উন্মুক্ত লাইব্রেরী
পর্ব ১১
আয্যাহ সূচনা
সময়টা অগ্রহায়ণ এর মাঝামাঝি।পুরোনো আমলের এই বাড়ির ছোট্ট বারান্দায় বসে
অন্বেষার চন্দ্র বিলাস।নিস্তব্ধ রাতে ভেসে আসছে সুবাস।আকাশের নীলিমায় চোখ মেলে দেখলো তাঁরাদের মেলা চাঁদের আলোয় মাখা।ছোটবেলায় কত গল্প শুনেছে।এই চাঁদে নাকি বসবাস করে এক বুড়ি।সেসব আজ যেন সোনালী রূপকথা।চারপাশে নিঃশব্দে বয়ে যায় হালকা পবন।উদাসীন মন বিশাল এক ভাবনায় ভাসমান।বেহায়া মন আবার ছটফট করে।বলে,
“আজকাল বর্ণ নামক বিবর্ণ মানবের কথা বেশি বেশি ভাবছিস অন্না”
নিজের মনের কথার বিরোধিতা করে অন্বেষা একাকী বলতে লাগলো,
“ভাবছি কারণ আছে।আমার ওকে দেখলে ভীষণ মায়া হয়। সর্বশ্রান্ত মনে হয়।যেনো এক বিশাল সমুদ্র সমান কিছু লুকানো ওর মাঝে।”
অদ্ভুত!নিজের মনই প্রশ্ন করলো, “শুধুই সহানুভূতি নাকি এটি প্রেমানুভূতি?”
নিজের মনের প্রশ্নেই হচকচিয়ে উঠে অন্বেষা।দেহ টানটান করে বসলো।আনমনে বিড়বিড় করলো,
“কারো প্রতি মায়া থাকলেই কি সেটা প্রেম বলে গণ্য হয়?আমি বর্ণের চোখে হাহাকার দেখেছি।ওর অনেক গল্প আছে।অজানা,অন্তরালে।আমি বুঝি।আমার বাবা চলে যাওয়ার পূর্বে যে শিক্ষাগুলো দিয়ে গেছেন সবই আমার মনে আছে। বাবা বলতেন হোক সে কোনো নারী বা পুরুষ?গরীব অথবা ধনী।কারো প্রতি শ্রদ্ধা, সহানুভূতি প্রকাশ করতে কখনো কার্পণ্য বোধ করতে বারণ করেছেন।নিজের হাত সবসময় বাড়িয়ে রাখতে বলেছেন।কারো প্রয়োজন হলেতো সে ধরবেই।”
মন যেনো ঠাট্টা করে বলে উঠলো,
“সত্যি এটাই অন্না তুই নিজের একাকীত্বকে কাটানোর সঙ্গী পেয়েছিস।কেনো বর্ণের গল্প আছে বুঝতে পারিস?কারণ তুই নিজেও একই নৌকার মাঝি।কঠোর আমি কেনো হুটহাট গলে যাই?”
অন্বেষা আত্মবিস্মৃত হয়ে পড়ে। এ কেমন বিবাদ?নিজের সাথেই নিজের।তবে সত্য!বহুকাল হতে একাকিত্ব নীরব চিৎকার করে যাচ্ছে।যেখানেই চায় শুধু মরুভূমি।এদিক ওদিক ফিরেছে মানুষের খোঁজে।যদি এমন কেউ মেলে?যাকে মনের কথা বলা যায়?পায়নি।ব্যর্থ হয়েছিল।তবে সেদিন বুড়িগঙ্গার তীরে অভিলাষে বলেছে,উজাড় করেছে মনের কথাগুলো বর্ণের নিকটে।
“বোধহয় দুটো বিচ্ছিন্ন খন্ডিত চিত্র একত্রে নতুন এক রঙিন ক্যানভাস সাজাবে”
______
“ফুপু আপনাকে দুইদিনের কথা বলেছিলাম।আজ পাঁচদিন হতে চললো।আগামীকাল আমার ফি জমা দেওয়ার শেষ দিন।কোনো রকম টাকা জোগাড় করে বাড়ির এডভ্যান্স দিয়েছি।মালপত্র এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিতে আমার ভ্যান ভাড়াও গিয়েছে।আপনি বুঝতে পারছেন আমি কত সমস্যার মধ্যে আছি?”
জেসমিন আক্তারকে তার বাড়ির নিচে ডেকেই রাগী সুরে কথা বলে যাচ্ছে অন্বেষা।বারবার বলার পরও টাকা দিচ্ছেন না তিনি।উল্টো অন্বেষার তীক্ষ্ম কন্ঠ শুনে অবাক।বললেন,
“তোমার টাকা যেমন মাইরা খাবো? বললামতো দিবো!একা থাইকা তোমার তেজ বাড়ছে!আগেতো এমন ছিলা না”
“পরিস্থিতি মানুষকে অনেককিছু শিখায় ফুপু।সাথে মানুষ চিনায়।আপনি জানেন আপনার ছেলে কি করেছে?”
সৌভিকের কথা আসতেই মুখের রং বদলে গেলো জেসমিন আক্তারের।দারুন উৎকণ্ঠা হয়ে প্রশ্ন করলেন,
“কি করেছে?”
“আমার নতুন বাড়ির সামনে গিয়ে অসভ্যের মতো আচরণ করেছে।আমার হাত ধরে টানাটানি করেছে।এসব কি শিখাচ্ছেন ছেলেকে?”
জেসমিন আক্তার কপট খাপ্পা স্বরে বলে উঠেন,
“অসম্ভব!আমার ছেলে এমন কিছুই করতে পারেনা”
অন্বেষা নিষ্ফল হেসে বললো,
“এই আধুনিক সমাজে সন্তানরা এমন অনেক কিছুই করে যেটা বাবা মা জানে না।আমি বলে দিচ্ছি আমাদের মধ্যে ভঙ্গুর যে সম্পর্কটুকু অবশিষ্ট আছে সেটাও নষ্ট করবেন না।”
“তুমি হুমকি দিচ্ছ সম্পর্ক নষ্ট করার?”
“বাধ্য হচ্ছি!আমার টাকাটা?নূন্যতম আত্মসম্মান বোধ থাকলে দিয়ে দিন। কোথায় গেলো আপনার অহংকার আপনার গরিমা?আপনি না প্রায়ই আমাদের বাড়ি এসে বাবাকে বলতেন আপনার স্বামী হেন আপনার স্বামী তেন।স্বামীর সংসারে চাকচিক্য দেখে নিজের আপন রক্তের ভাইকে হাসির পাত্র বানাতেন।এখন দেখান অহংকার।টাকা দিয়ে বুঝিয়ে দিন আপনি আজও সমৃদ্ধশালী।পারবেন?না পারলে বুঝবো আপনারা কাঙ্গাল।”
গায়ে এসে কাটার মত বিধলো কথাগুলো। ফুঁসতে লাগলেন জেসমিন আক্তার।চোখে সেই ঝলক স্পষ্ট।তবে এই গরমি জ্বলসাতে পারলো না অন্বেষাকে।সে অকুতোভয়।সোজাসুজি ফুপুর চোখে চেয়ে আছে।জেসমিন আক্তার বললেন,
“এসব দুই তিন লাখ টাকা আমার কাছে অবহেলায় পড়ে থাকে।আর তুমি আত্মসম্মানহীন বলছো আমাকে?ভাই যাওয়ার আগে তোমাকে মানুষ বানিয়ে যেতে পারেনি। দাঁড়াও এখানেই দাঁড়াও।পুরো দুই লক্ষ টাকা নগদ এনে দিচ্ছি তোমাকে।”
জেসমিন আক্তার ধেইধেই করে উপরে চলে গেলেন।যাক এতদিনে তাহলে আত্মসম্মান বোধ জেগেছে।চোখ খিঁচে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে অন্বেষা।মিনিট দশেক পর জেসমিন আক্তার নেমে এলেন।হাতের মুঠোয় মোটা খাম।একপ্রকার ছুঁড়ে দিলেন। অন্বেষা অকিঁচিৎ হাসলো।
জেসমিন আক্তার বলেন,
“কত ভালো অফার দিয়েছিলাম তোমাকে।আমার ঘরে আসার।মানুষের মতো বাঁচতে পারতা”
“এইযে সমাজের স্বনামধন্য বিত্তবান আপনারা?নিজেদের মানুষ বলে দাবী করেন আর অন্যকে অমানুষ।….সত্যি হচ্ছে মানুষ তারাই যাদের মানুষ বলে গণ্য করা হয়না।আসি”
______
শীতের অপেক্ষা করতে করতে অগ্রহায়নের মৃদু ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে মেতে ঢাকা শহর।ভাগ্যিস ওয়েদার ফরকাস্ট দেখেছিলো অন্বেষা।আজ ছাতা নিয়েই বেরিয়েছে।যার দৌলতে টাকাগুলো নিরাপদ।দুই লক্ষ টাকা নয় যেনো আলাদিনের চেরাগ পেয়েছে।এগুলো তার বাবার টাকা।মুখে জয়ের হাসি অন্বেষার।ব্যাগের এককোনে টাকা রেখেছে।বুকে চেপে আছে ব্যাগ।অন্যহাতে ছাতা।হুট করে মন খারাপ হলো।যে মানুষটা দুইলক্ষ টাকার ঊর্ধ্বে জমাতে পারেনি। ব্যাংকের সুদ পর্যন্ত গ্রহণ করেনি তার পরিণতি কি হলো ভদ্রলোকের সমাজে? অপবাদী? নিমকহারাম?আর?আর মৃত্যু!
লম্বা একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বাড়ির গলিতে ঢুকতেই মনে হলো কেউ তার পিছু নিচ্ছে। শিস বাজাচ্ছে অনবরত। অন্বেষা ঘুরে তাকালো।দেখলো অর্ধ ভেজা বর্ণকে। কৃষ্ণাভ মুখে লম্বা চওড়া হাসি।দাঁত বের করে হাসছে অন্বেষার দিকে চেয়ে।ঝাঁকড়া চুল সিক্ত পরিপাটি হয়ে কপালে ঝুঁকে।পাগলের মত হাসছে।
অন্বেষা ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করলো, “কি?”
বর্ণ চুল ঝাড়তে ঝাড়তে এগিয়ে আসে।বলে,
“কালকে আমারে খাওয়াইতে চাইছিলা।কই খাওয়ন কই?দাও!”
“সাথে নেই এখন….পাগলের মত অযথা কেনো হাসছো?”
“কি করুম?তোমার মুখ দেখলেই হাসি আহে।”
মুখে মানের রেশ।বুঝাতে চাইছে তার উপর রেগে আছে অন্বেষা।আধ পাগল লোকটা বুঝতে পারলে না!বললো,
“একটু পর বাড়ির নিচে এসে নিয়ে যেও।গেলাম আমি”
“তুমি কি আমার লগে গোসা করছো?”
ঘুরে দাঁড়িয়েছিলো অন্বেষা চলে যাবে বলে।বর্ণের প্রশ্নে আবার ঘাড় ঘুরায়।ভার মুখের অবয়ব বজায় রেখে বললো,
“করলেও কি?”
“করো!না করছে কেঠা?আমার খাওয়ন দাও আমি যাইগা”
অন্বেষা দেখলো বর্ণ ভিজে একাকার হয়ে যাচ্ছে।একটু একটু বৃষ্টি তাকে পুরোটাই কাকভেজা করে ফেললো।পাশেই একটা চায়ের দোকান।কোনো মানুষ নেই সেখানে। দোকানী একা বসে। অন্বেষা ছাতা বন্ধ করে শুষ্ক স্থানে গিয়ে বসলো। বর্ণও তাকে অনুসরণ করে এসে বেঞ্চিতে বসে।বর্ণ দোকানির দিকে চেয়ে বলে,
“আমগো দুইকাপ চা দেন চাচ্চা।বিল এই ছেমরি দিবো।বিরাট বড়লোক বুঝলেন!”
দোকানী বললো, “আচ্ছা”
বর্ণ অন্বেষার দিকে চেয়ে বলে,
“দিবা না?এক প্যাকেট সিগারেট লই?”
অন্বেষা আড়চোখে তাকায়। রুষ্ট চাহনি তার।চায়ের বিল দিতে ইচ্ছুক হলেও সিগারেট এর কথা শুনে দুটো বিল বর্ণের ঘাড়ে চাপাতে ইচ্ছে হচ্ছে।বর্ণ অন্বেষার মুখ পরখ করে বলে,
“এমন ঢং করতাছো কেন কও তো?এই দরদ দেখায়া খাইতে ডাকো আবার এহন ঘাড়ত্যাড়ামি!যেমন লাগে চিনোই না।”
অন্বেষা সাথে সাথে জবাব দিলো না।চায়ের কাপ আসে।এক চুমুক দিয়ে বলে,
“যতক্ষণ না তুমি তোমার পায়ের ব্যবস্থা করছো!ততদিন আমার সাথে তোমার কোনো আলাপ নেই।আবারো অপরিচিত হয়ে যাবো।”
“নাটকের শেষ নাই না?”
“নাহ নেই!”
“কইছিলাম জোর করতে না।”
অন্বেষা কিছুটা মুখ ঘুরায়।তবে তাকালো না বর্ণের দিকে।বললো,
“জোর করছি না।অপশন দিচ্ছি।….সরকারি হাসপাতালে বেশি টাকা লাগবে না।যা লাগে আমি আছিতো”
বর্ণ আবারো দুষ্টুমি করে কিছু বলতে যাচ্ছিলো।মুখ রেডিওর মত ঝিরঝির করতেই থাকে তার।কিন্তু অন্বেষার শেষ বাক্যে কিছুটা থমকে গেলো। ‘ আমি আছিতো’ শব্দজোড়া ছোট কিন্তু বিশাল ভাবার্থ বহন করে।কয়লা রঙের মনে একটু হলেও ছুঁয়ে যায়।কিন্তু নিজের স্বভাব ছাড়লো না।বললো,
“দেহি কি করা যায়!”
“ভাববার সময় আগামীকাল পর্যন্ত।”
“আবার থ্রেট দাও!আমার মাথা গরম কইরো না।”
বর্ণ এক চুমুক চা আবার একবার সিগারেট ঠোঁটে চেপে ধোঁয়া উড়াচ্ছে। অন্বেষা কিছুক্ষন চেয়ে রইলো বিবর্ণ মুখের দিকে।
“মদও খাও?”
তুচ্ছ হাসলো বর্ণ।বললো,
“মদ খাওয়ার যদি টাকা থাকতো? তাইলে আগে দুইবেলার জায়গায় চারবেলা ভাত গিলতাম। মদ ইজ ভেরি মাচ এক্সপেনসিভ।মাঝেমধ্যে সিগারেট খাই”
হৃদয়টা হুহু করে উঠলো অন্বেষার।কি নিদারুণভাবে বুকের মধ্যে লুকায়িত আর্তনাদ জাহির করে ফেললো!ফ্যাকাশে মুখে।কয়েক শব্দে দুমড়ে মুচড়ে রেখে দিলো চিত্ত।
“তোমার খারাপ লাগেনা মানুষ তোমাকে খারাপ চোখে দেখে যে?ইচ্ছে হয়না এই গুন্ডাগিরী ছেড়ে সঠিক পথে চলার?নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করার?”
শূন্যে নাক মুখ হতে সিগারেট এর ধোঁয়া উড়িয়ে বর্ণ গম্ভীর গলায় বললো,
“কারে প্রমাণ করমু?কি কারণে? আপন মানুষরে?নাকি কোনো পররে?....আমারে ত্যাজ্য করার আগে আমার বাপের খারাপ লাগে নাই।আমার মা মরার তিনদিনের মাথায় অন্য বেটি ঘরে তুলতে আমার বাপেরতো কষ্ট লাগেনাই।আমার পশ্চাতে লাত্থি দিয়া সৎ মা ঘর থেকে যখন বাইর করছিলো আমার বাপের তখন মায়া হয় নাই।রক্তের মানুষ আমারে কুত্তার চোখে দেখছে তখনও আমার কষ্ট লাগে নাই।বর্ণের অন্তর নাই।কারে প্রমাণ করমু?যারা আজ আছে কাল নাই।আমার এসব সামাজিকতা ভাল্লাগে না।আমি যেমনে আছি বিন্দাস আছি।”
চলবে….........................