রোদরঞ্জন - পর্ব ২৩ - আশফি শেহরীন চিত্রা - ধারাবাহিক গল্প


আধবোজা চোখে ইনান দেখল জেহফিল টেবিলে বসে কিছু একটা করছে, ঘোলা চোখে ভালো করে দেখতে পারল না, শুধু টেবিল ল্যাম্পের আলোর সামনে খালি শরীরে বসে থাকা জেহফিলের থেকে কাগজে খসখসানোর আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।‌ বারান্দা থেকে আসা ঠান্ডা বাতাসে ঘুম আরও জেঁকে বসলে গায়ে থাকা জেহফিলের শার্ট শরীরে জড়িয়ে ঘুমে ডুব দিলো আবার।

.

গলায় আর বুকে ঠাণ্ডা পানির ফোঁটা পড়তেই ইনানের ঘুম ভেঙে গেল। আড়মোড়া ভেঙে পাশ ফিরতেই দেখল শুধু তোয়ালে জড়ানো জেহফিল ইনানের উপর ঝুঁকে বসে আছে। তার ভেজা চুল থেকে টুপটুপ করে পানির ফোঁটা ইনানের উষ্ণ শরীরকে ভিজিয়ে দিচ্ছে। ইনানকে চোখ খুলতে দেখে জেহফিল স্মিত হাসে। ইনান মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় চেয়ে থাকে জেহফিলের নজর কাড়া হাসিতে। জেহফিল ইনানের নাকা নাক ঘষে আলতো গলায় বলে,

'বেবি, এগারোটা বাজে, ঘুম থেকে উঠবে না?' 

এত সময় ইনান ঘুমিয়েছে ভাবতেই হন্তদন্ত হয়ে উঠে বসে। আজ আর ভার্সিটি যাওয়া হলো না। 

জেহফিল ইনানকে কোলে তুলে নিলো। লজ্জায় ইনানের মরি মরি অবস্থা। তার পরনে শুধু জেহফিলের শার্ট। সেটাও কোলে তোলার কারণে বার বার উরু থেকে পিছলে পড়ে যাচ্ছে। ইনানকে ওয়াশরুমে দাঁড় করিয়ে কোমর চেপে ঘাড়ে চুমু খেল জেহফিল। শীতল ঠোঁটের পরশ ঘাড় ছুঁতেই মৃদু কেঁপে উঠল ইনান‌। কপালে চুমু দিয়ে বলল,

'যাও, গোসল সেরে আসো। তোমার প্রিয় ব্রেকফাস্ট রেডি করছি।'

.

চুল মুছতে মুছতে ইনান কিচেনে আসলো। দেখল জেহফিল তোয়ালে জড়িয়েই প্যানকেক বানাচ্ছে। শুধু পরনে অ্যাপ্রোন। অ্যাপ্রোনটা জেহফিলের শরীরকে পুরোপুরি আয়ত্ব করতে পারছে না। জেহফিলের পেশিবহুল বাহু, শক্ত কাঁধ, অ্যাডামস অ্যাপল ইনানকে চুম্বকের ন্যায় টানছে। জেহফিল নিজেও জানে না খালি গায়ে অ্যাপ্রোন পরনে জেহফিলকে কতটা আবেদনময় লাগছে।

'হ্যালো বেবিগার্ল!'

ইনানের ধ্যান ছুটে জেহফিলের গাঢ় কণ্ঠে। ডাইনিংএ গিয়ে গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে বলল,

'এমন উদোম হয়ে রান্না করছেন কেন? কেমন দেখায়?'

'হট লাগছে তাই না?' মিটিমিটি হেসে উত্তর দেয়।

পানি খেতে গিয়ে বিষম খায় ইনান, তোতলিয়ে বলে,

'কীসব আজেবাজে কথা!'

'আজেবাজে কাজ করতে ভালো লাগে অথচ কথা বললেই দোষ?' নিষ্পাপ গলা জেহফিলের।

ইনানের কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হতে থাকে। জেহফিলের মুখ এত লাগামহীন কেন? জেহফিল ইনানের লাজুক, অস্বস্তিকর চেহারা দেখে কাছে এসে বাঁকা হেসে বলল,

'তুমি কাল রাতে এত ওয়াইল্ড...'

জেহফিলের কথা শেষ হওয়ার আগেই ইনান জেহফিলের মুখে প্যানকেক ঢুকিয়ে দিলো, শাসানোর স্বরে বলল,

'আরেকটা কথা যদি মুখ দিয়ে বের করেছেন তো.. তো আপনার একদিন আর আমার দশদিন।'

জেহফিল আরামে প্যানকেক খেতে খেতে ভাবুক গলায় বলল,

'হুমম, তোমার দশদিনই লাগবে আমাকে ক্লান্ত করতে, আর আমার মাত্র একদি..আউচ বাটারফ্লাই!' 

ইনান জেহফিলের নাক বরাবর ঘুষি দিলো, জোরেই, রাগত স্বরে বলল,

'বেশরমা, অসভ্য, মুখে বন্ধ হয় না কেন আপনার?'

জেহফিল নাক ডলতে ডলতে বলল, 'এভাবে বন্ধ না করে কিস দিয়ে তো বন্ধ করতে পারতে, এত আনরোমান্টিক কেন তুমি? যত রোমান্টিকতা সব খালি আমিই করি।'

সকালটা কেটে গেল দুজনের খুনসুটিতে। জেহফিলকে আগের মতো দুষ্টুমি করতে দেখে ইনান সম্পূর্ণ ভুলে গেল গতকাল ভোরের জেহফিলের ভয়ানক রূপের কথা‌। 

.

অ্যাকাডেমীর দোতলার ভবনটা মাঠের একদম কোণায়। গাছ পালা ঘিরে আছে ভবনটাকে। এইখানের সিঁড়িঘরটা কেউ ব্যবহার করে না। অন্ধকার সিঁড়ির মধ্যে তাজবীর বসে আছে। কয়েক সেকেন্ড পরপর তার দু ঠোঁটের ফাঁক থেকে ঘোলাটে ধোঁয়ার কুণ্ডলী বের হচ্ছে। তাজবীর চোখ ছোটো ছোটো করে সামনের ভবনের নিচ তলায় তাকিয়ে আছে। তার টিমের সদস্যরা প্রজেক্টের স্ট্যাচু ঠিক করছে। আর তাদের দিক নির্দেশনা দিচ্ছে জেহফিল। জেহফিল থাকার কারণেই তাজবীর আর জয়েন করেনি ওদের সাথে। 

জেহফিলের প্রতি মনে মনে রাগ পুষে রেখেছে তাজবীর। তার এই রাগকে ফ্রেন্ডরা বলে হিংসা। আসলেই কি হিংসা নাকি? 

জেহফিলকে দেখতে না পারার কারণ ছিল একটি। তাকে ক্লাসের মধ্যে কঠিন অপমান করাটা। তবে পরবর্তীতে আরও কারণ খুঁজে বের করেছে, যদিও জেহফিল তাজবীরকে ততটা পাত্তাও দিত না। ক্লাসের অপমানটা ধীরে ধীরে রূপ নেয় ভয়ঙ্কর আকারে। জেহফিলের সব কাজ তার বিরক্ত লাগত এরপর থেকে, ইভেন জেহফিলকেই বিরক্ত লাগত। জেহফিলের সাকসেস, বিভিন্ন এক্সিবিশনে জেহফিলের আর্টওয়ার্ক প্রেজেন্টেশন, দেশে বিদেশে ওর সুনাম, এগুলো তাজবীরকে ভেতরে ভেতরে দাবানলে জ্বালায়। জেহফিল তাজবীরের প্রায় সমবয়সীই, সে যতটুকু জানে জেহফিল মাস্টার্সে বর্তমানে পড়ত যদি না পড়ালেখা ছাড়ত। আর তাজবীর মাস্টার্স ফাইনাল দিয়েছে। সেই হিসেবে জেহফিল তাজবীরের কিছুটা ছোটো হবে বোধহয়।

তাই তার ছোটো কেউ তাকে ক্লাসের মাঝে অপমান করে, তাও আবার রাগ দেখিয়ে, ধমক দিয়ে, কঠিন গলায়- এই ব্যাপারটা খুব ইগোতে লেগেছে তাজবীরের। তার উপর জেহফিলের সাফল্য তাজবীরের জ্বলন্ত আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করেছে।‌ এসব ভাবতে ভাবতে কপালের রগ ফুলে উঠেছে তার।‌ আধ খাওয়া সিগারেটটা পায়ে পিষে উঠে দাঁড়ায়। 

কোমরে এক হাত আর মাথায় এক হাত দিয়ে চুল চেপে ধরে। তাজবীরের সারা জীবনেও তাকে কেউ ফুলের টোকাও পর্যন্ত দেয়নি, ধমক দিয়ে কথা বলা তো দূরে থাক। এমনকি তার বাবা মাও কখনো তার সাথে উঁচু গলায় কথা বলেনি। সব সময় আদরের মাঝে বড় হওয়া তাজবীরের সবার সামনে অপমানিত হওয়াটা; তাও আবার ছোটো কারো কাছে; ব্যাপারটা সহজে হজমযোগ্য নয়। জেহফিলকে কোনো শাস্তি দিতে পারলে তার মন শান্ত হতো। কিন্তু জেহফিলকে শাস্তি দেয়ার কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছে না সে। 

ভাবনায় মশগুল থাকা তাজবীর এলোমেলো পায়ের করিডোরে হাঁটছিল। তখন ইনান সিঁড়ি থেকে দৌঁড়ে উপরে উঠে মোড় ঘুরতেই কাউকে সামনে দেখে। আচমকা কেউ সামনে আসায় তাজবীর দুইহাত সামনে বাড়ায় মানুষটি যাতে পড়ে না যায়। কিন্তু ইনান নিজেকে রক্ষার জন্য ফাস্ট ছিল, তাজবীর ধরার আগেই সে নিজের গতির ব্রেক কষে। তাজবীরের আর তার মাঝের ব্যবধান পাঁচ ইঞ্চি মাত্র। 

'পাগলের মতো ঘুরাঘুরি করে রাস্তা আটকে রেখেছেন কেন? এক্ষুনি তো পড়ে যেতাম।'

ত্যক্ত বিরক্ত ইনান তাজবীরকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে দ্রুত পায়ে চলে যায় আবার। তাজবীর হতভম্ব চোখে ইনানের চলে যাওয়া দেখে। আজব মেয়ে একটা।

ইনান নিচে জেহফিলের কাছে যায়। তার ক্লাস শেষ। বসে থাকতে ভালো লাগছিল না বিধায় জেহফিলের কাজ দেখার চলে এসেছে। 

জেহফিল গম্ভীর গলায় সবাইকে ডিরেকশন দিচ্ছে। আর ইনান জেহফিলের পেছনে এসে তার কাজ পর্যবেক্ষণ করছে। জেহফিল খেয়াল করেনি যে ইনান তার পেছনে দাঁড়িয়ে। স্ট্যাচুটা দেখতে এত সুন্দর লাগছিল যে ইনানের ঠোঁট দুটো বিস্ময়ে ফাঁকা হয়ে গেছে। এক রমণীর শরীর দুই টুকরো কাপড় দিয়ে ঢাকা, পা শিকল দিয়ে বাঁধা, তার চোখে অশ্রু, ঠোঁট দুটো যেন এখনি সাহায্যের জন্য চিৎকার করে উঠবে‌। এতটা করুণ দৃশ্য!

ইনান বেখেয়ালি পায়ে হেঁটে গেল মূর্তির কাছে। মূর্তির শিকল বাঁধা পায়ে হাত দেয়া মাত্রই কারো কর্কশ কণ্ঠের চিৎকার শুনে চমকে উঠে সে। 

সবার নজর যায় ইনানের দিকে। ইনান তাকায় তার উপর চিৎকার করা মেয়েলী কণ্ঠের মালকিনের দিকে। টিয়া ধমকে বলল,

'এই মেয়ে, এটা ধরলে কেন? চোখ কি আকাশে রেখে হাঁটো নাকি? দেখোনা মাটি এখনো শুকা…'

'জাস্ট শাট ইউর মাউথ মিস টিয়া।'

টিয়া চুপসে যায় জেহফিলের ধমকে, চুপসানো গলায় বলল,

'স্যার মেয়েটা স্ট্যাচুর পায়ের দিকটা টাচ করেছে, এতে শেপ নষ্ট হয়ে যেতে পারে।'

'হয়েছে?'

টিয়া বুঝলো না। বিভ্রান্ত নিয়ে চাইল জেহফিলের দিকে, 'সরি স্যার?'

'শেপ কি নষ্ট হয়েছে?' গাম্ভীর্য নিয়ে বলল।

টিয়া মূর্তিটার যেদিক ইনান ছুঁয়েছে, সেখানে দৃষ্টিপাত করল। ইনান হালকা করে ছুঁয়েছে যার কারণে কোনো দাগই পড়েনি, টিয়া মাথা দুদিক নেড়ে নিচু গলায় বলল,

'না স্যার। বাট হতো যদি..'

জেহফিল হাত উঠিয়ে থামিয়ে দেয়, 'হতো এবং হয়েছে- এর মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে। সিক্সের বই দেখে পার্থক্যটা পড়ে নিবেন।'

টিয়াকে অপমান করার ধরণটা দেখে না চাইতেও বাকিদের হাসি চলে আসে। মুখ টিপে তারা হাসতে থাকে।

জেহফিল কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ইনানের পানে চাইল। তার বাটারফ্লাইয়ের উপর টিয়ার গলা চড়িয়ে কথা বলার সাহস দেখে জেহফিলের রক্ত টগবগ করে উঠে। ইনানের সন্নিকটে গিয়ে তার হাত ধরে মূর্তির পা ছুঁয়িয়ে দেয়‌। 

'যেখানেই টাচ করতে মন চাইবে, ধরবে, কারো পারমিশনের প্রয়োজন নেই।'

ছোঁয়ার পর ইনানের হাত ধরে চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়। তার আগে পেছনে ফিরে টিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে,

'আগামীকাল আপনার হোমওয়ার্ক হচ্ছে ক্লাস সিক্সের বই জোগাড় করে টেন্সের স্ট্রাকচার মুখস্থ করবেন, সবার সামনে দাঁড়িয়ে টেন্সের ডেফিনেশন বলবেন, যদি না পারেন তাহলে পুরো স্ট্যাচুর দায়িত্ব আপনার নিতে হবে।'

অপমানে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে টিয়া। তার ফ্রেন্ডরা মুখ চেপে হাসলে আকাশ যে কিনা নতুন জয়েন করেছে সে হো হো করে হেসে উঠল। দামড়া একটা মেয়েকে এই ধরনের শাস্তি দেয়ার চেয়ে অপমানজনক আর কিছু হয় না। 

জেহফিল ইনানের হাত ধরে চলে গেল। সিঁড়ি দিয়ে উঠার সময় ইনান বলল,

'এই ধরনের শাস্তি না দিলেও পারতেন জেহফিল। মেয়েটা কত লজ্জা পেয়েছে।'

জেহফিল ইনানের ঠোঁট চেপে বলল,

'তোমার উপর কেউ ঝারি মেরে কথা বলবে আর আমি চুপ করে থাকব?'

'ঝারি মারল কোথায়? মেয়েটা চিন্তিত ছিল তাই এমন করে বলেছে, এটা স্বাভাবিক। আমিও হলে এভাবেই ডাক দিতাম।'

জেহফিল ইনানের গাল চেপে ধরে, হালকা করে,

'সোনা, তোমার কাছে স্বাভাবিক হলেও এসব মেনে নেয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। তোমার উপর চিৎকার করে কথা বলা হোক কিংবা আদর করে কথা বলা হোক, সবকিছুর অধিকার শুধু আমার।'

'জেহফিল..'

'শশশহ, কোনো কথা না। মাথা গরম আছে, কিস করো তো।'

ইনানের চোখ বড় বড় হয়ে যায়, 'পারবো না।'

জেহফিল ইনানকে সেই অন্ধকার সিঁড়ি ঘরে টেনে ধরে, 'বাটারফ্লাই, তোমাকে যখন যা করতে বলব সেটাই করবে, বিপরীতে একটা কথাও যেন তোমার এই সুন্দর মুখ দিয়ে না বের হয়।'

'যদি না করি?'

'ফল খারাপ হবে।'

ইনান জেহফিলের থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে, 
'ছাড়ুন এখন, পাবলিক প্লেসে এসব কী?'

'এখানে কেউ আসবে না, চুপ থাকো।'

এই বলে জেহফিল ইনানের ওষ্ঠাধর আয়ত্বে নিয়ে নেয়।

সিঁড়ি ঘরের উপরে থাকা তাজবীর সবটাই লক্ষ্য করল, দেয়ালে হেলান দিয়ে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে আপনমনে স্বগোতক্তি করল,

'ইন্টারেস্টিং।'

***

সুন্দর একটা দিন কাটানোর পর ইনান একাডেমি থেকে বাসায় ফিরছিল। জেহফিলের সাথে নরমাল কনভারসেশন করছিল সে। সেই টাইমে ইনানের বাবার কল আসে। ইনান ফুরফুরে মনে বাবার সাথে কথা বলায় খেয়াল করল না জেহফিলের অগ্নি চোখের লাভা।

'কল ধরছিলে না কেন আম্মু?'

'চার্জ ছিলো না বাবা। এখন অন হয়েছে।'

'জেহফিলের ফোনে কল ঢুকছে না কেন? সকাল থেকে কল করছিলাম।'

'কিজানি, বলতে পারছি না। আচ্ছা আমি দেখব।'

বাবার সাথে কথা বলা শেষ করে। জেহফিলের মোবাইল ইনানের সামনেই ছিল। সে মোবাইলটা নিয়ে কন্টাক্ট লিস্ট চেক করে। জেহফিলের মোবাইলে নাম্বারের সংখ্যা নিতান্তই কম। তাও সেগুলো কাজের ক্ষেত্রের।

ইনান তার বাবার নাম্বার খুঁজে পেল না। তাই স্বাভাবিকভাবেই বলল,

'বাবার নাম্বার আপনি সেভ করেননি?'

এই বলে জেহফিলের দিকে তাকায়। দেখল এতক্ষণ হাসিখুশি থাকা জেহফিলের চোয়াল শক্ত। তীক্ষ্ণ চোখে আগুনের হলকা।

'জে..'

'সেভ করার কোনো প্রয়োজন আছে?' 

জেহফিলের কথাটা কর্ণকুহরে প্রবেশ মাত্র হঠাৎ করেই জেহফিলের সেইদিন মোবাইল ছিনিয়ে নেয়ার কথাটা মনে পড়ে, মনে পড়ে তার বাবাকে নিয়ে ভৎর্সনা করাটা, সিরিয়ালি তার মনে পড়ে যায় ভোরের কথা। কপালে হাত চলে যায় ইনানের। সে এতো মনভুলো কেন? ধাতস্থ করে নিজেকে। গভীর শ্বাস ফেলে জেহফিলের দিকে চায়। 

'এক্সপ্লেইন।'

'এক্সপ্লেইন হোয়াট?'

'ফুল গাছ কেটে ফেলার কথা।' 

জেহফিল ইনানের কথা শুনে বাঁকা হাসে। কটাক্ষ করে বলে,

'এতক্ষণ পর মনে পড়ল?'

'কথা প্যাঁচাবেন না।' তীক্ষ্ম গলা ইনানের।

ইনানের জোরে জোরে কথা বলা শুনে জেহফিল বলল, 

'লাভ, আমি তোমাকে এখনো ম্যানারস শিখাতে পারিনি। এটা কি আমার ব্যর্থতা নাকি তোমার অমনোযোগিতা?' অসন্তোষ প্রকাশ পেল জেহফিলের কথায়।

'একদম কথা ঘুরাবেন না।'

ততক্ষণে তারা বাসায় এসে পড়েছে। জেহফিল গাড়ির দরজা খুলে ইনানকে কোলে তুলতে নিলে ইনান জেহফিলের বুকে ধাক্কা মারে। 

'বেশি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু বাটারফ্লাই।' হীম শীতল গলা জেহফিলের।

'আপনি বেশি করছেন, কথার জবাবা দেন না কেন? গাছগুলো কেন কেটেছিলেন? বিহেভিয়ার চেঞ্জ কেন আপনার?‌ আপনিই না আমার পছন্দে গাছ লাগিয়েছেন তাহলে কেন আপনি আবার সেগুলো তুলে ফেলেছিলেন? তাও এত কষ্ট দিয়ে?'

'গাছের কষ্ট নিয়েও ভাবো, আমার কষ্ট চোখে পড়ে না?'

'আপনার কীসের কষ্ট?' ভ্রু কুঁচকে আসে ইনানের।

'ভেতরে যাই?'

'এখানেই বলবেন।' হুকুমের সুরে বলল ইনান।

জেহফিলের ভালো লাগল না তার উপর ইনানের হুকুম জারি করা।‌ সিরিয়াস কথাবার্তায় তার উপর কেউ রুড হয়ে কথা বলবে, চিৎকার করবে, আদেশ দিবে- এসব জেহফিলের সবচেয়ে অপছন্দ। তাও আবার তার বাটারফ্লাই সুরেলা গলায় তাকে অর্ডার করবে কেন? বাটারফ্লাইয়ের মিহি কণ্ঠস্বর শুধুমাত্র ভালোবাসাময় কথা বলার জন্য তৈরি হয়েছে, রিনরিনে হাসির জন্য, সুখে…

'চুপ করে থাকবেন না, আপনিই না বলেন প্রশ্নের জবাব না দেয়া অভদ্রতা? তাহলে এখন আপনি নিজেই তো অভদ্র হয়ে গেলেন।'

জেহফিলের হাত মুষ্টিবদ্ধ হলো। রাগ হলে তার মাথা ঠিক থাকে না। কিন্তু বাটারফ্লাইয়ের সামনে লাগ দেখানো যাবে না। বাটারফ্লাই যদি কষ্ট পায়?

ইনান আবারও কিছু বলতে নেয়, তখন জেহফিল ইনানের হাত ধরে হেঁচকা টান মারল, কথা গলায় আটকে কাশি উঠে যায় তার। গিয়ে পড়ল জেহফিলের কাঁধে। হুট করে টান মারায় গাড়ির সাথে কপালে হালকা ব্যথাও পায়।

ইনানকে কাঁধে তুলে জেহফিল সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকে। ইনান ছোটার জন্য মোচড়ামুচড়ি শুরু করতে লাগল।

ইনানকে এনে খাটের উপর ফেলল জেহফিল। ইনানের উপর উঠে এসে দুই হাতের মাঝে বন্দী করল। ইনানের নাকের কাছে চুমু দিতে চাইলে ইনান সরে যায়। জেহফিলের অন্তঃকরণে আগুন জ্বলে উঠতে লাগল ধীরে ধীরে। রাগ কমানোর জন্য ইনানকে কাছে টানতে চাইছে আর ইনান কিনা উল্টো দূরে সরে গিয়ে তার রাগ বাড়িয়ে দিচ্ছে!!

'বেবি, আমার দিকে ফিরো.. ফিরো না সোনা.. কপালে গভীর চুমু দাও।' অস্থির গলায় বলল। যেন এখন ইনানের সান্নিধ্য পাওয়াটাই গুরুত্বপূর্ণ। 

ইনান মুখ সরিয়ে নিলো,

'এসবের মুডে নেই এখন, যা বলছি তার উত্তর দেন।'

'নাহলে যে আমার রাগ কমবে না বাটারফ্লাই।'

ইনান তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল, 

'রাগ যেখানে আমার হওয়ার কথা সেখানে আপনি রেগে আছেন? অদ্ভুত!'

জেহফিলের কানে কোনো কথা গেল না। সে ইনানকে কাছে পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠল। 

ইনানের মাথায় কোনো একটা ভাবনা খেলে গেল। জেহফিলের মোবাইল তার হাতেই ছিল। সে ব্লকলিস্টে গেল। এবং যা ভেবেছিল ঠিক তাই। তার বাবার নাম্বার ব্লকে রাখা।

এদিকে জেহফিলের নিজের শার্ট খুলে ইনানের কটি খোলা শুরু করেছে। ইনান জেহফিলের হাত থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল। 

'বাবাকে ব্লক করে রেখেছেন কেন?'

জেহফিল উন্মাদ হয়ে আছে ইনানেতে ডুব দেয়ার জন্য। তাই তার উন্মাদনার মাঝে ঐ বুড়োর কথা বলাতে তার মুড চলে গেল। সাথে রাগ হলো প্রচুর। ইনানের হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে কাউচে ছুঁড়ে মারল। 

'কারণ ঐ বুড়োটা সারাদিন কল দিতো।' ক্ষোভের সাথে বলল জেহফিল।

বাবাকে এমন‌ বেয়াদবি সম্বোধনে ডাকায় ইনান ফুঁসে উঠে। 

'যে বয়সে বড় কাউকে সম্মান দিয়ে কথা বলতে জানে না সে আবার আমাকে ম্যানারস শিখাবে? আগে নিজে বেয়াদবি বাদ দেন।'

'হয়েছে? শেষ জ্ঞান দেয়া?' 

'আজাইরা, আপনাকে জ্ঞান দেয়া মানে কলা গাছের সাথে কথা বলা। বাবা কল দিতো বলেই আপনাকে ব্লক দিতে হবে কেন?'

'কারণ তিনি তোমার মতোই জ্ঞান দিতো। তোমার কী কী পছন্দ, তরকারিতে ঝাল কেমন খাও, কীভাবে চালালে তুমি কম্ফোর্টেবল হবে এসব আলতু ফালতু কথা বলে কান পঁচিয়ে ফেলত। একমাত্র মেয়েকে বিয়ে দেয়ায় বাবার চিন্তা থাকবেই। তাই বলে সারাক্ষণ ঘ্যানঘ্যান করবে কেন এসব নিয়ে?'

'আমার বাবা ঘ্যানঘ্যান করে? এগুলা বলা কি পাপ নাকি? বাবা শুধুমাত্র আপনাকে আমার ভালো খারাপ লাগা সম্পর্কে অবগত করছে।'

'তোমার পছন্দ অপছন্দ তোমার বাবার চেয়েও ভালো জানি আমি। কোন রেস্টুরেন্টের কোন আইটেম পছন্দ, রাস্তার কোন স্টলের ফুচকা পছন্দ, কী টাইপের ড্রেস ইভেন তোমার কোন ডিজাইনের ইনার পছন্দ সবই জানি আমি।'

'এগুলো সব বিয়ের পরই জেনেছেন।'

তীর্যক হাসে জেহফিল, 'বিয়ের আগে থেকেই সব জানি।'

থম মেরে যায় ইনান, সন্দেহী গলায় বলল,

'কীভাবে?'

'ফলো করলে সবই জানা যায়।'

'মানেহ!!'

'তুমি কি বোকা? বাংলা কথা বুঝো না?'

'তারমানে আপনি আমাকে স্টক করতেন?'

'সব জায়গাতেই। শুধু রিয়েলেই না, সোশ্যাল মিডিয়াতেও।'

'আপনি না বলেছিলেন আপনি এসব ইউজ করেন না?'

জেহফিল হাসে। তার হাসিতেই ইনান বুঝে যায় জেহফিলের মিথ্যে বলা। 

'কেন করেছেন আপনি এসব?'

'তোমাকে পাওয়ার জন্য।' গাঢ় স্বরে বলল জেহফিল।

'পেয়ে তো গিয়েছেনই। তাও কেন থামছেন না?'

'তোমাকে পুরোপুরি পাওয়া বাকি।'

'মানে?'

জেহফিল ইনানের দুই পাশে দুই হাঁটুতে ভর করে বসেছিল। ইনানের মুখের কাছে মুখ এনে বলল,

'তোমার প্রায়োরিটির লিস্টে প্রথম হওয়া বাকি এখনো।'

ইনান জেহফিলের কথা বুঝল না। জেহফিল তো অলরেডি ইনানের প্রায়োরিটিতে আছেই, এখানে প্রথম হওয়ার কথা আসছে কেন?

জেহফিল বলেই চলছে, 'তুমি আমার থেকে ফুল গাছগুলোকে বেশি ভালোবাসতে, সকাল- বিকাল ফুল গুলোকে মুগ্ধ চোখে দেখতে, বারান্দায় গেলেই ফুল নিয়ে কথা বলতে, এসব আমার ভালো লাগত না। তোমার মুগ্ধ চোখের চাহনি শুধুমাত্র আমার জন্য বরাদ্দ থাকবে বাটারফ্লাই। এমনকি তোমার মিষ্টি কণ্ঠ শুধুমাত্র আমারই গুণগান গাইবে, আর কারো না। তাই..'

ইনান জেহফিলের কথা শেষ করল,

'তাই আপনি গাছগুলো কেটে ফেলেছেন?'

জেহফিল মাথা নাড়ায়।

ইনানের মুখ তেঁতো হয়ে গেল ঘৃণায়। নিষ্পাপ গাছগুলোকে পাষাণের মতো পায়ে পিষেছিল জেহফিল, কতটা হিংস্র ছিল সে!

'ইউ আর সিক জেহফিল।' 

'ইউ মেড মি সিক বাটারফ্লাই।'

জেহফিল বদলায়নি… ইনান আসলেই পাগল যে কিনা জেহফিলের গত কালকের মুখোশ পরা ভালো রূপে মুগ্ধ হয়ে মুখোশের আড়ালের জেহফিলকে ভুলেই গিয়েছিল।‌ সারাদিনেও জেহফিলের ধ্বংসাত্মক রূপের কথা মনে পড়েনি তার। অথচ কয়েক ঘণ্টা পেরোতেই জেহফিলের আগের রূপ ফিরে এসেছে। 

জেহফিল ইনানের কাছে আসার চেষ্টা করে। ইনান জেহফিলের হাত সরিয়ে জোরে ধাক্কা দেয়। হঠাৎ ধাক্কায় জেহফিল বিছানায় পড়ে যায়। ঘনিষ্ঠ মুহূর্তে ইনানের প্রত্যাখ্যানে রাগ এবার আকাশচুম্বী হলো তার। খুব কষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেয়েছিল, পারেনি, তার বাটারফ্লাই তাকে শান্ত থাকতে দেয়নি। এর শাস্তি তো পেতেই হবে তার। 

ইনানকে শাস্তি দেয়ার ইচ্ছা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। সে শান্তি দিবে তার বাটারফ্লাইকে, তবে কষ্ট দিয়ে না..

ইনান উঠে যেতে নিলে জেহফিল হাত ধরে বিছানায় উল্টো করে ফেলে। ইনানের পিঠের উপর উঠে এসে ইনানের মাথার নিচে বালিশ দুটো রাখে। তারপর ইনানের চুলের মুঠি চেপে ধরে একের পর এক আছাড় মারতে থাকে বালিশের উপর। তার বাটারফ্লাই ব্যথাও পাবে না, আবার তার শাস্তিও দেয়া হবে। 

আকস্মিক আক্রমণে ইনান নিজেকে বাঁচানোর সুযোগ পায় না। জেহফিল ইনানের চুল চেপে ধরেছে। ইনান হাত দিয়ে জেহফিলের হাত ধরল, ছাড়ানোর আশায়। তার আগেই জেহফিল বালিশের উপর ধড়াম করে আঘাত করতে লাগল। নরম বালিশের কারণে যদিও ইনান ব্যথা পায়নি তবে বালিশের উপর কিছুক্ষণ বাদে বাদে মুখ চেপে ধরায় শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল তার। মাথা দুদিক নাড়িয়ে ইনান জেহফিলের হাতের শক্ত বাঁধন থেকে চুল ছাড়াতে চায়। হিতে বিপরীত হয়ে যায়। ক্রোধান্বিত জেহফিল গর্জন করে ইনানের চুলের মুঠি শক্ত করে ধরে, এক হাতে ইনানের দুই হাত পিঠের কাছে এনে চেপে ধরে।

ব্যথায় ডুকরে কেঁদে উঠল ইনান। খুব কষ্টে শ্বাস নিয়ে বলল,

'ছেড়ে দিন জ..জেহফিল।'

জেহফিল ইনানের কথা শুনে থামে। ইনানের চুলের মুঠি ধরে নিজের দিকে ঘুরায়। চোখের জল পুরো মুখে লেপ্টে আছে। ব্যথায় চোখমুখ খিঁচে রেখেছে ইনান। জেহফিল ইনানের গাল চেপে ধরে, বাধ্য করে ইনানকে চোখ খুলতে। তার অশ্রুসিক্ত চোখের দিকে তাকিয়ে হিসহিসিয়ে বলল,

'ছাড়ব? মাই লিটল বেবিগার্ল... এত প্ল্যান করে বিয়ে করেছি কি ছাড়ার জন্য? ছাড়ার কথা তোমার এই ছোট্ট মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো সারাজীবের জন্য।' 

তারপর ইনানের আরো কাছে এসে প্রমত্ত গলায় বলল, 

'এটা আমাদের ভাগ্য ছিল বাটারফ্লাই। তাইতো তুমি স্বপ্নে রোদরঞ্জন হাতে ধরা দিয়েছিলে আমার কাছে‌। নিজেকে বন্দীর শিকল নিজ হাতে করেই নিয়ে এসেছিলে... এই ভাগ্য খণ্ডাবে কীভাবে? আমি...জেহফিল... বেঁচে থাকতে এই ভাগ্য খণ্ডানোর উপায় কোনোদিন খুঁজে পাবে না..খোঁজার সময়টুকুই যে আমি তোমাকে দিবো না সোনা... আমার মৃ'ত্যুর পরেও না.. 'This is called FATE. OUR FATE'
.
.
.
চলবে...........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন