" মিষ্টি তোমার কী হয়েছে বলো তো!"
পড়ার সময় হঠাৎ এমন প্রশ্নে চমকাল মিষ্টি। কী বলতে চাইছেন আহনাফ স্যার?
" কী হয়েছে আমার? "
" সেটা আমি জানলে তো প্রশ্ন করতাম না। আগে যখন তোমার সাথে দেখা হতো তখন কেমন প্রাণখোলাভাবে হাসতে, কথা বলতে। কিন্তু এখন! কেমন জানি চুপচাপ হয়ে গেছো। কথা কম বলো, সব সময় কেমন সংকুচিত হয়ে থাকো। ভয় পেয়েছ? বা কেউ কিছু বলেছে? "
আহনাফ শান্ত কণ্ঠে শুধালো। মাসখানেক হলো মিষ্টিকে পড়াচ্ছে আহনাফ। আর এই মাসখানেকের প্রায় প্রতিদিন মিষ্টির আচার-আচরণ খেয়াল করেছে ও। আহনাফের মনে হচ্ছে আগের মিষ্টি আর এখনকার মিষ্টি আলাদা মানুষ। কী এমন হলো যে এতটা বদলে গেছে মেয়েটা? মিষ্টি দৃষ্টি টেবিলের রেখেই উত্তর দিলো,
" লেখাপড়ার দিকে মনোযোগ দিচ্ছি এখন। আগে তো কেবল পড়ার জন্য পড়তাম কিন্তু এখন নিজের একটা অবস্থান গড়ার জন্য পড়ছি। "
" সেটা ঠিক আছে। যাইহোক, পরীক্ষা চলছে তাই এ বিষয় পরে কথা বলবো। আপাতত মন দিয়ে পড়ো শুধু। "
" জি স্যার। "
আহনাফ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পড়ানোর দিকে মনোযোগ দিলো। একটা সময় ছিলো যখন আহনাফ দিনের পর দিন আস্তে আস্তে করে এভাবেই যন্ত্রণার সাথে যুদ্ধ করে বদলে যাচ্ছিল। মানসিকভাবে কতবার ভেঙেছে আর গড়েছে নিজেকে তা ভাবতেই এখনো বুকটা চিনচিন করে উঠে । সেই দিনগুলো কেমন কেটেছে, কীভাবে কেটেছে তা ও ছাড়া কেউ বুঝবে না। তাই নিজের মতো কাউকে কষ্ট পেতে দেখলে আহনাফ জানার চেষ্টা করে।
" ওই রোশন আমাকে কুত্তার মতো মেরে অপমান করেছিল রে। আমি কখনো ভুলবো না ওই অপমান। শালার জন্য আমি গ্রামেও লুকিয়ে লুকিয়ে যাচ্ছি। নেহাৎ বাবা-মা গ্রামে থাকে। নইলে কোনো ভয় থাকতো না আমার। "
কিছুটা রাগ আর ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে পল্লবের কথায়। রুমে বসে তাস খেলতে খেলতে দুই বন্ধু কথাবার্তা বলছে। বিহান পল্লবের কাঁধে হাত দিয়ে বলে,
" আরে মামা চাপ নিস না। আমি তো তোর বন্ধু। আমার কাছে থাক তোর যতদিন ইচ্ছে। তবে ওই ডাকাতের বংশের কিছু একটা করতে হবে। সুযোগ পেলে ঠিক ওদের দুনিয়া ছাড়া করতে হবে। "
" হ দোস্ত। "
পল্লব খুশি হয়ে যায় বিহানের কথায়। হাতে হাত মিলিয়ে হেসে উঠলো দু'জনই।
" শরীর ঠিক আছে সুন্দরী আমার ? এই সন্ধ্যাবেলায় শুয়ে আছো!"
ঘরে ঢুকে শার্ট খুলতে খুলতে বললো রোশন। আজ একটা বড়সড় ডাকাতি করেছে। কাছাকাছি আরেকটা শহরের সবচেয়ে বড়ো ব্যাংকে হানা দিয়েছিল। সফলও হয়েছে। তবে একটু ক্লান্ত শরীর। মেহেক রোশনের দিকে না তাকিয়েই বলে,
" না ঠিক আছি। "
" এই নাও, বাদাম খাও।"
মেহেকের পাশে বসে হাতে বাদামের প্যাকেট নিয়ে বললো রোশন। একমুহূর্তের জন্য মেহেক সবকিছু ভুলে গিয়ে তাড়াতাড়ি উঠে বসলো। বাদাম ভীষণ প্রিয় ওর। হাত বাড়িয়ে বাদামের প্যাকেট নিতে গিয়েই চোখ পড়লো রোশনের উন্মুক্ত শরীরে। অস্বস্তিতে দৃষ্টি সরিয়ে ফেললো। মনে পড়ে গেলো এই লোকটা কতটা খারাপ! জোর করে কীভাবে আঁটকে রেখেছে ওকে। এভাবে কাউকে জোর করা রীতিমতো ক্রাইম। তাই আবারো শুয়ে পড়লো মেহেক।
" কী হলো! এই তো খুশিমনে উঠে বসলে। আবার কী হয়েছে? রাগ থাকলে আমার উপর, বাদামের সাথে তো রাগ নেই তাই না সুন্দরী? "
" আপনার হারাম টাকা দিয়েই তো কিনে এনেছেন। তারচে বড়ো কথা আপনি এনেছেন ওগুলো। "
রোশন প্যাকেটটা বিছানায় রেখে উঠে প্যান্ট পাল্টে লুঙ্গি পরে নিলো। তারপর মেহেকের পাশেই সটান হয়ে শুয়ে মুচকি হাসলো।
" আজকে না হয় একটু খেয়ে নাও। রাগটা আপাতত সাইডে থাক?"
" শুয়ে আছেন, থাকুন। আজাইরা কথা বন্ধ করুন। "
কথা বলার সময় মেহেকের ঠোঁটের দিকে দৃষ্টিপাত করেছে রোশন। কাটা দাগটা এখনো আছে! একটু একটু ফুলেও আছে। মেহেক সত্যি বলে। আসলেই নিজেকে জঙ্গলের পশু মনে হচ্ছে। নয়তো এভাবে কেউ আদর করে?
" মলম কি ঠিকমতো দাওনি ঠোঁটে? দিলে তো দাগ থাকতো না।"
" আমার ঔষধ খেতে কিংবা লাগাতে মনে থাকে না। "
রোশন শোয়া থেকে উঠে ড্রেসিং টেবিলের উপরে রাখা মলম নিয়ে আসে। কাত হয়ে শুয়ে আছে মেহেক। তাই ধরে সোজা করে শুইয়ে দেয়। মেহেক ছ্যাঁত করে ওঠে তাতে।
" কী করছেন! "
" কুল সুন্দরী। কিচ্ছু করছি না। একটু শান্ত হও। ঔষধ লাগিয়ে দিচ্ছি। "
" কোনো দরকার নেই। প্রথমে ব্যথা দিবেন তারপর আবার ঔষধও দিবেন। এটাকেই কি আপনার কাছে ভালোবাসা মনে হয়? "
মেহেক শোয়া থেকে উঠতে চাইলে রোশন উঠতে দেয় না। এই মেয়েকে মানাতে পারবে না। তাই মেহেকের উপর শোয়ার ভঙ্গিতে ঝুঁকে রোশন ডান হাতের আঙুলে মলম লাগিয়ে আলতো করে ওর ঠোঁটে লাগাতে থাকে। মেহেক অবশ্য এখনো চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে আছে। বাট রোশন বরাবরের মতোই ডোন্ট কেয়ার মুডে আছে।
" হ্যাঁ সুন্দরী। সবার ভালোবাসার ধরণ তো এক নয়। তাছাড়া আমি আলাদা সেটা তো জানো? আমি তোমার জীবনের নায়ক নই বরং ভিলেন। আর এই ভিলেনকে নিয়েই তোমার সংসার করতে হবে। "
মেহেক কিছু বলতে চাইলে ঠোঁটে আঙুল চেপে ইশারায় মানা করে রোশন। কথা বললে মলম ঘেঁটে যাবে।
" চুপ করে থাকো পাঁচ মিনিট। কথা না বলতে পারলেও তুমিই ফার্স্ট। ওকে?"
রোশন বসে চোখ টিপ্পনী কেটে বললো৷ মেহেকও তড়িৎ গতিতে উঠে বসলো। কথা না বললেও চোখ দিয়ে যেনো গিলে খাবে রোশনকে এমন হাবভাব। রোশনের ঠোঁটের কোণে দুষ্ট হাসির ঝিলিক দেখা যাচ্ছে। মেহেকের রাগটা আর একটু বাড়িয়ে দিতে হুট করে কপালে চুমু খেয়ে বিছানা থেকে উঠে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল রোশন। মেহেক থতমত খেয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। এতো তাড়াতাড়ি কিস করে ওখানে গেলো কীভাবে লোকটা! জ্বীন-ভূত না তো!
" সুযোগে সৎ ব্যবহার করলাম একটু। আসলে একটু চালাক না হলে বউকে আদর করা মুশকিল। বসো, খাবার নিয়ে আসছি। ততক্ষণে রাগটা একটু কন্ট্রোল করে রাখো। আমি আসার পর আবার কন্ট্রোললেস হবে কেমন? "
" অসভ্য, শয়তান, দুশ্চরিত্র লোক একটা। আমার জীবনটা শেষ করে দিলো ওওওওও......"
মেহেকের চিৎকার শোনার আগেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো রোশন। রাগে-দুঃখে নিজের হাতে কামড় বসিয়ে দিলো মেহেক। মাঝে মধ্যে ইচ্ছে করে গলায় দড়ি দিতে। কিন্তু কেনো দিবে? মরলে মরবে এই অসভ্য লোকগুলো । এসব ভেবেই নিজেকে শান্ত করছে মেহেক।
" বুঝলে মিষ্টির মা, আজকে মেহেকের কথা খুব মনে পড়ছে। কতদিন হলো মেয়েটাকে দেখি না। কোনো খোঁজ খবরও পাইনি। ওরা কি সত্যি মেয়েটাকে সম্মান দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে? না-কি..... "
কথা শেষ করতে পারেন না সিদ্দিক। দু-চোখ ছলছল করছে উনার। রাতের খাওয়াদাওয়া শেষে পাশাপাশি বিছানায় বসে আছেন এই দম্পতি।
আনজুম স্বামীর মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বলেন,
" এতো ভেবো না তুমি। আমার বিশ্বাস মিষ্টি সত্যি বলেছে। মেহেক ভালো আছে। তবে আমারও ইচ্ছে করে মেয়েটাকে একটু দেখতে । "
" একবার তো আসতেও পারে বলো? না-কি ওরা আসতে দিচ্ছে না? "
" আমিও তো জানি না বলো? অপেক্ষা করি বরং আর কিছুদিন। "
" অপেক্ষা ছাড়া আরকিছুই করার নেই মিষ্টির মা। আমরা চাইলেও কখনো মেহেকের কাছে যেতে পারবোনা। "
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বালিশে মাথা রেখে শুয়ে পড়লেন সিদ্দিক। আনজুম বসে রইলেন অন্ধকারে আরো কিছু সময়।
বর্ষাকাল। একাধারে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে কয়েকদিন ধরে। বৃষ্টি ভালো লাগে মেহেকের। কিন্তু এই বৃষ্টির সাথে মন খারাপের গল্পগুলোও খুব করে মনে পড়ে যায়। বাবা-মা, মিষ্টিকে খুব মিস করে সে। এই জঙ্গলে একঘেয়ে জীবন মোটেও ভালো লাগছে না। সারাদিন ঘরে বসে থাকা, মাঝে মধ্যে মীরার সাথে কথাবার্তা আর রাত হলে রোশনের ঘ্যানঘ্যান এই নিয়ে চলছে জীবন। রোশন যদিও সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে মেহেকের মন জয় করার কিন্তু সে আর হচ্ছে কই! সকালে খাইয়ে দেওয়া শুরু করে দুপুরে গোসলের জন্য জামাকাপড় পর্যন্ত বাথরুমে রেখে আসে। নিজ হাতে চুল আঁচড়ে দেয়, হাত-পায়ের নখ কেটে দেয়, মাঝে মধ্যে জঙ্গলে ঘুরতে বের হয়। দলের সবাই তো রোশনকে নিয়ে কানাঘুঁষা শুরু করেছে। সবাই বলছে বাঘ থেকে একেবারে মিনি বিড়াল হয়ে গেছে রোশন। সবকিছুই ওই মেয়েটার জন্য। দিনে দিনে মেহেকের জন্য সবার থেকে দূরত্ব বাড়ছে রোশনের। সবুর হোসেন এসব ভেবে ভেবে ছেলের প্রতি মনে কিছুটা অভিমানও পুষে রেখেছেন।
নিজের ঘরে বসে আছেন সবুর হোসেন। গত এক সপ্তাহে ছেলের সাথে কথা হয়নি তেমন। হবে কীভাবে? মেহেকের জ্বর আসায় দিনরাত চব্বিশ ঘন্টা ওর পাশেই বসে ছিলো রোশন। এখনো জ্বর কমেনি। ডাক্তার দেখাতে হবে। কিছু ঔষধ এনে খাইয়েছে এতদিন, সাধারণ প্যারাসিটামল। কিন্তু আশানুরূপ ফলাফল পায়নি। ফলশ্রুতিতে এখনো অসুস্থ মেয়েটা।
" বাবা! "
হঠাৎ ছেলের কণ্ঠে ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসেন সবুর। নড়েচড়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি।
" কী খবর? "
" বাবা!"
রোশন এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে বাবাকে। সবুর হোসেন বাচ্চাদের মতো অভিমানে দূরে সরাতে চায় ছেলেকে। কিন্তু রোশন ছাড়ে না। জোর করে জড়িয়ে ধরে থাকে। মন গলে সবুর হোসেনের।
" একেবারে পর হয়ে যাচ্ছিস রোশন। বাবাকে আগের মতো ভালোবাসিস না।"
" নো বাবা, আই লাভ ইউ। খুব ভালোবাসি আমি তোমাকে। ঘরে বউ এসেছে কিন্তু বাবা তো আরেকজন আসেনি বলো? বউয়ের কাজ কি বাবাকে দিয়ে হয়? না-কি বাবার কাজ বউকে দিয়ে হয়? তোমরা দু'জনই আমার জন্য ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। প্লিজ এভাবে আর মন খারাপ করে থেকো না। আমি সরি। আসলে মেহেকের শরীর খারাপ থাকায় আমার সবকিছু কেমন এলোমেলো লাগে আজকাল। তাই..... "
" থাক আরকিছু বলতে হবে না। এখন কেমন আছে মেয়েটা? "
ছেলেকে ছেড়ে দিয়ে চেয়ারে বসেছেন সবুর হোসেন। রোশনও বসেছে মুখোমুখি হয়ে।
" বাবা! "
" বলুন আপনার স্ত্রী কেমন আছেন? "
রোশন হেসে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে বাবার হাতে একটা দিয়ে নিজের জন্য একটা রাখল। সিগারেট ধরাতে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন সবুর হোসেন।
" জ্বর তো কমছে না। মাঝে মধ্যে একটু কমে কিন্তু রাতে আবারো বেড়ে যায়। "
ঠোঁটে সিগারেট গুঁজে সুখটান দিয়ে বললো রোশন। সবুর হোসেন একটু ভেবে বললেন,
" ওকে বরং কিছুদিন ওর বাবার বাড়ি রেখে এসো। টাকাপয়সা যা লাগে তার থেকেও দ্বিগুণ দিয়ে আসবে। যাতে কোনো সমস্যা না হয়। "
চলবে.............................