উন্মুক্ত লাইব্রেরী
পর্ব ২৩
আয্যাহ সূচনা
দক্ষ হাতে তরকারি কাটছে অন্বেষা।ঠিক তার পাশে জমিনে পা ভাঁজ করে বসা বর্ণ।আগে রাত কাটতো গোডাউনে মালপত্র কার্টনে প্যাকেজিং করে।এখন তার সম্পূর্ণ সময়টাই কাটছে অলস।ডেঁড়েমুষে বেকার।একদম অকেজো।বসে বসে অন্বেষার কঠোর মেহনত দেখে একবার সমানুভবী চিত্ত জেগে উঠলেও বেশিক্ষণ সেটি সক্রিয় থাকতে দেয়নি তার মাঝে।ধুলো ঝেড়ে ফেলার মতো সরিয়ে দিয়েছে।এই মুহূর্তে তার মুখ্য কাজ হচ্ছে অন্বেষাকে বিরক্ত করা। শাক সবজি ধরে ধরে দেখছে যেনো প্রথমবার দেখা। কাঁচা মটরশুঁটি গিলেছে হিসাব ছাড়া।
অন্বেষা এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে কেড়ে নিলো তার কাছ থেকে। বললো,
“জ্বালাচ্ছো কিন্তু!”
“ভাল্লাগে.....”
অন্বেষা অবাক সুরে জিজ্ঞেস করে, “কি?”
“তোমারে জ্বালাইতে”
মুখ ঘুরিয়ে কাজ করতে করতে প্রশ্ন করলো,
“আমাকে ভালো লাগেনা?”
“আমার রুচি এত খারাপ নাকি? তোমার চোখ দেখছো?মার্বেল এর মত গোল্লা গোল্লা।আর চিকন ঠোঁট ওয়ালা মাইয়ারা ঝগড়াখুন্নি হয়।চুলগুলি বাদ্দাইনিগো মত!আলুর মত নাক।”
অন্বেষা হাতের খুন্তির চলন থামিয়ে বেশ মনোযোগ দিয়েই শুনলো নিজের সম্পর্কে বলা কথাগুলো।বর্ণের তাকে নিয়ে বদনাম শেষ হওয়ার পরপরই সে প্রশ্ন করে,
“আমার এতকিছু খেয়াল করলে কখন?”
বর্ণ অচঁচলচিত্তে এড়িয়ে গেলো প্রশ্নটি।যেনো শুনেই নি। অন্বেষা সস্মিত মুখে বললো,
“তুমি পুরোটাই নকল বর্ণ।তোমার মুখে এক অন্তরে আরেক।”
“আমি মুখে কেমন?”
“কঠোর”
“যদিও তোমার কথা অসত্য।আমি যদি অন্তরের দিক দিয়া দুর্বল হইতে শুরু করি?তখন পাগলা ষাঁড়ের মত মাথা আর শরীর ঝাড়া দেই।ওই ঝাকানিতে দুর্বলতা মাটিতে গড়ায় পড়ে।”
“কিন্তু কেনো?এত কঠোর হতে চাওয়ার কারণ কি?”
বর্ণ ভাবুক চোখে চেয়ে বললো,
“দিনশেষে জানি কষ্ট নামক জিনিসটা আমারে ছুঁইতে না পারে।কি নাই আমার?একটা জান আছে।হাতপা আছে অক্ষত।খাইতে পারলে খাইলাম না খাইতে পারলে নাই।ঘুমাই নিজের ইচ্ছামত।মাথার উপরে একটা ছাদ আছে।আর কি লাগবো?আমার বেশিকিছুর দরকার নাই।যত চাহিদা তত আপোস।আমি কি দুনিয়াতে আপোস করবার আইছি?খালি হাতে দাপট দেহাইবার আইছি আমি।……তুমি কি ভাবো একটা বিয়া কইরা?সংসার কইরা আমি নিজের লগে আপোস করছি? মানায় নিছি?আমি এহনো ওই আগের বর্ণ।এই সংসারটা আমার নতুন চ্যালেঞ্জ।”
এতগুলো কথা শুনে অন্বেষা শুধু একটি ছোট্ট বাক্যে প্রশ্ন করলো,
“তুমি সম্পূর্ণ চিন্তাহীন?”
“নাহ!একটা চিন্তা আছে আমার।কেউ জানি আমারে নিচা দেহাইতে না পারে।তুমি আমারে কি ভাববা আমি জানি না।কিন্তু বাইরের কোনো মানুষ যদি আমারে কাপুরুষ ডাকে?আমি ঐটা সহ্য করমু না একফোঁটাও!”
কথা বলতে বলতে বর্ণের কপালের রগ ফুলে উঠেছে। তেজস্বী মুখভাগ। অন্বেষা তার হাত এগিয়ে বর্ণের হাতের উপর রাখলো।হাতের পিঠে বৃদ্ধাঙ্গুল ঘষে দিয়ে বললো,
“কেউ বলবে না তোমাকে কাপুরুষ।আমি আছি.....”
এই দৃঢ় আশ্বাস শ্রবণইন্দ্রিয়তে শীতল হয়ে ছুঁয়ে গেলো। অচঞ্চল নেত্রপাত করে বর্ণ তার হাতের উপর রাখা অন্বেষার কোমল হাতে। প্রমত্ততা ঘিরে ধরছে ধীর গতিতে।অনুভব করলো বর্ণ।আগ বাড়িয়ে অন্বেষার আঙুলের ভাঁজে ভাঁজে স্ব আঙুলের আধিপত্য বিস্তার করে।ঢেকে ফেললো মাংসল শুষ্ক হাতের আড়ালে।বাঁধন আরো দৃঢ় করলো বর্ণ। পৃষ্ট করে দিতে চাইছে যেনো।পরপরই আবার বল কমিয়ে আনে।কিছু সময়ের জন্য নিজের স্বজ্ঞান থেকে বিরতি নিয়েছে সম্ভবত।প্রগাঢ় দৃষ্টি তুলে অন্বেষার দিকে চাইলে সঙ্গেসঙ্গে অন্বেষা চোখ নামিয়ে নেয়।
আকস্মিক দরজায় কড়াঘাতে ছোট করে দম ফেলে।হাত ছেড়ে দিলো ধীরে সুস্থে।উঠে দরজা খুলে দেখলো দারোয়ান এর পোশাকে একজন দাঁড়িয়ে।বর্ণের বুঝতে বাকি নেই ইনি কে। অন্বেষার দিকে চেয়ে বললো,
“জব্বার চাচা আইছে”
এরপর জব্বার চাচার দিকে চেয়ে বলে,
“আহেন ভিতরে আয়া জিরান একটু। হয়রান হইয়া গেছেন।”
জব্বার চাচা হাসি মুখে বর্ণের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করে,
“আপনি আমারে কেমনে চিনেন?”
“আপনার নাম অনেকবার হুনছি।এক্কেরে মুখস্ত হইয়া গেছে।”
একগ্লাস পানি এনে তার দিকে এগিয়ে দিলো বর্ণ।জব্বার চাচা তেষ্টা মিটিয়ে ঘরের চারিদিক চেয়ে দেখলেন।বেশ খুশি হলেন তিনি।বললেন,
“এই তোমাদের নতুন সংসার?যাক!ভালোই হইছে।আমি অনেক খুশি হইছি।”
জব্বার চাচার কথার বিপরীতে বর্ণ বলে উঠলো,
“আপনি খুশি হইলে হইবো চাচা মিয়া?আমারে যে সুখে থাকবার দিতাছে না এই মাইয়া?জ্বালায় কয়লা কইরা ফালাইতাছে।”
জব্বার চাচা বর্ণের কথা শুনে হাসছেন।বুঝতে পেরেছেন ঠাট্টা করছে।অন্যদিকে অন্বেষার চোখ কপালে। অন্বেষা খাবার টিফিন বক্সে রেখে জব্বার চাচার হাতে ধরিয়ে বলতে লাগলো,
“ওর কথা শুনবেন না চাচা।সারাদিন আবোলতাবোল কথা বলে ননস্টপ।কোনো থামাথামি নেই।উল্টো আমার ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছে।”
জব্বার চাচা হেসে হাত তুলে দুজনকে ক্ষ্যান্ত হতে বললেন।মনে মনে আরো অনেকটা খুশি হলেন দুজনার খুনসুটির সংসার দেখে।অবশেষে বোধহয় মেয়েটি সুখের মুখ দেখলো।
___________
নতুন সংসার এর জন্য কেনাকাটা করতে এসেছে বর্ণ এবং অন্বেষা।বর্ণ নাকোচ করলেও তাকে এক প্রকার টেনে আনা হয়। বর্ণের একটি স্বভাব বোধগম্য হয়েছে অনেক সময় পর।সে প্রথমে সব ব্যাপারে না বোধক শব্দ উচ্চারণ করার কিছু সময় পর ঠিক সেই কাজের দিকেই পা বাড়ায়।তার বারণ শুধুই ভনিতা মাত্র।জ্বালাতন করার হাতিয়ার।একে একে বর্ণের ভিন্ন ভিন্ন রূপ প্রকাশ পাচ্ছে। অন্বেষা যত শীগ্রই এই বদ অভ্যাসের লাগাম টানবে তত মঙ্গলজনক তার জন্য।
শীতের পোশাকের প্রয়োজন। অন্বেষা বর্ণকে প্রশ্ন করলো,
“তোমার শীতের পোশাক আছে?”
পকেটে হাত গুঁজে কি যেনো ভাবলো। তারপর বলে উঠলো,
“আমি এমনেই মানুষটা গরম।আমার আবার শীতের কাপড় লাগে নি?”
অন্বেষা নিউ মার্কেটের আশপাশে ফুটপাতে ঘুরছে।দরকারি যাবতীয় জিনিস কিনে নিয়েছে সাধ্যের মধ্যে।এবার এগিয়ে গেলো ছেলেদের শীতের পোশাকের দোকানে।একটার পর একটা ফুল হাতা টিশার্ট তুলে বর্ণের গায়ের সাথে মাপ দিয়ে নিলো। শেষমেশ একটি মোটা সোয়েটার পছন্দ হয়।
দোকানির কাছে জানতে চাইলো,
“দাম কত?”
দোকানী গলা উঁচু করে বলে উঠে,
“এমনেতেই বেচি ১০০০ টাকায় আপনার লেইগা ৭০০ টাকা”
বর্ণ হুট করে বলে উঠে,
“ক্যান? ওয় কি আপনার বউ লাগে নি?”
অন্বেষা বর্ণকে থামিয়ে দেয়।আরো কয়েকটা কাপড় দেখলো।পছন্দ হয়নি।মন গিয়ে রয়েছে ধূসর রঙের সোয়েটারে।
অন্বেষা বললো,
“লাস্ট কত রাখবেন?”
দোকানি জবাব দেন,
“আর পঞ্চাশ কমাইলাম যান। সাড়ে ছয়শো দেন।”
“দুইশো টাকা দিবো”
হতভম্ব দোকানি।পাশে দাঁড়িয়ে ফোনে বাবল গেম খেলতে থাকা বর্ণের দিকে করুন দৃষ্টিতে চাইলো।বর্ণের সাথে চোখাচোখি হয়।বর্ণ এক হাত নাড়িয়ে বলতে লাগলো,
“ আমি এই মাইয়ারে চিনি না।আমার দিকে তাকায় লাভ নাই।আপনারা দুইজন চালায় যান”
এমন আকস্মিক পল্টিতে অন্বেষা চোখ পাকিয়ে তাকায়।দামাদামি করবে না নাকি?কেনাকাটা শেষে অন্বেষা ছো মেরে বর্ণের হাত থেকে নিজের ফোন কেড়ে নিলো।সারাদিন বাচ্চাদের মতো গেম খেলতে থাকে।স্থান, ক্ষণ কোনোটাই দেখে না।তার দুহাতে ব্যাগ ধরিয়ে বললো,
“তোমার পকেটে আমি তিনশত টাকা দেখেছি।চলো ফুচকা খাওয়াও”
বর্ণ কাদো কাদো মুখ বানিয়ে বললো,
“এই তিনশ টাকা আমার শেষ সম্বল। কাইড়া নিছ না কালনাগিনী!”
“একদম তুই তুকারি করবে না।”
বর্ণ ভনিতা করে অন্বেষার গাল টেনে বললো,
“আহা সোনা এটা আদরের ডাক।”
“আমার এত আদর দরকার নেই।ফুচকা খাবো সাথে চা।চলো বলছি!”
“আমি বুঝতাছিতো!আমার জান পরান গিল্লা খাইয়া তারপর ক্ষ্যান্ত হইবা তুমি”
______
বাড়ি ফিরে সুদীপ্তা আর তার স্বামীকে দেখে কিছুটা অবাক হয় অন্বেষা।বাড়ির বাহিরে তারা যেনো বর্ণ অন্বেষারই অপেক্ষায়।বর্ণ তার চেয়ে অধিক পরিসরে চমকিত।হতভম্ব হয়ে পড়লো সুদীপ্তার পাশে দাঁড়ানো জীবনকে দেখে। সুদীপ্তাকে চিনেছে অন্বেষার প্রতিবেশী হিসেবে।আর জীবন তার সহকর্মী ছিলো। হিসেব মিলাতে না পেরে পায়ের দ্রুততা বাড়িয়ে দাঁড়ায় জীবনের সামনে। জীবনও বর্ণকে দেখে ঠিক ততটাই স্তম্ভিত।
“কিরে জীবন?”
“বর্ণ?তুই এদিকে?”
তাদের দুজনের আলাপচারিতা দেখে অন্বেষা সুদীপ্তা কেউই কিছু বুঝলো না। অন্বেষা প্রশ্ন করলো,
“তুমি ওনাকে চিনো?”
বর্ণ জবাবে বলে,
“চিনমু না? গার্মেন্টসে ওর লগেইতো কাম করতাম আমি।”
সুদীপ্তা স্বামীর দিকে চেয়ে বললো,
“তাহলেতো হয়েই গেলো। অন্বেষা আমি পরিচিত।আর কাকতালীয়ভাবে আমাদের স্বামীরাও পূর্ব পরিচিত।”
জীবন সুদীপ্তার কথা শুনে আশ্চর্য ভঙ্গিতে প্রশ্ন করে,
“কিরে বর্ণ?তুই বিয়া করসোস?”
বর্ণ ঝড়ো নিঃশ্বাস ফেলে মাথা দোলায়।হতাশ গলায় বলে,
“ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে!আমিও বগা বিয়ার ফান্দে ঝুইলা পড়ছি।”
বর্ণের কথাবার্তার ধরন জীবনের অজানা নয়।একে অপরের সাথে চতুর্মুখী পরিচয় যেনো নতুন চমক।অনেকক্ষণ যাবত দাঁড়িয়ে আছে সুদীপ্তা,জীবন এবং তাদের মেয়ে।তাদের নিয়ে ঘরে চলে গেলো। অন্বেষা হাতমুখ ধুয়েই চা বসলো চুলোয়।সুদীপ্তা বারণ করছে কোনো ঝামেলা করতে।তারপরও খালি মুখে মেহমান ফেরাবে না।
বর্ণের উদ্দেশ্যে জীবন বলে উঠে,
“তোরে ছাড়া কাম করতে ভাল্লাগে নারে।একলা একলা করি।শালার ম্যানেজার তোরে বাইর করায়ই ছাড়লো।”
চাকরিচ্যুত হওয়াতে বর্ণের উপর তেমন প্রভাব পড়েনি।হেসে জবাব দিলো,
“গার্মেন্টস এর বাকি মাইনষেরে টাকা খাওয়াইছে ম্যানেজার।সবাই জানি ওর পক্ষে আর আমার বিপক্ষে কথা কয়।”
“ঐটাতো জানি।কিন্তু আমার একটুও মন টিকে না।”
বর্ণ জীবনের কাঁধে হাত রেখে বললো,
“কারো প্রতি এত মায়া জন্মাবি না কোনোদিন।ছাইড়া গেলে যেনো কষ্ট পাইতে না হয়”
“তুই তো পাষাণ!”
“হ ঠিক কইছোস।”
অন্বেষা চা ঢালছে কাপে।সাথে বর্ণের কথাটি মনোযোগ সহকারে শুনলো।ভাবলো কিছু সময় নিয়ে।তাহলে কি বর্ণের মনেও তার জন্য অগাধ মায়া জন্মাবে না?হুট করে গরম চা অল্প একটু ছিটকে পড়ে অন্বেষার হাতে। আর্তনাদে মুখ ফুটে শব্দ বেরোলে বর্ণ তড়াক করে ঘুরে তাকায়।বিছানা থেকে পা নামিয়ে দ্রুত অগ্রসর হলো অন্বেষার দিকে।
বাজখাঁই সুরে ধমকে উঠে,
“কাম করার সময় মনোযোগ কই থাকে তোমার!অঘটন না ঘটাইলেই না!”
বর্ণের বিচলিত রূপ আর শাসনসুলভ কণ্ঠে কিছুক্ষন পূর্বের ধারণা ঘুচে যায়।সামান্য ব্যথার মধ্যে অদৃশ্য স্বস্তি মেলে।অজান্তে মুখে হাসি ফুটলে বর্ণ বলে উঠে,
“পাগল হইয়া গেছো?গরম চা হাতে ফালায় আবার হাসো! জ্বিনে ধরছে?”
অন্বেষা মাথা দুলিয়ে না সূচক ইঙ্গিত করলো।হাতে পানি দিয়ে চা আর কিছু বিস্কিট পরিবেশন করে।জীবন বললো,
“আমি নতুন কাম খুঁজতাছি বুঝছস।সামনের সপ্তাহে চলিস আমার লগে।দুই ভাই মিলা যামু নে”
বর্ণ তুচ্ছ হাসে।বলে,
“তোর অতি দরদী স্বভাবটা গেলো নারে জীবইন্না!”
“যাবি কিনা?”
“লইস”
খুনসুটিতে মেতে উঠলো বর্ণ আর সুদীপ্তার মেয়ে।শান্ত মেয়েটা খিলখিল করে হাসছে বর্ণের সাথে।আলাপ আলোচনার মধ্যে বর্ণ সুদীপ্তার মেয়ের উদ্দেশ্যে বলে উঠে,
“এই তুমি আমারে বিয়া করবা?”
সুদীপ্তার মেয়ে লজ্জায় মুখ ঢেকে নিলো।তারপর মাথা দুলিয়ে বললো,
“না না”
বর্ণ আবার বলে উঠে,
“আরেহ করো না বিয়া!তোমারে চকলেট কিনা দিমু।”
“না না তুমি বুড়ো।আমি তোমাকে বিয়ে করবো না।”
অন্বেষা হেসে জবাব দেয়,
“ঠিক!বুড়ো লোককে বিয়ে করতে নেই।”
সারাদিনের ধকলে প্রায় অচল অন্বেষার দেহ।বর্ণ বিছানা সম্পূর্ণ দখল করার পূর্বেই পিঠ ঠেকিয়ে শুয়ে পড়েছে।দুর্বল লাগছে।ক্লাস,অফিস,রান্না যেকোনো একটা কাজ বাদ দেওয়া যেতো?তাহলে হয়তো ক্লান্তি কমতো।তার উপর জুড়েছে সংসার এর কাজ।ভার হয়ে আছে মাথা।পরিশ্রান্ত চোখজোড়া বুঁজে অন্বেষা।মিনিট দশেক পরই চুলে টান পড়লো।বিরক্তির নিঃশ্বাস ফেলে পাশে চাইতেই দেখে বর্ণকে।বুকে ভর দিয়ে শুয়ে আছে।মুখ ফেরানো অন্বেষার পাশে। কেশ থেকে গিট বাঁধছে কখনো আবার খুলে দিচ্ছে।অদ্ভুত কর্মকাণ্ড তার।যেনো কোনো নাদান শিশু।
অন্বেষা বললো,
“খাবার গরম করে খেয়ে নিও।আমার ক্লান্ত লাগছে….”
“একলা একলা খাইলেতো আবার খোটা দিবা”
ক্লান্ত সুরে অন্বেষা জবাব দেয়, “দিবো না”
“তুমি দেহি দুইদিন সংসার কইরা আইলসা হইয়া গেছো।আমার মনে হয় আরেকটা বিয়া করাই লাগবো!”
“তোমারতো আবার প্রেমিকার অভাব নেই।আফজাল চাচার স্ত্রী তোমার ডার্লিং।গলিতে দাঁড়িয়ে হাতে আঙুলে ওড়না পেঁচানো প্রেমিকাও আছে। আবার সুদীপ্তা দিদির নাবালক মেয়েকেও তোমার বিয়ে করার ইচ্ছে।মনে রেখো!ঘরের বাহিরে রমণীরা ঘরের বাইরেই থাকে।ঘরে থাকে ওয়ান এন্ড অনলি বউ!সেই রানী,তারই রাজত্ব সবখানে।”
বর্ণ ফিক করে হেসে উঠলো।এই কথায় হাসির কি আছে বুঝে উঠতে পারলো না অন্বেষা।কপাল কুঁচকে কিঞ্চিত রেগে চেয়ে আছে।বর্ণ তার রাক্ষসী হাসি থামিয়ে বলে,
“ফকিরনীর ঘরে আবার রানীগিরী মারাইতে আইছে!”
অন্বেষা হেয় করে বলে উঠলো,
“হ্যা! তুমিইতো বলো, তুমি এসেছো খালি হাতে রাজত্ব করতে।যেহেতু তুমি রাজা আমি ওই হিসেবে রানী তাই না?রাজা রানী হতে অঢেল সম্পদের দরকার পড়ে না।”
“বাংলা ছায়া ছবির ডায়লগ কম মারো।”
“সে নাহয় কম মারলাম।কে তোমাকে বিয়ে করে দেখে নিবো”
বর্ণ দেখলো অন্বেষার হিংসেমীতে ভরা মুখমণ্ডল।রেগে আগুন হয়ে উঠছে।ঠোঁট কামড়ে হাসলো বর্ণ।এইতো সুযোগ আরো যন্ত্রণা দেওয়ার। আয়েশী ভঙ্গিতে বলে উঠে,
“আমি মিষ্টি জাতীয় প্রাণী আমারে দেখলেই মাছিরা ফিট হইয়া যায় বুঝলা।এসব তিন চারটা বিয়া আমার বায়ে হাতের খেল।”
“কেন?পানির বদলে চিনির শিরায় ডুব দাও নাকি?
“ঐটার দরকার পড়ে না।”
“ঠিক আছে।তবে এটাও মনে রেখো আমি মাছি না লাল পিপড়া।কামড়ে মাংস তুলে ফেলবো”
বর্ণ ভুল অর্থ বের করলো অন্বেষার কথার।সামান্য ঝুঁকে এসে সন্দিহান তেরছা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
“নেস্টি!”
অন্বেষা বর্ণের মাথার বালিশ টেনে নিলো নিজের দিকে।তাকে জ্বালানোর দায়ে একদিন বালিশ ছাড়া ঘুমোলে তেমন কোনো ক্ষতি হবেনা।বর্ণ অন্বেষার পরিকল্পনাকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে অন্বেষার হাতের উপরে আরামে মাথা রাখলো।পাতলা পুরোনো কম্বলে পেঁচিয়ে ধরে বললো,
“বালিশের চেয়ে তোমার হাত নরম।এটা আজকা থিকা আমার পার্মানেন্ট বালিশ”
“ঘেষাঘেষি করবে না বলে দিচ্ছি!দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার।”
“না সোনা স্বামীরে এভাবে দূরে সরায় দিলে পাপ হইবো।দেখো আমি কত সোহাগে তোমারে জড়ায় ধইরা আছি।”
অন্বেষা রেগে বলে উঠে,
“গন্ধ তোমার শরীরে।দুর হও!”
বর্ণ মাথা দোলায়।আরো শক্ত করে জাপ্টে ধরে বলে উঠে,
“সোয়ামির গায়ের দুর্গন্ধও ফুলের সুবাসের মতো।এমন করতে নাই পাখি।”
চেপে ধরে আছে অন্বেষাকে।সুযোগ পেলে একদম হাতছাড়া করেনা।শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে অন্বেষার।হাত পা চালিয়েও কোনো লাভ হলো না।পুরুষালি শক্তির কাছে পেরে উঠা দায়।তাছাড়াও ভীষণ দুর্বল;ক্লান্ত দেহ।কোনো রকমে।মিনিট দশেক পর অন্বেষা বললো,
“যেদিন আমায় ভালোবাসবে?সেদিন থেকে সারাদিন জড়িয়ে ধরে রাখলেও আমি কিছু বলবো না। এখন এসব ঢং বাদ দিয়ে খাবার গরম করে খেয়ে নাও।দোহাই লাগে!”
বর্ণ স্তব্ধ হলো অজান্তে।অন্বেষার রাগে ভরা কপোল কৃষ্ণচূড়ার পুষ্পিত শিখার ন্যায়।দৃষ্টিতে যেন দাবানলের প্রজ্জ্বলন।স্থির গোলাকৃতির বিশাল চোখে শাসিয়ে যাচ্ছে বর্ণকে।বর্ণর হাতদ্বয় দৃঢ়ভাবে চেপে আছে তাকে।তার গভীর চোখে ধরা পড়েছে নিগূঢ়তা।হঠাৎ দেহখান সমস্ত বল ছেড়ে দিলো কেনো?রাগান্বিত মুখের অভিব্যক্তি দেখে কেউ কিভাবে নীরব থাকতে পারে? এ কেমন অনির্বচনীয় বন্ধন যা তাদের মধ্যে বিরাজমান?কিছুটা অগোছালো,অনেকটা গুরুত্বহীন।মহাসাগরের অতল গহ্বর,নির্বিচার ঝড়ের প্রলয়।অন্বেষাকে কিংকর্তব্য বিমূঢ় করে দিয়ে ঝড়ের অন্বেষার গালে অধর ছুঁয়ে দেয়।অন্তরের নিত্যনতুন ঢেউ আড়াল করতে নিজের চিরচেনা ভঙ্গিতে ফিরে এলো বর্ণ।অন্বেষার মাথায় হাত চাপড়ে দিয়ে বলতে লাগলো,
“চুম্মা দিছি।এবার মাথাটা ঠান্ডা করো। দেহো ধোঁয়া বাইর হইতাছে।চুল পুইড়া টেকো বউ হইলে কিন্তু ঘেঁটি চিপ দিয়া ঘর থিকা বাইর কইরা দিমু”
চলবে…….....................