উন্মুক্ত লাইব্রেরী
অন্তিম পর্ব ৩১
আয্যাহ সূচনা
“একটা ছিলো রাজা।আরেকটা ছিলো রানী।রাজাটা ভীষণ দুষ্টু ছিলো।রাগ নাকের ডগায় থাকতো।আর রানী ছিলো ভীষণ চুপচাপ।একদম শান্ত।রাজা যখন রাগ করতো তখন রানী তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো।তারপর সেই রাজার রাগ একটা সুন্দর পরী এসে পুঁটলিতে করে নিয়ে চলে যেতো।রাজা রানীকে অনেক অনেক ভালবাসতো জানো?কিন্তু কখনও মুখে স্বীকার করতো না।রানীকে অনেক বিরক্ত করতো।আবার যত্নও করতো।তার জন্য লুকিয়ে লুকিয়ে উপহার নিয়ে আসতো।আর রানী সেই উপহার দেখে ভীষণ খুশি হতো। রানী নিজ হাতে রাজাকে খাইয়ে দিতো।অনেক অনেক দিন পর রাজা রানীর ঘরে একটা রাজপুত্র আসে।এই রাজপুত্রতো রাজার চেয়েও ভারী দুষ্টু। জানো রাজপুত্রের নাম কি?”
ঠোঁট গোল করে প্রশ্ন আসে, “কু?”
অর্থ হচ্ছে কি?জবাব এলো আদুরে কণ্ঠে, “ওই রাজপুত্রের নাম হচ্ছে বর্ষণ।”
সময়টা দুই হাজার আটাশ সন।ত্রৈবৎসরকাল কেটেছে জীবনপ্রবাহ হতে।উত্থান-পতনের স্রোতে ভেসে চলছে এই জীবন।মায়াময় নগরীর অন্তরালে।পরিবর্তন এসেছে শাখা প্রশাখায়।বট বৃক্ষের ভিত্তি এখনও অপরিবর্তিত।
অম্লান গগনে ছায়ামেঘের অভিসার।বর্ষার প্রথম বৃষ্টি। ক্ষণে ক্ষণে গর্জে উঠছে অম্বর।আকাশচুম্বী অট্টালিকার প্রাচীরে বর্ষার শুভাগমন ঘটেছে।পুরোনো জীর্ণ শীর্ণ প্রাচীরে এসে ঝাপটে পড়ছে বর্ষার নব্য অশ্রুবিন্দু। পুরান ঢাকার সরু অলিগলিতে বর্ষার অনুপ্রবেশ।প্রাচীন ইটের গন্ধে ভরেছে আঙিনা।
অন্বেষা ফোন হাতে তুলে বর্ণের নাম্বারে ডায়াল করে।বাহিরে অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে।একবার চেয়ে দেখলো।এর কিছু সময় পরই ফোন রিসিভ হয়।বৃষ্টির আওয়াজে বর্ণ কিছুটা জোরে বললো,
“হ্যাঁ।হ্যালো!কি হইছে?”
অন্বেষাও একই সুরে জবাব দেয়,
“কোথায় তুমি?”
“কই থাকমু বাল এই সময়?বাসায় আইতাছি।রাখো!”
এই ছেলের কথার ধরন আর স্বভাব কখনো বদলাবে না। অন্বেষা রাখলো না ফোন।উল্টো প্রশ্ন করলো,
“পরীক্ষা শেষ?”
“না!শেষ হইবো কেন?আমি রাস্তায় বৃষ্টিতে বইয়া পরীক্ষা দিতাছি।”
অন্বেষা কপট রাগ দেখিয়ে বললো,
“ভালোভাবে উত্তর দেওয়া যায় না?”
বৃষ্টির আওয়াজে কিছুই শোনা যাচ্ছে না।বর্ণ বৃষ্টি থেকে বাঁচতে একটি দোকানের কোণে শেড এর নিচে আশ্রয় নিয়েছে।তার মধ্যে অন্বেষা একটার পর একটা প্রশ্ন করে মাথা খারাপ করে ফেলছে।
“তুমি কি তামাশা করতাছো আমার লগে?মোবাইলে পানি ঢুকতাছে।ফোন যদি নষ্ট হইছে তোর টাকা দিয়া কিনামু কইয়া দিলাম।দুইমাস হয় নাই ফোনটা কিনছি।”
অন্বেষা চেঁচালো।বললো,
“সাধে কি ফোন করেছি?তোমার পুত্রধন আব্বা আব্বা করতে করতে গলা শুকিয়ে ফেলেছে।ওর জন্য কিছু না নিয়ে আসলে ঘরে ঢুকার দরকার নেই।রাখছি!”
“হ মা পোলা মিলা আমার রক্ত চুইষা খাইয়া ফালা!”
শেষ কথাটি শুনলো না অন্বেষা।এর আগেই ফোন কেঁটে দিয়েছে।ফোন টেবিলের উপর রেখে ছেলের দিকে চাইলো।বিছানায় উঠছে আর নামছে।এটাই তার খেলা।কোমরে হাত রেখে দাঁড়ালো তার সামনে। আকস্মিক ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“তোমার বাপজান একটা জল্লাদ!”
বর্ষণ এগিয়ে আসলো মায়ের দিকে।কথা যতটুকু বুঝেছে সেটি যথেষ্ট নয়।তিন বছরের পুঁচকে এসেই ওড়না টেনে ধরলো মায়ের।উদ্দেশ্য টেনে নিয়ে বারান্দায় যাবে।বৃষ্টিতে ভিজবে। অন্বেষা তার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে দ্রুত তাকে কোলে তুলে নেয়।ধমকের সুরে বলে,
“একদম!এই বয়সে পাকামো শিখেছো!”
হাত পা ছুঁড়ে ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে উঠে।কোলে টিকলো না এক মুহুর্ত।অস্থির হয়ে নেমে গেলো।লুটিয়ে পড়লো মাটিতে।চিৎকারের আওয়াজে সুদীপ্তা ছুটে আসে।তিন বছর হলো তারাও এখানেই ভাড়া এসেছে।যেখানে আগে বর্ণ থাকতো। ব্যাচেলর কেউ নেই সেখানে আর।বর্ষণকে মাটিতে গড়াগড়ি করে কাঁদতে দেখে এগিয়ে এসে বললো,
“খালামণি?কি হয়েছে বাবা?কান্না করছো কেনো?”
অন্বেষা জবাব দিলো, “মহারাজের বৃষ্টিতে ভেজার শখ জেগেছে।পুঁচকে পা দুটো ভেঙে দিবো একদম”
“বাচ্চা ছেলের সাথে এমন কেউ করে? বুঝিয়ে বললেইতো পারো।”
“উনি আর ওনার বাপ বুঝবার লোক না।”
সুদীপ্তা বর্ষণকে কোলে তুলে নেয়।আদর দিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করলো।আজকাল বর্ষণ তার কাছেই থাকে অনেকটা সময়।আরেক মা হয়ে উঠেছে সে তার।তার বাবা মা দুজনেই কাজে থাকে। অন্বেষা পড়ালেখা শেষ করে ব্যাংকে ডাটা এন্ট্রি অপারেটরের কাজ করে।আর বর্ণ পড়ালেখার পাশাপাশি অন্বেষার সহায়তায় একই কাজ করে গার্মেন্টে।মাস খানেক আগে তার পদের উন্নতি হয়েছে।বর্ণের কথামতই হয়েছে তাদের সবকিছু। অন্বেষা নিজের ভবিষ্যত গড়ে বর্ণের ঢাল হয়ে আছে এখনও।
সুদীপ্তা বর্ষণের দিকে চেয়ে বললো,
“কে বলেছে আমার ছোট্ট বাবা আর ভাই বুঝবার লোক না?মনে নেই বর্ষণের জন্মের দিন বর্ণ কেমন চুপচাপ হয়ে গিয়েছিলো।বোকা ছেলের মতো মাথা চুলকাচ্ছিলো বারবার।তোমাদের নিষ্পলক দেখেছে রাত জেগে জেগে।মাঝ রাতে আমাকে আর জীবনকে ডেকে তুলেছে।বর্ণ আগের মত নেই।অনেকটা শুধরে গেছে।”
অন্বেষা সুদীপ্তার কথার বিপরীতে জবাব দিলো,
“কচু শুধরেছে!ভিতরে ভিতরে খাঁটি শয়তান ওর বাপ।বাহিরে লোক দেখানো দায়িত্বশীল।ঘরের খবর আমিই জানি দিদি।”
“এসব বলতে নেই আমার ভাইটা ভালো। ঘাড়টা একটুখানি ত্যাড়া।”
বলে হেসে উঠলো সুদীপ্তা।বর্ষণ থেমে গেছে ততক্ষনে।সাথে প্রকৃতির বর্ষণও। অন্বেষা বারান্দার দিকে চেয়ে দেখে নিলো অবস্থা।গুড়িগুড়ি বৃষ্টি আছে এখনও।সুদীপ্তা প্রশ্ন করে,
“তোমার চাকরির কি খবর?”
অন্বেষা বিছানায় বসে বললো,
“আর চাকরি!পড়ালেখা শেষ করে কত জায়গায় দৌঁড়ঝাঁপ করলাম।শেষমেশ এই ডাটা এন্ট্রি অপারেটরের কাজটাই পেয়েছি।আসলে গরীব মানুষের জন্য ভালো চাকরি সোনার হরিণের মতো।”
সুদীপ্তা বললো,
“ভালোইতো চলছে তোমাদের।আফসোস করে কি হবে বলো?”
“আফসোস আপনার বর্ণ ভাইয়ের জন্য করা যায়?আমি হতাশ হয়ে গেলে আমাকে ধমকে উঠে।বলে আমি নাকি দিনদিন লোভী হয়ে যাচ্ছি।”
বলে দুজনে একসাথে হেসে উঠে।অন্যদিকে বর্ণ এসেছে কাক ভেজা হয়ে। এসেই চিৎকার করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো।থেমে গেলো সুদীপ্তাকে দেখে। সুদীপ্তা উঠে দাঁড়ালো।এখন নিজের ঘরে চলে যাওয়াই শ্রেয়।বর্ষণ একলাফে নেমেছে।বর্ণের ভেজা গায়ে লেপ্টে যাওয়ার আগেই বর্ণ তাকে হাত দিয়ে সরিয়ে বললো,
“আরেহ খাড়াস না ব্যাটা! কাপড় বদলায় আহি”
অন্বেষা ছেলের দিকে চেয়ে বললো, “তোমাকে একদম ভালোবাসে না দেখলে?”
বর্ণ অন্বেষাকে ধাক্কা দিয়ে চলে গেলো বাথরুমে।সেখানে যাওয়ার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে কাপড় চেয়ে চেঁচামেচি শুরু করেছে। অন্বেষা বর্ষণের হাতে কাপড় ধরিয়ে এগিয়ে দিলো।ছোট্ট হাতে ভারী কাপড় নিয়ে দাঁড়িয়েছে বাথরুম এর সামনে।সেও চেঁচাচ্ছে,
“আব আব বলে”
বর্ণ বললো, “কিরে কাপড় কই আমার?”
অন্বেষা জবাব দিলো, “হাত উঁচু করে রাখলে হবে?নিচে নামাও তোমার ছোট নবাব তোমার কাপড় নিয়ে দাঁড়িয়ে।”
বর্ষণ বোধহয় তাদের কথপোকথন বুঝলো।সেও হাত উঁচু করে ধরে। আব্বাজান কঠিন শব্দ।বলতে পারেনা ঠিকমতো।তবে চেষ্টা করে।নিজের মতো সহজ করে বলার।অস্পষ্ট স্বরে বলতে থাকে,
“আব!... আবা”
বর্ণের মনেও ছটফট শুরু হয় এই মধুর ডাকে।শরীরে পানি ঢালতে ঢালতে তার মধ্যে আবদ্ধ থাকা এই অস্থিরতা দমালো।দ্রুত গোসল সেরে বেরিয়ে আসতেই দেখলো গামছা হাতে দাঁড়িয়ে তার পুত্র।
“আবা গামতা”
চওড়া হাসি মুখে নিয়ে একহাতে ছেলেকে টেনে কাঁধে বসিয়ে দিলো।অন্যহাতে চুল মুছছে।বর্ষণ ভীষণ খুশি।আবার ভীতও।ছোট হাতে বর্ণের ঘাড় খামচে ধরে আছে।চুল মুছা শেষে বর্ষণকে বিছানায় বসিয়ে ব্যাগ থেকে একটি চকলেট বের করে এগিয়ে দেয় তার দিকে।সেও হাতে ভর দিয়ে আধ শোয়া অবস্থায় আছে বর্ষণের পাশে।
অন্বেষা ডাকলো।বললো, “বর্ষণ তোমার আব্বাজানকে জিজ্ঞেস করো চা দিবো নাকি?”
বর্ণ তেরছা চোখে চেয়ে জবাব দিলো, “তোর মায় ভেংসা ধরছে। কইয়া দে এসব বর্ণের গায়ে লাগে না।”
অন্বেষা শব্দ করে চায়ের হাঁড়ি চুলোয় রাখলো নিজের জেদ জাহির করতে।বর্ণ ইচ্ছেকৃত বর্ষণের গাল টেনে তাকে বিরক্ত করে বলে,
“তোর মায় তোর নাম রাখছে বিদেশী।আমি যে বহিপীর রাখবার কইছিলাম ভাল্লাগে নাই। বিগত চাইর বছর যাবত যন্ত্রণা করতাছে আমারে।নিজের পোলার নাম রাখার হকটা পর্যন্ত পাইলাম না।”
অন্বেষা দ্রুত হাত চালিয়ে কাজ করতে করতে বর্ণকে শুনিয়ে বলে,
“নয়মাস পেটে ধরেছে কি তোর বাপ?তোকে পেটে নিয়ে আমি ক্লাস করেছি,কাজ করেছি।সংসার সামলেছি।সে লাট সাহেবের মত ছিলো। জমিদারের মত হুকুম চালিয়ে গেছে।এখনও সাহায্য করেনা।উল্টো আমাকে ঝাড়ি দেয়।”
বর্ণ মুখ বেঁকিয়ে বললো, “এই ছেড়ি খ্যাচ খ্যাচ কইরো নাতো।ভাল্লাগে না।”
“আর বহিপীর নামটা খুব সুন্দর তাইনা?”
“তাইলে মদন রাখতাম?”
অন্বেষা চোখ পাকিয়ে তাকায়।মেজাজ খারাপ করে ফেলছে একেবারে। অন্বেষার শুক্র শনি ছুটির দিন।এই দুটো দিন পাড় করে নিজের ছেলের সাথে।মাঝেমধ্যে বর্ণ নামক স্বামীর ভালোবাসাও পায়।সেটা খুবই কম।এখনও খাবার রান্না করে পাঠায়।কিন্তু সেটা শুধুই জব্বার চাচা আর তার পরিবারের জন্য।লোকটা কাজ করতে পারে না আর।বয়স হয়েছে।
দরজায় কড়া নাড়লো সাব্বির।দাঁত বের করে হেসে বললো,
“ভাবি কেলাশে পঞ্চম হইছি আমি”
অন্বেষা হাসলো।হাত তুলে ডাকলো সাব্বিরকে।ছেলেটা এখন পড়ালেখা করে।বয়সের তুলনায় যদিও অনেকটা পিছিয়ে।তারপরও নিজ থেকে অনেক চেষ্টা করছে।বর্ণ আর সাব্বিরকে একত্রে চা দিলো।
সাব্বিরের উদ্দেশ্যে অন্বেষা বললো, “তুমি এখন পড়ালেখা করো। ক্লাসকে কেলাশ বললে মানুষ তোমাকে কি বলবে?”
লজ্জা পেলো সাব্বির।বললো, “আর কমু না ভাবি।”
“আর বলবো না।”
আবার শুধরে দেয় অন্বেষা সাব্বিরকে।বর্ণ দুজনের মধ্যে বলে উঠলো,
“তোর ভাবির কথা হুনবি না।ছেড়ি মাস্টারনি সাইজা ঘুরে সব জায়গায়।ঢং এর শেষ নাই।”
“থাক ভাই ঝগড়া কইরেন না।আমি বাড়িত গেলাম। পরে আমুনে।”
দ্রুত চা খেয়েই কেঁটে পড়লো সাব্বির।জানে তাদের দুজনের মধ্যে থাকলে বলির পাঁঠা সেই হবে। বর্ণও একই।গপাগপ বিস্কিট চা গিলে বর্ষণকে নিয়ে আয়েশি ভঙ্গিতে শুয়ে পড়ে।তাকে পেটে বসিয়ে বললো,
“কিরে বহিপীর?তোর মায়তো আমারে একবারও জিগাইলো না আমার পরীক্ষা কেমন গেছে।”
বিষয়টা তর্কাতর্কির মধ্যে মাথা থেকেই চলে গিয়েছিলো।হুট করেই মস্তিষ্ক জ্বলে উঠে অন্বেষার।রাগ অভিমান ঝেড়ে ফেলে প্রশ্ন করলো,
“পরীক্ষা কেমন হলো?”
বর্ণ বাঁকা চোখে চেয়ে বলে, “কমু না”
“ঢং করবে না বলে দিচ্ছি।বলো কেমন হয়েছে?”
বর্ণ হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে নাটকীয় ভাবে বলতে লাগলো,
“পড়ালেখা হইলো একটা পাপ।দুনিয়ার মধ্যে বিশ্ববিখ্যাত পাপ।যেটা সবাই করে।কিন্তু স্বেচ্ছায় করেনা।আমারে এই পাপ কামে তুমি ঢুকাইছো।তুমি দ্বিগুণ পাপী।….. এমনেতে আমার পরীক্ষা ভালো হইছে অনেক।”
বর্ণের কথার শুরুর দিকে চোখ আপনাপানি প্রসারিত হতে শুরু করেছিলো অন্বেষার।হুট করে শেষ বাক্য শুনে মেজাজ আরেকদফা চটে যায়।সোজা কথা বললো সেটিও ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে।নাকের পাটা ফুলেফেঁপে উঠেছে।সরে আসে সেখান থেকে।জব্বার চাচার সাথে সাথে নিজেদের জন্যও রান্না করতে হবে।সাথে বর্ষণের খিচুড়ি।
এসব করতে করতেই রাত আটটা পেরিয়েছে।সবার প্রথমে বর্ষণের খিচুড়ি তৈরি করে বর্ণের হাতে ধরিয়ে দিলো।বললো,
“বাপের দায়িত্ব পালন করো।ওকে খাওয়াও।”
বর্ণ নিঃশব্দে বাটি হাতে তুলে বর্ষণকে নিজের দুই পায়ের মাঝে আবদ্ধ করে।ছেলেটা ভীষণ চঞ্চল।খাবার দেখেই তার মুখ কুঁচকে গেছে ইতিমধ্যে।বর্ণ তাকে আলতো করে চেপে ধরলো। গালে হাত রেখে এক চামচ খিচুড়ি মুখে পুড়ে দিয়ে বললো,
“হুন ব্যাটা!তুই হইলি বাঘের বাচ্চা।তোর মায় তোরে বানাইতাছে বিলাইর বাচ্চা।যা দিমু তাই খাবি।তোর মায়ের মত শখ আহ্লাদ কইরা খাওয়াইতে পারমু না।”
বর্ষণ মাথা দুলিয়ে অসম্মতি জানায়।মুখভর্তি খাবার নিয়ে বলে উঠে,
“কাবো না”
“হোপ! ভাত খাবি না,খিচুড়ি খাবি না।তো খাবিটা কি?”
বর্ষণ জবাব দেয়, “চক্কেট”
“হ তোর বাপের জমিদারিতো!জলদি খা খিচুড়ি।শরীরে শক্তি না থাকলে এলাকায় রঙবাজি করবি কেমনে?বর্ণের পোলা তুই। এমন হাড্ডিগুড্ডি হইলে চলবো না।আমার পরে তোর দাপট।একহাতে তিনটারে তুইল্যা পটকাইতে না পারলে কিয়ের ব্যাটা মানুষ!”
মুখের চারিদিকে খিচুড়ি লেগে আছে। হা করে চেয়ে রইলো বর্ষণ বাবার দিকে।মনোযোগ দিয়ে শুনছে কথা।অনেকক্ষণ নিষ্পলক।তারপর মাথা উপর নিচ দুলিয়ে সম্মতি জ্ঞাপন করে।বর্ণ হালকা হাতে পিঠ চাপড়ে বললো,
“শাবাশ! ল এবার গিল।”
মুহূর্তের মধ্যে মত বদল হয়ে গেছে বর্ষণ এর।ঠোঁট চেপে আছে খাবেনা বলে।এটা প্রতিদিনের কান্ড।যুদ্ধ করতে হয় বর্ণের।রাতের খাবার খাওয়ানোর দায়িত্ব তারই।বর্ণ এবার অসহায় কণ্ঠে বলে উঠে,
“বাপ না ভালা।খাইয়া ল আরেকটু আছে।নইলে তোর মা আমার মগজ খাইবো।”
অন্যপাশ হতে অন্বেষা বললো, “হ্যাঁ হ্যাঁ।শিখাও এগুলোই ছেলেকে।ভালো কিছুতো শিখাবে না। শিখাবে যত আজেবাজে জিনিস।”
বর্ণের কাছে অন্বেষা যেনো অদৃশ্য।ছেলেকে কথার ছলে খাইয়ে কোলে তুলে হাঁটতে শুরু করে।না হাঁটলে বর্ষণের ঘুম আসেনা।রাত আটটার মধ্যেই তাকে খাইয়ে ঘুম পাড়াতে হয়।সকালে উঠে দৌঁড়াতে হয় বর্ণ অন্বেষাকে নিজের কাজে।এই আঙিনা বর্ষণের খেলার জায়গা।বন্ধু হিসেবে সুদীপ্তার মেয়ে আছে।সাব্বির প্রায়ই আসে।মায়ের অনুপস্থিতি ঘুচিয়ে দেয় সুদীপ্তা।দাদা দাদীর কমতি পূরণ করে আফজাল মিয়া এবং রোকেয়া বেগম।
জনি দীর্ঘদিন হলো দুবাইয়ে পাড়ি জমিয়েছে।এর মাঝে বর্ণের ছেলের কথা শুনে কয়েকবার দেখতে চেয়েছে তাকে মোকলেস মাতবর।বর্ণ অনুমতি দেয়নি।একদিন দুঃসাহস করে অন্বেষা দেখা করিয়েছিলো তাকে।সাব্বিরের পাশাপাশি রোকেয়া বেগম ও আফজাল মিয়াকেও বারণ করেছে সেই ব্যাপারে বর্ণের কাছে খোলাসা করতে।সবকিছুর মিশ্রণে চলছে তাদের জীবন।
জব্বার চাচার ছোট ছেলে খাবার নিয়ে যাওয়ার পরপরই বর্ণকে রাতের খাবার দিলো অন্বেষা। রেষারেষি তাদের মধ্যে সেই বিকেল থেকে।খাবার দিয়ে সরে যেতে চাইলে বর্ণ বর্ষণকে খাটে শুইয়ে দিয়ে অন্বেষার হাত টেনে ধরে বলে,
“নিয়ম ভুইলা যাইতাছো।খাওয়ায় দিয়া যাও।”
অন্বেষা মুখ ভেংচি কেটে বললো, “ঝগড়া করার সময় মনে থাকে না?”
“তুমি একটা মনে রাখার জিনিস হইলা?”
“আমি দিবো না খাইয়ে যাও।”
“আহা বউ এমন করেনা। আহো আদর করি”
অন্বেষা হাত ছাড়িয়ে নিলো। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে সামনে এসে বসে।ভাত মাখিয়ে মুখে দিতেই কামড় পড়ে হাতে। গাল ভর্তি খাবার নিয়েই দুষ্টু হাসলো বর্ণ।গাল টেনে দিলো অন্বেষার।অন্যহাতে বর্ষণের গায়ে চাদর টেনে দেয়।একই প্লেটে ভাত নিয়ে নিজের রাতের খাবারও সেরে নিয়েছে অন্বেষা।
বিপত্তি বাঁধলো রাত বারোটায়। বিদ্যুৎ চলে গেছে।আকাশে মেঘ জমেছে।গর্জনে কেঁপে উঠলো চারিদিক।ঝড় আসবে আসবে ইঙ্গিত।বৃষ্টি পড়ছে ঝিরিঝিরি।এই হিম হওয়া বর্ণের কদম টেনে নিয়ে যায় বারান্দার দিকে। অন্বেষা টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়েছে বর্ষণের পাশে।মশারী টাঙিয়ে দিলো সাথে।পরপর উঠে জানালা বন্ধ করতে করতে বর্ণের ভারী গলার আওয়াজ ভাসলো,
“গরীবের ঘরে অন্ন না থাকলেও সুখ আছিলো।তারপর আইলো এক পিশাচিনী।আমার সুখ শান্তি সব লুণ্ঠন কইরা লইয়া গেলো।আর ফিরায় দিলো না।”
অন্বেষাকেই খোচা দিয়ে বলা হচ্ছে কথাগুলো। অন্বেষা কয়েক কদম এগিয়ে আসে বর্ণের দিকে।বুকে হাত হাত বেঁধে বললো,
“এখন উপায়?”
“উপায়ইতো নাই।সুখ পাখি একবার উইড়া গেলে আর ধরা দেয়না।”
“কি করবে তাহলে এখন?”
তমসাচ্ছন্ন কামরায় সোজা দাঁড়িয়ে হাসছে বর্ণ। স্বাভাবিকভাবেই মুখ ঘুরিয়ে তাকায়। অন্বেষার হাত টেনে কাছে টেনে নেয়।ঠান্ডা শীতল পবনের সম্মুখে দাঁড় করিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে নেয় বাহুডোরে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে কয়েক দফা।চুলের গভীরে মুখ গুঁজে জবাব দিলো,
“দুঃখ নিয়াই নাইলে থাকলাম সারাজীবন।আজকাল অন্বেষা আর বর্ষণ নামক দুঃখ আমার ভালাই লাগে।”
“ঢং!”
অন্বেষার কানের লতিতে কামড়ে দিয়ে বর্ণ স্বীকারোক্তি দিলো,
“আমি গলা পর্যন্ত চোরাবালিতে ডুইবা আছিলাম…হঠাৎ কইরা একটা হাত আইলো। টাইনা হেঁচড়ায় আমারে তুললো”
“সেই হাতটা কার?”
অন্বেষা জানে।জবাব তার অজানা নয়।তারপরও প্রশ্ন করেছে।বর্ণের মুখে শুনতে ইচ্ছুক সে।বর্ণের হাতের উপর হাত রেখে উত্তরের আশায় চেয়ে।বর্ণ বললো,
“আমার বহিপীরের মা।…..শালার আমারে ডুবাইয়া ছাড়লো!পুড়ায় মারলো!আমিতো জ্বলছি অনেক আগে থিকাই।কিন্তু এই জ্বালাটা অনেক ভালা।আমার সুখ সুখ লাগে।আমার পোলাটা আমার কলিজা।”
“আর আমি?”
“তোমারে আমি এই খুপড়ি ঘরের রানী আগেই বানাইছি।আর কি লাগবো?”
অন্বেষা অভিমানী গলায় বলে,
“আমাকে জ্বালাতন বন্ধ করতে হবে।”
“এত বেহেংরা কেন তুই?.....লোভী মহিলা।আদর যত্ন পাইয়াও পেট ভরে না?ভুলিস না এই বর্ণর উপরেই ফিট হইয়া গেছিলি।আমি জ্বালানি বন্ধ করলে এই সংসার এতদিন টিকতো না।”
“ভালোবাসোতো?এটাই যথেষ্ট ভন্ড বর্ণ।”
বৃষ্টিস্নাত রাত্তিরে দূর থেকে এক গানের সুর ভেসে এলো।বর্ণ অন্বেষার উভয়ের মনোযোগ সেখানে আকর্ষিত হয়।কেউ একজন দোতারা বাজিয়ে গেয়ে চলেছে,
“অযত্নে কুড়ায়ে লইলাম যে পারিজাত ফুল
সে ফুলের নাম ধাম গাত্র বর্ণ নাহি জানি।
শুধু জানি তাহারে দরকার
জীবনের এই অন্ধকার পাথারে
এই দুনিয়া ছাড়ি ঐ হাশরে।
আমি পূজি তাহার দারিদ্র্য
ক্লেশ খেদ আর অক্লান্ত জেদ
জানি অন্তে এসে ঠায় নেবে
আমার ই বক্ষজুরে আত্মাখানি।
তাহার ভরসা আমি
স্নেহ আমি
যদি বলি পৃথিবীর একমাত্র টান আমি।
এই নশ্বর পৃথিবীতে
এক অমরাবতী আমার কুড়িয়ে পাওয়া এই প্রেম”
সমাপ্ত..........................