পূর্ণিমা সন্ধ্যা - পর্ব ০৪ - নবনীতা শেখ - ধারাবাহিক গল্প


আয়শা প্রচণ্ড সুখ অনুভব করল। স্ত্রী হিসেবে যেমন-তেমন, মা হিসেবে সে জিতে গেছে। এ কথা ভাবলেও যেন মন বাগিচায় ভ্রমর ওড়ে, গান গায় আমোদিত হয়ে।

এমন সময় হুট করেই কলিং বেল বাজায় সামান্য ভড়কেই উঠল আয়শা। হাসি নিভে এলো অরণীর। সরু চোখে তাকাল দরজার দিকে। এ-বাসায় তো কারো আসার কথা নয়!

অরণী দরজা খুলে দেখতে পেল, একজন অপরিচিত মহিলা হাতে একটা বাটি নিয়ে হাস্যজ্বল মুখে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে হালকা রঙের সুতির শাড়ি। চেহারায় আভিজাত্য রয়েছে। বয়স চল্লিশোর্ধ্ব। মুখটায় কী মায়া! নিশ্চয়ই সে যৌবনে অসম্ভব রূপবতী ছিল! অরণী কিঞ্চিৎ বিস্মিত নজরে তাকে অবলোকন করল।

সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রমহিলার নাম তনুজা। এখানকার একটা কলেজের লেকচারার। দোতলার ফ্ল্যাটে একাই থাকে সে। স্বামী-সন্তান নেই তার। তনুজা নিজের পরিচয় দিতেই, কোঁচকানো কপাল শিথিল হলো অরণীর। সে সরে দাঁড়িয়ে তনুজাকে বলল,
-“ভেতরে আসুন।”

বসার ঘরে বসার মতো ব্যবস্থা করা হয়নি এখনও। তাই অরণী তনুজাকে সোজা বেডরুমেই নিয়ে গেল। তনুজা আয়শাকে বলল,
-“আপু, কালই আসতে চেয়েছিলাম। অতরাতে এসেছেন, বাসা গোছাতে ব্যস্ত ছিলেন ভেবে আসা হয়নি। তাই আজ চলে এলাম। বিরক্ত করে ফেললাম কি?”

আয়শা অবিলম্বে বলল,
-“সমস্যা নেই একদমই।”

তনুজা হাসল সামান্য, এরপর অরণীর দিকে তাকিয়ে আয়শাকে জিজ্ঞেস করল,
-“কন্যা?”

আয়শাও হেসে মাথা নাড়ল। তনুজা অরণীকে জিজ্ঞেস করল,
-“কী নাম, সুন্দরীকন্যা?”

অরণী এমন সম্বোধনে লাজুক হেসে বলল,
-“আঞ্জুমান অরণী!”

তনুজা প্রফুল্লচিত্তে বলল,
-“কী মিষ্টি!”

অরণী লজ্জায় মিশে যাচ্ছে৷ তনুজাকে তার একদেখায় পছন্দ হয়ে গেছে। তার বাহ্যিকতা, ড্রেসিংসেনস, বাচনভঙ্গি, আন্তরিকতা সবকিছুই আভিজাত্যপূর্ণ। এমন একজন মানুষের থেকে কমপ্লিমেন্ট পেয়ে অরণী সত্যিই কিছুটা মিইয়ে যাচ্ছে। আর তা তনুজার চোখেও পড়ল। এবার সে শব্দ করেই হাসল। মার্জিতভাব সেই হাসিতেও বিরাজমান। সে হাতের বাটিটা এগিয়ে দিলো অরণীর দিকে,
-“ভীষণ মিষ্টি মানুষদের জন্য সামান্য মিষ্টি এনেছি। পায়েস রেঁধেছি আপনাদের জন্য।”

অরণী হাতের বাটিটা নিয়ে বলল,
-“আমাকে তুমি করে ডাকবেন, প্লিজ। আমি আপনার অনেক ছোট। আর এসবের প্রয়োজন ছিল না একদমই।”

তনুজা জোর গলায় বলল,
-“অবশ্যই প্রয়োজন ছিল। এত মিষ্টি মানুষদের কাছে খালি হাতে এলে পাপ লাগত।”

তনুজার রসিকতায় আয়শা ও অরণীও হাসতে বাধ্য হলো। অরণী বড়োদের মাঝে থাকতে চাইল না, কিন্তু মাকে একা ছাড়তেও তার ইচ্ছে করল না। তাই চুপচাপ একপাশে দাঁড়িয়ে তনুজাকে পর্যবেক্ষণ করল। একসময় গিয়ে তার ভীষণ জানতে ইচ্ছে করল, এত চমৎকার মানুষটা কেন জীবনে এতখানি একা? তার কি কোনো সঙ্গী হয়নি জীবনে? সে কি কখনও ভালোবাসা পায়নি? নাকি পেয়েছে এবং হারিয়েছে? এই মানুষটারও কি কপালে মন্দবাসা জুটেছিল?

অস্বাভাবিক নয়। তার মা-ও তো চমৎকার একজন মানুষ। অথচ লোকটা তাকে ঠকিয়েছে। তার মানে কি রূপ, ঐশ্বর্য, মহত্ত্ব, ব্যক্তিত্ব—কোনোকিছুই পুরুষকে বাঁধতে জানে না? ভাবতেই বিষ বিষ লাগল সবকিছু অরণীর কাছে। মুখের ভেতরটা তেঁতো হয়ে উঠল। হাঁসফাঁস লাগতে লাগল। সে বেরিয়ে এলো ফ্ল্যাট থেকে। ছাদের এক কোণায় গিয়ে বসল।

ছাদের অর্ধেকটায় বাগান করেছে ইফতি। বিভিন্ন ফুলগাছ লাগিয়েছে। এসবের পরিচর্চা করিম করে থাকে। তবে আজ যেহেতু ইফতি বাসায় আছে, তাই নিজেই বিকেল করে চলে এসেছে। সব গাছে পানি দেওয়া শেষে ভালো করে গাছগুলোর পরিদর্শন করছিল সে। আচমকা তার নজর যায় ছাদের উলটো দিকের সিঁড়ির ওখানটায়।

অরণীদের ফ্ল্যাটের ওপরের অংশে আরেকটা ছাদের মতো জায়গা আছে। সেজন্য এখানে সিঁড়ির ব্যবস্থা। ইফতি লক্ষ করল, একটা অলিভ রঙের গোলজামা পরে তৃতীয় সিঁড়িতে উঠে গালে হাত দিয়ে বসে আছে মেয়েটি। মুখখানা মলিন। এমনিতেও তাকে হাসতে দেখা যায় না। সর্বদা এভাবেই তো থাকে। তাই বিশেষ কিছু না। 

ইফতি ছোট্ট করে শ্বাস ফেলল। সম্পূর্ণ একদিন হয়নি এই মেয়েটাকে চেনে সে, এটুকুতেই বড়ো কৌতূহলী বোধ করছে ওর ব্যাপারে। অথচ এরকমটা হওয়ার কথা ছিল না।

ইফতি থমকাল। আদৌ কথা ছিল না? অকস্মাৎ সে আবারও টের পেল, নারী মাত্রই ছলনাময়ী। তারা দুনিয়ার যত ছলা-কলা আছে, সব আয়ত্তে রেখেছে।

সে আর ছাদে দাঁড়াল না। দ্রুত পায়ে প্রস্থান ঘটাল। সিঁড়িতে ওরকম জোর পদধ্বনিতে অরণী হতভম্ব হয়ে সিঁড়িঘরের দিকে তাকাল। এইমাত্র ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে সে একদমই অবগত নয়।

_______

আমজাদ অফিস থেকে ফিরে দেখল, তার সদ্য বিয়ে করা নতুন বউ বাড়ি থেকে পালিয়েছে। ফেলে গেছে একটা চিঠি। চিঠিটা পড়ে ক্ষোভে দিশেহারা হয়ে ফেটে পড়ল আমজাদ। এমন প্রতিক্রিয়ায় সকলে অবাক হলো। তার ছোট ভাবি ফরিনা হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে পড়া শুরু করল। 

শুরুতে করা “কাক্কু” সম্বোধনে হতবিহ্বল হয়ে গেল ফরিনা। একবার উত্তেজিত আমজাদের দিকে তাকিয়ে পুনরায় পড়া শুরু করল,

“সম্মানিত কাক্কু,
দুঃখিত, মুখে বললেও আপনার প্রতি অন্তর থেকে আমার কোনো রকমের সম্মান আসছে না। এমনিই আপনি আমার চরম অপছন্দের একজন মানুষ ছিলেন। গ্রাম পরিদর্শনে যখন এসেছিলেন, তখন আমাকে দেখে যে আপনার মনে লাড্ডু ফুটেছিল—তা আমি টের পেলে শরবতের মধ্যে ছাগলের নাদা মিশিয়ে দিতাম। আফসোস! আমি বুঝতে পারিনি যে আপনার পাকা গোফের তল দিয়ে এত শয়তানি। খোদার কসম, বুঝতে পারলে সেই রাতে যখন টয়লেটের জন্য বেরিয়েছিলেন, রামদা নিয়ে পুরো এলাকার একটা চক্কর কাটিয়ে আনতাম আপনাকে। 

আমি বহু কষ্ট করে পড়াশোনা করছিলাম। প্রতিনিয়ত বিয়ের প্রস্তাব আসত। কোচিং করাতাম, প্রাইভেট পড়াতাম—এ থেকে গ্রামে তেমন একটা উপার্জন করা সম্ভব না। তবুও যা ছিল, আব্বাকে ওটুকু দিয়ে শান্ত রাখতে পারতাম মাসের শুরুর কয়েকটা দিন। শেষে এসে আব্বা আবার ঘটক ডাকত। এভাবেই চলছিল আমার দিনগুলো।

তারপর একদিন হুট করেই আব্বা আমাকে বলে বসল, তিনদিন পর আমার বিয়ে। পাত্র ঠিক করে রেখেছে। শিক্ষিত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের লোক। আমি রাজি হচ্ছি না দেখে আব্বা উঠতে বসতে অকথ্য গালি শুরু করল। অবশেষে কান যখন পচে যাওয়ার উপক্রম, আমি রাজি হয়ে বসি।

বিয়ের রাতে জানতে পারি, পাত্র আমার বাপের বয়সী। হয়তো বাপের চেয়েও বছর খানেক বড়ো। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে রইলাম। বুদ্ধি লোপ পেল আমার। কিছু বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আর এর মধ্যেই আমার বিয়েটা হয়ে গেল নিজের বাপের বয়সী একটা লোকের সাথে। 

বিদায়বেলায় আমি অবাক হতেও ভুলে গেলাম। জানতে পারলাম, চড়াদামে বিক্রি করা হয়েছে আমাকে। যে বেচেছে, সে আমাকে জন্ম দেওয়া বাপ। আর যে কিনেছে, সে আমার কিছুক্ষণ আগে কবুল করা স্বামী। আমার দাম মাত্র দশলক্ষ টাকা। 

প্রচণ্ড হাসলাম বিদায়ের সময়ে। মাকে জড়িয়ে ধরে একবার বললাম, ‘অমানুষের সাথে সংসার করেছ কী করে এতকাল?’

মা মুখ লুকোল আঁচলে। সে আদোও জানে তো? হয়তো হ্যাঁ। গ্রামে আবার স্বামীরা মহাপাপ করলেও স্ত্রীদের মুখে অদৃশ্য সেলোটেপ আটকে পা ধরে ঝুলে থাকার অলিখিত নিয়ম আছে। মা হয়তো নিয়ম পালনেই ব্যস্ত। 

সে যাক! আমার সাথে কী হচ্ছে, সেটুকু বুঝে উঠতে না উঠতেই আরও চমকপ্রদ কিছু ঘটেই যাচ্ছিল। আমি চমকাতে চমকাতে এমন পর্যায়ে চলে গেলাম যে কথা বলার শক্তিটাও হারিয়ে ফেললাম। 

আধবয়সী বুড়ো কাক্কু, শোনেন! এসব দুষ্টুমি করা উচিত না। এরকম দুষ্টুমি আর করবেন না। আপনার না বউ আছে ঘরে? এরপরও বাইরে এত চোখ যায় কেন? যাহ দুষ্ট! সবখানে এত সুড়সুড়ি কেন?

যৌবনের শুরুতেই সতিনের ঘরে ঢুকলাম, সেই ঘরে আবার আমার বয়সীই আরেকটা মিষ্টি মেয়ে আছে। একটুও কি মায়া লাগেনি আপনার? কীভাবে পারলেন এসব করতে? আমার সাথে না হয় অন্যায় হয়েছে, আমি মানছি আমার ভাগ্যের দোষ। অথচ একত্রে তিনজন নারীর সাথে আপনি যেই অন্যায়টা করলেন, এটাকে ভাগ্য মানতে আমার বড়ো কষ্ট হচ্ছে। 

আমি এখনও ভুলতে পারছি না সেই নারীটিকে, যার তেইশ বছরের সংসারে আমি কাটা হয়ে ঢুকেছি। আমি এখনও সেই মেয়েটির ঘৃণিত দৃষ্টি ভুলতে পারছি না, যার দুনিয়া এলোমেলো করা ঝড়ের অনুরূপ আমি এসেছি।

অথচ আমার জানামতে দোষ আমি করিনি। আমার সাথেও অন্যায় হয়েছে। আপনার স্ত্রী সন্তানের থেকে শিখেছি, অন্যায়ের সাথে আপোষে না আসতে। আমি এখন কী করব, কোথায় যাব, জানি না। শুধু জানি, যতদিন আপনার মতো জানোয়ারের সাথে সংসার করব, ততদিন নিজের প্রতি ঘৃণা জন্মাতে থাকবে। আর তা আত্মঘাতে রূপ নিতে খুব বেশি সময়ও নেবে না। অথচ জান বাঁচানো ফরজ। তাই আল্লাহ আমাকে মাফ করবেন নিশ্চয়ই।

নিজের জীবনের প্রতি শতভাগ ভালোবাসা আমার ছিল। আপনার মতো নিকৃষ্ট লোকের জন্য সেই ভালোবাসায় আমি সামান্য ঘাটতিও আনব না। 

অতএব জনাবের নিকট আকূল আবেদন, সবাই রোকসানার মতো ভালো লোক হবেনানে, এদিকে একটু বিবেচনা করে পরবর্তী শাদিতে পাত্রী নির্বাচন করে বাধিত করবেন। নয়তো দেখবেন, তার দিলে আমার মতো এত মায়া-মোহাব্বত নাই। আপনার একপা তো গর্তে গিয়ে আছে, সে পালানোর আগে অন্য পা-ও গর্তে ঢুকিয়ে এরপর ভাগবে। বুচ্ছেন মিয়া?

উপদেশ দিচ্ছি, শোনেন, কাজে লাগবে। মেয়ের বয়সী কারো উপদেশ শুনলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
১. কুড়কুড়ি আর সুড়সুড়ি, দুইটাই কমান। নইলে ভরা রাস্তায় লুঙ্গি খুলে দৌড়ানো লাগবে।
২. মানুষকে মানুষ মনে করবেন, নইলে শুয়োরও আপনাকে ত্যাজ্য করবে, আপনার মতো কচুর পশ্চাতে লাত্থি মেরে দূরে সরাবে। 
৩. আপনি দুর্গন্ধযুক্ত নালায় গোসল করে শান্তি পেতেই পারেন। তবে পরিষ্কার পুকুরে একবার লাফ মেরে দেইখেন। সেই মজা।
৪. মনের আগাছা পরিষ্কার করে, ধর্মের পথে ফিরে আসেন। 

আজকের মতো এখানেই খতম, আবার দেখা হবে, অন্য কোনো গল্পে। 

ইতি
রূপসী রোকসানা

পুনশ্চ: আবার দেখা হওয়াটা কথার কথা বলেছি, কাক্কু। সিরিয়াসলি নিয়েন না। আপনার মুখ দেখলেই বমি পাবে আমার। পরে লোকে প্রেগন্যান্ট ভাববে। এদিকে আপনার সাথে এখনও আমার কিছু-মিছু হয়নাই। যদি কিছু করতে যেতেন গতরাতে, আল্লাহর ওয়াস্তে একটা কোরবানি করে ফেলতাম রে কাক্কু। বেঁচে গেছেন। শুকরিয়া আদায় কইরেন।”
.
.
.
চলবে........................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন