উন্মুক্ত লাইব্রেরী
পর্ব ২৮
আয্যাহ সূচনা
পৌষের অন্তিম প্রহরে পুরান ঢাকার অলিন্দে সাকরাইনের উচ্ছ্বাসে জাগ্রত হয়েছে কালের গৌরবময় স্মৃতিরাজি। আকাশে ওড়া ঘুড়ির সূক্ষ্ম সুতোর বাঁধনে অঙ্কিত এই রঙিন ক্যানভাস।প্রাচীনতার শ্যামলিমায় আচ্ছাদিত। সন্ধ্যায় আতশবাজির অপার রঙিন বিস্ফোরণ। এ যেন এক আলোকচ্ছটায় মিশিয়ে দেয় ঐতিহাসিক গাথা। প্রতিটি ঘরের ছাদে ফুটে ওঠে ঐতিহ্যের সুধা।বয়ে আনে প্রজন্মান্তরের অন্তঃসলিলা স্মৃতিধারার নিবিড় স্পর্শ।
পুরান ঢাকার মানুষ উৎসবে আজ বিভোর। ছেলেরা ঘুড়ির সুতো বাঁধতে ব্যস্ত আর কেউ রং মাখাচ্ছে সুতোয়। এ যেনো কোনো আনন্দের প্লাবন।বাড়ির ছাদে ছাদে জমেছে বৈচিত্র্যের পসরা।ঘরের গিন্নীরাও বসে নেই।নানান পদের পিঠা তৈরি এবং খোশগল্পে সেজেছে তাদের আড্ডাখানা।
বর্ণ বিশাল ব্যস্ত।এই ঠান্ডায় গোসল সেরে তৈরি।গতকালের আলাপ দীর্ঘ করতে চায়নি সে।বিরক্ত হচ্ছিলো ভীষণ।অন্বেষাকে ডেকে বললো,
“যাইবা না?”
অন্বেষা অবাক সুরে প্রশ্ন করে, “কোথায়?”
“আরেহ মিয়া আজকা সাকরাইন। ঘুড্ডি উড়ামু। প্রতিযোগিতা আছে।জিতলে নগদ দশ হাজার ট্যাকা।”
অন্বেষা উৎসুক হয়ে বললো, “ বাহ! বেশতো।”
“বেশ বুশ বাদ দিয়া রেডি হও।”
অন্বেষা আর কথা বাড়ায়নি।এক এক করে কাপড় বের করে খুঁজে নিয়েছে একটি সাদা রঙের কামিজ তার সাথে লাল রঙের ওড়না।দ্রুত গোসলখানায় গিয়ে কাপড় পরিবর্তন করে ফিরে এলো।নাটাই নিয়ে ব্যস্ত থাকা বর্ণের সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
“চলো”
বর্ণ মুখ তুলে চায়।এত দ্রুত কাপড় বদলে হাজির হওয়াটা অবাক করছে তাকে।মুখে কোনো সাজসজ্জা নেই।শুধু কাপড় পরিবর্তন করেছে।বর্ণ তেমন মাথা ঘামালো না সেটি নিয়ে। গুরুত্বহীন ভঙ্গিতে শুধু বললো,
“শাল লও।বাইরে ঠান্ডা অনেক।”
বর্ণের কথামত খুঁজে খুঁজে পুরোনো একটি শাল বের করে গায়ে জড়ায়।দুজনেই বেরিয়েছে। সাব্বিরদের পাশের বাড়ির ছাদে ঘুড়ি প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে।
অন্বেষার হাত ধরে উপরে আসতেই আরেক ছাদে দেখা মিললো জনির।তার পাশের ছাদে সাদিয়াও রয়েছে।পরিস্থিতি অস্বাভাবিক হওয়ার পূর্বেই বর্ণকে পাশে এনে অন্বেষা বললো,
“দেখো বর্ণ।যা হওয়ার অতীতে হয়ে গেছে।আমার মনে হয় ক্ষ্যান্ত দিয়ে দাও।অমানুষের সাথে মুখ নষ্ট করতে নেই।”
বর্ণ ডান দিকের ভ্রু উঁচু করে সন্দিহান গলায় প্রশ্ন করে,
“ক্ষ্যান্ত দিমু?”
অন্বেষা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জবাব দিলো,
“যে নিজের রক্তের মূল্য দিতে পারেনা তাদের দিয়ে তুমি ভালো কিছু আশা করো?ওরা খারাপ।তোমার খারাপ করতে এক মুহুর্ত ভাববে না।তোমাকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে যার বাঁধে নি তখন এখনও তার কিছুই আসবে যাবে না।……কিন্তু আমি? আমার তুমি ছাড়া কেউ নেই।”
মানতে নারাজ ছিলো বর্ণ। অন্বেষা যা যা বলবে সবটাই নাকচ করার চিন্তা পোষণ করে রেখেছিল।শেষ কথাটায় দমে গেলো। অন্বেষা আবার বললো,
“ওরা তোমার কোনো ক্ষতি করে ফেললে আমার কি হবে?আমার জন্য অন্তত!”
বর্ণ ভাবলেশহীন জবাব দিলো,
“এতদিন কিছু করতে পারে নাই এহনও পারবো না।আমি যদি আমার হক চায়া বই মোকলেস মাতবরের গুষ্টি রাস্তায় নামবো।”
অন্বেষা দুদিকে মাথা দুলিয়ে বলে,
“দরকার নেই ওসব ছাইপাঁশ সম্পদের।আগুন দাও ওসবে।আমরা আমাদের মত দিব্যি থাকবো।”
মাঝেমধ্যেই অন্বেষার কথার জবাব দিতে ইচ্ছে হয়।কখনো দীর্ঘ সংলাপে যেতে ইচ্ছে হয়।কিন্তু কোথাও কোনো এক বাঁধা আছে।নিজেকে পুরোপুরি রূপে উন্মুক্ত করতে পারেনি বর্ণ।তবে করছে!করতে চাইছে। অন্বেষার ভালোবাসার খোলামেলা আহ্বান তাকে ভাবায় মাঝেমধ্যে।কিছুক্ষন চেয়ে রইলো।পরপর চোখ নামিয়ে নেয়।ঠান্ডা নিবারণের জন্য একপাশে আগুন জ্বালানো হয়েছে। অন্বেষাকে চেয়ার টেনে সেখানে বসিয়ে দিলো। বললো,
“এদিক ওদিক ঘুরাফিরা করবা না।চোখে চোখে থাকো”
শুরু হলো ঘুড়ি উৎসব। বিকেলের প্রহর নেমেছে আকাশ জুড়ে।আর রং বেরঙের ঘুড়ির মেলা।যেনো কোনো ক্যানভাসে ইচ্ছেমত রং ছড়াচ্ছে লোকে।
অন্বেষা বর্ণের দিকে চাইলো।খুব প্রিয় তার ঘুড়ি উড়ানো।ব্যস্ততা আর উত্তেজনা সেটারই জানান দিচ্ছে।এত কিছুর মাঝেও চোখে চোখ পড়েছে।মাথা উঁচু করে ঘুড়ির দিকে সম্পুর্ণ মনোযোগ রাখলেও অন্বেষা রয়নি গুরুত্বহীন।তার দিকেই খেয়াল দিচ্ছে ঘুরে ঘুরে।
সাব্বিরকে ডাকলো বর্ণ।পকেটে বিশ টাকা ছিলো।সেটি সাব্বিরের হাতে ধরিয়ে দিয়ে নিচু গলায় বললো,
“তোর ভাবিরে এক কাপ চা আইনা দে”
সাব্বির বন্ধুর হাতে নাটাই ধরিয়ে দৌঁড়ে গেলো।যেই গতিতে গিয়েছে সেই গতিতে ফিরেও এসেছে। অন্বেষার হাতে চা ধরিয়ে বললো,
“ভাবিইইইইই চা খান”
অন্বেষা ফিক করে হেসে ফেলে এরূপ সুরেলা ডাকে। সাব্বিরের কান টেনে বলে,
“আপু থেকে ভাবি?”
“হ ভাবি কারণ ভাই কইছে তোর ভাবির লেইগা চা নিয়া আয়।এরমানে আমগো রিশতা সেট।আমি আপনি দেওর ভাবি।”
অন্যদিকে বিগত চার বছরের ন্যায় বর্ণ প্রতিযোগিতায় বিজয়ী।এবার যেনো তার চেয়ে বেশি খুশি অন্বেষা।লাফিয়ে উঠে তালি বাজিয়ে খুশি প্রকাশ করে।চায়ের কাপটা অর্ধ খেয়ে পাশেই রেখে দিয়েছে।আর দরকার নেই।অন্যদিকে বর্ণ হতবিহ্বল।খানিক লজ্জাবোধ করছে।কেনো সেটার উত্তর জানা নেই।মাথার পেছনে হাত রেখে মাথা নুয়ে সরে আসলো।
প্রতিযোগিতায় জিতে যাওয়া টাকা নিয়ে পকেটে গুঁজে বললো,
“আহো তোমারে বাড়িতে দিয়া আহি।”
“আরেকটু থাকি?” প্রতুত্তরে বলে উঠে অন্বেষা।
বর্ণ সরাসরি বলে উঠে,
“না এদিকে ডিজে পার্টি হইবো একটু পর।অনেক মানুষের ভিড় হইবো।”
“এটাইতো ভালো।আমি দেখবো সবকিছু।কত মজা হবে”
বর্ণ ভ্রু কুটি করে জবাব দেয়,
“পোলা মানুষের মেলে থাকা লাগবো না এতো।বাড়ির ছাদে উইঠা দেইখো।”
সেই মুহূর্তে সাব্বির দৌঁড়ে আসে।একটি কাগজের প্যাকেট এগিয়ে বললো,
“ভাবি এই নেন।”
বর্ণ জানতে চাইলো, “এগুলি কি ব্যাটা?”
“ভাইজান পিঠা।পুলি পিঠা আছে আবার ভাপা পিঠাও আছে।সবাই খাইতাছে আপনারা খালি মুখে যাইবেন গা?আমি আপনাগো লেইগা আলাদা প্যাকেটে কইরা আনছি।”
বর্ণ বাঁকা হেসে সাব্বিরের চুলে হাত বুলায়। পরক্ষণেই বললো,
“ওরে একটু বাড়ি পর্যন্ত দিয়া আয়।আমার একটু কাম আছে।…..আর হুন সন্ধ্যার দিকে মোল্লা হোটেলের সামনে খাড়াবি।”
“আচ্ছা ভাই”
কোথায় যাচ্ছে?কেনো যাচ্ছে প্রশ্নটাও করতে পারলো না অন্বেষা।এখন বর্ণের বাহিরে যাওয়ার কথা নয়।তার কাজ শুরু হবে আগামী মাস থেকে।প্রশ্ন করার পূর্বেই এক পলক চেয়ে ফুড়ুৎ বর্ণ।ঝড়ের গতিতে এক ছাদ থেকে অন্য ছাদে লাফিয়ে নিচে চলে গেলো।
অন্বেষা দুষ্টুমির ভঙ্গিতে সাব্বিরের উদ্দেশ্যে বললো,
“তোমার ভাই মনে হয় আগে বানর ছিলো”
“হ ভাবি খালি ফাল পাড়ে”
__________
হলদে বাতির টিম টিম আলোয় অন্বেষা বারান্দায় দাঁড়িয়ে বর্ণের প্রতীক্ষায়। শীতের ম্লানতা গ্রাস করেছে পরিবেশকে।কম্পন অঙ্গে।রাত নয়টায় এসে ঘড়ির কাঁটা থমকেছে।সেই গোধূলি লগ্নে বর্ণ বেরিয়েছিলো। কোথায় গেছে জানা নেই।এখনও সে বাড়ি ফেরেনি। ফোনে ব্যালেন্স নেই যে জিজ্ঞেস করবে।বিরক্ত হলো অন্বেষা।এতটা হেঁয়ালি করলে হয়?ঘরে যে একজন তার জন্য অপেক্ষায় আছে সেটা মনে আছে?
চারিদিকে ব্যাপক কোলাহল। আতশবাজি প্রদর্শনীতে আকাশ।গান বাজনার আওয়াজ।হৃদয়ে ব্যাকুলতা আর প্রতীক্ষার দাহ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অল্পতে ভীত হয়ে উঠে অন্বেষা।বর্ণের ব্যাপারে আজকাল বেশীই ভীত।প্রতিটি মুহূর্তে শীতের হিমেল বাতাসও স্বস্তি দিচ্ছে না।
ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরে আসার পাঁচ মিনিটের মাথায় পায়ের ধুপধাপ আওয়াজ ভেসে এলো।বর্ণ ফিরেছে।হাতে ব্যাগ। এসেই বলল,
“সাব্বির ছেমড়াটা আমারে রাস্তায় আধা ঘন্টা অপেক্ষা করাইলো। শ্যাহ!”
অন্বেষা প্রশ্ন করার পূর্বেই বর্ণ বলে উঠলো,
“বাজার আনছি।মুরগি রাইখা আইছি আফজাল চাচার ফ্রিজে।এইযে চাইল, ডাইল আর কিছু মশলাপাতি।সবজি কিনি নাই।নষ্ট হইয়া যায় যদি?টাকা রাখলাম বিছনার তলে।সবজি কিনা লইও।”
বর্ণের মাঝে নবীন উৎসাহের ঝিলিক দেখা দিলো। গভীর আগ্রহ প্রকাশ করছে সাংসারিক বিষয়ে।এই অভূতপূর্ব কৌতূহলে অন্বেষা খানিক চমকিত চোখে চেয়ে আছে।বর্ণ এগিয়ে আসে। অন্বেষার বাহু ঝাঁকিয়ে বলে,
“কিরে কালনাগিনী!আমারে সংসারের জঞ্জালে ফাঁসায় ভাল্লাগতাছে না অনেক?”
অন্বেষার ঠোঁটে হাসি ছড়িয়ে পড়ে।কথা সত্য! বেয়াড়া বর্ণ সংসারী হচ্ছে।হতে চেষ্টা করছে।বর্ণের বাহু চাপড়ে বললো,
“আম প্রাউড অফ ইউ মায় ম্যান!”
“বাল বড় বড় বাল!”
“অসভ্য!”
অন্বেষা বাজারের ব্যাগ তুলে ঘুরে হাঁটতে শুরু করলে বর্ণ আকস্মিক হাত টেনে তাকে পূর্বের স্থানে ফিরিয়ে আনলো।বিছানায় রাখা আরো একটি ব্যাগ অন্বেষার হাতে ধরিয়ে বাজারের ব্যাগ পাশে রেখে দেয়। অদ্ভুত শান্ত গলায় বললো,
“ছেড়ি মানুষের উপর আমি ভরসা করিনা।কোনদিন খোটা দিয়া বয়।”
অন্বেষা অবাক সুরে প্রশ্ন করলো, “কি?”
বর্ণ চোখ দিয়ে ইশারা করলো ব্যাগটির দিকে।খুলে দেখার জন্য ইঙ্গিত করে।অবাক অন্বেষা ধীর হাতে ব্যাগটি খুলে দেখে।লাল টকটকে একটি বেনারসি শাড়ি বেরিয়ে এলো। আশ্চর্যের চরম সীমায় আপাতত অন্বেষা।একবার বর্ণের দিকে আরেকবার শাড়ির দিকে দৃষ্টি বদল করছে। চরম বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলো,
“তোমার মনে ছিলো?”
লাল বেনারসিতে বউ সাজবার শখ।কথাটি অক্ষরে অক্ষরে মনে রেখেছে বর্ণ। অন্বেষার এই ব্যাকুল নয়ন দেখে থতমত খেয়ে যায় বর্ণ।ঠোঁট ভিজিয়ে বললো,
“আমার স্মৃতি শক্তি ভালো।এহন ঢং কইরো না। দেহো শাড়ি ভাল্লাগছে নাকি?ফুটপাত থিকা চুরি কইরা আনছি।”
এই খুনসুঁটিতে মেতে থাকা সংসারটা যেনো ভালো লাগার আস্তানা। জাঁকজমকহীন সুখ এখানে।ধীরেধীরে বোধহয় বর্ণও উপলব্ধি করতে পারছে।তাই ঝুঁকছে এখানে।দায়িত্ব নেওয়ার যথাযথ চেষ্টা করছে।
অন্বেষাকে ভীষণ খুশি দেখালো। তড়িঘড়ি করে শাড়িটি খুলে দেখে। বলে অতি আগ্রহী সুরে,
“এই আমি এটা এখন পড়ি?”
বিনিময়ে শুধু মাথা দুলিয়ে সম্মতি দিলো বর্ণ। বললো না তেমন কিছুই। সে যে অগোচরে নিজের মনের মধ্যে চেপে রাখা পাথর সরালো।নিজেকে মনে হচ্ছিলো অন্বেষার ঘাড়ে চেপে থাকা এক অকর্মা বোঝা। অন্বেষা চলে যাওয়ার পর বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়।মলিন মুখ আর নেতানো নেত্র তুলে তাকায় আসমানের দিকে।ভাবে, ‘ কত দ্রুত গতিতে পরিবর্তিত হয় জীবনের রং।যেখানে এক ঘোলাটে ভবিষ্যত ছিলো তার,সেখানে এখন এক উজ্জ্বল আলো জ্বলজ্বল করে।’
“দেখো কেমন লাগছে আমাকে?”
চন্দ্রের কাছ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আনলো বর্ণ।এক আগ্রহের প্রাচুর্যে পূর্ণ কণ্ঠে। অন্বেষার রক্ত লাল রঙে সাজানো বদনে দৃষ্টি স্থির হয়। অন্বেষার ঠোঁটে চওড়া হাসি।এগিয়ে এসে বললো,
“এই আমাকে কয়টা ছবি তুলে দিবে?আমি স্মৃতি হিসেবে রাখবো।”
বর্ণের নজর নীরব;চঞ্চল। অন্বেষার অম্লান হাসি। স্নিগ্ধতার ছড়াছড়ি সর্বত্র।আকস্মিক নিজেকে হালকা অনুভব করলো বর্ণ। উদ্ভাসিত মুখপানে চেয়ে হিম সুরে জিজ্ঞাসা করলো,
“অল্পতে এত খুশি কেন তুমি?”
কণ্ঠের গাম্ভীর্যে হাসি মিলিয়ে আসে অন্বেষার। অধরজোড়া কিঞ্চিত ফাঁকা হয়ে আছে।এটি বর্ণের স্বাভাবিক কন্ঠ নয়। অপ্রস্তুতভাবে জবাব দেওয়ার চেষ্টা করে বললো,
“অল্প কোথায়?..... এতো আমার জন্য....অনেক বেশি কিছু”
নিরুত্তর রয় বর্ণ। নিস্তব্ধতায় মিশে কদম ফেলে একেবারে কাছাকাছি এসে হাজির হলো।অদ্ভুত গভীর দৃষ্টিপাত করে অন্বেষার দিকে।সাহস করে চোখ তুলে অন্বেষা।বিভোর চক্ষুযুগল।যেনো কোনো স্বপ্নীল ঘোরের আভাস দিচ্ছে।শুকনো ঢোক গিলে চোখের পলক নামিয়ে নামিয়ে ফেলে।
বর্ণ আরো এগিয়ে এসে অবলীলায় আঁচল অন্বেষার মাথায় টেনে দেয়।
খাদে নামানো এক মোহগ্রস্ত কন্ঠ তার কানে ঝংকার তুলে,
“এবার সুন্দর লাগতাছে…..”
অন্বেষা আরো একটু জড়োসড়ো হয়ে পড়ে।এই মুহূর্তে লজ্জা গ্রাস করছে পুরোটাই।খুব উৎসাহ নিয়ে শাড়িটি পরনে জড়িয়েছিল।
দূরত্ব ঘুচিয়ে অন্বেষাকে নিজের বুকের সাথে জাপটে ধরেছে বর্ণ মুহূর্তেই। ধড়ফড়িয়ে উঠলো অন্বেষা। বর্ণের বুকে দুহাত রেখে পুরোপুরি সংকুচিত হয়ে গেলো।
“এক মন চায় এই ঠোঁটজোড়া ছুঁয়ে নাস্তানাবুদ হই।….আর…”
“আর?”
প্রশ্নটি করেও তৎক্ষনাৎ ঠোঁট কামড়ে ধরে অন্বেষা।গভীর কণ্ঠে জবাব আসে,
“আরেক মন সতর্ক করলো এই মাইয়া তোরে সারাজীবন প্রেম উত্তাপে জ্বালাইবো, পুড়াইবো।একদম ভস্ম কইরা দিবো”
অদ্ভুত এক সাহস সঞ্চিত হয় মনে।এই লোকটাকে সম্পূর্ণরূপে চাই তার। পড়ুক তার প্রেমে।ভস্ম হোক।শুধু তার হয়েই থাকুক।তেজি চোখজোড়া তুলে কম্পিত কণ্ঠে বলে উঠে,
“প্রেমে পুড়তে রাজি নাকি নারাজ?”
“পুড়তে পুড়তে খাঁটি সোনা হওয়া লাভ না লস?”
অস্থিরতা বাড়তে শুরু করে অন্বেষার।নিজের মনের উপরই কোনো নিয়ন্ত্রন নেই।অন্তর এই মুহূর্তে তাগাদা দিচ্ছে পালাবার।নয়তো বর্ণের এই রূপ তাকেই ঝলসে দিবে।এলোমেলো ভাবে বললো,
“বিরাট লস।দেখি আমি…..”
“ঠিক…আমার জীবনটাই লসের ঘানি টানতাছে।”
অন্বেষা ব্যাকুল নয়নে জানতে চায়,
“এখন উপায়?”
“উপায় নাই.... দিলাম ঝাঁপ আগুনে...”
বলে অন্বেষার অধরোষ্ঠ আঁকড়ে ধরে শক্তপোক্তভাবে।অধরের সন্নিধানে ছুঁয়ে যায় নিবিড় উন্মেষ।এক অধীরতম স্পন্দনের নিনাদ।তবে চারিদিক নিঃশব্দ। এ যেনো কোনো নীরবতার মহাকাব্য। বিরল এই স্পর্শে আকাঙ্ক্ষার কঠোর অভিলাষ জাগছে বিবর্ণের ধূসর হৃদগহ্বরে।ক্ষ্যান্ত দিলো মিনিট খানেক বাদে। অন্বেষাকে মনে হলো জ্ঞানশূন্য। দেহভার ছেড়ে দিয়েছে পুরোপুরি।
আকুল কন্ঠ তার উদ্দেশ্যে বলে উঠে,
“আমার….বুক ধড়ফড় করতাছে অন্বেষা!”
অন্বেষা শুনেও যেনো শুনলো না। সান্নিধ্যে হারিয়ে চলেছে নিজেকেই। কিভাবে ভরসার কাঁধ পেতে দিবে? অন্বেষাকে দ্রুত জড়িয়ে ধরলো।নিজেকে শান্ত করা উচিত বলে মনে হলো।প্রশ্ন করলো,
“তোমার কি খারাপ লাগতাছে?”
অন্বেষা চুপ রইলো কিছু সময়।এক সমুদ্রসম ব্যাকুলতা।প্রকাশ করবে কি করে?শুধু মাথা দুলিয়ে না বোধক জবাবটাই আসলো এই মুহূর্তে।
শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো আরো একটুখানি।এভাবে দাঁড়িয়ে পা ঝিমঝিম করছে অন্বেষার।মুখ ফুটে বলার মত অবস্থা নেই।বর্ণ অনুভব করলো শার্ট ভিজে যাচ্ছে তার।বুঝতে বাকি নেই এসব যে চোখের জল। বিচলিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলো,
“কি?..... কাঁন্দো কেন?...আমি কি ভুল….”
বর্ণকে দুহাতে পেঁচিয়ে ধরে অন্বেষা ক্রন্দনরত কণ্ঠে বলে উঠে,
“ভালোবাসি।”
“কিহ?”
“আমি…বিবর্ণকে তার নিজস্ব রূপেই ভালোবাসি”
স্পষ্ট শুনতে পেলো বর্ণ। মাথা তুলে সোজা হয়।দুহাতে অন্বেষার মুখ তুলে চাইলো তার দিকে। অন্বেষার কান্নার জোর বেড়ে গেলো যেনো। নাক মুছ কুচকে বললো,
“তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিবে?....ফিরিয়ে দিলে আমি কার কাছে যাবো?আমিতো চাই একটা ছোট সুখের সংসার।আমাদের দুজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।কেনো এমন করো বলোতো?আমার অনুভূতির দাম নেই। ভালোবাসতে পারো না আমাকে?কেনো পারো না?বলো?”
ফুলে উঠেছে নাক আর চোখ।বর্ণ হাসলো।চুপচাপ শান্ত থেকে ডান গালে চুমু খেয়ে বললো,
“নাহ পারিনা”
অভিমানের পাল্লা ভারি হলো। জেদি কণ্ঠে অন্বেষা প্রশ্ন ছুঁড়ে,
“তাহলে বিয়ে করেছো কেনো?আমি চলে যাবো…”
বর্ণ হেসে প্রশ্ন করে,
“কই যাইবা?আমার জানা মতে তোমার বাপের বাড়িও নাই”
অন্বেষা কাঁদতে কাঁদতে বললো,
“জানি না!যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাবো।এমন লোকের সংসার আমি করবো না। ঢং করে শুধু! আস্ত নাটকবাজ!”
“তুমি আসলে অনেক ধুরন্ধর একটা ছেমড়ি বুঝছো! শাড়ি পিন্দা আমারে ভুলায় ফুসলায় কাছে টানার ফন্দি করছো।এইযে এহন পিছলায় গেলাম!সকালে ঠান্ডা পানি দিয়া গোসল করার দোষ জানি আমার ঘাড়ে না চাপে কইলাম!”
শূন্যে ভাসমান অন্বেষা।খানিক বাদে পিঠ ঠেকলো শক্ত শয্যায়।উষ্ণ আলিঙ্গনের মত্ত হতে শুরু করে। অধীর চুম্বন আঁচড় কেঁটে যাচ্ছে দেহাবয়বে।যেনো বিবর্ণের স্নিগ্ধতার সুর। তার নতুন পাগলপ্রায় চরিত্রের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে।তার প্রণয়ের তলে একান্ত প্রেমের সমাহার।উন্মাদনা ছড়াচ্ছে অব্যক্ত অনুভূতিরগুলো। অন্বেষার ঘোরে ডুবে পাগলামি করছে।গ্লানির অতীত যেনো একেবারেই নিঃশেষ।উষ্ণতার কোলে খুঁজে পাওয়া সুরভিত সম্পূর্ণতা।প্রেমের উৎসবে সমবেত অন্তরের অন্তরাল।প্রেমের স্বর্গীয় এই নীরবতা প্রকৃতির ন্যায় হিম শীতল।ঠান্ডা পবন বারান্দা বেয়ে সম্পূর্ণ ঘর জুড়ে বিচরণ করছে।অবাক হয়ে চোখ বুজে শুধু অনুভব করলো অন্বেষা।বর্ণের চুলের গভীরে হাত ডুবিয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু ঝড়ায়। দীর্ঘশ্বাসের সহিত পূর্ণতাকে নির্বিকার চিত্তে ধারণ করছে।
শক্তিহীন অন্বেষা মনে মনে বলে উঠলো,
“বর্ণ পাগল….পুরোটাই পাগল…”
শৈত্যপ্রবাহ বইছে।বাহিরে কুয়াশার চাদরে ঢাকা সবটাই। বিদঘুটে অন্ধকার ঘরের মাঝে।বর্ণ কিছুটা ঘোর থেকে টেনে বের করে আনলো।এক কোণে অবহেলায় পড়ে থাকা লাল শাড়িটি সরিয়ে নিলো তৎক্ষনাৎ।জমিনে লুটোপুটি খাওয়া শার্ট তুলে গায়ে জড়িয়েছে।ভোর রাত্তিরে বুকে জড়িয়ে নিলো কুঁকড়ে যাওয়া অন্বেষাকে।নিজ হাতে তার মোটা সোয়েটার অর্ধজ্ঞান অন্বেষার গায়ে জড়িয়ে দিলো।ঢুকরে কান্নার আওয়াজ ভাসলে হুমকি আসে বর্ণের তরফ থেকে,
“কাঁনলে ধাক্কা দিয়া ফালায় দিমু।ঘুমাও চুপচাপ। সারাটা রাইত যন্ত্রণা করছো!একটা সেকেন্ডের লেইগা শান্তি পাই নাই।এটা বলে সুখী বিবাহিত জীবন আমার!”
জোরে জোরে নাক টানলো অন্বেষা।বর্ণ পরাজয় বরণ করলো মুহূর্তেই। অন্বেষার গায়ে ভালোভাবে কম্বল টেনে বুকে আঁকড়ে ধরে বললো,
“আচ্ছা ধমকামু না। জড়ায় ধইরা রাখছি। ঘুমাও।”
চলবে……....................