তুমি রবে নীরবে - পর্ব ০৬ - নাদিয়া সাউদ - ধারাবাহিক গল্প


ভেতরের ঘরের দিকে একপলক তাকাল রওনক।পরক্ষণে কুহুর হাত টেনে ধরে নিজের রুমের দিকে পা বাড়াল!হতবিহ্বল,নির্বাক হয়ে চেয়ে রইল কুহু!ভয়ে তার হাত-পা শৈথিল্য হওয়ার উপক্রম!যদি কুহুর বলা কথাগুলো সবাইকে জানিয়ে দেয় রওনক?তখন লজ্জায় মাথা কাঁটা যাবে কুহুর!রিশাকে জেলাসি ফিল করাতেই তখন ইচ্ছে করে আশফিকের ওমন বর্ননা দিয়েছিল!দরজার ছিটকিনি'র শব্দ হতেই ভাবনার ঘোর কাটলো কুহুর।ততক্ষণে দরজা এঁটে এসেছে রওনক!ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে কাঁচুমাচু করতে লাগল কুহু!ভয় হচ্ছে তো কথাগুলো নিয়ে!কোনো ছেলের দিকে জীবনেও ভালমতো তাকায়নি কুহু!আর আজকে এই জল্লাদটার সামনে এসব উদ্ভট কথা বলে ফেলেছে!রওনক কাছে এসে দাঁড়াতেই ঘাবড়ে গেল কুহু।কোনোরকম তুতলিয়ে বলল,
"আ..আশ্চর্য!এভাবে টেনে কেন নিয়ে আসলেন আমায়?ক..কি করেছি আমি?

কপাল জুড়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে কুহুর।সুতি ওড়নার কোনা দিয়ে কপাল মোছায় ব্যস্ত হলো সে।অস্থির হয়ে উঠলো ক্রমেই!রওনকের চোখেমুখে এখনও রাগের আভা!শক্ত গলায় বলল,
"ভাল লেগেছে আশফিককে?এরকম হ্যান্ডসাম,ড্যাশিং একটা ছেলে,তারপর কি যেন?হ্যাঁ...একদম হট!এক্ষুনি গিয়ে বরং আশফিককে বলি একটা মাথামোটা,নির্বোধ মেয়ে প্রথম দেখাতেই তোর জন্য দেওয়ানা হয়ে গেছে!

কথাগুলো তীব্র রাগ নিয়েই বলল রওনক।কুহু যেন এই ভয়টাই পাচ্ছিল!এসব কথা আশফিকের কানে গেলে বিচ্ছিরি অবস্থা হয়ে যাবে!বুদ্ধি খাটিয়ে পরিস্থিতি তাকেই সামাল দিতে হবে।পাল্টা রাগ নিয়ে বলল কুহু,
"আমার ভাল লাগলে আমি নিজেই গিয়ে বলবো।আপনার এত কষ্ট করতে হবে না।সরুন তো।আমি বের হবো।এভাবে টেনে নিয়ে চলে এলেন কেউ দেখলে কি ভাববে?

হাত উঁচিয়ে কুহুর পথ রোধ করল রওনক।চোয়াল শক্ত করে বলল,
"সুদর্শন কোনো যুবককে দেখলে বুঝি একটা শান্ত,লাজুক স্বভাবের মেয়ের ভেতর এরকম চঞ্চল হয়ে উঠে?যা তাকে একেবারে বেহায়ার করে তোলে!হায়া ভুলে একেবারে চোখ দিয়ে গিলে খায়!

রওনকের কথাগুলো শুনতে ভীষণ খারাপ লাগছে কুহুর।স্পষ্ট কুহুকে বেহায়া তকমা দিচ্ছে!অথচ কুহুর মনে বাজে কোনো ভাবনা ছিল না!এটা বলার মূল কারণটাও তো বলতে পারবে না রওনক ভাইকে।তবে তার তিতকুটে কথার জবাব তো অবশ্যই দেবে!
" এভাবে কেন বলছেন?একটা মানুষ দেখতে সুন্দর হলে প্রশংসা করাই যায়!নাকি আপনার হিংসে হচ্ছে কোনটা?বলুন?

কুহুর কথায় চমকে গেল রওনক!কি বোঝাতে চাইল মেয়েটা?আশফিকের প্রশংসা করায় রওনকের যে তীব্র রাগ,কষ্ট হয়েছে সেটা কি কুহু বুঝতে পেরেছে?তবে কি এই নির্বোধ মেয়েটা অবশেষে বুঝতে পারলো রওনকের অনুভূতি?ধীরে ধীরে কপালের সুক্ষ ভাজ মিলিয়ে গেল রওনকের।শীতল কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়লো সে,
"আমার হিংসে হচ্ছে মানে?

দুই হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল কুহু,
" এই যে আপনার মামাতো ভাই দেখতে আপনার চেয়েও সুন্দর!যে কেউ-ই তার প্রশংসা করবে!এদিকে আপনি দেখতে হাবলার মতো!কখনো প্রশংসা পাননি বোধহয়!এই জন্য অন্যের সুনামটা ঠিক সহ্য হচ্ছে না!

কুহুর কথায় আশ্চর্য বনে গেল রওনক!রাগ উঠে গেল তুঙ্গে!সামাল দেওয়া নির্ঘাত দুষ্কর হয়ে যাবে এখন।ঝড়ের বেগে এগিয়ে এসে কুহুর দুই কাঁধে হাত রাখল সে!চশমা ভেদ করে ভয়ঙ্কর সে চোখে দৃষ্টি রাখতে পারল না কুহু।গন্ডস্থল শুকিয়ে গেল!তার তো মনেই নেই এমুহূর্তে বাঘের ডেরায় আঁটক সে!চোয়াল শক্ত করে বলল রওনক,
"দেখার মতো দৃষ্টি আছে নাকি তোমার?মানুষ তো মনের চোখ দিয়েই কতকিছু দেখতে পারে,অনুধাবণ করতে পারে।সবাই তো আর তোমার মতো মাথামোটা নয়!

রওনকের কথা শেষ হতেই দরজায় টোকা পরলো।ওপাশ থেকে আশফিকের কন্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে।তাড়া দিচ্ছে সে।রওনকের রুমে গিয়ে ফ্রেশ হবে।আসার সময় এক্সট্রা কোনো ড্রেসই নিয়ে আসেনি বলল।কুহুকে ছেড়ে দিয়ে বন্ধ দরজায় দৃষ্টি রাখল রওনক।কুহুর চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার জোগাড় হয়েছে!জল্লাদটা যে তাকে সমেত দরজা এঁটে দিল,এখন বেরোবে কি করে?চোখেমুখে ফের বিরক্তি টেনে বলল রওনক,
" সব তোমার জন্য হয়েছে!স্টুপিড মেয়ে কোথাকার!

"হ্যাঁ আমি তো বলেছিলাম আমার হাত ধরে আপনার রুমে নিয়ে যান।তারপর দরজা লাগিয়ে দিয়ে মনখুশি মতো বকুন জাহাঁপনা!

"একদম চুপ!ইডিয়েট মেয়ে!ঘটে বুদ্ধি থাকলে এসব বলতে না।

কুহুর সঙ্গে আর তর্ক করলো না রওনক।এদিক-সেদিক তাকাল।ওয়াশরুমে কুহুকে পাঠানো যাবে না।আশফিক এক্ষুনি ফ্রেশ হবে।দরজা খুলতে দেরি হওয়ায় রাশেদ জামাল এসে ছেলেকে ডাকলেন।কুহুর এবার হাতপা কাঁপছে ভয়ে!রওনক কম্পিত গলায় কোনোমতে জানাল সে ওয়াশরুমে আছে।এক্ষুনি দরজা খুলছে।দ্রুত ওয়াশরুম গিয়ে ড্রেস চেইঞ্জ করে শুধু তোয়ালে পড়ে বেরিয়ে আসল রওনক!আহাম্মকের মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল কুহু!পরক্ষণে চোখমুখ কুঁচকে বলল,
" দুশ্চিন্তায় কি লজ্জা সরম খেয়ে ফেলেছেন?জলজ্যান্ত একটা মেয়ে এখানে দাঁড়িয়ে আছে দেখছেন না?ছিহ!

কথাটুকু বলেই অন্যপাশে দৃষ্টি রেখে হাত দিয়ে চোখ ঢেকে রাখল কুহু।পূর্বের মতো আবারও হাতে হ্যাচকা টান পরল।পিলে চমকে উঠলো কুহু!ততক্ষণে কুহুকে টেনে নিয়ে গিয়ে বিশাল কাবার্ডের একপাশের দরজা খুলে বসিয়ে দিল রওনক।দরজায় হাত রেখে অবাক কন্ঠে বলল কুহু,
"এক মিনিট,এক মিনিট!এখন কি দরজা লাগিয়ে দিবেন রওনক ভাই?আমি তো দম বন্ধ হয়ে মারা যাব!

" আর একটা কথা বললে একদম মেরেই ফেলব!পরপুরুষের দিকে আর নজর দিবে?এটাই তোমার শাস্তি!নেক্সট টাইম মুখে লাগাম টেনে রাখবে।মনে থাকে যেন!

কথা শেষ করেই ঠাস করে দরজা লাগিয়ে দিল রওনক।ঘুটঘুটে অন্ধকারে ছেয়ে গেল কুহুর চারিপাশ!রওনক ভাইয়ের শেষের কথাটা তার মস্তিষ্ক ঠিক বুঝল না!পরপুরুষের দিকে নজরের শাস্তি মানে?কুহু কি বলেছিল রওনক ভাইকে তোয়ালে পরে তার সামনে আসতে?আর নজর কোথায় দিল সে?উল্টো চোখ ঢেকে ফেলেছিল!

!!৯!!

হাসিমুখে দরজা খুলে দিল রওনক।স্বস্তির শ্বাস ফেলে বলল আশফিক,
"এতক্ষণ লাগলো তোর দরজা খুলতে?মেয়ে মানুষও তো শাওয়ার নিতে এত টাইম নেয় না!ফিরেছিস তো সেই আমার সঙ্গেই!এতক্ষণ অব্ধি ওয়াশরুমেই ছিলি?

আশফিকের কথার প্রতিত্তোরে একটু হাসলো রওনক।সে তো শাওয়ার নিতেই পারেনি বজ্জাত মেয়েটার জন্য!অভিনয় করে তোয়ালে পরে আছে এখন।আশফিক রুমে প্রবেশ করতেই রিশার আগমন হলো দরজার সামনে।কেমন চোরা দৃষ্টিতে ভাইয়ের পুরো রুমে দৃষ্টি বুলাচ্ছে সে।জিগ্যাসু দৃষ্টিতে তাকাল রওনক।চোখ পাকিয়ে বলল রিশা,
" অনেক্ক্ষণ যাবৎ কুহুকে পাচ্ছি না ভাইয়া।তুই কি তাকে দেখেছিস?

"আমি কি জানি!দেখ কোথাও বসে শাস্তি ভোগ করছে হয়তো!

ভ্রু কুঁচকে বলল রিশা,
" মানেহ?তুই কি কুহুকে গুম করে দিয়েছিস ভাইয়া?

"এত কথা না বলে বাবা আর মায়ের সঙ্গে রুমে গিয়ে কথা বল।দশমিনিট যেন তাঁরা কেউই বের না হয়।খেয়াল রাখবি।

ভাইয়ের কথা মাথার উপর দিয়ে গেল রিশার।তবে হুট করে কুহুর হারিয়ে যাওয়াতে তার ভাইয়ের হাত আছে এটুকু বুঝতে পেরেছে।দরজা আঁটকে দিয়ে রুমে আসল রওনক।কাবার্ডের দিকে এগোতে এগোতে বলল আশফিক,
" জিন্স পরে ঠিক রিল্যাক্স হতে পারছি না।তোর একটা
ট্রাউজার নিচ্ছি।

কোনোমতে দৌড়ে গিয়ে কাবার্ডের দরজায় হাত রেখে বলল রওনক,
"তুই যা না ওয়াশরুমে।আমি দিচ্ছি ট্রাউজার।

কিয়ৎক্ষণ রওনকের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল আশফিক,
" আমি নিতে পারতাম তো!তা ছাড়া ওভাবে দৌড়ে আসলি কেন?মনে হচ্ছে কাবার্ডে গুপ্ত কিছু আছে!

"গুপ্ত কিছু নয়।আমার জীবনের সবচেয়ে মহা মূল্যবান জিনিসটা আছে।পার্সোনাল ব্যাপার স্যাপার।বুঝবি না।

শব্দ করে হেসে বলল আশফিক,
" শালা যেভাবে বলছিস আর বাঁধা দিচ্ছিস,মনে হচ্ছে আমি কোনো মেয়ের কাবার্ডে হাত দিতে গিয়েছিলাম!খুললেই পার্সোনাল কিছু বেরিয়ে আসবে!তোর মহা মূল্যবান বস্তু আর কি হবে?বড়োজোর আন্ডারওয়্যার!

আশফিকের কথার আর কোনোরকম উত্তর দিল না রওনক।তার চিন্তা হচ্ছে ভেতরে থাকা কুহুর জন্য!একেবারেই অক্সিজেন নেই সেখানে।আশফিককে কোনোরকম বুঝিয়ে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে দিল রওনক।পরক্ষণে কাবার্ডের এক পার্ট খুলতেই দেখলো ঘাপটি মেরে বসে আছে কুহু।একদম ছোট্ট বিড়াল ছানার মতো লাগছে দেখতে!ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো রওনকের।আলতো হাতে কুহুর মাথায় হাত রাখল।চমকে তাকাল কুহু!হাত ধরে টেনে বের করল রওনক।দাঁড়িয়ে প্রলম্বিত শ্বাস নিল কুহু।ভেবেছিল আজকেই বুঝি মা'রা যাবে!তাড়া দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে যেতে বলল রওনক।একছুটে বেরিয়ে গেল কুহু।সেদিকে তাকিয়ে থেকে স্বগতোক্তি করলো রওনক 'বোকা মেয়ে'


রিশার কাছে একে একে সব ঘটনা খুলে বলল কুহু।বেশ মনোযোগ নিয়ে শুনলো রিশা।ভীষণ হাসি পাচ্ছে তাঁর!এমুহূর্তে রওনক কতখানি রেগে আছে সেটা রিশার চেয়ে ভাল কেউ জানে না।পছন্দের মানুষের মুখে অন্যের প্রশংসা শুনলে রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক!তার উপর কুহু দ্বিগুণ রাগিয়ে দিয়ে এসেছে রওনককে!সব শুনে বলল রিশা,
"তুই কথায় কথায় আমার ভাইকে হাবলা কেন বলিস?আশফিক ভাই দেখতে সুন্দর ঠিকাছে কিন্তু আমার ভাইয়া তার থেকেও লম্বা!ফর্সা গায়ের রঙ!মোট কথা সবদিকেই পার্ফেক্ট!আর সুদর্শন!কত মেয়ে ভাইয়ার পেছনে পরে আছে জানিস?

মুখ বাঁকিয়ে বলল কুহু,
" জানতে চাই-ও না!আমি দেখতে কোনদিক দিয়ে খারাপ বল?আত্নীয়স্বজন থেকে পাড়াপ্রতিবেশি সবাই-ই প্রশংসা করে।আর তোর ভাই কিনা বলে আমাকে দেখতে চাকরানী সখিনার মতো!সে বললে আমি বলতে পারব না কেন?নিজের ভাই বলে সাফাই গেয়ে যাচ্ছিস!আমার হয়ে কথা বলার কে আছে?

কুহুর কথায় দীর্ঘশ্বাস ফেলল রিশা।এই কথার জবাব তার কাছে সত্যিই নেই।ভাইয়া তো এই কুহুর মন দিন দিন বিষিয়ে দিচ্ছে!শেষে পস্তাতে না হয়!ডাইনিং রুম থেকে শারমিন বেগমের ডাক আসল।রিশা মাকে বলে রেখেছিল খাবার বেড়ে দেওয়ার সময় তাকে যেন ডাকা হয়।দুপুরের সময় কুহু সমেত সবার খাওয়া হয়ে গেছে।এখন কেবল রওনক আর আশফিক বাকি।রিশার সঙ্গে কুহুও আসল কাজে কিছুটা সাহায্য করতে।উদ্দেশ্য আশফিকের সঙ্গে কথা বলবে সে।শারমিন বেগম জানালেন মুরগীর মাংসটা রিশা রান্না করেছে।খানিকটা খেয়ে বেশ প্রশংসা করলো আশফিক।লজ্জায় কেমন মিইয়ে গেল রিশা!পায়েসের বাটি আনতে কিচেনে চলে গেলেন শারমিন বেগম।কুহু পোলাওয়ের ডিশ নিয়ে আশফিকের সামনে গেল।আরেকটুখানি লাগবে কিনা জিগ্যেস করল।ঠোঁটে প্রশস্ত হাসি লেপ্টে আছে তার!রওনক দৃষ্টি নিচু করে খাওয়ায় মনোযোগী হলেও কুহুর কান্ডকারখানা নজর রাখছিল।রওনকের সামনে তো একবারও এসে জিগ্যেস করল না,কি চাই তার!চোখমুখ শক্ত করে খাবার চিবুতে থাকল রওনক।কুহুর দিকে তাকিয়ে শুধাল আশফিক,
"হেই কিউটি!হু আর ইউ?

রওনক সবে খাবার মুখে তুলছিল।আশফিকের কথায় থেমে গেল।দৃষ্টি রাখল কুহুর পানে।কুহু খুশিতে গদগদ হয়ে পরিচয় দিল,রিশার বেস্ট ফ্রেন্ড হয় সে।কোন ক্লাসে পড়ে,বাড়ি কোথায় এক নিঃশ্বাসে সব বলে ফেলল!

বোকা মেয়েটা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালে বোধহয় খেয়াল করতো আরেক জোড়া চোখ ভয়ানক ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিয়ে তাকে দেখছে!
·
·
·
চলবে...............................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন