রোদরঞ্জন - পর্ব ৩২ - আশফি শেহরীন চিত্রা - ধারাবাহিক গল্প


অসময়ের বৃষ্টি ঝরতে আরম্ভ করেছে ধরণীতে। শীত এবং বৃষ্টির ঠাণ্ডা বাতাস গোডাউনের ভারী লোহার জানালা ভেদ করে না আসলেও শীতের প্রবলতা আঁচ করা যায় ভেতর থেকেই। তারউপর ইনানের চুল এখনো পুরোপুরি শুকোয়নি। গা কাঁপুনি দিয়ে উঠছে তার। ইনান জেহফিলের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। হাতে তার ডার্ক রেডের ফিতা। বুকে সাহসের জোগান দিয়ে ধাতস্থ করেই জেহফিলের নিকট পা আগায়। জেহফিল এখনো চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। তবুও ইনানের মনে হচ্ছে জেহফিল যেন তাকে চোখের সূঁচালো দৃষ্টিতে এফোড় ওফোড় করে দিতে চাইছে। এই ভয়ের কারণেই ইনানের শরীর কাঁপছে নাকি শীতের কারণে ঠাহর করতে পারছে না সে। 

‘ফাস্ট বেবি।’ জেহফিল তাড়া দিলো। ঠোঁটে তার স্মিত হাসি।

ইনান ফিতা নিয়ে জেহফিলের চারিদিক ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বাঁধল। হাত জোড়া ভাঙা চেয়ারের হাতলের সাথে রেখে কয়েকবার প্যাঁচালো। দুই পা একত্র করে পায়ার সাথে বাঁধল। ফিতা যখন শেষ হয়ে গেল ইনান কয়েক পা পিছু হটে জেহফিলকে পর্যবেক্ষণ করে নিলো। যে বাঁধনটা আদৌ যথাযথ হয়েছে কিনা জেহফিলের সৌষ্ঠব বিশালদেহী শরীরের জন্য! জেহফিলকে দেখে মনে হচ্ছে তাকে যেন চিকন একটা সুতা দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। 

সময় আর মাত্র সাত মিনিট…

ইনান পাশে পড়ে থাকা জেহফিলের ব্যাগ থেকে দড়ি বের করল। হাতের কাছে যা পাবে তা-ই দিয়েই বাঁধতে হবে। গোডাউনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মোটা, চিকন দড়ি দিয়ে জেহফিলকে বাঁধা আরম্ভ করল। 

বাঁধা শেষে ইনান‌ কোমড়ে হাত রেখে বড় বড় শ্বাস ফেলে দাঁড়াল। নিজের সর্বশক্তি লাগিয়ে জেহফিলকে বেঁধেছে সে। হাত দুটো সামনে এনে দেখল লাল হয়ে গেছে। 

সময় আর মাত্র চার মিনিট…

ইনান তড়িঘড়ি পায়ে গোডাউন থেকে বেরিয়ে আসলো। গোডাউনের দরজা পার হতেই সে দ্রুত পেছনে ফিরল। কেন যেন তার মনে হলো জেহফিল তার পেছনেই.. অথচ জেহফিল এখনো চোখ বন্ধ করে আছে। শরীরে আষ্টেপৃষ্টে আছে শক্ত দড়ির বাঁধন, নিশ্চয়ই জেহফিলের শরীরে দাগ বসে গেছে। জেহফিলের প্রভাব এতই মারাত্মক যে ইনান নিজেই নিজেকে ভরসা করতে পারছে না। 

গেটের বাইরে আসতেই ইনান দুদিকে তাকায়, কোনদিকে গেলে জেহফিল তাকে খুঁজে পাবে না সেটা ভাবতে থাকে। চট করে তার মাথায় আসে গাড়ির কথা। গাড়ি নিয়ে একটাবার চোখের আড়ালে হলেই কেল্লাফতে। ইনান বাড়ির ভেতরে আসলো। অতি সন্তর্পণে সিঁড়ি ঘরের লাইটগুলো বন্ধ করে দিলো। চাবি আনার জন্য অন্ধকারে দোতলা বেয়ে উঠতে নিলো পা টিপে টিপে। গোডাউনের ভেতর নিভু নিভু হলদে আলোয় জেহফিলকে দেখা যাচ্ছে। জেহফিল এখনো কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। শরীর শান্ত করে চেয়ারে বসে আছে। তার মানে সময় এখনো শেষ হয়নি।

সময় আর মাত্র দুই মিনিট…

ইনান বাসায় প্রবেশ করে তাড়াতাড়ি করে জেহফিলের রুমে গেল। ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে চাবিটা নিয়ে মাত্রই ঘুরল ইনান, সঙ্গে সঙ্গে রুমের সবগুলো লাইট বন্ধ হয়ে গেল। লোডশেডিং! শিট! ইনান দুহাত হাতড়ে হাতড়ে রুমের বাইরে আসলো। চারিদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার। ইনান মেইন দরজার দিকে গেল না। ওখান দিয়ে বের হতে গেলে জেহফিল দেখে ফেলবে। যদিও জেহফিলের বাঁধন খোলার সুযোগ একদমই নেই। কিন্তু ইনান ঝুঁকি নিতে চায় না। সিঁড়ি দিয়ে নামতে গেলে জেহফিলের হিংস্র গর্জন শুনলে ইনান ঐখানেই ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যাবে। তখন আর পালানো হবে না। যদি জেহফিল ইনানকে দেখে মুভির মতো শক্তি ফিরে পায় আর তখন এক সেকেন্ডে বাঁধন খুলে ফেলে? আবার অন্ধকারে সিঁড়ি দিয়ে পা ফেলাটা রিস্ক, হাতেও সময় কম। 

ইনান পায়ে পায়ে কিচেনের পাশের মিনি বেলকনিতে গেল। ছাদের সাথেই বাঁকানো গাছ আছে। ইনান কয়েকবার এই গাছ বেয়ে নিচে নেমেছিল। সেই উপায়ে শর্টকাটে নিচে নেমে সোজা গেটের সামনে নামবে। বেলকনিতে যেতেই তাকে হতাশ হতে হয়। বৃষ্টিতে গাছ পিচ্ছিল হয়ে আছে। ইনান হাল ছাড়ল না। গাছের ডালে হাত দিলো। 

পা উঠাতে যাবে ঠিক তখনই শক্ত কিছু তার কোমড় পেঁচিয়ে ধরল, ঠিক সাপের মতো। ইনান থমকে যায়। শরীরের সংকোচন প্রসারণ যেন বন্ধ হয়ে শরীর মুহুর্তের মাঝেই কার্যক্ষমতা হারিয়েছে। বৃষ্টির শীতল পানি তার চুল বেয়ে ঘাড়ে পড়ছে, সেই শীতলতার সাথে হঠাৎ উষ্ণতার ছোঁয়াও ইনানের কাঁধে আছড়ে পড়ছে। ইনানের পেটের কাছে থাকা বাঁধনের প্রগাঢ়তা বাড়ল, সাথে বাড়ল ইনানের শরীরের কম্পন। দেখল ব্লে’ড কিংবা ছু'রির মতো ছোট্ট একটা চকচকে জিনিস সেই বাঁধনে। অজানা ভয়ে তার বাকশক্তির সাথে শরীরের শক্তিও হ্রাস পেয়েছে যেন। মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে জট পাকানো কিছু মুহুর্ত। গাছ থেকে হাত ছিটকে পড়ল শক্তির অভাবে। ঘাড়ে টের পাওয়া উষ্ণ পরশ ক্রমান্বয়ে আরো নিকটে আসতে লাগল। যেন ইনানের শরীরের ঘ্রাণ একেবারে নিয়ে নেয়ার জন্য কেউ গভীর শ্বাস টানছে। সেই সময় হাস্কি ভয়েসে কারো ঝংকার তোলা ভয়ানক সুর ইনানের কানে আসলো সহসা,

‘কট ইউ লি’ল কিটেন।’

চিরচেনা কণ্ঠ শুনে ইনানের মাথায় বাজ পড়ল যেন। সে এত কষ্ট করে, এত শক্ত করে দড়ি দিয়ে বাঁধল… এসব কি শুধু ইনানকে বোকা বানানোর জন্য, এবং তার শরীরের শক্তি অপচয় করার জন্য…

ইনানের ঘাড়ে নরম ঠোঁটের ছোঁয়া পেতেই ইনানের হুশ ফিরে যেন। শরীরের কাঁপাকাঁপি দ্বিগুণ হয়। থরথর করে কাঁপতে থাকে যেন ভূমিকম্প হয়েছে। ইনানের শরীরের অবস্থা থেকে মৃদু হাসির আওয়াজ শোনা যায় পেছন থেকে, যেন সে খুব মজা পেয়েছে ইনানের অবস্থা দেখে।

ইনানের কাঁধ ধরে মুখোমুখি করে। রাস্তার নিয়নের আলোয় ইনান দেখতে পায় ভেজা চুলের জেহফিল তার দিকে শান্ত অথচ হিংস্র চোখে তাকিয়ে আছে। তার আলুথালু সাদা শার্ট বুকের সাথে লেগে বলিষ্ঠ শরীরের ভাঁজগুলো দৃশ্যমান।

‘আমার বোকা বাটারফ্লাই।’ জেহফিল বাঁকা হাসল। ইনানের ডান হাত নিয়ে চুমু খেল সে,

‘তুমি এত বোকা কেন সোনা? জেহফিল কেন তার বাটারফ্লাইকে হঠাৎ যেতে দিবে-এই ভাবনাটা কি তোমার ছোট্ট মস্তিষ্কে একবারো আসেনি? ইট ওয়াজ এ টেস্ট। জেহফিল তার বোকা বাটারফ্লাইয়ের বোকামি দেখার জন্য এই পরীক্ষা নিয়েছে।’

ইনানের হাতে চুমু দিয়ে তাকে ঘরের ভেতরে নিয়ে আসলো কোলে করে। খাটের উপর বসিয়ে দিয়ে বলল,

‘অ্যান্ড কংগ্রাচুলেশন। তুমি বোকামির সর্বোচ্চ ধাপ অতিক্রম করতে পেরেছ।’

জেহফিল ঠোঁট কামড়ে হাসল ইনানের হতবুদ্ধিতা দেখে। সিরিয়াসলি তার বোকা বাটারফ্লাই কত সহজ সরল। জেহফিলকে কী সহজে বিশ্বাস করল!! যেই জেহফিল ইনানকে ছাড়া এক মুহুর্তও থাকতে পারে না সে কেন কেন ইনানকে হঠাৎ মুক্তি দিবে- এই সহজ প্রশ্নটা ইনান ভাবল না? সে তার শিকারকে জেনে শুনে যেতে দিবে? কোন শিকারি এমন করে? 

খাঁচায় বন্দী করা পাখিকে কয়েক মুহুর্তের জন্য উড়তে দিয়েছে সে, অথচ সদ্য মুক্তি পাওয়া পাখি ভুলে গেছে তার পায়ে যে শিকল বাঁধানো। সে যে ফিরে আসবে তার সোনার খাঁচাতেই। নির্দয় মালিকের কাছে…

ইনানের বোকামিতে জেহফিলের হাসির চেয়ে রাগ বেশি হচ্ছে। সাহস কত বাটারফ্লাইয়ের!! জেহফিলকে ছেড়ে যাওয়ার সুযোগ লুফে নিলো! একটাবারও ভাবল না জেহফিল কী করে থাকবে তার বাটারফ্লাইকে ছাড়া! এই দুনিয়াতে তার দ্বিতীয় কে আছে যাকে আকড়ে ধরে বাঁচবে? যাকে মনপ্রাণ ঢেলে দেখবে? যার সাথে হাসবে? যাকে ভালোবাসবে?

ইনানকে কী শাস্তি দেয়া উচিত? দম বন্ধ করে নিজের বুকে জড়িয়ে রাখবে? নাকি আদর করতে করতে মে’রে ফেলবে??

জেহফিল রাগে ফুঁসছে। চোখ দিয়ে যেন লাভা প্লাবিত হচ্ছে। কপালের, ঘাড়ের রগ ফুলে উঠছে। সেই রাগ টের পায় ইনান। তার চোখ বেয়ে ইতোমধ্যে জল গড়িয়ে পড়া শুরু করেছে। জেহফিলের দেয়া শর্তগুলো এক এক করে ইনানের মাথায় ধাক্কা মারছে। 'তোমাকে আমার বশ্যতা স্বীকার করতে হবে ফর দ্য রেস্ট অফ ইওর লাইফ।' কথাটা তার কানে বাজছে অবিরত। 

.

মোমের আলোয় রুম হালকা আলোকিত। বৃষ্টির রিমঝিম আওয়াজ এখন আর সুমধুর হয়ে কানে প্রবেশ করছে না। কেমন ভয়ানক হাসির আওয়াজের মতো লাগছে ইনানের কানে‌। সাথে গগনবিদারী বজ্রপাত! তার ভয় লাগছে, ভীষণ ভয়! বজ্রপাতে নয়, তার সামনে বসা দানবকে ভয়! আর্ট রুমে জেহফিল তার সামনে চেয়ার নিয়ে বসে ইনানকে কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে দেখছে, ঘাড় কাত করে। যেন কোনো কুটিল চিন্তা জেহফিলের মনে চলছে।

‘আমরা আমাদের লাইফের নতুন অধ্যায় শুরু করতে যাচ্ছি। তাই না বাটারফ্লাই?’ গম্ভীর গলায় বলল জেহফিল।

ইনান ঢোক গিলল।

‘তাই না বাটারফ্লাই?’ হিসহিসিয়ে ফের বলল জেহফিল।

ইনান উপর নিচ মাথা নাড়ায়‌। সঙ্গে সঙ্গে জেহফিল ইনানের গাল চেপে ধরে এক হাত দিয়ে। 

‘আহ..’ ব্যথায় কঁকিয়ে উঠল ইনান। 

‘মুখ নেই তোমার? মুখে বলা যায় না?’ দাঁত কটমট করে বলল সে।

ব্যথার মাঝেই ইনান কষ্টে হ্যাঁ বলল।

জেহফিল ইনানের মুখ ছেড়ে দিলো। ইনান গাল চেপে ফুঁপিয়ে উঠল। 

‘একদম চুপ। আর একটা আওয়াজ করলে মুখ সেলাই করে দেব একদম।’

পলকের মুখ সেলাইয়ের ঘটনাটা চোখের সামনে ভাসতেই ইনান একহাতে মুখ চেপে ধরে কান্না আটকানোর চেষ্টা করল। 

জেহফিল উঠে গিয়ে টুলবাক্স হতে কিছু একটা নিয়ে ইনানের সামনে এসে বসল। ইনানের ভেজা জামার বোতাম হঠাৎ একটানে ছিঁড়ে ফেলল সে। ইনান নিজেকে রক্ষা করার সুযোগ পায়নি, তার আগেই তার বস্ত্র মার্বেলের ফ্লোরে দু টুকরো অবস্থায় পড়ে গেছে। 

জেহফিল আবেশিত হয়ে ইনানকে দেখল, ভেজা চুল লেপ্টে আছে ইনানের ঘাড়ে, গলায়, বক্ষবিভাজনে.. বিন্দু বিন্দু জলকণাগুলো কী আরামে ইনানের দেহের সাথে মিশে আছে। জেহফিলের রাগ হলো খুব, ঐ জলকণাদের প্রতি। এগিয়ে এসে ইনানের শরীরের দুঃসাহসিক বিন্দুদের নিজের অধরের মাঝে নিয়ে নিলো। ইনানের ঠোঁট থেকে, গাল থেকে, গলা থেকে…

ইনান কাঠ হয়ে বসেছিল। জেহফিলের হাবভাব সুবিধার না। কেমন অন্যরকম নেশা জেহফিলের চোখে। ইনানের চোখ যেন পড়ে নিলো জেহফিল। তীর্যক হেসে ইনানকে ছেড়ে পকেটে থাকা ছোট্ট ছু’রিটা নিয়ে আচানক নিজের আঘাতপ্রাপ্ত স্থানে আবারো আঘাত করল কয়েকবার। জলের মতো রক্ত গড়িয়ে পড়তে লাগল জেহফিলের হাত বেয়ে। ইনান চিৎকার করে কান চেপে ধরল। 

‘শশহ! কাঁদছ কেন? তোমাকে কি কিছু করেছি?’

‘আ…আপনি জানেন…আমি..রক্ত…’ বড় বড় নিশ্বাস নিতে নিতে মাঝপথে তার কথা আটকে গেল। 

‘আই নো বেবি। তোমার হিমোফ্লোবিয়া আছে তাই না? হুমমম…’ জেহফিল চিবুকে হাত ঠেকিয়ে চিন্তার ভান করল।

টুলবাক্স থেকে চিকন একটা তুলি বের করে ইনানের হাতে দিলো জেহফিল।

‘এটা হচ্ছে তোমার বোকামির শাস্তি। মন দিয়ে শুনবে। তুলি দিয়ে তোমার নগ্ন শরীরের প্রতিটা জায়গায় আমার নাম লিখবে। আর রং..’ জেহফিল কা’টা হাত ইনানের সামনে বাড়িয়ে দিলো,

'রং হলো আমার রক্ত, প্যালেট হলো আমার হাত এবং ক্যানভাস হলো তোমার দেহ।’ 

ক্রুর হাসি জেহফিলের ঐ সুন্দর ঠোঁটজোড়ায় আসন গেড়ে বসল।

‘পারব…পারব না আমি।’ হেঁচকি তুলে কাঁদতে লাগল ইনান।

জেহফিল ইনানের হাতে জোর করে তুলি চাপিয়ে দিলো। 

‘ডোন্ট মেক মি গো হার্ড অন ইউ। তোমাকে লাইট পানিশমেন্ট দিচ্ছি। আশা করি তুমি আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিবে না।’

ইনানের গাল বেয়ে অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়ছে। সে রক্ত ভয় পায় জেনে কী কঠিন এক শাস্তি দিলো তাকে! জেহফিলের চোখে চোখ রাখতেই ইনান চোখ নামিয়ে ফেলল। ঐ ক্রোধান্বিত চোখে চোখ রাখার সাহস তার নেই। কম্পিত হাতে তুলি নিয়ে জেহফিলের রক্তাক্ত হাত থেকে রক্ত নিয়ে নিজের হাতের মধ্যে জেহফিলের নাম লিখল। 

ইনানকে বড় করে ওয়ার্ড লিখতে দেখে জেহফিল থামাল তাকে, হিমশীতল গলায় বলল, 

‘আরো ছোট করে, খাতায় লিখার মতো করে আমার নাম লিখবে। শরীরের একটা অংশও যাতে বাদ না থাকে। গট ইট?’

ইনান ধরা গলায় ‘হুম।’ বলল।

বাচ্চাদের গালে আদর করার মতো করে জেহফিল ইনানের গালে হালকা করে চাপড় দিলো, আদুরে গলায় বলল,

‘সাচ আ গুড গার্ল।’

রক্ত শুকিয়ে গেলে জেহফিল ছু’রি দিয়ে আবার হাতে পোঁচ দিলো, ইনানের চিৎকারে রুম ভারী হলো আবার। আর তা দেখে জেহফিল নির্দয় হাসি হাসে, বিড়বিড় করে বলল,

‘ইটস গনা বি আ লং নাইট।’

.

বিদ্যুত চমকানোর আলো এবং মোমের আলোয় রক্ত বর্ণে রঞ্জিত অনাবৃত দেহের ইনানকে দুই রূপের লাস্যময়ী নারীর মতো ঠেকে জেহফিলের কাছে। জেহফিলের মনে হয়, ইনান নামক মিষ্টি একটা পরী তার সামনে…না না, মনে হবে কেন, তার বাটারফ্লাই তো আসলেই একটা পরী। জীবন্ত পরী। যার রুপ একেক আলোতে একেক রকম, মাতাল করার মতো। তার বাটারফ্লাইয়ের এত চমৎকার রূপ শুধুমাত্র তার..একান্তই তার। 

মোহাবিষ্টের ন্যায় ইনানের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে জেহফিল গভীর গলায় হঠাৎ তার প্রিয় গানটি গেয়ে উঠে,

‘my love is mine, all mine
I love, my, my, mine..
Nothing in the world belongs to me,
But my love, mine, all mine..
Nothing in the world is mine for free,
But my love, mine, all mine, all mine…’

***

শীতকালীন বৃষ্টিমুখর দীর্ঘ রাত শেষে দিনের একফালি নরম রোদ লুটোপুটি খায় ফকফকা ফ্লোর জুড়ে। গভীর ঘুমে নেতিয়া পড়া ইনানের হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় পেটের ক্ষুধায়। অসহ্য যন্ত্রণায় ফেটে পড়া মাথা নিয়ে পিটপিট করে চোখ খুলে ইনান। বুকে মনে হয় কয়েক মণ পাথর চেপে দেয়া হয়েছে এমন ভার। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল ইনানের। যখন তার পেটে তপ্ত শ্বাস আছড়ে আছড়ে পড়তে লাগল তখন বুঝল পাথর নয়, আস্ত এক মানুষের ভার তার ক্ষীণকায় দেহের উপর। ঝট করে চোখ মেলল ইনান। মাথা উঁচিয়ে দেখে জেহফিল খুব আরামে ইনানের বুকে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে।‌ তার বড় বড় পেশীবহুল হাত দুটো ইনানকে সাপের মতো পেঁচিয়ে আছে। পা দিয়ে ইনানের পা পেঁচানো। ইনান দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার আর ফিরে যাওয়ার উপায় নেই। তাকে তৈরি হতে হবে… বশ্যতা স্বীকার করে নতুন জীবনের জন্য…

গতকাল জেহফিলের শাস্তির পর রক্ত দেখতে না পেরে একসময় অজ্ঞান হয়ে যায় ইনান। শাস্তি তখনো শেষ করতে পারেনি ইনান। হাত থেকে পেট অবধি রক্ত দিয়ে নাম লেখার পর মাথা দুলে উঠে। সইতে না পেরে ঢলে পড়ে জেহফিলের বুকে। ইনান তাকায় জেহফিলের হাতের জখমের দিকে। রক্ত শুকিয়ে আছে। কতগুলো দাগ হাতে! দেখেই তো ইনানের হাত পা শিরশির করে উঠে ভয়ে। জেহফিল কীভাবে নিজেকে কষ্ট দিতে পারে? বুক কাঁপে না? ইনান নিজেকে কষ্ট দেয়ার কথা ভাবলেই তো রুহ কেঁপে উঠে।

জানালার দিকে চায় সে। আকাশ দেখে মনে হচ্ছে দুপুর। তারা এতক্ষণ ঘুমিয়েছে! ঘুমানোর কথা অবশ্য, গতকাল সকাল থেকে মধ্যরাত অবধি যা ধকল গেছে তাতে রাত করে ঘুম থেকে উঠলেও ইনান অবাক হবে না। 

জেহফিলকে সরিয়ে উঠতে চায় ইনান। তার হাত দুটো পেট, পিঠ থেকে সরাতে চাইলে ফের জড়িয়ে ধরে ইনানকে। যেন সে ছাড়বে না এই পণ নিয়েছে। জেহফিলের চুলগুলো ইনানের গলায় সুড়সুড়ি দিচ্ছে। তার গালে আলতো চাপড় দিয়ে ইনান কিছুটা বিরক্ত গলায় তাকে ডাকতে থাকে। জেহফিলের হাত কিছুটা আলগা হলেই ইনান ফাঁক গলে উঠে পড়ে। এবং সাথে সাথেই জেহফিলের ঘুম ছুটে যায় আর ইনানকে পাগলের মতো খুঁজতে থাকে‌। কাঙ্ক্ষিত মানুষকে খাটের পাশে দেখামাত্র ঝাঁপিয়ে পড়ে জড়িয়ে ধরার জন্য। শক্ত করে বাহুডোরে আবদ্ধ করে নেয় তার বাটারফ্লাইকে। পাগলের প্রলাপের মতো বকতে থাকে, ‘আমার বাটারফ্লাই.. আমার বাটারফ্লাই…’ বলে।

ইনান কিছু বলে না করেও না। বলে এবং করে যেহেতু লাভ নেই তাই চুপ থাকাই শ্রেয়। শরীর এমনিতেই দুর্বল…

এক মুহুর্তের জন্য যখন বুক খালি খালি লাগল তখনই জেহফিলের ঘুম উবে যায়, তার বাটারফ্লাই… আবার হারিয়ে গেল না তো! এই ভয়, আতঙ্ক মুষড়ে দেয় জেহফিলকে‌। তাইতো বাটারফ্লাইকে দেখামাত্রই নিজের বুকে টেনে নিয়ে আসে। সারা জীবনেও সে কোনোকিছুকে ভয় পায়নি। কাউকে, কিছুকেও না। পিছুটান ছিল না জীবনের। রোবটের মতো দিনাতিপাত করছিল। সেই রোবটিক জীবনযাপনকে ছন্দময় করার উদ্দেশ্যে ইনান ধরা দিয়েছিল হুট করে। যাকে দেখলে জেহফিল বেঁচে থাকার মানে খুঁজে পায়। জীবনের স্বাদ বুঝে। কেন বেঁচে থাকতে হবে সেটাও বুঝে‌। তার পিছুটান আছে‌ এখন। ভালোবাসার মানুষ আছে। এখন কাজে যাওয়ার পর চিন্তা থাকে বাড়ি ফেরার। বাড়িতে তার অপেক্ষার মানুষ আছে। তাকে বেঁচে থাকতে হবে, তার মানুষটার জন্য। কাজের পর ফিরে আসতে হবে, তার মানুষটার জন্য। নিজেকে কর্মঠ রাখতে হয়, শুধুমাত্র তার মানুষটার জন্য। আর সেই মানুষটা মিসেস ইনান এহসান। তার বাটারফ্লাই…

জেহফিল বুকে থাকা ছোট্ট শরীরের ইনানের দিকে তাকাল। ইনানের দেহে তার নাম লেখা রক্তগুলো শুকিয়ে আছে। যেন ইনানের শরীরও এখন বলছে, ‘আমি জেহফিলের’। জেহফিলের পরিতৃপ্তির হাসি হাসে। ইনান তার, সেটা ইনান এখন আর নিজেও অস্বীকার করতে পারবে না। কারণ তার বাটারফ্লাই নিজেই তো জেহফিলের নাম নিজ শরীরে লিখেছে। সিলবদ্ধ করেছে নিজকে, জেহফিলের নামে।

সেই সময় ইনানের পেট থেকে গুড়ু গুড়ু শব্দ শোনা গেল। জেহফিল হেসে ফেলল। ইনানের দিকে তাকাতেই দেখে ইনানও তার সুন্দর চোখজোড়া মেলে জেহফিলের দিকে তাকিয়ে আছে। ইনানের চোখের ভাষা জেহফিল বুঝতে পারে। এই যেমন এখন ইনানের চোখে হার মেনে নেয়ায় জেহফিলের জন্য রাগ, অসন্তোষ দেখতে পারছে, পারলে যেন জেহফিলকে মে’রে দেয়। কিন্তু সে পাত্তা দিল না। যতক্ষণ পর্যন্ত ইনান তার চোখের সামনে থাকবে এবং পালাই পালাই করবে না ততক্ষণ পর্যন্ত ইনানের রাগ ঘৃণা সব মেনে নিতে পারবে সে। ইনান কাছে থাকলেই হলো।

জেহফিল ইনানকে কোলে তুলে আগে বাথরুমে নিয়ে গেল। বহুত হয়রানি করেছে এই মেয়েটাকে। এবার একটু শান্তিতে নিঃশ্বাস ফেলতে দেয়া দরকার। 

বাথরুমের ঠাণ্ডা টাইলসে পা রাখতেই শরীরে কাঁপন ধরে গেল ইনানের। গিজার অন করে দিল জেহফিল। ইনানের কপালে চুমু দিয়ে বলল,

‘সরি তোমার সাথে জয়েন হতে পারছি না বলে। তুমি গোসল সারতে সারতে ঝটপট কিছু বানিয়ে নিচ্ছি। টেইক ইওর টাইম বেবি।’ 

জেহফিল ইনানের গালে, চোখের পাতায় আলতো ছুঁয়ে চলে গেল। তার ব্যবহার এমন যেন তাদের সম্পর্ক আর পাঁচটা দম্পতির মতো স্বাভাবিক। ইনানের গা জ্বলে গেল রাগে। 

বাবার সাথে কথা হয় না অনেকদিন। ইনান ভাবল জেহফিলের দেয়া অন্য যেকোনো একটা শর্ত মাথা পেতে নেবে, তার বদলে বাবার সাথে কথা বলার শর্তটা মওকুফ করে দিতে বলবে। এদিক দিয়ে ইনানের লাভ হলো বাবার সাথে কথা চালানো যাবে। শুধু এই একটাই লাভ…

কম সময়ে জেহফিল শুধু বেগুন ভাজি আর ডিম ভুনা করতে পারল। একটু ঝোল ঝোল না হলে তার বাটারফ্লাই খেতে পারে না, তাই ডিম ভুনায় মশলা দিয়ে কষিয়ে ঝোল করে নিলো। প্লেটে ভাত বেড়ে ইনানের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল সে। ঘড়িতে এখন বিকেল সাড়ে চারটা। চারিদিক আঁধারে ছেয়ে যাবে কিছু সময় বাদে। শীতের দিন ছোট। ঐ পুলিশটাকে এখনো ডিসচার্জ করা হয়নি। গাড়ির ডিকিতে পড়ে আছে। জেহফিল চেক করেছিল একটু আগে। নিঃশ্বাস পড়ছে। চোখেমুখে জগের পানি ঢেলে দেখল জ্ঞান আছে কিনা। পলক জ্ঞান ফিরে কেশে উঠল জেহফিল ঘাড়ে অজ্ঞান করার মতো আঘাত করে। সঙ্গে সঙ্গেই চৈতন্য হারিয়ে ফেলে পলক। ব্যাটাকে সেন্সলেস অবস্থাতেই কোনো এক জায়গায় ফেলে দিতে হবে।

ইনান মাথায় তোয়ালে পেঁচিয়ে ডাইনিংএ আসলে মিষ্টি হাসি দেয় জেহফিল। ইনান যেন সদ্য প্রস্ফুটিত হওয়া গোলাপ, এত স্নিগ্ধ! এত সুন্দর। জেহফিল বুকে হাত রাখল। অন্তঃকরণে অবস্থিত দ্রিম দ্রিম করে বাজতে থাকা হৃদয় ইনানকে দেখে ডঙ্কার ন্যায় আওয়াজ তুলে ছন্দ নিয়ে বেজে উঠে, দ্বিগুণ শব্দে। ইনানকে দেখলে জেহফিলের সবটা কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যায়, পৃথিবী উল্টে পাল্টে দেয়া ঝড় হয়‌। কী এমন আছে এই মিষ্টি মুখখানিতে? যা কিনা পৃথিবীর দ্বিতীয় কোনো নারীতে খুঁজে পায় না সে!

জেহফিল ঢোক গিলে। এমন কোনো উপায় কি নেই যাতে জেহফিল ইনানকে বুকের মাঝে ঢুকিয়ে রাখতে পারবে? ইনানের যেই ছোট্ট শরীর তাতে অনায়াসে জেহফিলের বুকে ঢুকে যাবে সে। কিন্তু উপায় কী?

চেয়ার টানার শব্দে জেহফিলের ধ্যান ফিরে। ইনানকে চেয়ারে বসতে দেখে খুব দ্রুত জেহফিল পাশের চেয়ারে বসে পড়ে। যার ফলে ইনান চেয়ারে নয়, বরং জেহফিলের কোলে বসে। ইনান হতভম্ব হয়ে ভ্যাবাচ্যাকা চোখে চেয়ে থাকে। যখন বুঝল সে জেহফিলের কোলে সে তড়াক করে উঠতে নেয়। জেহফিল দেয় না, ইনানের কোমর চেপে ধরে এক হাতে। প্লেট এগিয়ে এনে ইনানকে খাইয়ে দেয়া শুরু করে।

‘এখন থেকে তোমার চেয়ার আমি।’

ইনান কিছু না বললেও মনে মনে হতাশ নিঃশ্বাস ফেলল।‌ শুরু হয়ে গেছে। খাওয়ার মাঝে ইনান ডাকল জেহফিলকে,

‘আপনি বলেছিলেন শর্ত রিপ্লেস করা যাবে। আমি একটা শর্ত রিপ্লেস করতে চাই।’

জেহফিল ইনানের মুখে ভাতের লোকমা তুলে দিল। সে এই মুহূর্তের অপেক্ষা করছিল। সে জানে ইনান কোন শর্তের কথা বলছে। ইনান ভেবেছে সেই শর্তের বদলে অন্য কোনো শর্ত মেনে নিবে‌!! জেহফিল হাসল। সে যেই শর্ত দিবে তা কি এতই সোজা ভেবেছে বোকা বাটারফ্লাই?

‘তুমি শিওর তো?’

‘হান্ড্রেড পার্সেন্ট।’ ইনানের অকপট জবাব।

জেহফিল মিট মিটিয়ে হাসতে লাগল। ইনানকে দিকে তাকিয়ে। ইনান ভেবে পেল না এখানে হাসির কী হলো!

‘ভেবে বলছো?’

বিরক্ত লাগল ইনানের। ভাবাভাবির তো কিছু নেই। বাবার সাথে কথা বলার জন্য যেকোনো শর্ত সে মেনে নিবে। অধৈর্য হয়ে বলল,

‘জি, ভেবেই বলছি।’

জেহফিল ঠোঁট কামড়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল ইনানের দিকে। তার ঠোঁটের কোণে উঁকি দিচ্ছে তেরছা হাসি। এই হাসিটা জেহফিলের কূটনৈতিক। ইনান জানে। তাই সে দম খিঁচে রইল। জেহফিল যদি ভয়ানক কোনো শর্তের কথা বলে?

জেহফিল দুষ্টু হেসে বলল,

‘পরে বলব, আগে বাকি শর্তগুলোর অভ্যেস করে নাও। কারণ যেই শর্তটা বলব ওটা অনেক অনেক হার্ড, ইউ নো, মানিয়ে নিতে সময় লাগবে তোমার।’ বলেই চোখ টিপ দিলো সে।

ইনান ফাঁকা ঢোক গিলে। কী শর্ত তা বলার সাহস পায় না সে। চুপচাপ খাবার গিলতে থাকে।

.

.

রাতে জেহফিল বেরোবে পলকের দেহটাকে ফেলে দিয়ে আসতে। ইনান তখনো জানতো না যে পলক এখনো গাড়ির ডিকিতে আছে। সে ভেবেছিল জেহফিল বোধহয় গতকালই পলককে রেখে এসেছে। কিন্তু জানার পর ইনান কিছুটা দুশ্চিন্তা করে এই ভেবে যে আবার মা’রা টারা গেল নাকি। কিন্তু চোখের তারায় সেই দুশ্চিন্তা ফুটানোর সাহস করে না। শুধু সন্তর্পণে একবার জিজ্ঞেস করেছে,

‘বেঁচে আছে?’

জেহফিল ছোট্ট করে জবাব দিয়েছিল, ‘হু।’

তারপর আর একটা টু শব্দও করেনি ইনান। মনে মনে প্রার্থনা করছে পলক যাতে সব ভুলে যায়। আর কোনো ঝামেলা চায় না সে।

জেহফিল গাড়ির চাবি নিয়ে বেরোনোর আগে কী মনে করে ইনানকেও রেডি হতে বলল। ইনানের ভালো লাগছিল না পলকের মুমূর্ষু অবস্থা দেখতে। তাই সে নাকচ করেছিল। কিন্তু জেহফিলের গিলে ফেলার মতো দৃষ্টি দেখতেই ভয়ে ভয়ে তৈরি হয়ে নিলো সে। তার জেহফিলকে ভীষণ ভয় লাগে।

সাদা ফতুয়া আর প্লাজো পরে গায়ে চাদর জড়িয়ে বেরিয়ে পড়ল জেহফিলের সাথে। গাড়িতে উঠে জেহফিল রোম্যান্টিক গান ছেড়ে শিষ বাজাতে থাকে। ইনান গাঁট হয়ে বসে থাকে। ডিকিতে পলকের অর্ধমৃ’ত দেহ আর সামনে গানের আসর। অদ্ভুত গা ছমছমে পরিবেশ!

হসপিটালের পাশে নীরব জায়গা খুঁজে নেয় জেহফিল। রাত হওয়ায় অসুবিধা হবে না। গাড়ি থেকে নেমে সিসিটিভি নেই এমন জায়গায় ডিকি থেকে লাথি মেরে ফেলে দেয় পলককে। ইনান সারাটা সময় ঝিম মেরে বসে ছিল। এই বুঝি কোনো অঘটন ঘটে!

জেহফিলের ইচ্ছা করছিল কিছুক্ষণ ইচ্ছে মতো লাথি মা’রে জারজটাকে। মনের আঁশ মিটিয়ে পিষে ফেললে জেহফিলের মনটা একটু শান্ত হতো। কিন্তু হাতে সময় নেই।

গাড়িতে উঠে গাড়ি চালানো আরম্ভ করল। সারা রাস্তা ইনান কথা বলল না। কেমন গুমোট ভাব গাড়ি জুড়ে। গাড়ি যখন বাড়ির রাস্তা না ধরে অচেনা রাস্তা ধরল ইনান মুখ খুলল তখন,

‘কোথায় যাচ্ছি আমরা?’

‘এক জায়গায়।’

‘এক জায়গাটা কোথায়?’

‘আমার প্রিয় এক জায়গা, তোমাকে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে অনেক। গেলেই দেখতে পাবে।’

জেহফিলের ঠোঁটে রহস্যজনক হাসি। চোখেও রহস্য। ইনান ভেবে পেল না কী বলবে। তখন জেহফিল ইনানকে এক টানে নিজের কোলে উঠিয়ে নিলো। বুকের সাথে মিশিয়ে রাখল তাকে। সেভাবেই গাড়ি চালাতে লাগল জেহফিল।

রাত বাড়তে থাকে অথচ রাস্তা শেষ হয় না। ইনানের কোমর ধরে গেছে বসে থাকতে থাকতে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল সে। একটা গাড়িরও চলাচল নেই এই রাস্তায়। রাস্তার একপাশে, অনেক নিচে নদী। আরেক পাশে সুউচ্চ পাহাড়ের মতো। যেন পাহাড় ধরে ধরে রাস্তাটা নেমেছে। 

ইনানের ঘুম আসছিল। ঘুমে চোখ বন্ধ হবার জোগাড়। জেহফিল উষ্ণ বাঁধনে ঘুম গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়ে উঠল। জেহফিল এক হাত স্টিয়ারিংএ রেখে আরেক হাতে ইনানের চুলে বুলাতে লাগল। চাদর দিয়ে ইনানের শরীর ভালো করে জড়িয়ে জানালার কাঁচ তুলে দিল। ইনানের কপালে চুমু দিয়ে ধীরস্বরে বলল,

‘গন্তব্য আসতে আরো আধ ঘন্টা, ততক্ষণ ঘুমিয়ে নাও বাটারফ্লাই। গুড নাইট।’

জেহফিলের বুকে মাথা রেখে ঘুমের অতলে তলিয়ে গেল ইনান।

.

তীক্ষ্ণ আওয়াজে ইনানের নিদ্রা ছুটে যায়। চোখ খুলতে নিবে ঠিক সেই সময়ে দুনিয়া ওলট পালট হয়ে যায় তার, যেন একটা গোল বলের মাঝে সে ঘুরছে, অথচ আওয়াজ কতটা ক্রুর! লোহায় লোহায় ধাক্কা খেলে যতটা তীক্ষ্ণ আওয়াজ হয় তেমন। তখনো জোরালো ঘুমের ঘোর কাটেনি ইনানের। সময় পায়নি ঘুম কাটানোর। তার আগেই সে পেছন থেকে খুব জোরে ধাক্কা অনুভব করে। মাথায় ক্যাচ করে না কোনো ঘটনা।চোখ খোলার আগেই মাথা ঘুরে উঠে। অস্ফুটে একটা শব্দ তার কানে বারি খায়, কেউ অস্থির হয়ে চিৎকার করে ডাকছে,

‘বাটারফ্লাই…!’

তারপর শব্দটি মিলিয়ে যায়। কানে চিঁ চিঁ আওয়াজ ছাড়া আর কোনো শব্দ আসে না। ভাবনার জন্য হিতাহিত জ্ঞানটুকুও হ্রাস পায় ইনানের। কী ঘটছে, কী হয়েছে কিছুই বুঝে উঠতে পারে না সে। আধো আধো চোখে অন্ধকার ছাড়া কিছুই নজরে আসে না। একটু বাদে খুব জোরে কিছুর আওয়াজ পায় আবার। মাথায় তরল কিছু অনুভব করে, শরীরের নিচে শক্ত পাটাতনের মতো। নিঃশ্বাস নিলেই বালু নাকে মুখে ঢুকছে, বালির সাথে মুখে নোনতা কিছু অনুভব করে সে। তখনই, হঠাৎ করে, একদম হঠাৎ করে অন্য কোনো দৃশ্য নয়, চিন্তা নয়, বরং তার মস্তিষ্কে ফ্ল্যাশ লাইটের মতো জ্বলে উঠে জেহফিলের সুশ্রী মুখখানি। মিষ্টি করে বলা ‘বাটারফ্লাই’ ডাক। তারপরই ইনানের চোখ বন্ধ হয়ে যায় ধীরে ধীরে।

পরিশেষে খালি অন্ধকার আর অন্ধকার…
.
.
.
চলবে...........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন