পর্ব ০৫
শারমিন আক্তার বর্ষা
.
.
.
' আমি তোমাকে ভালোবাসি। এই তিনটি ছোট কথা বললেই ভালোবাসা হয় না। ভালোবাসার জন্য সারাজীবন পাশে থাকতে হয়। দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে ভালোবাসা প্রমাণ করতে হয়।' কথাটি চাপা গলায় বলল নীল।
অভ্র বলল,
' তুমি আমাকে দায়িত্ব দিয়েছ?'
নীল চুপ করে আছে। নীলের মুখের অভিব্যক্তি বুঝতে অভ্র কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। নীল একটু থেমে বলল, ' মারিয়া মেয়েকে আমি পছন্দ করি না। ওঁ আপনাকে সব সময় ফলো করে।'
অভ্র বলল,
' আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন ওঁর সাথে আমার দেখা হয়েছিল খেলতে খেলতে। তারপর হঠাৎ আমেরিকা চলে যাই। আমি যখনই বাড়িতে আসতাম তাকে খুঁজতাম। আমি ওঁকে খুঁজে পাইনি, আমার ওঁর ওপর একটা টান ছিল. যা আর নেই। আজ বিমানবন্দরে ওঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তাই বাড়িতে নিয়ে আসি। কিন্তু এখন সে শুধুই আমার বন্ধু।'
গভীর রাত, নীল চুপচাপ শুয়ে পড়ল। দুজনের মাঝে আর কথা হলো না। অভ্র ঘুমিয়েছে কি-না বুঝার জন্য একবার ওঁর দিকে তাকাল। অভ্রর ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে থেকে নীল বিড়বিড় করে বলল, ' না চাইতেও, আপনি আমার মন জুড়ে আছেন। আমার অজান্তেই আপনি আমার হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন। আমার জীবনের সমস্ত অংশ জুড়ে, এখন শুধুমাত্র আপনি। আপনাকে ছাড়া এই কয়েকটা দিন কেটে গেছে বছরের মতো। আমি আপনাকে অনেক মিস করেছি। আপনার অনুপস্থিতি আমাকে বুঝিয়েছে আমি আপনাকে ভালোবাসি।'
সকাল ছয়টা বাজে রাজীব চৌধুরী আজ সিলেট যাবেন। ওনাকে বিদায় দিয়ে অভ্র অফিসের উদ্দেশ্য রওনা দিল, দুপুরের পর অফিসে আজ বিদেশি ক্লাইন্টদের সঙ্গে মিটিং আছে। নীল একসময় মারিয়ার সঙ্গে গল্প করতে করতে ওঁর সঙ্গে বন্ধুত্ব করে নিল। তোয়া স্কুল যেতে তৈরি হয়েছে, নীলকে দেখে সে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, 'ভাবী কি হয়েছে তুমি দেখছি মারিয়া আপুকে বন্ধু বানিয়ে নিয়েছ?'
নীল মৃদু স্বরে বলল, 'সে আমাদের অতিথি তাই।'
তোয়া স্কুলে চলে যায়। নীল একটু অসুস্থ এজন্য আজ কলেজ যাবে না। রুমে আরাম করছে। আছিয়া চৌধুরী বাজার যাবেন। প্রস্তুতি নিচ্ছেন। মাথা খানিক ব্যথা করছে বলে নীল কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিল। ঘুম ভাঙলো তখন সকাল দশটা, ঘুমঘুম চোখে ফোনে সময় দেখে রুম থেকে বের হলো। সহসা মারিয়ার রুমের কাছাকাছি এসে হাসির শব্দ শুনে নীল দাঁড়াল। মারিয়ার রুমের জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখল মারিয়া কাজের ভুয়ার সাথে কথা বলছে। তাদের কথা নীলের কানে পৌঁছল। মারিয়া বলল, 'বুঝলাম না কেন হঠাৎ বদলে গেল অভ্র? ওঁ গতকাল আমাকে মাথায় তুলে রেখেছিল আর আজ কথাই বলেনি।'
কাজের ভুয়া লায়লা বললেন,
'কেউ দেখে ফেলবে আমি এখন যাই।'
মারিয়া বলল,
'বাড়িতে কেউ নেই ফুপু। কেউ আমাদের দেখবে না। আর শোনো খুব দ্রুত এবং সাবধানে কাজগুলো করতে হবে।'
নীল তার হাতের ফোনে ভিডিও রেকর্ডিং চালু করে।
লায়লা ভীত গলায় বললেন,
'অভ্র খুব চালাক। যদি ধরা পড়ি?'
মারিয়া বলল, 'ফুপু, আমি কাঁচা খেলোয়াড় না। সবাই জানি অভ্র তার হারিয়ে যাওয়া ছোটবেলার বন্ধুর জন্য কতটা পাগল ছিল। নীল মাঝখানে এসে সব প্ল্যান নষ্ট করে দিল। কিন্তু এখনো সময় আছে। আমি নীলকে সরিয়ে অভ্রকে বিয়ে করব। ফুপু, অভ্রকে আমার চাই। অভ্রর চোখ, ঠোঁট আমাকে পাগল করে দেয়। আমি তার জন্য সবকিছু করতে পারি। অভ্রর বন্ধু হয়ে নীলের জায়গা নেব।'
' সবকিছু এত সহজ? ভুলে যাসনা, নাম পরিচয় বিহীন একটা মেয়ের নাম ভাঙিয়ে তুই এই বাড়িতে ঢুকেছিস।'
ঠোঁটে বিভ্রান্ত হাসি নিয়ে মারিয়া বলল, 'আমি কিছু ভুলিনি, ফুপু। আমি অভ্রের জন্য এই মিথ্যা পরিচয়েও বাঁচতে রাজি আছি।' মারিয়া থামল। কিছুক্ষণ পর আবার বলল, ' আমি জানতাম যে অভ্র যখন হঠাৎ করে তার ছোটবেলার বান্ধবীকে ফিরে পাবে, আসল না নকল তা সে খুঁটিয়ে দেখবে না। এবং তা ঘটল ও।'
যাওয়ার আগে লায়লা বলল, 'যাই করিস না কেন, সাবধানে করিস যাতে কেউ লক্ষ্য না করে।'
নীল রুমে এসে মেঝেতে বসল। চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছে। একজন মানুষের পেছনে এত ষড়যন্ত্র। ভাবতেই অবাক লাগছে।
আছিয়া চৌধুরী দুপুরের রান্না শেষ করেন। সিঁড়ির নিচে আসামাত্র কলিংবেলটা বাজালো। তিনি এগিয়ে গেল। নীলের বাবা-মা রায়হান সরকার ও মিসেস রোজা আসছেন। আছিয়া চৌধুরী হাসিমুখে ওদের সাথে করে নিয়ে এসে ড্রয়িংরুমে বসতে দিল। তোয়া বলল, ' আমি ভাবীকে ডাকছি।'
রায়হান বললেন, ' বেয়াইকে দেখছি না। উনি কি অফিসে?'
আছিয়া বললেন, ' না বেয়াই মশাই। উনি আজই সিলেট গেছেন।'
' তাহলে তো ভুল সময়ে চলে আসলাম। গতকাল এলে বেয়াইয়ের সঙ্গেও দেখা হত।' রোজা বললেন।
আছিয়া হেসে বললেন, ' অনেকদিন পর আসলেন। নীল আপনাদের দেখে ভীষণ খুশি হবে।'
রায়হান বললেন, ' মেয়ে তো আমাদের ভুলেই গেছে। তাই আমাদের ওঁর কাছে আসতে হয়।'
নীল ওঁর বাবার কাছে এসে বসল। রায়হান ও রোজা মেয়ে নীলকে নিতে আসছেন। নীল ওদের সঙ্গে দুদিন থাকলে তাদের ভাল লাগবে। সবদিক বিবেচনা করে ওদের সঙ্গে নীলকে যেতে পারমিশন দিল আছিয়া। ইচ্ছার বিরুদ্ধে ব্যাগপত্র গুছিয়ে বিকেলে বাবা মায়ের সঙ্গে চলে গেল নীল।
তোয়া টিভি দেখছে। হঠাৎ মায়ের দিকে তাকিয়ে অভিমান মিশ্রিত কণ্ঠে বলল, ' মা, তুমি ভাবীকে যেতে দিয়েছ কেন? ভাবীকে ছাড়া আমার ভালো লাগে না।'
আছিয়া চৌধুরী মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন, ' নীল তোর ভাবী হয়। ওঁ চলে যাওয়ায় তোর এত খারাপ লাগছে তাহলে ভাব যারা ওঁকে জন্ম দিয়েছে তাদের কত কষ্ট হয়।'
মারিয়া বলল, 'আমি রুমে যাই, আন্টি, আপনার যদি কিছু লাগে, দয়া করে আমাকে ডাকবেন।'
'ঠিক আছে। যাও।'
রাত ৯টা বাজে।
মেয়ে আসছে সে আনন্দে মিসেস রোজা মেয়ের পছন্দের সব খাবার রান্না করেছেন। নীল কোনো কিছু খাচ্ছে না। আনমনে প্লেটে আঙুল নাড়িয়ে আঁকিবুঁকি করছে। মিসেস রোজা লক্ষ্য করে বললেন, ' নীল, কি হয়েছে মা? খাচ্ছো না কেন?'
নীলের মন অভ্রর জন্য ছটফট করছে। সে বলল,
' আমি চলে যাব মা। আমার এখানে ভালো লাগছে না।'
রায়হান অবাক চোখে স্ত্রী রোজাকে দেখলেন এরপর মৃদু গলায় বললেন, ' খাবারটা শেষ কর। আমি তোকে পৌঁছে দিয়ে আসব।'
'না, আমি খেতে পারব না। আমি এখুনি যাব।'
নীল হাত ধুয়ে নিল। ব্যাগ নিয়ে বাসা থেকে বের হলো সে। লতিফ চাচা গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। নীল উঠে বসল। অভ্রকে কল করবে কি না বুঝতে পারছে না। তবু সে কয়েকবার কল করল। কল রিসিভ করেনি অভ্র। নীল ফোনটা হাতের মুঠোয় নিয়ে ফুপিয়ে উঠল। অজানা এক আশংকায় কান্না পাচ্ছে তার।
গাড়ি হঠাৎ থেমে যায়। লতিফ গাড়ি থেকে নেমে ইঞ্জিন চেক করে নিল। ইঞ্জিন খারাপ হয়েছে। নীল গাড়ি থেকে নামে অন্য গাড়ি খুঁজতে লাগল। সহসা নীল বলল, ' লতিফ চাচা আমি এগিয়ে গেলাম। গাড়ি ঠিক করে আমার ব্যাগ ও বাড়ি পৌঁছে দিও।'
'একা একা যাইও না মা। একটু অপেক্ষা করো।' বললেন লতিফ। বিশাল এক বটবৃক্ষের নিচে চারজন পুরুষ লোক বসে আছে। সম্ভবত তাস খেলছে ওঁরা। এই সময় একজন মেয়েকে একা দেখে একজন বলে উঠল, ' ও-ই দেখ একটা ছেড়ি এইদিকে আসতাছে। চল গিয়া ধরি। অনেকদিন পর একটু মোজ করুম।'
' সত্যি কইছস। চল গিয়া ধরি। অনেকদিন ধইরা মাইয়া মানুষের স্বাদ পাই নাই।'
ওদের ভেতর একজন লিডার আছে। সে গাছের গুড়িতে শুয়ে আছে। হঠাৎ তার কণ্ঠ শোনা গেল, ' খবরদার। কেউ ওই মেয়েকে উত্যক্ত করবি না। আমরা চোর, মাতাল হতে পারি কিন্তু ধর্ষক নই।'
চারজন উঠে গেল। নীলের সামনে গোলগোল ঘুরছে। ওদের একজনের হাতে একটা ছুরি। সে ওটা দিয়ে ভয় দেখিয়ে বলল, ' প্রাণে বাঁচতে চাইলে সাথে যা যা আছে ভালোই ভালোই সব দিয়ে দে।'
নীল ওঁর ব্যাগ ওদের হাতে দিয়ে দিল। এরপর স্বর্ণের জিনিসগুলো ও ওঁরা নিয়ে নিল। তারপর হঠাৎ একজন বলল, ' এহনো ফোনটা দেস না কেন?'
নীল কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
' আমি ফোন দিতে পারব না।'
চতুর্থ জন বলল, ' ফোন দিবি না কি তোকে গুলি করব?'
নীল কেঁপে উঠল। লিডার লোকটা হঠাৎ সশব্দে হেসে উঠল। তারপর বলল, ' সঙ্গে একখান আসল ছুরিও নাই। আর ওঁয় গুলি করার হুমকি দেয়। শালারা একটা ছেঁচড়া চোর। না চোর না, চোর নামে কলঙ্ক।'
নীল হাঁটু ভাজ করে বসে তাদের কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাইল। এ সুযোগে ফোনটা জামার পকেটে রাখল। তারপর কিছুটা সাহস নিয়ে উঠে দাঁড়াল। দুই হাতে বালি। সে সেগুলো ওদের মুখে ছুড়ে দিয়ে একদিকে দৌঁড়ে গেল। খুব একটা দূরে যেতে পারেনি। একটা পুরোনো বাড়ি তার ঠিক পাশে ঝোপঝাড় সরিয়ে গাছের আড়ালে গিয়ে লুকিয়ে পড়ল। ফোনটা সাইলেন্ট করে তারপর আবারও অভ্রকে কল দিতে লাগল। অভ্র কল রিসিভ করছে না। নীল ছোট্ট করে 'হেল্প' লিখে মেসেজ পাঠাল। লোকগুলো ওর পিছু পিছু এখানে চলে আসে।
একজন বলল, ' শালি পালাইছে।'
' পালাইয়া যাইব কই? খুঁজে দেখ আশেপাশে আছে।'
মিটিং শুরু হয় সাতটা বাজে। শেষ হতে হতে ন'টা বেজে যায়। অভ্র ওঁর ফোন সাইলেন্ট করে তার পিএ নিলয়ের কাছে দিয়েছিল। অভ্র কেবিনে এসে বসা মাত্র নিলয় ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বলল, ' স্যার, আপনার ফোন। মিটিংয়ের সময় অনেকগুলো কল এসেছিল।'
' কে করেছিল?'
' জানিনা স্যার।'
আকাশ পানি পান করে বলল,
' দেখ, কে কল দিয়েছে। ইম্পর্ট্যান্ট ও তো হতে পারে।'
' দুপুরের মিটিং সেটা হলো রাতে আবার তাদের নাকি এখনো চিন্তা ভাবনা করার বাকি আছে। আমার জাস্ট বিরক্ত লাগছিল, ইচ্ছে করছিল সবগুলোকে সালাম দিয়ে বিদায় করি।' বিরক্তিকর কণ্ঠে বলল শুভ।
অভ্র হাসি ঠোঁটে নিয়ে ফোন হাতে নিল। কল লিস্ট চেক করে দেখল, নীল কল দিয়েছে। এবং মেসেজটি চোখে পড়ল। অভ্র নীলের নাম্বারে কল দিল। রিং হচ্ছে কিন্তু কেটে কেটে যাচ্ছে। মায়ের নাম্বারে কল দিল অভ্র। মায়ের থেকে জানতে পারল নীল ওঁর বাবার বাড়ি। একটু অস্বস্তি নিয়ে রায়হান সরকারকে কল দিল সে। উদ্বিগ্ন গলায় অভ্র জিজ্ঞেস করল, ' বাবা নীল কল রিসিভ করছে না কেন? মা বলল, সে আপনার বাসায় গেছে।'
রায়হান সরকার সহজ ভাষায় বললেন, 'সে তো কিছুক্ষণ আগেই চলে গেছে বাবা। তোমার জন্য দুশ্চিন্তা করছিল। যাওয়ার সময় বলে গেছে, তোমাকে সত্যটা আজই জানাতে হবে।'
অভ্র বলল, ' আমি এখনও অফিসে আছি বাবা।'
রায়হান সরকার শান্ত কণ্ঠে বললেন,
' আমার মেয়েটা এতদিন পরে এসে একদিনও থাকতে পারেনি, তোমার জন্য চলে গেছে। একদিন সময় করে এসে বেরিয়ে যেও।'
' আচ্ছা বাবা। এখন রাখি।'
আকাশ জিজ্ঞেস করল,
' কি হয়েছে?'
' নীল বিপদে আছে।' এলোমেলো কণ্ঠে বলল অভ্র।
অভ্রর চোখ রক্তিম হয়ে গেল। হঠাৎ নীলের ফোনের লাস্ট লোকেশন চেক করার পর তারা গাড়ি নিয়ে চলে যায়।
.
.
.
চলবে........................