ভোরবেলা সর্বপ্রথম ঘুম ভাঙে মীরার। ঘুম থেকে উঠেই হুড়মুড়িয়ে সে বেড়িয়ে যায় ঘর থেকে।মূলত উশানের সামনে যাতে তার আপাতত না পরতে হয় তারই কারণ বশত এমনটা করা। মীরা কুঁড়ে ঘরের সামনে থাকা খড়ি দিয়ে তৈরি রান্নাঘরের দিকে যায়। সেখানে হাশেম মিয়ার স্ত্রী রোজি এবং পাখি রান্না করছিলো তখন। মীরা তাদের সামনে গিয়ে মিষ্টি কন্ঠে বলে,
-' আসসালামু আলাইকুম আন্টি। '
' সুপ্রভাত ' শব্দটা কন্ঠনালি দ্বারা উচ্চারণ করতে গিয়েও থেমে যায় মীরা। সালাম করা উচিত এখন, অন্তঃকরণ হতে বার্তা এলো। রোজি সালামের উত্তর নেয়। ম্লান হেঁসে বলল,
-' রাতে তোমাগো ঘুমাইতে অসুবিধা হইছে? '
-' না আন্টি। আপনাদের অনেক অনেক ধন্যবাদ রাতের বেলা আমাদের আশ্রয় দেয়ার জন্য। '
-' হইছে থামো! তা তোমার ভাই কুণে? তারে দেহিনা যে? '
মীরা ইতস্তত বোধ করে জবাব দিলো, ' ও ঘুমাচ্ছে! ঘুম থেকে উঠতে দেরী লাগে তার। '
-' ওহ! যাও তুমি কলপাড় তে মুখ ধুইয়া আহো।খুদা লাগছে না? খাইতে দেই। '
মীরা সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে কলপাড়ে আসে। মুখ ধুয়ে আসার পথে তার দৃশ্যমান হয় উশান কে। ঘুমু ঘুমু চোখে হাশেম মিয়ার সাথে হেঁসে কথা বলায় ব্যাস্ত সে। মীরা একটু অবাক হলো। এইতো সে আসার পথে দেখলো লোকটা গভীর ঘুমে মগ্ন! আর এখনি উঠে গেলো? এতো জলদি? অদ্ভুত! উশান মুখ ধুয়ে আসার পর দু'জনকে সকালের নাস্তা দেয়া হয়। নাস্তা শেষ করে হাশেম মিয়া এবং রোজির থেকে বিদায় নিয়ে উশান মীরাকে নিয়ে রওনা হয়। আসার পথে উশান বেশ কিছু টাকা দিয়ে আসে হাশেম কে। নিতে চাচ্ছিলেন না যদিও হাশেম মিয়া তবে পাখির পড়াশোনায় কাজে লাগবে বলে টাকা গুলো তার হাতে গুঁজে দিয়ে কৃতজ্ঞতা পেশ করে চলে এসেছে পাহাড় ছেড়ে জঙ্গলে। মীরা, উশান ২ জনই নিশ্চুপ, নির্লিপ্ত! মীরা চোখ মেলাতে পারছে না উশানের সাথে। কেনো?কে জানে!
-' মাথা ব্যাথা করছেনা? '
উশানের থমথমে কন্ঠস্বর। মীরা তটস্থ হলো। আমতা আমতা করে বলল,
-' কি আশ্চর্য! আমার মাথা ব্যাথা করতে যাবে কেনো?'
-' কাল রাতে ভাং খেয়ে মাতলামি করলে আর এখন বলছো মাথা ব্যাথা করবে কেনো? '
মীরা হকচকিয়ে উঠলো। ইশ! সে তো ভুল করে ফেললো একটা। কাল রাতে কৃত্রিম মাতালের মতো ব্যাবহার করার পর সকালে ঘুম থেকে উঠেই সে সব ভুলে বসেছে। আলগোছে, উশানের দৃষ্টি অগোচরে কপাল চাপড়ালো মীরা। শান্ত হয়ে স্বভাবগত কন্ঠে বলল,
-' মাথা ব্যাথা করছেনা। একটু ভার হয়ে আছে শুধু।'
উশানের পাল্টা প্রশ্ন, ' কাল রাতের কথা কিছু মনে আছে? '
-'উহ্.. না! মনে থাকার কথা নাকি? '
উশান সম্মুখে দৃষ্টিপাত ফেললো৷ অধর কোণে ফুটে উঠলো তেরছা হাসি। আলত স্বরে, বিড়বিড়িয়ে শুধালো,
-' ডাফার গার্ল! '
______
লোকালয়ে ফিরতে উশান, মীরার সময় লাগলো ১ ঘন্টার মতো। আরো আগে ফিরতে পারো তবে মীরা অত্যান্ত ধীর পায়ে হেঁটেছে। কালকের পায়ের আঘাতের নিদারুণ যন্ত্রণা এখনো আছে। তাই চাইলেও সে দ্রুত হাঁটতে পারেনি। নিজেদের ফ্লাটে এসে পৌঁছাতেই মাহদি দৌড়ে আসলেন। মেয়ের মাথায় হাত রেখে উত্তেজিত হয়ে বললেন,
-' ঠিক আছো আম্মু? '
নম্র কন্ঠে মীরা প্রতিত্তুর করলো, ' জি বাবা। আমি ঠিক আছি। শান্ত হও! মায়ান কোথায়? '
-' মায়ান তো স্কুলে। আসো ভিতরে। উশান? তুমিও আসো। '
উশান বিরোধিতা পেশ করে বলল, ' না আঙ্কেল! অন্য কোনো সময় আসবো। আমার গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে আঙ্কেল! তাই একটু তাড়া আছে। পরে আসবোনে। '
-' আচ্ছা। এসো কিন্তু! '
উশান দ্রুত পদে বেড়িয়ে যায়। মীরা বাবার সাথে কথা বলতে জানতে পারে আহনাফ বিয়ে ভেঙে দিয়েছে যৌক্তিক কারণ দেখিয়ে। স্বস্তির শ্বাস ফেলে মীরা। যাক! একদিক তো ঠিক হলো। মাহদির সাথে আরো কিছুক্ষণ কথা বলে মীরা হাস ফাঁস করে বলল,
-' বাবা আমি ফ্রেশ হবো। জামাকাপড়ে ধুলোবালি লেগে আছে। ভালো লাগছেনা আমার। গা গুলিয়ে আসছে। পরে কথা বলবো তোমার সাথে। '
মীরা তড়িৎ বেগে প্রস্থান করলো কক্ষ হতে। মাহদি হতাশ দৃষ্টিতে তাকালো। মেয়েটার খুঁতখুঁতে স্বভাবের পরিবর্তন তাহলে হলোই না।
_______
-' আর কতোবার গোসল করবি মীরা? '
রুহি হাই তুলে প্রশ্ন ছুড়লো। মীরা তখন নিজেকে আরশিতে দেখতে ব্যাস্ত। তোয়ালে দিয়ে ব্যাস্ত হাতে চুল মুছছে৷ দুই ঘন্টায় প্রায় সাত থেকে আটবার তার গোসল করা শেষ। তবুও বারংবার মনে হচ্ছে, ধুলোবালি, নোংরা যেনো তার সাথে এখনো মিশে রয়েছে। রুহির কন্ঠে মীরা পিছন তাকালো। সঙ্গে সঙ্গে মৃদু স্বরে চেঁচিয়ে বলল,
-' বাহির থেকে এসে পা না ধুয়ে আমার বিছানায় বসতে তোকে মানা করেছিনা রুহি?নাম জলদি! '
রুহি বিরক্ত হয়। ভীষণ বিরক্ত! মেয়েটা একটু অতিরিক্ত করছেনা? বিছানা থেকে নেমে দাঁড়িয়ে মীরার সন্নিকটে এগোল রুহি। ফ্লোরে বসে পড়ে বলল,
-' হইছে শান্তি এবার? মাটিতে বসছি। '
আঁড়চোখে রুহিকে দেখে নিজের কাজে তুমুল ব্যাস্ত হয় মীরা। রুহি দাঁত দিয়ে নখ কাটতে শুরু করলো। কিয়ৎক্ষণ বাদে হৃষ্টচিত্তে বলল,
-' তো সোনা! কাল রাত উশান ভাইয়ের সাথে কি কি করলা? ঝগড়া করছিস দু'জন? উশান ভাই আবার তোকে কিছু করছে? বকা দিছে?আঘাত করছে কোনো?'
-' আঘাত সে আমাকে করেনি। বরং আমি তাকে করেছি। '
রুহি চমকিত হয় বেশ। ওষ্ঠাধর গোল গোল করে জিজ্ঞেস করলো,
-' হোয়াট? '
কাল রাতের সম্পূর্ণ ঘটনা মীরা একে একে খুলে বলল। রুহি সবটা শুনে হাসতে গিয়েও থেমে গেলো। তার খটকা লাগছে বড্ড! সন্দিহান কন্ঠে বলে উঠলো,
-' ওয়েট! ওয়েট! আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না তুই মিথ্যা মাতলামোর নাটক করে ভাইয়াকে এতো কষ্ট দিছিস আর ভাইয়া কিছুই বুঝেনাই৷ আমার সন্দেহ হচ্ছে জান! আমার কেনো যেনো মনে হচ্ছে উশান ভাই সব জানতো। জানতো তুই এক্টিং করছিস। দেখ এটা কিন্তু তেমন কোনো বড় ব্যাপার না। তাছাড়া ভাইয়া ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট! সে বেশ চতুর। তার সাথে এমন নাটক করলি তুই আর সে বুঝলো না? হোয়াট এ জোক্স!'
মীরা ভাবনায় পড়লো। একটু গভীর মনোযোগ সহকারে চিন্তা করার পর সে নিজেও বেড়াজালে ফেঁসে গেলো। আসলেই তো! রুহির কথাটা তো এতোটা হাল্কা ভাবে নেওয়া যাচ্ছেনা। কিন্তুসন্দেহ এবং প্রশ্ন এক জায়গাতেই। উশান যদি সব জেনে যায় ও তবে সে চুপ কেনো ছিলো?
_____
তীব্র শব্দ যোগে হাসছে। হাসতে হাসতে গাল ব্যাথা হওয়ার উপক্রম তবুও হাসি, অতীব চেষ্টা করেও থামানো যাচ্ছে না। দিগন্ত অতী কষ্টে নিজের হাসি চেপে রেখেছে। এখন হাসলেই বিপদ। মহা বিপদ! উশান স্যার দেখা যাবে হু হা করে হেঁসে দিলে তার চাকরি ধরে টান দিতে পারে। হাসি চেপে রাখা ভীষণ কষ্টসাধ্যকর কাজ দিগন্ত আজ তা হারে হারে টের পেলো। কোনোমতে সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
-' স্যার? একটু বাহির যাই? ঐ মানে.. প্রকৃতির ডাক এসেছে। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে যাই স্যার?'
উশান জলদগম্ভীর কন্ঠে বলল, ' যাও! '
দিগন্ত দৌড়ে রুম থেকে বের হয়। এখন সে মন - প্রাণ খুলে কতক্ষণ হাসবে অতঃপর রুমে প্রবেশ করবে।
তীব্র, দিগন্তের হাসির কারণ মূলত উশান। কাল রাতে মীরা তার সাথে যা যা করেছে তা সে সংক্ষিপ্ত করে তীব্রকে বলেছে। তেমনি দিগন্ত রুমে কাজে মহা ব্যাস্ত থাকার পরও উশানের সকল কথা মনোযোগ সহকারে কাজ ফেলে শ্রবণ করেছে। উশানের কথা শেষেই তীব্রের এই হাসি। উশান কড়া দৃষ্টিতে তাকালো। নিজেকে সামলায় তীব্র। লম্বা শ্বাস টেনে বলে উঠলো,
-' সিরিয়াসলি দোস্ত? তোর এতো ধৈর্য কোথা থেকে আসলো? এতো মার খাওয়ার রেকর্ড গড়লি তাও সেই মার খেয়েছিস ইচ্ছে করেই? '
-' ইচ্ছে করেই সহ্য করেছি। আর মীরা মাতাল ছিলো না। ভাং খায়নি ও। ইচ্ছে করে এমন ব্যাবহার করেছে আমার সাথে। গ্লাসে ভাং ঢেলে ও ফেলে দিয়েছিলো। অন্ধকারে অতোটা স্পষ্টত না দেখতে পেলেও কিছুটা দেখেছি। প্রথমে পাত্তা দেয়নি। দ্যান ও যখন মাতালের ব্যাবহার এবং কথা বলতে শুরু করলো তখন প্রথমেই বুঝে গিয়েছিলাম ও একদম ঠিক আছেনা। অন্ধকারে যা দেখেছিলাম ঐ দৃশ্যটুকু ছিলো ও যখন গ্লাস থেকে ভাং ফেলে দিচ্ছিলো। মীরা এমনটা করেছে মেইবি সেদিন সকালের ঘটনাকে কেন্দ্র করে। '
তীব্র চমকালো! রুমে মাত্র প্রবেশ করা দিগন্তও অবাক উশানের কথায়। তীব্র জিজ্ঞেস করলো,
-' সহ্য করলি? '
-' ইচ্ছাবশত! '
-' কেনো?' তীব্রের বিস্মিত কন্ঠ!
-' কারণ এটার প্রাপ্য আমি। মীরার সাথে যা করেছি, যেই অপমান! তার বদলে ও আমাকে কমই আঘাত দিয়েছে। '
হাস্য-রসক পরিবেশ লহমায় গম্ভীরতায় পরিণত হলো। তীব্র তীক্ষ্ণ চাহনি নিক্ষেপ করে আছে উশানের মুখোশ্রীতে। বোঝার চেষ্টা করছে উশানের অন্তঃকরণ। আসলে উশান চাইছেটা কি?
দিগন্ত হটাৎ বলে উঠলো,
-' স্যার! তূর্শী ঢাকায় আসছে। ও ঢাকায় আসলে আমরা ওকে কিডন্যাপ করি? তাহলেই তো যা জানার জানতে পারবো। কেনো আপনাকে জেলে পাঠালো অযথা! '
উশান মৌনতা বজায় রাখলো কিয়ৎক্ষণ। শেষে ফিচেল কন্ঠে বলল,
-' তার দরকার পড়বে না। আমার যা জানার ছিলো জেনে গিয়েছি। তূর্শী ইচ্ছে করে আমায় জেলে পাঠায়নি। ওকে ব্লাকমেইল করছিলো কেও। তূর্শীর আম্মুকে কিডন্যাপ করে আঁটকে রেখে বলা হয়েছিলো যাতে আমাকে মিথ্যা অভিযোগে জেলে পাঠিয়ে আমার জীবন থেকে দূরে চলে যায়। নয়তো ওর আম্মুকে মে'রে ফেলা হবে। তূর্শীর তখন বয়স কম ছিলো, বুদ্ধি কম ছিলো, আবেগী ছিলো। ভয় পেয়ে ওদের কথা মেনে নিয়েছিলো। কিন্তু ও যখন আমায় জেলে পাঠায় তখন কায়দা করে ও ট্রাই করেছিলো আমাকে জেল থেকে বের করার কিন্তু তখনই যারা ওকে ব্লাকমেইল করছিলো তারা তূর্শীর আম্মুকে মেরে ফেলে। তূর্শী ভেঙে পড়ে যখন মানষিক ভাবে তখন ওর কাজিন ওকে যশোরে নিয়ে যায়। '
তীব্র অবাক কন্ঠে বলল,
-' এতকিছু জানলি কি করে? আর মীরাকে দূরে রাখার কারণন তাহলে এটাই? '
-' হ্যা! আমার ক্ষতি চাচ্ছে কেও। মে'রে ফেলার চেষ্টায় ব্যার্থ হয়ে এখন আমার উইক পয়েন্টে আঘাত করছে।এই কারণেই মীরা কে শত অপমান করে নিজের থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করি। এসব কে করছে? তা না জানা পর্যন্ত আই কান্ট হ্যান্ডেল মীরা! '
দিগন্ত কথার মাঝে ফোড়ন কেটে বলল,
-' এখানে মীরা ম্যামকে আগলে নেয়ার কথা বলছেন কেনো স্যার? '
তীব্র ম্লান হেঁসে উত্তর দেয়, ' হি লাভ'স মীরা! এতদিন ঢং করছে অযথা। '
.
.
.
চলবে...........................