দুপুরের তীব্র রোদে মুখরিত চারপাশ। রোদ্দুরের তাপে দগ্ধনীয় শহর। ক্লান্তিতে গা চুইয়ে ঘাম ঝড়ছে রাস্তাঘাটে অবস্থানরত মানুষগুলোর। আর এই দগ্ধনীয় প্রকতির ভিড়ে তীব্র রোদের মাঝে হাতে ছেঁড়া জুতো নিয়ে খালি পায়ে হাঁটছে ফাবিহা। বিরক্তি আর পায়ে তীব্র ব্যাথা অনুভব হচ্ছে তার। তবুও সে হাঁটছে। ফাবিহার একটা সমস্যা হলো সে তীব্র রোদ সহ্য করতে পারে না। গায়ে জ্বালা করে। এছাড়া গরমাক্ত পিচঢালা রাস্তায় খালি পায়ে হাঁটার কারণে তার পায়ে জখম হয়েছে। ফোস্কা ফুটে যাচ্ছে তাই অবস্থা। আশেপাশে কোনো রিকশাও নেই যে যাতে চড়ে ফাবিহা বাড়ি যাবে। ফাবিহার হঠাৎ কান্না পাচ্ছে। বাড়ি কি করে যাবে ভেবে পাচ্ছে না! পায়ের যে করুণ অবস্থা ঠেকছে তাতে করে আর বেশিদূর হাঁটাও যাবে না। ফাবিহার মনে হয় আজকের দিনটাই খারাপ। সে অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। আজ তার একটা গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস ছিল কিন্তু ভার্সিটি এসে জানলো স্যার কোনো এক কারনে ক্লাস নিতে পারবেন না। ফাবিহার এমনিতেও ক্লাস করতে ওতটা পছন্দ নয়। তবুও আজ এসেছিল। কতক্ষণ বন্ধুদের সাথে আড্ডাটাড্ডা করে বেরিয়ে এলো। ভেবেছিল কাছের এক পাবলিক লাইব্রেরিতে যাবে। কিন্তু আচমকাই জুতো ছিঁড়ে ঘটে গেল আকস্মিক ঘটনা। জুতোটা এমন বেকায়দায় ছিঁড়ল যে কোনোভাবেই পায়ে পড়ে আসা যাচ্ছিল না। ফাবিহা নিরাশ হয়ে জুতো হাতে নিয়েই হাঁটা শুরু করল। পুরো রাস্তায় রিকশা খুঁজেছে কিন্তু কোথাও কোনো রিকশা নেই। ওদিকে অসহ্য গরমে তার শরীর বিষিয়ে উঠছিল। পায়ে ফোস্কা পড়ে ইতি মধ্যে ফেটেও গেছে।"
ফাবিহা আর হাঁটতে পারল না। সে রাস্তার ওপাশের একটা বড় গাছের গোঁড়ায় বসল। তার বড্ড অসহ্য লাগছে। মনে হচ্ছে এখনই জ্ঞান-ট্যান হারিয়ে বিচ্ছিরি কান্ড ঘটিয়ে ফেলবে। জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলল দ্রুত। আজ তাড়াহুড়োর চক্করে ছাতা আনতেও ভুলে গেছে। চটজলদি ব্যাগ থেকে পানির বোতলটা বের করে ঢকঢক করে পানিটা গিলল। কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। ফোনেও ব্যালেন্স নেই যে কাউকে ফোন করে বলবে, আসতে। ফাবিহা তার পায়ে হাত দিল। জায়গাটা অসম্ভব জ্বলছে। এতটুকু সময়ের মধ্যে এতটা ক্ষত হয়ে যাবে বুঝতে পারেনি। নির্জন পরিবেশ। তীব্র রোদে খাঁ খাঁ করছে সব। বিশাল পিচঢালা রাস্তায় দু'একটা বড় গাড়ি ছুটে যাওয়া ছাড়া কিছুই নজরে পড়ছে না। ফাবিহা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নিরাশ হয়ে বসে রইল। হঠাৎ কারো কণ্ঠে শোনা গেল। পুরুষালীর ভাড়ি কণ্ঠে শুধাল কেউ,
“আপনি কি কোনো সমস্যায় আছেন?”
আচমকাই কণ্ঠটা কানে বাজতেই চমকে উঠল ফাবিহা। তক্ষৎণাৎ সামনে তাকাল। দেখল, কালকের ছেলেটা। কি যেন নাম?– হ্যাঁ, আরহান। ফাবিহা বিষম খেল। ততক্ষণে তার মুখোমুখি বসে পড়েছে আরহান। তার আবারও প্রশ্ন,
“কি হলো কথা বলছেন না কেন?”
ফাবিহার অসস্তিকর চেহারা। থমথমে মুখ। চোখের পলক বারকয়েক ফেলা শেষ। আরহান অবস্থাটা বুঝল। আশ্বাস দিয়ে বলল, “আমরা তো একেবারেই অপরিচিত নই, সমস্যায় থাকলে আমাকে কিন্তু বলাই যায়।”
ফাবিহার উসখুস চাহনি। কণ্ঠনালি কোথাও যেন আটকে যাচ্ছে। আরহানের আঁখি অধীম আগ্রহে তাকিয়ে আছে। কিছু শোনার অপেক্ষা। ফাবিহা বুঝতে পারল। বহু কষ্টে শুধাল,
“আসলে তেমন কোনো ব্যাপার নেই।”
আরহানের বিশ্বাস হলো না। সে তড়িৎ প্রশ্ন করল,
“তাহলে এই রোদ্দুরের মধ্যে বসে আছেন কেন?”
ফাবিহা ভাবল সত্যিটাই বলবে। এমনও তো হতে পারে ছেলেটা তাকে সাহায্য করল। এভাবে ভরদুপুরে মাঝরাস্তায় গাছের তলায় একা একা থাকাটাও তো সুরক্ষিত নয়। ফাবিহার কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে আরহান আর ঘাটল না। হয়তো তাকে বলতে চাচ্ছে না। আরহান বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। বলল, “আপনি যেহেতু কিছু বলতে চাচ্ছেন না তাহলে আমারও বসে থেকে কাজ নেই। তবে বলব বাড়ি যান। এভাবে ভরদুপুরে একা একা রাস্তাঘাটে থাকা ঠিক নয়।”
আরহান যেতে নিলে সঙ্গে সঙ্গে ডেকে ওঠে ফাবিহা,
“শুনুন।”
আরহানের পা থেমে গেল। সে পুনরায় এগিয়ে এসে বলল, “জি বলুন।”
ফাবিহার সংকোচতা কাজ করছে। আরহান বলল,
“ভয় নেই, আমি খারাপ মানুষ নই।”
“না না ব্যাপারটা তা নয়।”
“তাহলে,
“আপনি কি আমায় একটা রিকশা ডেকে দিতে পারবেন? আসলে আমার জুতোটা ছিঁড়ে গেছে, খালি পায়ে রোদ্দুরে হাঁটার কারণে আমার পায়ে ফোস্কা পড়ে জখম হয়েছে।”
এতক্ষণ পর আরহানের নজরে আসলো ফাবিহার পা৷ ডান পায়ের তলিতে ফোস্কা পড়ে লালচে হয়ে গেছে। আরহান আচমকাই হাত দিতে নিল ফাবিহার পায়ে। কিছুটা কাছে এগিয়েও দ্রুত সরিয়ে নিল। খানিকটা বিচলিত কণ্ঠে বলল,
“আমি কি আপনার পা স্পর্শ করতে পারি?”
তড়িৎ বুক কেঁপে উঠল ফাবিহার। যদিও আরহান ভয়ংকর কিছু বলেনি। তবুও কেমন যেন ঠেকল। একটু ভিন্ন রকম। সে বলল,
“পায়ে স্পর্শ করাটা কি খুব জরুরি?”
“আপনার অনুমতি না থাকলে আমি ধরব না, কিন্তু আমার কেন যেন মনে হচ্ছে আমার স্পর্শ করাটা খুব জরুরি।”
ফাবিহা আঁটকে পড়ল। এবার কি বলবে? হ্যাঁ বলবে নাকি না। চরম দোটানায় পড়া গেল। আরহান আচমকাই হেঁসে ফেলল। চমৎকার দেখাল সেই হাসি। ফাবিহা চেয়ে রইল। প্রশ্ন করল,
“হাসছেন যে?”
“এই যে আপনি আমায় একটু বিশ্বাস করতে পারছেন না। মনে করছেন পা ছুঁইলেই, হাত না ধরে বসি।”
ফাবিহা লজ্জায় মিইয়ে গেল। মাথা নিচু করে বলল,
“ধরুন।”
“কোনটা ধরব পা নাকি হাত?”
ফাবিহার চোখ রাঙানো চাহনি। আরহান হেঁসে বলে,
“মজা করছিলাম। মনে নিবেন না কথাটা। একজন জ্ঞানী মানুষ বলেছিলেন মাঝে মাঝে মানুষের সাথে মজা করতে হয়।”
“তাই নাকি তা কোন জ্ঞানী মানুষ বলেছিলেন এই কথা?”
“কে আবার– আমি।”
বলেই হেঁসে ফেলল আরহান। ফাবিহাও হাসল। আরহান দ্রুত স্বরে 'সরি' বলল। এরপর হাত রাখল ফাবিহার পায়ে। জখমের জায়গাটা ভালো মতো দেখল। আশেপাশে কোনো ফার্মেসিও দেখা যাচ্ছে না। আরহান বলল,
“আপনি এমন একটা জায়গায় এসে আহত হলেন যে আমাদের কিছুই করার নেই।”
“কিছু করতে হবে না। শুধু একটা রিকশার ব্যবস্থা করে দিতে পারলেই হবে আমি বাড়ি গিয়ে মলম লাগিয়ে নিব।”
আরহান আর ভাবল না। পকেট থেকে ছোট্ট একটা রুমাল বের করল। বলল,
“আপনার কাছে পানি থাকলে এটা ভিজিয়ে ভালো মতো চিপকে পায়ে বেঁধে নিন। সাময়িক আরাম পাবেন। আমি দেখছি রিকশা পাওয়া যায় কিনা।”
আরহান উঠে গেল। দিয়ে গেল নিজের রুমাল। ফাবিহা কিছুক্ষণ রুমালটার দিকে তাকিয়ে থেকে আরহান যা বলল তাই করল। খানিকটা আরামও মিলল বুঝি।'
কাঠফাটা রোদ্দুরে আরহান দাঁড়িয়ে আছে। দূরদূরান্তে কোনো কিছু আসার নাম গন্ধ নেই। যাও আসছে তাও খালি নয়। আরহান নিশ্বাস ফেলে দাঁড়িয়ে রইল। তীব্র রোদে কপাল চুইয়ে ঘাম পড়ছে। হঠাৎ নজরে আসলো একটা রিকশা। আরহানের ঠোঁটে ফুটল এক চিলতে প্রশান্তির হাসি। একটা চিকনা মতো রোগা পাতলা ছেলে মমতাজের বুকটা ফাইট্টা যায় গানটা গাইতে গাইতে এগিয়ে আসছে। তবে নিজের মত করে গাইছে,
“বান্ধুবী যখন জামাই লইয়া,
আমার রিকশার পাশ দিয়া হাইট্টা যায়,
ও বুকটা ফাইট্টা যায়।”
আরহান দ্রুত ছুটে গিয়ে গানের মাঝখানে বলল,
“রিকশা ভাই, ফাটাফাটি পড়ে করেন আগে আমারে সাহায্য করেন।”
রিকশাচালক রিকশা থামাল। বলল,
“কি সাহায্য করতাম?”
“রিকশায় কইরা বাড়ি পৌঁছাইয়া দিতেন।”
“ও আইচ্ছা আহেন। কই যাইবেন?”
আরহান তার কাঙ্ক্ষিত স্থানের নাম বলে বলল,
“আমি যাবো না। অন্য আরেকজনকে পৌঁছে দিতে হবে।”
“ব্যাপার না, নিয়া আহেন।”
আরহান দ্রুত ফাবিহার দিকে এগিয়ে গেল। ফুটপাতের রাস্তা তার ওপাশে বড়গাছের নিচে ফাবিহা বসে আছে। আরহান দ্রুত গিয়ে বলল,
“উঠুন রিকশা পেয়ে গেছি।”
ফাবিহা তাকাল। সত্যি সত্যিই রিকশা দেখে আস্তে করে উঠে দাঁড়াল। আরহান বলল,
“ফোস্কা পড়া পায়ে বেশি চাপ দিবেন না। কাপড় আটকে গেলে পরে ছাড়াতে কষ্ট হবে।”
ফাবিহা মেনে নিল। ডান পা উঁচকিয়ে হাঁটতে লাগল সে। আরহানের ধরে সাহায্য করার ইচ্ছে থাকলেও করল না। কিন্তু বিপত্তিটা বাজল রিকশায় ওঠার সময়। ডান পায়ে ভর না করে ফাবিহা উঠতে পারছে না। কোনো না কোনো ভাবে পায়ে চাপ লাগবেই। আরহান কিছুক্ষণ বিষয়টা লক্ষ্য করে। তার দেরি হচ্ছে। তারওপর এত গরমে টেকা যাচ্ছে না। সে আচমকাই ফাবিহাকে কোলে তুলে নিল। ফাবিহা হতভম্ব হয়ে গেল। আরহান দ্রুত ফাবিহাকে রিকশায় উঠিয়ে দিয়ে বলল, “দুঃখিত।”
ফাবিহা কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল,
“পা ছোঁয়ার সময় পারমিশন নিয়ে ছিলেন এটার বেলায় তো নিলেন না।”
আরহান এক চিলতে হেঁসে। অনুতপ্ত নিয়ে বলল,
“আমি ব্ড্ড অধৈর্য্যশীল মানুষ রৌদ্রময়ী, প্রথম বেলায় ধৈর্য্যটা আঁটকে রাখতে পারলেও দ্বিতীয়টায় আর পারলাম না। আমি খুবই দুঃখিত।”
.
.
.
চলবে..........................................................................