পাতা বাহার - পর্ব ২৫ - বেলা শেখ - ধারাবাহিক গল্প


জোৎস্না রাতে মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। চাঁদের ম্লান আলো পুরোপুরি ছড়াতে না পারলেও ঘনঘটা অন্ধকার দূর করেছে। কালো মেঘলা আকাশ চাঁদের আলোয় মৃদু আলোকিত। দেখা নেই তারকারাজির। ধরনীতে মৃদু এলোমেলো হাওয়া। রাস্তার দু'পাশে ধানক্ষেতে শূন্যতায় ভরপুর। ধান নেই তাতে। মাটি ঘেঁষে সবুজ ঘাসের সমাহার তাতে হাঁটুর নিচ অবধি বৃষ্টির পানি জমে। আবাদি জমির শেষ সীমান্তে বসতি গড়ে উঠেছে। সেখানে থেকে আলো এসে পড়েছে জমিতে। এছাড়াও জমিতে আলো নিয়ে অনেকেই মাছ ধরতে নেমেছে। পানির ভিতরে থাকা সোনা ব্যাঙ গুলো ডাকছে অনবরত! ফাঁকা পিচঢালা রাস্তার হাত ধরে হাঁটছে দুই বন্ধু। অরুণ ও রাসেল। পিছনে ড্রাইভার হেড লাইট বন্ধ করে গাড়ি চালিয়ে আসছে খুবই ধীর গতিতে। রাস্তার দু ধারে বিভিন্ন গাছের সারি। বিভিন্ন আগাছাও জড়িয়ে আছে। সেখানে দুই তিনটি জোনাকি পোকা উড়ছে। অরুণ একটা ধরে এনে হাতের মুঠোয় পুরে। ভিতরে জ্বল জ্বল করে জ্বলছে জোনাক পোকা! হাতের আঙ্গুলের ফাঁকা স্থান দিয়ে সেই আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে। অরুণ হেসে বলে,

-" ভোর এটা দেখলে অনেক খুশি হতো!"

রাসেল বন্ধুর দিকে অন্ধকারে চোখ ছোট ছোট করে চায়। খুব হাসছে এই বেডা!

-" বাহ বিয়ে করে দেখছি অরুর মুখ থেকে হাসিই সরছে না। মনে লাড্ডু ফুটছে তাই না?"

অরুণ হাসিমাখা মুখ বিরক্তিকর চাহনিতে পরিণত হয়।
 
-" হ্যা‌ সরছে না। লাড্ডুও ফুটছে। তোর কোনো সমস্যা রাসেলস ভাইপার?"

রাসেল সাপের মতোই ফুঁসে উঠে।

-" খবরদার ওই নামে ডাকবি না। আমি মেজর রাসেল রানা তোকে বৃষ্টির জলে চুবিয়ে মারবো!'

-" তুই কেন অরু ডাকিস শালা?"

রাসেল হো হো করে হেসে উঠে। অরুণে কপোল জোড়া টেনে বলে,

-" ও কিউটি পাই! অরু ইজ আ সুইট নেম!"

-" রাসেল ভাইপার ওলসো আ সুইট নেম! এই এই রাসেল দেখ ওই ওইটা কি সাপের মতো দেখা যাচ্ছে!"

অরুণ জঙ্গলের দিকে আঙুল তুলে ইশারা করে খানিক সতর্কতার সুরে বলে। এমনিতে বর্ষাকাল। চারদিকে পানি থৈ থৈ করছে। সাপ বের হওয়া সিমপেল ব্যাপার। রাসেল অরুণকে জাপটে ধরে 'সাপ সাপ' বলে চিল্লাতে থাকে। সে সাপে খুব ভয় পায় কি না। অরুণ চুপ হয়ে যায়। রাসেলের চিল্লানো থেমে যায়। ফিসফিসিয়ে ধীরে খানিক ভিতু গলায় বলে,

-" এই অরু অরু? মটকা মেরে গেলি কেন? কোথায় সাপ?"

অরুণ গম্ভীর মুখে বলে,

-" আমাকে জাপটে ধরে আছে। রাসেলস ভাইপার। তাইতো শান্ত হয়ে আছি!"

রাসেল চোখ বুজে নেয়। বুঝতে অসুবিধা হয় না শালা মজা করছে। এই যবে থেকে রাসেলস ভাইপার সাপ ভাইরাল হয়েছে সাথে তার নামটারো পিন্ডি চটকে গেছে। ইয়ার শালার ছেলে মেয়েরাও আজকাল আব্বু বলে ডাকে না! রাসেলস ভাইপার বলে ডেকে হাসিতে ফেটে পড়ে! ইয়া আল্লাহ তুমি সহায় হও। সে অরুণকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বলে,

-" শালা তুই জীবনেও ভালো হবি না। তোর ফোন পেয়ে আসাও ভুল হয়েছে।মিরজাফর!"

অরুণ তার মাথায় চাটি মেরে হাঁটা শুরু দেয়। রাসেল সেথায় দাঁড়িয়ে থেকে অরুণের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছু পল। তারপর দৌড়ে বন্ধুর কাঁধ জড়িয়ে বলে,

-" এই অরুণ সিরিয়াসলি বলতো এই বিয়ের চক্কর টা কি? হ্যা শুভ বললো বিয়ের জন্য রাজি হয়েছিস! তাই বলে এভাবে? মেয়েটা বয়সেও ছোট! অবিবাহিত। ভোরকে মেনে নেবে তো?"

অরুণও এক হাত পিছনে দিয়ে বন্ধুকে আকড়ে ধরে। দুজন গলাগাটি ধরে হাঁটতে থাকো পথ ধরে। 

-" আমি ভেবেচিন্তেই এগিয়েছি। পাতা মেয়েটা কাইন্ড হার্টেট। সি উইল নেভার হার্টস মায় চাইল্ড। সে ভালোবাসবে আমার কলিজাটাকে।"

-" আর সেটা কিভাবে বুঝলি?"

অরুণ হাসে।

-" কিভাবে? দেখ জীবনের সাইত্রিশটা বছর পার করে এসেছি। এখনো মানুষ চিনতে ভুল করবো? মানুষের ধোঁকা ছলচাতুরীতে পা দিয়ে দিয়ে এখন শিখে গেছি মানুষ চেনা।"

রাসেল অধরকোনে হাসি ফুটে ওঠে। সে বন্ধুর পিঠ চাপড়ে বলে,

-" তো বর বাবু বলো? বুড়ো বয়সে কচি বউ পেয়ে ফিলিংস কেমন?"

অরুণ বন্ধুর পেটে গুতো মারে। রাসেল পেট ধরে। মুখ দিয়ে বের হয় ব্যথাতুর ধ্বনি।

-" শালা! মারলি ক্যান?"

অরুণ গম্ভীর গলায় বলে,

-" রেসপেক্ট হার! সি ইজ নাও মিসেস অরুণ সরকার!"

রাসেল ব্যাথা ভুলে যায়।

-" ও হো হো হো! মিসেস অরুণ সরকার! এই শালা সত্যি করে বলতো? ঘটনা কি ? আগে থেকেই লাড্ডু ছিলিস নাতো?"

অরুণ তার কথার উত্তর দেয় না। হাঁটতে হাঁটতে বলে,

-" আর হ্যা! আমি ওতটাও বুড়িয়ে যায় নি। স্টিল গার্লস ক্রাশড অন মি।"

রাসেল তার সাথে পা মিলিয়ে অরুণের কানের পিঠের চুল টেনে বলে,

-" কচি খোকা তুই!! বাল পেকে সাদা হয়ে গেছে। ছেলে বিয়ে দিতে হবে ক'দিন পর! গার্লস ক্রাশড অন মি!!"

শেষের কথাটা ভেঙ্গিয়ে বলে। অরুণ চুলে হাত চালিয়ে খানিকটা হাসে। রাসেল হঠাৎ অরুণের সামনে দাঁড়িয়ে দু হাত বাড়িয়ে থামায়। অরুণ ভ্রু কুঁচকে চায়। রাসেল হেসে ফিসফিসিয়ে বলে,

-" এই বিয়ে করলি অথচ বাসর না করে বউ শশুরবাড়ি রেখে আসলি! কাজটা কি ঠিক হলো?"

অরুণ লম্বায় রাসেলের থেকে দু ইঞ্চি ছোট। সে বন্ধুর ঘারে হাত গলিয়ে বলে,

-" একদম না। তবে রেখে আসতে হলো! অরুণ সরকারের বউকে এই রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে চুরিয়ে ঘরে তুলবো নাকি? ধুমধামের সাথে ঘরে তুলবো। সাথে বাসরটাও সেরে নেবো!"

রাসেল মেয়েদের মতো ভেংচি কেটে ভঙ্গিমা করে বলে,

-" আমি কি বুঝিনা! তুই শালা মুখিয়ে ছিলি। যে কেউ বলুক অরুণ সরকার তুমি আজ রাতটা থেকে যাও? তুই সাথে সাথে পাতাকে নিয়ে ঘরে খিল দিতি! তোকে আমি চিনি না ভেবেছিস? শালা পিপাসায় কাতার রসিক ভোঁমড়া! ফুলের মধু খাওয়ার জন্য পাগল পাড়া!"

অরুণ ছেড়ে দেয় তাকে। গাড়ির দিকে যেতে যেতে বলে,

-" আমার কলিজা অপেক্ষা করছে আমার জন্য। তোর ফালতু কথা শোনার সময় মুড কোনোটাই নেই। তুই রাসেলস ভাইপার আপন প্রজাতির সাথে দেখা সাক্ষাৎ কর! পিছনেই ওৎ পেতে আছে!"

রাসেল চোখ বড় বড় করে দৌড় লাগায়।

-" শালা তোর বাসর ঘরে মনষা দেবী না এসে রাসেল ভাইপার আক্রমণ করবে। আমি নিজে সাপের লিডারের সাথে ডিল ফাইনাল করবো!"

•••••••••••••

এক বৃষ্টিস্নাত ভোর। শেষ রাতের বেলায় বেশ সময় নিয়ে ভারি বর্ষণ বর্ষিত হয়েছে ধরনীতে। গর্ত ডোবা পানিতে টইটুম্বর। একে বারে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেছে যেন। এখনো ঝিরিঝিরি বারিধারা বহমান। পাতা নিজের ঘরে বসে কাপড়চোপড় ব্যাগে ভরছে। বিছানা ঘেঁষে জানালা খোলা।সেখান থেকে আগত হালকা বাতাস রুমটা শীতল করে রেখেছে। জানালার পানে দেখা মিলে পানিতে ভরা জমি। যেন কোনো শান্ত তটিনী। যার বুকে আছড়ে পড়ছে শিশির কনা। অন্যসময় হলে পাতা জানালায় মাথা ঠেকিয়ে এমন সৌন্দর্য ঘেরা দৃশ্য অনুভব করতো। কিন্তু আজকের ব্যাপারটা ভিন্ন। সে ব্যাগ গোছাতে খুবই মনোযোগী। সে গুনগুন করতে করতে কাপড় সহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ভড়তে থাকে। এমন সময় লতা গম্ভীর মুখে ভেতরে প্রবেশ করে মেয়েকে কোলে নিয়ে, পিছনে লাবিব। পাতাকে গোছগাছ করতে দেখে বলে,

-" জামাইয়ের বাড়িতে যাওয়ার খুব তাড়া দেখছি! একেবারে কাপড়চোপড় গুছিয়ে রেডি!"

পাতা বোনের পানে চায়‌। লতাপু রাত থেকেই বেশ গম্ভীর। সে নারাজ আছে তার উপর অরুণ সরকারকে বিয়ে করার জন্য। পাতা হেসে বলে,

-" বাহ রে! নিজের বাড়ি দেখার জন্য এক্সাইটেড হবো না!"

লতা কটমট করে চায়।

-" মনে রাখিস! সেটা তোর নিজের বাড়ি না। শশুর বাড়ি! আর সংসার! সেটার ভাগ তো আগেই হয়ে গেছে। তোর স্বামীটাই একসময় অন্যকারো ছিল! অথচ তুই একান্ত নিজ মানুষের স্বপ্ন দেখছিলি।"

পাতার হাস্যোজ্জ্বল মুখ মলিন হয়ে আসে। তবুও ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে বলে,

-" ওটা পাতার জামাই বাড়ি নট শশুড় বাড়ি!আর তুমিই তো বললে ছিলো! এখন তো নেই। এখন সে একান্তই আমার বনে গেছে। আর পাতা অনেক সহ্য করেছে‌। দেখ ইনশাআল্লাহ আর করবে না। যা পাতার তা পাতারই। এক আনাও অন্য কারো নয়।"

-" আর অন্যের ছেলেকে পালবি? সৎ মা হয়ে থাকতে পারবি সারাজীবন?"

পাতা বোনের দিকে চায়।

-" আপু অন্যের না। যেই মুহুর্ত থেকে লোকটা আমার হয়েছে সেই মুহূর্ত থেকেই তার সকল কিছুই আমার। অন্যের ছেলে নয় সে আমার ছেলে। আর মা সৎ হয় না। মা তো মা' ই। দেখো না, তোমার খালাকে সবাই বলে পাতার পালিত মা। কিন্তু আমার কাছে তা না। আম্মুর মতো সেও আমার মা। আমি তাকে মায়ের মতোই ভালোবাসি। আমার ছেলেও আমাকে ভালোবাসবে। আমিও বাসবো।"

লতা রাগে গজরাতে গজরাতে বেড়িয়ে যায় মেয়েকে বিছানায় বসিয়ে রেখে। পাতা শুনতে পায় লতা চিল্লিয়ে বলছে,

-" এসেছে জনদরদী! আপডেট যুগের শাবানা! ইশ যন্ত্রণায় আমার মাথা ফেটে গেল!"

লাবিব পাতার দিকে জহুরি নজরে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ।পাতা ওড়না ভাঁজ করতে করতে ভ্রু নাচিয়ে বলে,

-" কি বোনের ছেলে? ওভাবে কি দেখো?"

লাবিব বড়দের মতো ভাব নিয়ে দু হাত পিছনে রেখে বলে,

-" মায়ের বোন? তুমি এখন ওই বুড়ো লোকটার বাড়ি যাবে?"

পাতা চোখ রাঙিয়ে আঙ্গুল তুলে শাসিয়ে বলে,

-" বুড়ো কাকে বলছো? খালুজান হয় তোমার! সম্মান দিয়ে কথা বলো! পাতার জামাইকে নিয়ে কোনো ঠাট্টা চলবে না। রেসপেক্ট হিম!"

•••••••••••••••

সরকার বাড়ির পরিবেশ রমরমা সাথে বেশ গরম। গতরাতের ভারি বর্ষণ বাইরে চলমান বারিধারার সাথে শীতল বাতাস কিছুই যেন পরিবেশ ঠান্ডা করতে পারছে না। অরুণ ছেলের শিয়রে বসে। ভোর কম্ফোর্ট জরিয়ে শুয়ে চিল্লিয়ে কাঁদছে। অরুণ করুণ চোখে ছেলের দিকে চেয়ে। তাকে ধরতেই দিচ্ছে না। ছুলেই গলা ফাটিয়ে কাঁদে। এদিকে গায়ে ভিষণ জ্বর।‌ গতরাত বাড়ি ফিরে দেখে ছেলে ঘুমোচ্ছে পাশে আদুরি জলপট্টি দিচ্ছে। সে অস্থির হয়ে পড়েছিল। আদুরি সান্ত্বনা দিয়ে বলে,

-" বড়ভাই সিরিয়াস কিছু না। অল্প জ্বর। ওষুধ খাইয়ে দিয়েছি। কয়েকবার জলপট্টি দিলাম। ঠিক হয়ে যাবে।টেনশনের কিছু নেই। তুমি বসো আমি খাবার আনছি তোমার জন্য।তখন না খেয়েই বেরোলে!"

সে মানা করে দেয়। তার কলিজা জ্বরে পুড়ছে আর সে খাবে? খাবার গলা দিয়ে নামবে!! সে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে জলপট্টি দিয়েছে। অল্পসময়ের মধ্যেই জ্বর কমে আসলে তবেই দু'চোখ জুড়ে ঘুম নামে। 
ভোরের দিকেও ভোরের জ্বর ছিল না। সে মর্নিং ওয়াক থেকে এসে দেখে গা গরম অল্প। নাস্তা ওষুধ নিয়ে আসে তুলে খাইয়ে দিবে। ওঠে ভালো ছেলে হয়ে। কিছু কিছু সময় পিটপিট করে চেয়ে তাকে দূরে সরিয়ে কান্না জুড়ে দেয়। তাকে ধরতেই দেবে না। ধরলেই কান্নার গতি বেড়ে যায়। অরুণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছেলের গা থেকে কম্ফোর্ট সরিয়ে বুকে টেনে নেয়। ভোর আরো জোরে চিল্লাতে থাকে। হাত পা ছুঁড়তে থাকে।অরুতের বেড়ে যাওয়া দাঁড়ি ধরে টান মারে। বুকে কিল ঘুষি মারতে থাকে। অরুণ ছাড়ে না। বেশকয়েকটি চুমু খায়। ভোর অরুণের গালে দাঁত বসায় জোরে। ছাড়ে না। ব্যাথায় অরুণের চোখে পানি চলে আসে তবুও ছাড়ে না। ভোর মুখে নোনতা স্বাদ পেলে তবেই ছেড়ে দিয়ে বিছানায় শুইয়ে কম্ফোর্টে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে থাকে। বাড়ির সবাই উপস্থিত হয় অরুণের রুমে। ভোরকে ডাকে আদর করে শোনে না। কাছেই ঘেঁষতে দেয় না। না মিনু না আভারি! কাউকেই না। সকলে অরুণের গালে রক্ত ঝরতে দেখে ঘাবড়ে যায়। স্যাভলন তুলা দিয়ে আরিয়ান রক্ত পরিষ্কার করে। অরুণ প্রতিক্রিয়াহীন।ছেলেটার কি‌ হলো? এমন করছে কেন? সে উঠে দাঁড়ায়। ব্যস্ত ভঙ্গিতে পায়চারি করতে করতে ফোন বের করে। আরিয়ান বিরক্ত হয়ে বলে,

-" ভাই? তুই পাগল হয়ে গেলি নাকি। ক্ষতস্থান পরিষ্কার করতে দে না?"

অরুণ তোয়াক্কা করে না। কল করে কানে ঠেকিয়ে রাখে। একটু পর রিসিভ হলে অরুণ উদ্বিগ্ন স্বরে বলে,

-" মিস পাতাবাহার?"

পাতা ফোন রিসিভ করে লাউডে দিয়ে বিছানায় রাখে। পাশে লাবিব টুম্পা বসে খেলছে। ব্যাগের চেন আটকাতে আটকাতে জবাব দেয়,

-" বলে ফেলুন!"

অরুণ নিজেকে শান্ত করে শান্ত ভাবেই বলে,

-" ছেলেটা ঘুম থেকে উঠেই কাঁদছে। থামছেই না। কেন কাঁদছে সেটাও বলছে না। আমাকে কাছেই ঘেঁষতে দিচ্ছে না। গেলেই গলা ফাটিয়ে কাঁদে। গায়ে অনেক জ্বর। ওর কি হয়েছে বলুনতো?"

পাতার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। এমন করে কাঁদছে কেন? হঠাৎ মনে পড়ে বাপ বেটার মধ্যে মান অভিমান চলছে। গাড়িতেও তো একে অপরের সাথে কথা বলছিল না।

-" আপনি কালকে ওই আইসক্রিম পার্লারের ইন্সিডেন্সের পর ছেলেটার সাথে কথা বলেছিলেন?"

অরুণ ছেলের দিকে তাকিয়ে গাল ফুলায়। 

-" নাহ!"

পাতা ব্যস্ত ভঙ্গিতে কাজ করতে করতে বলে,

-" তাহলে আগে ছেলের সাথে কথা বলুন। সব ঠিক হয়ে যাবে।"

-" ওকে রাখছি!"

-" শুনুন ভোরের বাবা?"

অরুণ চোখ তুলে চায়। কি সুন্দর সম্বোধন! তার কানটা যেন জুড়িয়ে গেল।

-" জি বলুন?"

পাতা ইতস্তত করে খানিকটা। ফোন নরমাল করে কানে তুলে বাচ্চাদের থেকে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ায়।

-" আমি প্রিয়দের বাড়িতে যাবো কিছুদিনের জন্য। ভাবলাম আপনাকে জানিয়ে দিই!"

অরুণের ভ্রু কুঁচকে যায়। সে কোন প্রিয় টিয় কে চেনে না। তবে প্রশ্ন করে না। আগে ছেলেকে ঠিক করে নিক।

-" আচ্ছা। যান! আমি কল করবো! সাবধানে যাবেন"

পাতা ফোনটা বুকের মধ্যখানে চেপে ধরে। 'সাবধানে যাবেন' কথাটাতে তার মনটা ভালো হয়ে যায়। লোকটার সাথে আগেও কথা বলেছে। তবে সেটা স্টুডেন্টের গার্ডিয়ান হিসেবে। কিন্তু আজকের কথা বলাটা আলাদা।

অরুণ ফোন রেখে ছেলের কাছে যায়। কম্ফোর্ট সরিয়ে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে ডাকে,

-" আব্বু? কলিজা? মানিক আমার?"

এবার আর ভোর সরিয়ে দেয় না। তবে কান্না থামায় নি। অরুণ বুঝতে পারে ওষুধে কাজ হচ্ছে। সে ছেলেকে আস্তে ধীরে তুলে যে গালে কাল মেরেছিল সেখানে চুমুতে ভরিয়ে দিল। আবেগ জড়িয়ে ডাকে,

-" আব্বু কলিজাটা! অনেক অনেক স্যরি। আমার সোনাটাকে মেরে আমি অনেক ভুল করেছি। আর হবে না কলিজা। আর রাগ করে থেকো না। আমার সব অভিমান ভেঙে গেছে। তোমার টাও ভাঙিয়ে দিলাম। কলিজা‌ আমার!"

ভোর বাবার গলা‌ জড়িয়ে ফুঁপিয়ে কাদে।ঘারে নাক মুছে কাঁদতে কাঁদতে বলে,

-" আব্বু তুমি পঁচা। আমার সাথে কথা বলো নি! আমার অনেক কষ্ট হচ্ছিল!"

অরুণ ছেলেকে আদরে আদরে ভরিয়ে তোলে। ইশ ছেলেটাকে কষ্ট দিলো ছেলেমানুষী অভিমানের জন্য।

-" আব্বু। কলিজা আমার। আব্বু অনেক পঁচা। আর হবে না মানিক সোনা। হয়েছে আর কাঁদে না। গলা বসে গেছে তো! আর মাথা ব্যাথা করবে! চুপ করো কলিজা!"

 ভোর বাবার জখম হয়ে যাওয়া গালে চুমু দেয় আর বিড় বিড় করে 'আব্বু আব্বু' বলতে থাকে। অরুণ ছেলের মুখ আজলায় ভরে কপালে চুমু দিয়ে চোখের পানি মুছে দেয়।

-" আর কাঁদবে না। জ্বর ডেকে এনেছো! খেয়ে ওষুধ খাবে। জ্বর‌ বাপ বাপ বলে পালাবে।"

 ভোর বাবার টি শার্ট হাতে নিয়ে নাক ঝাড়ে।

-" ভোর লাভস ইউ ভেরি মাচ আব্বু কলিজা।"

অরুণ হাসে। এতো আদুরে কেন তার কলিজাটা! আদুরি এগিয়ে এসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

-" উই ওল নো দ্যাট ভাইয়ের কলিজা! আমার
 ভাইয়ের শার্টে কি ভরিয়ে দিলেন রাজকুমার?"

ভোর চোখ ডলে হেসে দেয়।

-" ভালোবাসা!"

আরিয়ান হামি তুলতে তুলতে বলে,

-" তোমাদের বাপ ছেলের হয়েছে? জলদি করো, ক্ষুধায় পেটের ইঁদুর হাতি হয়ে নাচছে যে!"

ভোর এবার খিলখিল করে হেসে দিল।
.
.
.
চলবে..........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp