সিগারেটের ধোঁয়ার কুন্ডলির দিকে তাকিয়ে আনমনে ভাবনায় বিভোর রোশন। ইদানীং এই জঙ্গল ওর কাছে অশান্তির জায়গা মনে হচ্ছে। এসব খুনাখুনি, ডাকাতি আর ভালো লাগে না। ঘরে বসে বসেও এখন বিরক্ত লাগছে। দু'দিন ধরে টানা বৃষ্টি হচ্ছে এখানে। এমনিতেই তো ফোনে নেটওয়ার্ক থাকে না, তার উপর বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই! মিষ্টির থেকে দু'দিন আগে মেহেকের শরীরের অবস্থা সম্পর্কে জেনেছিল রোশন। কিন্তু দু'দিন ধরে মেহেকের কোনো খোঁজও নিতে পারছে না। এভাবে থাকা ভীষণ মুশকিল লাগছে। অস্থির লাগছে সবকিছু। এই অস্থিরতা কাউকে বোঝানো যায় না।
" রোশন!"
আচমকা বাবার গলার আওয়াজে নড়েচড়ে উঠলো রোশন। দরজার দিকে দৃষ্টিপাত করে মুচকি হেসে দাঁড়াল।
" হ্যাঁ বাবা, ভেতরে এসো।"
সবুর হোসেন ধীর পায়ে ঘরে ঢুকে চেয়ারে বসলেন। রোশন পা দুলিয়ে বসলো বিছানার একপাশে।
" সন্ধ্যায় দলবল নিয়ে জঙ্গলের পূর্বদিকের গ্রামে যেতে হবে। "
" এই বৃষ্টির মধ্যে? "
" হ্যাঁ। বৃষ্টি হচ্ছে বলেই যাবে। কারণ বৃষ্টির সময় সবাই ঘরে থাকে। বাইরে কেউ কিছু অত খেয়াল করে না। তুলনামূলক কম রিস্ক থাকে। "
" কিন্তু বাবা গ্রামে? গ্রামে কী এমন আছে যা লুটতে যাবো!"
সবুর হোসেন উঠে দাঁড়ালেন। ঘরের দক্ষিণ দিকের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বিকেলের শেষ সময়ের প্রকৃতির দিকে দৃষ্টিপাত করে বললেন,
" ওখানে হাওলাদার বাড়ি আছে। হাওলাদার বাড়ির ধনসম্পত্তি নেহাৎ কম না রোশন। সারাজীবন লোকজনকে ঠকিয়ে টাকা রোজগার করেছে ব্যাটা। পাশাপাশি গাঁজা, ইয়াবার ব্যবসাও করতো। সবমিলিয়ে বেশ বড়সড় পার্টি বলা চলে। "
রোশনও বসা থেকে উঠে সবুর হোসেনের ঠিক ডানপাশে দাঁড়িয়েছে। সিগারেটের অবশিষ্ট অংশটুকু জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে আড়মোড়া ভাঙার ভঙ্গিতে হাই তুলে বলে সে,
" ঠিক আছে। "
" আজকে বাড়িতে লোকজন কম থাকবে ওদের। আর বৃষ্টিও আছে, সবমিলিয়ে দারুণ সুযোগ বুঝতে পেরেছ?"
" হ্যাঁ। "
" ওকে। "
সবুর হোসেন ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য দরজার দিকে এগোলেন। ঠিক দরজার কাছাকাছি থেমে বললেন,
" মেহেকের কী খবর? "
" দুই দিন ধরে কোনো খবর জানি না বাবা। "
ছেলের চেহারার মলিনতা দৃষ্টি এড়ালো না সবুরের।
" কাজটা ঠিকঠাক মতো করে এসো। তারপর একদিন সন্ধ্যায় না হয় গিয়ে দেখে এসো। "
রোশন মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে বৃষ্টির মধ্যেই নদীর দিকে এগোলো। সবুর হোসেন এখনো দরজার কাছে দাঁড়িয়ে। রোশনের মন খারাপ হলে যে নদীর পাড়ে গিয়ে বসে থাকে তা ভালো করে জানেন তিনি। অতিরিক্ত শব্দটাই খারাপ! অতিরিক্ত কোনো কিছু ভালো না। হোক সেটা ভালোবাসা কিংবা টাকাপয়সা। অতিরিক্ত জিনিস সব সময় বিপদ ডেকে আনে বলেই মনে করেন সবুর। বাইরে এই ঝুম বৃষ্টির দিকে দৃষ্টিপাত করতেই বুকটা হু হু করে উঠে সবুর হোসেনের। বর্ষা আসেই বুঝি স্মৃতিচারণ করাতে!
দেখতে দেখতে কেটে গেছে অনেকগুলো দিন। মিষ্টির এসএসসি পরীক্ষা শেষ হয়েছে তিনদিন আগে। আহনাফ এখন আর পড়াতে আসে না। সন্ধ্যা হলে তাই একটু ফাঁকা ফাঁকা লাগে মিষ্টির।
ভোরের আগমনে সূর্যের আলো ঠিকরে পড়ছে চারদিকে। ঘরের বারান্দায় বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে মেহেক। পরনে কালো রঙের থ্রিপিস, খোলাচুল, নাক-কান খালি। কোনো প্রসাধনী নেই কোথাও। মেহেক এখন পুরোপুরি সুস্থ। কিন্তু মন মানসিকতা ভীষণ খারাপ থাকে ইদানীং। রোশন আর আসেনি। আশেপাশের লোকজন, গ্রামের লোকজন সবাই বলাবলি করে, বিয়ের নামে ভোগ করা শেষ তাই আর নিয়ে যাচ্ছে না। আনজুম বেগমও যে মনে মনে তাই ভাবেন সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না মেহেকের। তবে মিষ্টি মেহেককে বোঝায়, হয়তো কোনো সমস্যার মধ্যে আছে রোশন। নইলে এই একমাসে কিছুতেই না এসে থাকতো না সে। মেহেক চুপ করে থাকে সব সময়। আগের মতো কথা বলে না। সারাক্ষণ রোশনের কথা ভাবে। হুটহাট কান্না করে তবে লোকচক্ষুর আড়ালে। কীভাবে যেনো ডাকাত লোকটার প্রতি মায়া জন্মে গেছে। অসুস্থতার সেই দিন, রাতগুলোতে লোকটার সেবা করার কথা ভুলতে পারে না মেহেক। নারীর মন যেমন কঠিন তেমনই কোমল। যেই মানুষটাকে দুচোখেও দেখতে পারতো না,আজকের দিনে এসে তাকে একবার দেখার জন্যই অস্থির হয়ে থাকে মেহেক। শুধু জানতে ইচ্ছে করে কেনো? কেনো এভাবে জোর করে মায়ায় জড়িয়ে ছেড়ে গেলো লোকটা? নাকি মানুষ এমনই? মায়ায় বেঁধে ছেড়ে যায়!
" মেহেক! এই মেহেক! ভাত খেতে আয়। "
আনজুম বেগমের ডাকে ভাবনার ছেদ ঘটে ওর। খেতে ভালো লাগে না। শরীরে কেমন একটা অবসাদ!
" তোমরা খেয়ে নাও মা। আমি খেয়ে বাসনকোসন ধুয়ে নিচ্ছি। "
প্রত্যুত্তর কিছু বললেন না আনজুম বেগম। মেহেক বসে রইলো আবারও আনমনে।
সিদ্দিক আহমেদ বড়ো মেয়েকে নিয়ে ভীষণ চিন্তায় থাকেন। এদিকে মিষ্টিকে বিয়ে দিবে বলে উঠেপড়ে লেগেছেন আনজুম। কয়েক দিন আগেই একটা ভালো সম্মন্ধ এসেছিল। মোটামুটি কথা বলে রেখেছে মিষ্টির মা। কিন্তু সিদ্দিক রাজি নন বলেই পুরো কথা এগোতে পারছে না। মিষ্টি তো চাইলেও না করতে পারে না। কারণ নিজের কৃতকর্মের জন্য বাবা-মায়ের মুখের উপর কথা বলতেও লজ্জা লাগে এখন। তাই তাদের কথামতো বাকি জীবন চলবে বলে ঠিক করেছে। কিন্তু ওর খুব ইচ্ছে ছিলো অন্তত গ্রাজুয়েশন শেষ করবে।
" তুমি কেনো আপত্তি করছো মিষ্টির বাবা? মেহেকের ওই অবস্থা, মিষ্টিরও একটা অতীত আছে। এরমধ্যে যদি মেয়েটার জন্য একটা ভালো সম্মন্ধ পেয়েও হাতছাড়া করি তা কী হয় বলো?"
স্বামীর প্লেটে আরেক চামচ মাছের ঝোল দিয়ে বললেন আনজুম। দুপুরের খাওয়াদাওয়া চলছে। মিষ্টি আগেই খেয়েদেয়ে নিজের ঘরে চলে গেছে। মেহেক খাবে আসরের আগে আগে। এরকম করেই চলছে এখন ওর দিনকাল।
" মিষ্টির মা তোমার কি মনে হয় না, মিষ্টির মতামত নেওয়া দরকার? ও তো বিয়ে করতে চায় না এখন। "
" ওর কথা বাদ দাও তুমি। আমি মোটামুটি কথা বলে রেখেছি, তুমিও মত দিয়ে দাও। মেয়েটার বিয়ে হলে একটু বাঁচি। লোকের কথা শুনতে আর ভালো লাগে না।"
কিছুটা রাগান্বিত স্বরে বললেন আনজুম। সিদ্দিক আহমেদ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হাত ধুয়ে উঠে দাঁড়ালেন।
" তোমার যা ভালো মনে হয় করো। যদি মনে হয় বিয়ে দিলেই শান্তি তবে তাই করো। কিন্তু দেখেশুনে নিও ভালো করে। সবকিছু জেনেও কেনো উনারা বিয়েতে এতো আগ্রহী সেটাও সন্দেহের বিষয়। "
" রাখো তোমার সন্দেহ। মিষ্টির বিষয় কেউ তো সবকিছু জানে না। আর জানবেও না। মেহেকের কথা আলাদা। কে জানে মেয়েটার কপালে কী আছে! "
মেহেকের কথা উঠতেই বুকটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো সিদ্দিকের। সত্যি তো এভাবে তো জীবন চলে না! চোখের সামনে তিলে তিলে শেষ হতে দেখছে নিজ সন্তানকে। কীভাবে যোগাযোগ করবে রোশনের সাথে? ভালোমন্দ কিছু তো একটা জানতে পারতো অন্তত। এসব ভাবতে ভাবতে খাওয়ার ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন মেহেকের বাবা।
মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে মিষ্টি ও আহনাফ। পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে দুজনের মধ্যে। এই ভরসন্ধ্যায় লোকটা হঠাৎ বাড়ির সামনে দেখা করতে কেনো এলো বুঝতে পারছে না মিষ্টি। পাশের বাড়ির টোটনকে বলে মিষ্টিকে বিকেলে খবর পাঠিয়েছিল আহনাফ। কিন্তু মিষ্টির মনে অন্য ভাবনা! কী এমন কথা যা বাড়িতে গিয়ে বলা যেতোনা? নীরবতা ভেঙে আহনাফ নিজেই কথা বললো।
" মিষ্টি! "
" জি স্যার। "
" কিছু কথা জিজ্ঞেস করতে ডেকেছি তোমাকে। তোমার যা বলার মন থেকে বলবে সবকিছু, যদি অনুমতি দাও বলবো।"
মিষ্টি কিছুটা অবাক হলো। কী এমন কথা জিজ্ঞেস করবেন যার জন্য অনুমতি চাইছেন স্যার?
" জি বলুন। "
" শুনেছি, তোমার বিয়ের কথাবার্তা চলছে। মানে বেশ এগিয়েছে। তুমি কি বিয়েতে রাজি? "
" পরিবারের লোকজনের কথা ভেবে রাজি। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে এখন বিয়ে করতাম না। "
" পাত্র হিসেবে কি তাকে খুব পছন্দ হয়েছে? "
কোথা থেকে কী বলছে লোকটা? কথার আগামাথা খুঁজে পেলো না মিষ্টি।
" আমি ছেলের ছবি দেখিনি। বাবা-মা যাকে বলবে তাকেই বিয়ে করছি এতটুকুই। আমার পছন্দের কিছু নেই। "
মিষ্টির সোজাসাপটা উত্তর। আহনাফও ভনিতা ছাড়াই বলে ফেলে,
" তাহলে আমি যদি তোমার বাবা-মাকে বিয়ের জন্য রাজি করাই,পাত্র হিসেবে আমাকে মেনে নিবে?"
আহনাফের এমন প্রস্তাবে চমকাল মিষ্টি। শুকনো ঢোক গিলে চোখে চোখ রাখলো সে। না মজা করার লোক স্যার নন। কিন্তু!
" উত্তর? "
আহনাফের প্রশ্নের জবাবে মিষ্টি চুপ করে থাকায় ফের বলে উঠলো আহনাফ। মিষ্টি গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,
" বাবা-মা যা চাইবেন তাই হবে। মা'কে বলেছিলাম অনেক করে উনি বোঝেননি আমার যন্ত্রণা। "
" আমাকে বলো তোমার কী কষ্ট, যন্ত্রণা! আমি মাঝে মধ্যে খেয়াল করতাম, তোমার কিছু একটা হয়েছে। এবং সেটা বেশ গাঢ় কিছু। "
মিষ্টি দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সেইসব দিনগুলোর কথা ভাবতেই ভয়ে কেঁপে উঠল একবার। আহনাফের নজর এড়ালো না তা।
" হ্যাঁ বলবো। আমি চেয়েছিলাম, আমার যার সাথেই বিয়ে হোক সে যেনো আমার সবটা জানে। কিন্তু মায়ের জন্য বলতে পারিনি পাত্রপক্ষের কাউকে। কিন্তু আপনাকে বলবো অবশ্যই। "
আহনাফ অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে মিষ্টির দিকে। মিষ্টি বলতে থাকলো প্রথম থেকে সবকিছু। কীভাবে বাড়ি থেকে বের হয়েছিল, কীভাবে অন্ধকার গলিতে সময় কেটেছে এবং কীভাবে আবারও গ্রামে ফিরেছে সবকিছুই। আহনাফ শুধু কথাগুলো শুনে অবাক হচ্ছে। এই মেয়েটার সাথে এতো খারাপ কিছু ঘটে গেছে অথচ কারো সাথে মন খুলে বলতে পর্যন্ত পারেনি! মিষ্টির চোখ থেকে নোনাজলের ফোয়ারা বইছে। সেই দিনগুলোর স্মৃতি আজ-ও ক্ষত-বিক্ষত করে দেয় মিষ্টিকে। আহনাফের হুট করে ভীষণ মায়া হচ্ছে মিষ্টির জন্য। কী ভেবেই যেনো আলগোছে বুকে জড়িয়ে নিলো মেয়েটাকে। মিষ্টিও কিছু না ভেবেই আহনাফের বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে দীর্ঘশ্বাস ফেললো আহনাফ নিজেও। সত্যি প্রত্যেকটা মানুষের জীবনের গল্প আস্ত একটা উপন্যাস। আবার বলতে গেলে একের অধিক উপন্যাসের চিত্ররূপ।
চলবে..............................