্না থামাতে বাহুডোর থেকে মুক্ত করে ললাটে চুম্বন এঁকে দিলো।
" শেষ যখন তোমার সাথে কথা হয়েছিল, তেলে-বেগুনে জ্বলতে আমাকে দেখে। অথচ আজ! আমার ভালোবাসায় পাগল হয়ে এতদূর ছুটে এলে! আমার জন্য এটা পৃথিবী জয় করার সমান সুন্দরী। ভাগ্যিস গুলিটা লেগেছিল! "
মেহেক ঠোঁটে আঙুল চেপে ধরে। রোশন হেসে আঙুলে কিস করে। লজ্জায় আঙুল সরিয়ে ফেলে মেহেক।
" এসব কথা বলবেন না। যদি কিছু হয়ে যেতো? আমি কী করতাম তখন? আপনি কেনো বোঝেন না..."
" আমি সবই বুঝি সুন্দরী। যেমন এখন বুঝতে পারছি, আমার বউটা তার ডাকাত স্বামীর প্রেমে হাবুডুবু না একেবারে ডুবে গেছে। "
এতক্ষণে হাসলো মেহেক। সেই হাসিটুকু এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে রোশন।
" এখনো কি খুব যন্ত্রণা করে? "
" এমনি করে না৷ তবে জোরে আঘাত লাগলে একটু ব্যথা পাই। এমনিতে ঠিকই আছে। "
"কোথায় গুলি লেগেছে দেখান তো।"
" আহ অনেকদিন আমার হটহট বডি দেখোনি তাই না? তাই এভাবে ছুতোয় দেখতে চাইছো?"
রোশনের দুষ্ট হাসিতে ভেংচি কাটলো মেহেক।
" ইশ! হট হট পরে করবেন আগে দেখান। "
রোশন আস্তে আস্তে শার্টের বোতাম খুলতে লাগলো। কিন্তু দু'টো বোতাম খুলতেই থামলো হঠাৎ। মেহেক ভ্রু উঁচিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করলো,
" কী হয়েছে?"
রোশন মেহেকের কানের পাশে মুখ এনে ফিসফিস করে বলে,
" তুমিই খোলো। একটু ফিলিংস আসবে মনে!"
চোখমুখ কুঁচকে ফেললো মেহেক। এই লোকটার সব অবস্থায় এসব বলা চাই! তাই আর কথা না বাড়িয়ে নিজেই শার্টের বাকি বোতাম গুলো খুলে নিলো। ক্ষতটা এখনো আছে, বলতে গেলে তাজা! নিশ্চয়ই জঙ্গলে ভালো করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারেনি।
" আপনাকে আমি বাড়িতে নিয়ে যাবো। এখনো আপনার প্রপার ট্রিটমেন্ট দরকার। "
" সে আমি যেতেই পারি। তবে চিকিৎসার দরকার নেই। তুমি এসে গেছো এখন এমনি ঠিক হয়ে যাবো।"
" এতো প্রেম তাহলে একবারও খবর দিলেন না কেনো?"
" এটা লিমনের বুদ্ধি ছিলো বুঝলে? আমার অনুপস্থিতিতে তোমার হৃদয়ে আমার জন্য একটুও প্রেম জাগে কি-না সেটার জন্যই এমন করেছি। অবশ্য ওরা তোমার খোঁজ রাখতো সব সময়। মিষ্টির বিয়ে ঠিক নিয়ে কথা হচ্ছে তা-ও জানি। তুমি আসবে সেটা অবশ্য জানতাম না। "
মেহেক কী বলবে বুঝতে পারছে না। লোকটাকে খারাপ না বলে বজ্জাত বললে ভালো হবে মনে হচ্ছে।
" আপনারা সবাই মিলে আমাকে এরকম টেনশনে রেখেছিলেন! "
" তার জন্য সরি সুন্দরী। চিন্তা নেই এখন, তোমার বর এখন সুস্থ। আদর, ভালোবাসা সবকিছুর জন্য রেডি আছে। যতো ইচ্ছে ভালোবাসো, চাইলে একটু আদরও করতে পারো। "
রোশন ঠোঁট উঁচিয়ে ইশারায় কিস করতে বললো। মেহেক চোখ বড়ো করতেই পিছিয়ে গেলো সে। চমকাল মেহেক! এই লোক আবার ভয়ও পায় এখন? কতবার তো জোর করেই এসব করেছে।
" আগে সুস্থ হোন তারপর এসব। যাইহোক, নাস্তা করেছেন? "
রোশন অদ্ভুতভাবে হেসে বিছানায় শুইয়ে দিলো মেহেককে। কিছু বলার আগেই মেহেকের ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে রোশন নিজেও পাশে শুয়ে বললো,
" নাহ। তুমি খেয়ে এসেছো? নাহ মুখ দেখে মনে হচ্ছে খাওনি।"
" এটা কী হলো?"
" তুমি জানো আমি এমনই! "
" আচ্ছা আপনি থাকুন। আমি মীরা আপুর সাথে কথা বলে আসছি আর নাস্তার কী ব্যাপার দেখছি।"
মেহেক শোয়া থেকে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। রোশন শুয়ে শুয়ে একা হাসছে। মনে হচ্ছে আজ জীবনের সবচেয়ে দামী জিনিসটা পেয়ে গেছে।
চলবে...........................