পর্ব ২০
মৌরিন আহমেদ
.
.
.
ঝলমলে সোনালী সকাল। রায়হান স্ট্রিটের এলাকাটা এখন ভীষন ব্যস্ত। কর্মজীবী মানুষেরা ব্যস্ত হয়ে যে যার কর্মস্থলে যাচ্ছেন। চারিদিকে হৈ চৈ কলোরব, রাস্তায় বাস-ট্রাকের তর্জন-গর্জন, বাজারে মানুষের হট্টগোল। এই কিচির মিচির এলাকায় হঠাৎ একখানা দামী গাড়ির অনুপ্রবেশ ঘটলো। টকটকে লাল রঙের ঝকঝকে তকতকে একটা মার্সিডিজ এসে থামলো ঠিক মাঝখানে। রোদের আলোয় সেটা যেন ঝিলিক দিয়ে উঠলো! আরেকবার আলোর ঝলকানি দিয়ে উঠে গাড়ির পেছনের দরজাটা কেউ খুললো। সেখান থেকে বেরিয়ে এলো ব্ল্যাক শু পরা দুটি পা। নেমে এলেন স্যুট-কোট পরা একজন ভদ্রলোক, ভাব গাম্ভীর্যই যার আলাদা। ফর্সা গায়ে জড়ানো সাদা শার্টের উপর ব্ল্যাক কোট। গলায় রেড চেকের টাই। চোখে ব্রাউন কালার সানগ্লাস আর মুখে সার্জিক্যাল মাস্ক। সে তার গাম্ভীর্য বজায় রেখে মাথা হেলিয়ে গাড়ির ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে কিছু একটা বললো।
আদেশ অনুযায়ী ড্রাইভারও ইউটার্ন দিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে, বাজারের এক কর্নারে পার্ক করে রাখলো। তারপর জানালার কাঁচের ফাঁক দিয়ে ডান হাত বের করে, মুঠো করে হাতে বৃদ্ধা আঙুল উঁচিয়ে তার 'বস'কে জানালো কাজ হয়েছে। কোট-টাই পরা ভদ্রলোক তার দাড়ালেন না। ভীড়ের ভেতর কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন।
কলিং বেলের আওয়াজ শুনে আড় চোখে দরজার দিকে তাকালো প্রদোষ। সে সবমাত্র ঘুম থেকে উঠেছে। উঠেই ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে দাঁত মাজতে শুরু করেছে। আজ তার দেরি হয়ে গেছে! অবশ্য ঘুম থেকে দেরি করে ওঠা ওর জন্য নতুন কিছু না। প্রায়ই সে এমন দেরি করে যায় অফিসে। ফলস্বরূপ ডিপার্টমেন্টের চিফ স্যারের কাছে বকা-ঝকাও খায় সবচেয়ে বেশি! তবুও নিজেকে শোধরাতে পারে না। "ইল্লত যায় না ধুইলে, খাসলত যায় না মইলে।"- এ প্রবাদটা বোধ হয় তার জন্যই বানানো!
আবারও বেল বেজে উঠলো। আবারও। পর পর তিনবার বেল বাজানো দেখে কী যেন ভাবলো সে। এটা সবজি কিংবা পেপারওয়ালা না। বিশেষ কেউ, কোড অনুযায়ীই কাজ করছে।
কিন্তু এত সকালে কে এলো? আর আসবেই বা কেন? ও তো একটু পর নিজেই গিয়ে হাজিরা দেবে। যাই হোক, দরজাটা খুলতে হবে।
ব্রাশ করতে করতেই দরজার দিকে এগিয়ে যায় ও। মুখে জমানো থুথু নিয়ে বলে,
- কে?
- তোর বাপ! দরজা খোল তাড়াতাড়ি!
কণ্ঠটা শুনে একটু চমকায় সে। অনেকদিন পর এই ছেলে ওর কাছে এসেছে? অবিশ্বাস্য! তাই ব্যঙ্গো করে বললো,
- কিন্তু আমার বাপ তো মরে গেছে.. সে আসবে কী করে?
- আমি তোর মরা বাপের ভুত!.. ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করা বাদ দিয়ে দরজা খোল.. নয় তো সামনে পেলে ঘাড় মটকে দেব!
ওপাশ থেকে নাঁকি সুরে কথা বলে ওঠে কেউ। ভুতের হুশিয়ারি বার্তা শুনে আর দেরি করে না প্রদোষ। ব্রাশ করতে করতেই আরেকটু এগিয়ে যায়। মুখ ফুলিয়ে, ব্রাশটা দাঁতেরf ফাঁকে আটকে দু' হাত ব্যবহার করে দরজার সিটকিনি টা খোলে।
দরজা খুলতেই ওপাশের ব্যক্তিটি অনেকটা ধাক্কা দিয়েই ওকে সামন থেকে সরিয়ে দেয়। নিজে নিজে ঘরের ভিতর ঢুকে যায়। অবাক হয়ে তাকায় ও। তারপর নিজেও ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়।
ড্রইং রুমে এসে প্রদোষ কিছু একটা বলতে যায়, কিন্তু মুখে পেস্টের ফেনা থাকার কারণে কিছুই বোঝা যায় না। আগন্তুক ব্যক্তি একবার অবাক চোখে ওর দিকে তাকায়। এই এলোমেলো চুলের লোকটা, যে কি না বর্তমানে ওর সামনে ধুতি আর পৈতে পড়ে, মুখে পেস্ট নিয়ে সং সেজে দাড়িয়ে আছে তাকে দেখে হঠাৎ হাসি পেয়ে যায় ওর। এখন। ওকে দেখে বস্তিবাসী টিপিক্যাল বাঙালিই লাগছে অথচ লোকটা তেমন নয়! দেশের ডিফেন্স টিমে তার নামের ভীষণ কদর! তার ব্যক্তি জীবন, কর্মজীবন সবকিছুই হওয়া উচিত অন্যদের থেকে আলাদা, অন্যরকম! অথচ সে কি না দাড়িয়ে আছে গেঁয়ো বাঙালি ভুতের মত করে!
কথাগুলো ভেবে ফিক করে হেসে উঠলো লোকটি। তার হঠাৎ হাসি দেখে কিছু বুঝতে পারলো না প্রদোষ। আবারও কিছু একটা বলতে চেষ্টা করলো। আফসোস! এবারেও গো গো ছাড়া কিছু বোঝা গেল না। সেটা খেয়াল করে আরো জোড়ে জোড়ে হেসে ওঠে আগমনকারী ব্যক্তি। ওর দিকে এক হাত উঁচিয়ে বললো,
- মি. প্রদোষ মিত্র আপনি দয়া করে ওয়াসরুমে যান! আপনার যা অবস্থা তা দেখে ফাঁসির আসামিও মৃত্যুর কথা ভুলে হাসতে শুরু করবে!
প্রদোষ ইতস্তত করে কিছু একটা বলতে যায়, কিন্তু লোকটা ওকে সে সুযোগ না দিয়ে দ্রুত হাত নেড়ে বলে,
- প্লিজ, প্রদোষ ভাই বলছি,.. প্লিজ, বেসিনে গিয়ে মুখ ধো, আর তোর এই ভুড়িওয়ালা পেটটাকে ঢাকার ব্যবস্থা কর! প্লিজ!..
চুপচাপ ওয়াসরুমে চলে যায় সে।
হাত মুখ ধুয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসে প্রদোষ। দেখা যাচ্ছে, সে তার পরনের ধুতিটা বদলে প্যান্ট আর একটা স্যান্ডো গেঞ্জি পরেছে। মুখের খোঁচা খোঁচা দাড়ি গুলোও শেভ করে নিয়েছে এই ফাঁকে। তার ব্যবহৃত আফটার শেভিং ক্রিমের গন্ধে পুরো ঘরটা ভুরভুর করছে। ও আলমিরার কাছে গিয়ে একটা ইস্ত্রি করা সাদা শার্ট বের করলো। কালো প্যান্ট এর উপরে সাদা একটা শার্ট পরাতে এতক্ষণে যেন ওকে ভদ্রলোক মনে হলো। ইন করে বেশ টাইট করেই কোমড়ে বেল্ট বাঁধে, যেন তার স্বাস্থ্য সম্মত ভুঁড়িটা যথাসম্ভব চোখে না পরে! হাতে ঘড়ি পড়ে, চুলগুলোকে চিরুনি করে নেয়। তারপর কফি মেকারের সামনে গিয়ে দু' কাপ কফি রেডি করে। টেবিলের উপরে রাখা একটা বয়াম থেকে বিস্কিট বের করে পিরিচে সাজায়। কাপ দুটো আর পিরিচটা এনে রাখে টি-টেবিলের উপরে।
কোট টাই পরা লোকটি এতক্ষণ সোফায় বসে মুখ ঢেকে পেপার পড়ছিলেন। কাপ রাখার শব্দ শুনে মুখের সামন থেকে পেপারটা সরায়। সেটা ভাঁজ করে সোফার অপর প্রান্তে রেখে দিয়ে একটা কফির কাপ হাতে তুলে নেয়। ওকে নিতে দেখে প্রদোষও নিজের কাপটা হাতে নেয়, সাথে পিরিচ থেকে দুটো বিস্কিট। সেটা কাপে ভিজিয়ে রেখে বলে,
- তা এই খটখটে রোদ্দুরের মধ্যে হঠাৎ বর্ষণ সাহেবের আগমন? কেন বলুন তো?
বর্ষণ নামের লোকটি সবে কাপে ঠোঁট লাগিয়েছেন, চুমুকও দেন নি। তাতেই ওর দিকে তাকিয়ে বললো,
- সবসময় কী নিয়ম অনুযায়ী বর্ষণ হবে? হঠাৎ বর্ষণ হওয়া কী ভালো না?
বলেই অন্য দিকে তাকিয়ে কাপে চুমুক দেয়। প্রদোষ কী যেন ভাবে তারপর বলে,
- তারপর কবে এলি, বল্? ওদিকে কাজ কদ্দুর? মিশন কমপ্লিট?
- আপাদত কমপ্লিট। তবে...
- তবে কী?
- নাহ্, তেমন কিছু না।
কি যেন বলতে গিয়েও থেমে যায় বর্ষণ। ভাবে এমন ঘটনা তো কতশতই ঘটনা ঘটেছে! সবসময় কী সবকিছুই বলাউচিৎ? কিছু গোপন কথা থাকলে কি খুব ক্ষতি?
_______________________________
আজকাল ঠিক মতো ঘুমাতে পারে না অনন্যা। বিছানায় শুতে গেলেই শুধু ধ্রুবের কথা ঘুরপাক খায় মাথায়। মনে মনে ভাবে, ধ্রুব ওকে ধোঁকা দিয়েছে। নিজের নাম, ঠিকানা ভুল বলেছে। আবার মাঝে মাঝে মনে হয় ধ্রুবের কোনোই দোষ নেই। সব দোষ ওর! ওর নিজের!
ধ্রুব তো কোনোদিন কোনোভাবে ওকে নিয়ে ইন্টারেস্ট দেখায় নি! ও তো কোনদিনও নিজে থেকে একটা বাড়তি কথা বলে নি। বরং যথাসম্ভব ওকে এড়িয়েই চলেছে! আবার ও যে ধ্রুবকে ভালোবাসে সে কথাটাও তো আর বলা হয়ে ওঠে নি! তাহলে? ধ্রুব কে কি ধোঁকাবাজ বলা যায়?
ওর ভাবনায় ডুবে গিয়ে সারারাত নির্ঘুম কাটে অনুর। ঘুমোতে পারে না, জেগে থাকে সবসময়! ঠিক মতো খেতে পারে না, পড়তে বসলে মন বসে না। জীবনযাত্রার অনিয়মের কারণে ওর স্বাস্থ্যেরও বেহাল দশা! চোখের নিচে কালি জমেছে, না ঘুমোতে ঘুমোতে চোখ দুটো যেন অক্ষি কোটরে ডেবে গেছে। নিয়মিত চুল আঁচড়ায় না, জটা পেকে থাকে চুলের মাঝে। ওর কোমল নমনীয় চেহারায় এখন শুধু রুক্ষ ভাব!
মেয়ের এমন হঠাৎ পরিবর্তনে মনে মনে উদ্বিগ্ন হন জোহরা বেগম। মেয়েকে কাছে ডেকে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করেন। কিন্তু লাভ হয় না। অনন্যা কিছুতেই কিছু বলে না। বারবার এড়িয়ে যায়!
আজ ওকে ধরে মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছেন উনি। চুলের অমন অযত্নের জন্যে বকাও দিচ্ছেন প্রচুর। কিন্তু অনন্যা তাতে ভাবলেশহীন। তেমন একটা উত্তর দিচ্ছে না। অথচ অন্য সময় হলে ঠিকই কথার পৃষ্ঠে কথা বলতে দেখা যেত ওকে। বিষয়টা খেয়াল করে অবাক হলেন জোহরা। একসময় মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন,
- হ্যাঁ রে অনু, তোর কী হয়েছে বল তো?
- আমার আবার কী হবে? কিছু হয় নি তো!..
কেমন রুক্ষ স্বরে জবাব দেয় অনন্যা। জোহরা আরও কোমল সুরে বলেন,
- কিছু তো একটা হয়েছেই.. আমাকে বলবি না তুই? আমি না তোর মা?
- বললাম তো কিছু হয় নি।
- আসলেই কিছু হয় নি?
- না....
- ঠিক আছে, তাহলে তুই এমন করে থাকিস কেন?
- কেমন করে থাকি?
- কেমন আবার? উদাসীন। সারাদিন কী যেন ভাবিস, ঠিক মতো খাচ্ছিস না, ঘুমাচ্ছিস না। সারাদিন ঘরে দরজা বন্ধ করে থাকিস।... সত্যি করে বল না তোর কী হয়েছে?.. দেখ, তুই এমন মন মরা হয়ে থাকলে কি আমার ভালো লাগে?.. তোর বাপটা সারাদিন নিজের কাজ, অফিস নিয়েই থাকে... আমার সাথে কথা বলার তার সময় আছে?.. লেবুটা সারাদিন কুঁড়েমি করে কাটায়। কথা বলতে গেলেই যতসব উদ্ভট সিনেমা আর বইয়ের গল্প!.. তুইও এমন করিস, তাহলে আমি কি করি, বল তো?
মায়ের এমন অভিমানী বাক্যে মন গলে যায় অনুর। সত্যিই তো ধ্রুবের রাগ কি, মায়ের সাথে দেখানো যায়? মায়ের দিকে মুখ ফিরিয়ে বসে। আদুরে ভঙ্গিতে মায়ের কোমড় জড়িয়ে কোলে মাথা রাখে। সুর নরম করে আহ্লাদী করে বললো,
- তুমি কিছু ভেব না তো, মা। সামনে আমার পরীক্ষা।.. সেটা নিয়ে একটু টেন্সড আপ... তাই দরজা বন্ধ করে পড়ছি। বুঝেছ মা, এই পরীক্ষার টেনশনে খাওয়া- দাওয়াতেও মন বসছে না। তোমার সাথেও তো কথা বলার সময় পাই না। কিছু মনে করো না, মা। খুব চিন্তায় আছি, কী যে হয়!..
- ঠিক আছে। কিন্তু পড়াশুনা নিয়ে অত টেনসন কেন করছিস? মন দিয়ে পড়লেই তো হয়। এরপরও যদি এক্সামে খারাপ হয়, তাতে কী? তুই তো তোর পড়া করেছিস!.. এরপর আর এমন করবি না, বুঝেছিস?
- বুঝেছি!.. আর করবো না।
- আচ্ছা, শোন তেল দেয়া শেষ। এবার যা একটু চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাক। ঘুম আসবে....
বলেই তেলের বাটিটা হাতে নিয়ে চলে যান জোহরা। উনি চলে যেতেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনন্যা। মনে মনে হতাশ হয়ে ভাবে, আমি যে কী নিয়ে ভাবি, তুমি তো তা জানো না, মা!
.
.
.
চলবে........................