অতিথি নিবাস - পর্ব ০১ - তানজিল মীম - ধারাবাহিক গল্প


“আপা হুনছেন, চাচায় আপনের লাইগ্গা তিন তিনডা পোলার লগে বিয়া ঠিক করছে।”

রাহেলার কথা শুনে মুখ ভরতি পানিটা থুঁ মেরে ফেলে দিল ফাবিহা। যা গিয়ে পড়ল সোজা রাহেলার মুখে। রাহেলা চমকে বলল,
 “ছ্যাহ্! ছ্যাহ্, আপা এইডা কি করলেন?”

ফাবিহা সে'কথার জবাব দিল না। বিস্মিত কণ্ঠে বলল, “বিয়ে ঠিক করছে মানে, কি বলছ এসব?”

রাহেলা তার গায়ের ওড়না দিয়ে ভেজাল মুখটা মুছে বলল, “আপা হাচা কই, আমি কতকুন আগে হুনছি চাচায় কারে জানো কয় আপনার লগে তিনতা পোলার বিয়া দিব।"

ভ্রু-কুচকে গেল ফাবিহার। বিরক্ত নিয়ে বলল,
 “তোমার কি মাথা ঠিক আছে তিনটে ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক করে কেমনে?”
 “হাচা কই আপা মিত্তা কইলে এহনই চুলায় চড়ানো তরকারি পুইড়া যাইবে।”

ফাবিহা বিপাকে পড়ল। নির্ঘাত এই মেয়ের মাথাটা গেছে। হঠাৎই নাকে পোড়া পোড়া গন্ধ আসলো রাহেলার। সে বলল, 
 “আপা কি যেন পোড়ার গন্ধ আহে না?”

রাহেলার কথা শুনে ফাবিহাও গন্ধ শুঁকার চেষ্টা করল। একটু শুঁকে বলল, “হুম পাচ্ছি তো চুলায় কি দিছিলা?”

রাহেলার হঠাৎই মনে পড়ল কতক্ষণ আগে কালকের তরকারি গরম করতে দিয়েছিল। রাহেলা দ্রুত উঠে দাঁড়াল ছুটে যেতে যেতে বলল, “আরে আফা আমার তরকারি গেছে গা। কই ভাবলাম কাইলের তরকারি দিয়া ভাত খামু। আহ্ আহ্!

বলতে বলতে দৌড়ে গেল রাহেলা। ফাবিহা তাকিয়ে রইল। এই মেয়েটা আসলেও পাগল। সবসময় দুইলাইন বেশি বোঝা পাবলিক। ফাবিহার মাঝে মাঝে বিরক্ত লাগে একে। যেমন এখন লাগছে বাবা নাকি তিনটে ছেলের সাথে তার বিয়ে ঠিক করেছে! এমন অদ্ভুত কথাবার্তা রাহেলার মুখ থেকেই বের হয়। কি শুনতে কি শুনেছে কে জানে!'

ফাবিহা বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। নীরব দীর্ঘশ্বাস ফেলে যেতে নিল নিজ কক্ষে। এরই মাঝে বাড়ির কলিংবেলটা বেজে উঠল। তপ্ত দুপুরের এই গরমাক্ত সময়ে কে এলো! আর দরজা আটকালো কে! আবারও কলিংবেল বেজে উঠল। ফাবিহা দ্বিধাহীন এগিয়ে গেল। বর্তমানে ঘরে সে আর রাহেলাই আছে। মা আর বাবা ছাঁদে গেছেন। দরজাটা বোধহয় ওই রাহেলাই বন্ধ করে দিয়েছে। মেয়েটাকে নিয়ে আর পারা গেল না।'

ফাবিহা এগিয়ে গিয়ে দেখল দরজা খোলা তবুও কেউ কলিংবেল বাজাচ্ছে। ফাবিহা কৌতুহলী চাপিয়ে রাখা দরজাটা খুলে দিল। সঙ্গে সঙ্গে তার চোখ গিয়ে ঠেকল একজন যুবকের দিকে। গায়ে জড়ানো গ্রীন শার্ট, কালো প্যান্ট, এলেমেলো চুল, গা চুইয়ে কিছুটা ঘাম ঝড়ছে। ফাবিহা চিনতে পারল না। যুবকটিকে পুরোই অপরিচিত লাগল তার। ফাবিহা শান্ত স্বরে প্রশ্ন করল,
 “কাকে চাই?”

ছেলেটির এলেমেলো চাহনি। উসখুস ভাব। সে বলল, “আসসালামু আলাইকুম। আমি আরহান। মাসুদ আঙ্কেল কি বাড়িতে আছেন?”

ফাবিহা খানিকটা অবাক হলো। বলল, 
 “ওলাইকুম আসসালাম। জি আছেন। তবে ঘরে নেই ছাঁদে।”

আরহান দৃষ্টি সরিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে বলল,
 “ওনাকে একটু ডেকে দিলে ভালো হতো আমাদের উনি আসতে বলেছিলেন।”

'আমাদের' আমাদের বলতে কি বুঝাচ্ছেন! উনি একা নন আরোও মানুষ আছেন। ফাবিহা বেশি না ভেবে বলল, “আপনি দাঁড়ান আমি দেখছি।”

আরহানের সাবলীল উত্তর,
 “ঠিক আছে। তবে একটু তাড়াতাড়ি করবেন।”
 “জি।”

ফাবিহা ঘর ছেড়ে ছাঁদের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠল। চেঁচিয়ে বলল, “বাবা, তোমার সাথে আরহান নামের কেউ দেখা করতে এসেছে।”

গাছের পাতা কাটছিলেন মাসুদ উদ্দিন। মেয়ের কথায় ধ্যান ভাঙল। খানিকটা বিচলিত কণ্ঠে বললেন,
 “ওরা চলে এসেছে তাহলে?”

বলতে বলতে দ্রুত নিচে নামলেন মাসুদ উদ্দিন। পাশেই ফাবিহার মা রিনা বেগম তাকিয়ে। ফাবিহা বলল, “কে এসেছে মা?”

রিনা বেগম মাথা নাড়ালেন। যার অর্থ,'তিনি জানেন না।'

  মাসুদ উদ্দিন নিচে নামতেই দেখলেন আরহান দরজার মুখে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাসুদ উদ্দিন দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে বলল, “আরে আরহান তুমি বাহিরে দাঁড়িয়ে আছো কেন– ভিতরে চলো। ফাবিহা তোমায় ভিতরে যেতে বলেনি?”

আরহান কি বলবে বুঝতে পারছে না। মিথ্যে বলবে নাকি সত্যিই। বেশি দ্বিধায় না থেকে সরল মনেই বলল, “বলেনি।”

মাসুদ উদ্দিন লজ্জা পেলেন মেয়েটার আর বোধবুদ্ধি কিছু হলো না। তিনি বললেন,
 “তুমি কিছু মনে করো না ও একটু...”
 “সমস্যা নেই আঙ্কেল আমি কিছু মনে করিনি। চাবিটা দিলে খুব ভালো হতো।”
 “হুম অবশ্যই। তুমি আগে ভিতরে আসো। তোমাদের তো আরো আগে সকালে আসার কথা এতটা দেরি করলে?”
 “সবটা গোছাতে গোছাতে একটু দেরি হয়ে গেল।”
 “ওহ আচ্ছা। আসো ভিতরে আসো।”

ইচ্ছে না থাকা সত্যেও আরহান ভিতরে ঢুকল। বাহিরে তার দুই বন্ধ দাঁড়িয়ে আছে। বেশি দেরি করাটা ঠিক হবে না। আরহান ভিতরে ঢুকে পুরো ঘরে একবার চোখ বুলালো। চারপাশ বেশ পরিপাটি। মাসুদ উদ্দিন সোফার দিকে ইশারা করলে বললেন,
 “তুমি সোফায় বসো আরহান, আমি এক্ষুণি চাবি নিয়ে আসছি।”
 “আচ্ছা আঙ্কেল।”

মাসুদ উদ্দিন নিজের ঘরে অগ্রসর হলেন। আরহান চুপটি করে বসল সোফায়। তখনই ঘরে ভিতর প্রবেশ করল ফাবিহা ও তার মা রিনা বেগম। আরহান রিনা বেগমকে দেখেই উঠে দাঁড়াল। ভদ্রতার সহিত বলল, “আসসালামু আলাইকুম আন্টি।”

রিনা বেগমও মিষ্টি হেঁসে উত্তর দিলেন, “ওলাইকুম আসসালাম। বসো তুমি।”

আরহান পুনরায় বসল। রিনা বেগম ছুটে গেলেন নিজেদের ঘরে। ফাবিহা চুপটি করে দাঁড়িয়ে। দৃষ্টি তার আরহানের দিকে। সে ধরতে পারছে না বাবার কাছে এই ছেলের কি কাজ! মাসুদ উদ্দিন বেরিয়ে আসলেন মিনিট তিন যেতেই। রিনা বেগম তার আগে জিজ্ঞেস করলেন, “ছেলেটা কে?”

মাসুদ উদ্দিন জবাব দিলেন না। সোজা আরহানের কাছে এসে চাবিটা এগিয়ে দিয়ে বলল, “নেও।”

আরহান উঠতে নিবে তার আগেই বললেন,
 “কিছু খাবে আরহান?”
 “কিছু লাগবে না আঙ্কেল তবে এক গ্লাস পানি খাওয়ালে খুব ভালো হতো।”

মাসুদ উদ্দিন দ্রুত রাহেলাকে ডাকলেন,
 “রাহেলা কোথায় তুই? একগ্লাস পানি নিয়ায়।”

  রান্নাঘরে রাহেলা জানালার ফাঁক দিয়ে তাদের সামনের বাড়িটির দিকে দু'দুটো যুবককে বসে থাকতে দেখে তাকিয়ে আছে। মনে মনে ভেবেই ফেলেছে এই পোলা দুইডার কাছেই ফাবিহা আপার বিয়া দিব চাচা। কিন্তু তিনডা পোলা থাকার কথা এহানে তো দুইডা আরেকটা কই! মাসুদ উদ্দিন দ্বিতীয়বার ডাকলেন। সঙ্গে সঙ্গে কেঁপে উঠল রাহেলা। এমন জোরে কেউ ডাকে। রাহেলা বুকে ফুঁ দিয়ে দ্রুত রান্নাঘর থেকে বের হলো। বলল, “কি হইছে চাচা?”

মাসুদ উদ্দিন তাকালেন রাহেলার দিকে। তাড়া দিয়ে বললেন, 
 “এক গ্লাস পানি নিয়ায় দ্রুত।”

রাহেলা একঝলক আরহানকে দেখে বলল,
 “জে আচ্ছা।”

আরহানের বড্ড অসস্থি লাগছে। মনে হচ্ছে পানি চাওয়াটা ঠিক হয়নি। ওদিকে বাহিরে তৌহিদ আর শান্ত দাঁড়িয়ে আছে। রাহেলা ছুটে আসলো একগ্লাস পানি নিয়ে। সে পানিটা এগিয়ে দিল মাসুদ উদ্দিনের দিকে। তিনিও নিলেন। এগিয়ে দিলেন আরহানের দিকে। আরহান গ্লাসটা হাতে নিলো।'

অন্যদিকে রাহেলা ফাবিহার পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
 “দেখছেন আপা কইছিলাম না চাচায় আমনের লগে তিনডা পোলার বিয়া দিব। এই একজন আর বাকি দুইডা বাহিরে আছে।”

ফাবিহা চোখ রাঙিয়ে বলল,
 “তুমি চুপ করবে।”
 “হ আমারে তো কইবেনই চুপ করতে যহন হাঁচা হাঁচা ঘটব তহন বুঝবেন।”
 “তোমার মাথায় কি গোবর আছে?”
 “দেহেন আপা আপনের বিশ্বেস না হইলে চাচারে জিগাইতে পারেন। চাচায় তো ওই সামনেই দাঁড়াইয়া আছে যাইয়া জিগান।"
 “রাহেলা থামো।”
 “ক্যান থামমু আমনে জিগান চাচারে।”

ফাবিহার এবার বেশ বিরক্ত হলো। রাগও লাগল। সে আট-পাঁচ কিছু না ভেবেই ফট করে বলে ফেলল,
 “বাবা তুমি নাকি আমার সাথে তিনটে ছেলের বিয়ে ঠিক করেছো।”

মাত্রই পানিটা গিলেছিল আরহান। আচমকাই ফাবিহার এমন উদঘাট কথা শুনে কাশি উঠে গেল তার। মুখ থেকে পানি পড়ে গেল নিমিষেই। সে কাশতে লাগল। মাসুদ উদ্দিনসহ দূরে দাঁড়ানো রিনা বেগমও ভড়কে গেলেন। ফাবিহা তাকাল আরহানের দিকে। মাসুদ উদ্দিন বিচলিত কণ্ঠে বলল, “তুমি ঠিক আছো তো বাবা?”

আরহান বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। কোনোমতে শ্বাস ফেলে বলল, “জি আঙ্কেল। আমি তাহলে যাই বাহিরে আমার বন্ধুরা দাঁড়িয়ে আছে।”
 “ঠিক আছে।”

আরহান চলে গেল। মাসুদ উদ্দিন বিরক্ত বেসে ফাবিহার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার মাথায় কি বিন্দুমাত্র কান্ডজ্ঞান নেই। এমন আবল-তাবল প্রশ্ন করছ কিভাবে?”

ফাবিহা পাত্তা দিল না। সে বলল,
 “এই কথা তুমি রাহেলাকে জিজ্ঞেস কর ও নাকি শুনেছে তুমি জানো কাকে বলেছ আমার সাথে তিনটে ছেলের বিয়ে ঠিক করেছ।”

রাহেলা পড়ল বিপদে। তবুও বুক ভরা সাহস নিয়ে বলল, “দেহেন চাচা মিথ্যা কইবেন না আমি কিন্তু হুনছি।”

মাসুদ উদ্দিন হতাশ হলেন। তবুও বললেন,
 “তোরে শীঘ্রই পাবনায় পাঠাব দাঁড়া।”

কথাটা বলে রাগে হন হন করে চলে গেলেন মাসুদ উদ্দিন। আর রাহেলা হ্যাবলার মতো তাকিয়ে রইল। সে ফাবিহাকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা আপা, পাবনায় কি আমার জামাই আছে? কিছু হইলেই চাচায় খালি কয় পাবনায় পাডাইব। আমি আজও বুঝলাম না বাকি জেলা গুলানে কি সমেস্যা?"

ফাবিহা উত্তর দিল না। মাথা চাপড়ে চলে গেল। তবে মনে মনে ভাবল ঠিকই, “এ মেয়ে আধতেও কোনো কামের না।”

এদিকে,
আরহান নিচে আসতেই তৌহিদ প্রশ্ন ছুঁড়ল,
 “কিরে শালা ভিতরে চাবি আনতে গেছিলি নাকি বউ আনতে এত সময় লাগে।”

আরহান কি বলবে বুঝচ্ছে না। তার মাথাটা এখনও কেমন যেন ঝিম ধরে আছে।
.
.
.
চলবে..........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp