-“স্টক করছেন কেন? কী সমস্যা?”
থতমত খেয়ে গেল অরণী। তাকাল ডানে-বায়ে। এরপর নিজের দিকে। সবশেষে ইফতির দিকে। চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
-“আসার পথে ব্রেইন কি রাস্তায় ফেলে আসছেন? নাকি মলমপার্টিরা ‘দে দে’ বলে নিয়ে গেছে?”
তীব্র তেজমিশ্রিত ঝাঁজালো আওয়াজ শুনে ইফতি কেশে উঠল। সে কেন অমন কথা বলল, বিপরীতে মেয়েটা কী করে এমনটা বলতে পারল—ইফতি ভাবতেই পারছে না। পরিস্থিতিটা কাটিয়ে ওঠাও ইফতির দ্বারা সম্ভব হচ্ছে না। সে কী বলবে এখন? আবারও তাকাল সামনের মেয়েটির চোখে। সেই চোখের দৃষ্টি অসম্ভব দৃঢ়। জ্বলন্ত অগ্নি যেন, এখনই ভস্ম করে ছাড়বে!
ইফতি শ্বাস ফেলে বলল,
-“আমি মনে হয় পাগল হয়ে যাচ্ছি, যেখানে-সেখানে পাগলামো করে বেড়াচ্ছি।”
অরণীর কঠোরতা কিছুটা নেমে এলো। তবে গাম্ভীর্যের এক বিন্দুও সরল না। সেভাবেই বলল,
-“ডাক্তার দেখান।”
ইফতি অপমানিতবোধ করতে করতেও করল না। থমথমে গলায় বলল,
-“ঠিক আছে।”
বিপরীতে অরণী পাশ কাটিয়ে চলে গেল। এ-বার বেচারা ইফতি বহুকষ্ট পেল, সেই সঙ্গে অপমানিতও বোধ করল। এমন মেয়ের প্রতিই দূর্বলতা আসার ছিল তার? মেয়েটার ঝাঁজই তো সহ্য করে এগিয়ে যাওয়া যায় না।
অরণী বাসা থেকে বের হয়ে ক্যাম্পাসে গেল। সেখানে তাবাসসুমের সাথে দেখা হলো। তাবাসসুম এখন আগের মতো রসিকতা করলেও, অরণী প্রাণখুলে হাসে না। ওপরে ওপরে যা হাসে, তাতে দুঃখবোধটা তাবাসসুমের মধ্যেও এসে যায়। অরণীকে দেখেই সে এগিয়ে এসে বলল,
-“বন্ধু, জলিলুদ্দীন আমাকে প্রপোজ করেছে।”
অরণী কপাল কুঁচকে বলল,
-“এরপর?”
-“রিজেক্টেড।”
-“কেন? তোর না ক্রাশ?”
-“কচুর ক্রাশ আমার। ক্রাশ জিনিসটা আসলে পরিবর্তনশীল। আজ এখানে, কাল সেখানে, পরশু অন্যখানে। এভাবেই চলে।”
-“ওহ আচ্ছা।”
তাবাসসুম একহাতে অরণীকে জড়িয়ে ধরে বলল,
-“দোস্ত?”
-“বল।”
-“তুই কেমন আছিস?”
-“ভালো আছি। তুই ভালো?”
তাবাসসুম ছলছল চোখে তাকিয়ে বলল,
-“তোর দুঃখবোধ আমাকে কাঁদাচ্ছে। আমি ভালো থাকতে পারছি না কেন?”
অরণীর খুব খারাপ লাগল। সে অসহায় চোখে তাবাসসুমের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করতে পারল না।
_____
ফ্ল্যাটে আয়শা একাই আছে। মেয়ের জন্য আজ কিছু নাড়ু আর আচার বানাচ্ছে সে। পুরো ফ্ল্যাটটা গোছানো হয়ে গেছে। এই তিনমাসের অক্লান্ত পরিশ্রমে অরণী মায়ের সাথে মিলে সংসারটা সাজিয়ে ফেলেছে।
হঠাৎ কলিং বেল বাজায় আয়শা হাত ধুয়ে এগিয়ে যায় ওদিকে, দরজা খুলে সামনে তনুজাকে দেখে মুচকি হাসল সে। তনুজা নিজেও ঠোঁটে মিহি হাসি ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে ঠোঁট চেপে হেসে বলল,
-“ভেতরে আসতে পারি?”
আয়শা গালভরে হাসল,
-“নিশ্চয়ই।”
তনুজা ভেতরে চলে এলো। একটা ভালো সুঘ্রাণে সে আমোদিত হয়ে বলল,
-“আপু, কী বানাচ্ছেন?”
আয়শা তনুজাকে নিয়ে কিচেনেই চলে এলো। তারপর দেখাল কী কী বানাচ্ছে। তনুজা তাতে বলল,
-“আপনার রান্নার হাত ভীষণ ভালো। আপনি চাইলে কুকিং ক্লাস করাতে পারেন অনলাইনে। বর্তমানে কিন্তু খুব চলছে এসব। সব ধরনের সুবিধা হাতের নাগালে আছে। আমাদের উচিত কাজে লাগানো। আর আপনি যা রাঁধেন না! দু-তিনটে রেসিপিতেই ফলোয়ার কয়েক হাজার হয়ে যাবে দেখে নেবেন।”
আয়শা প্রশংসনীয় বাক্যে লজ্জা পেল। মেয়ে ছাড়া কোনোদিন কেউ তার প্রশংসা করেনি। বিয়ের পর তো যেন সবকিছু নিঁখুত করা শ্বশুরবাড়ির একটা দাবিই ছিল, একটু এদিক-সেদিক হলেই বরঞ্চ খোঁটা শোনা লাগত। সেখানে তার প্রচণ্ড ভালো কিছুতে কারো প্রশংসা, এটা চাহিদা থেকেই মুছে গেছিল অগোচরে।
তনুজা বলল,
-“পূজার ছুটিতে কলেজ অফ। একা একা লাগছিল, তাই আপনার কাছে চলে এলাম।”
-“ভালো করেছ। একা একা থাকা লাগে সারাদিন। তুমি এলে আমার ভালোই লাগে আর তোমার সঙ্গও আমার ভীষণ পছন্দ।”
তনুজা প্রশস্ত হাসল। আরও কিছুক্ষণের কথোপকথনে হুট করেই আয়শা জিজ্ঞেস করল,
-“তনুজা, আমি কি তোমাকে ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে পারি?”
তনুজা কিছুটা থমকাল, পর পর মাথা নেড়ে বলল,
-“অবশ্যই পারেন।”
আয়শা সময় নিয়ে শুধাল,
-“তুমি বিয়ে করোনি?”
তনুজা মিহি হাসল,
-“আপু, আমি ডিভোর্সি।”
আয়শা ব্যাপারটা কিছুটা আন্দাজই করে নিয়েছিল। সাধারণত বিবাহিত আর অবিবাহিত মহিলাদের মধ্যে কিছুটা দৈহিক গড়নের পার্থক্য থাকে। তনুজাকে দেখে বিবাহিতই মনে হয়। কিন্তু স্বামী যেহেতু নেই, তাই আয়শার ধারণাই ছিল এমন কিছু। কৌতূহল তার দমছে না। এদিকে আর কিছু জিজ্ঞেসও করতে পারছে না। তনুজা নিজ থেকেই তাই বলল,
-“আমার বিয়ে হয়েছিল সতেরো বছর বয়সে। ডিভোর্স তেইশ বছরে। তারপর মামার কাছে থেকে পড়াশোনা শেষ করি। একটা ভার্সিটির লেকচারার ছিলাম। কিছু বছর পর ওই জবটা ছাড়তে হয়। আর এখন এখানে চলে আসি।”
কী স্মুদলি নিজের জীবনের স্রোতের দিক অল্প কয়েকটা শব্দে জানিয়ে ফেলল। অবাক হয়ে আয়শা জিজ্ঞেস করল,
-“তোমার তো সুযোগ ছিল, আবার বিয়ে করোনি কেন?”
-“বিয়েই সব?”
আয়শা থতমত খেয়ে গেল,
-“না। কিন্তু আর কারো প্রতি ভালোবাসা আসেনি?”
-“এসেছিল।”
-“তবে?”
তনুজা চোখে হাসল,
-“ইমতিয়াজ তালুকদার শুদ্ধ। একটা নেশা, একটা আবেগ। একটা অদ্ভুত চিনচিনে সুখ, একটা হাসতে থাকা মুখ। কোঁকড়াচুলো ছেলের গজদাঁতের হাসি। ছেলেটা কথায় কথায় চুলগুলোয় হাত বুলিয়ে হাসত। সুখে হাসত, ব্যথায় হাসত, রেগে গিয়েও হাসত, অসম্ভব যন্ত্রণায় কান্না করার বদলেও হাসত। গান গাওয়ার ওপর প্রবল ঝোঁক ছিল, তারও অধিক ঝোঁক ছিল আমার ওপর। সে গান গাইতে ভালোবাসত, চিঠি লিখতে ভালোবাসত, প্রতিটি পঙক্তি আমাকে উৎসর্গ করে দুষ্ট হাসতে ভালোবাসত।
আমার প্রতি তার দূর্বলতা আমাকে অবাক করত প্রতিনিয়ত। যেই ভালোবাসা আমি আজন্ম চেয়ে এসেছি, সেই ভালোবাসা না চাইতেই এই ছেলেটা আমাকে দিয়ে ছেড়েছিল।”
আয়শা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনে গেল। তনুজাকে থামতে দেখে জিজ্ঞেস করল,
-“তবে তার মধ্যে কী সমস্যা ছিল?”
এক বুক যন্ত্রণার সাথে তনুজা হাসল,
-“সে আমার চেয়ে আটবছরের ছোট একটা পাগল ছেলে ছিল! আমার স্টুডেন্ট ছিল। আজ আমার ঊনচল্লিশ বছর। ছেলেটা পুরুষ হয়েছে, তার একত্রিশ বছর।”
একটা কাটা এসে বিঁধল আয়শার গলায়। হাঁসফাঁস লাগল তার। পৃথিবীতে ভালোবাসার মতো অসহায় জিনিস দ্বিতীয়টা হয় না। যার থেকে চাই তার থেকে পাই না, যে দিতে চায় তার থেকে নিই না। আশ্চর্য সব!
এমন সময় তনুজার ফোনে কল এলো একটা প্রাইভেট নাম্বার থেকে। সে ড্রয়িং রুম সংলগ্ন বারান্দাটিতে চলে এলো। কল রিসিভ করে কিছু বলল না, চুপচাপ বিপরীত ব্যক্তিটির কথা বলার অপেক্ষায় রইল। অথচ যেই লোকটা কল দিয়েছে, সেও কথা বলছে না। বড়ো বড়ো শ্বাস ফেলছে। সেই নিঃশ্বাসের শব্দ ভীষণভাবে শোনা যাচ্ছে। তনুজা আরও চুপ হয়ে গেল, থমকানো নজরে একদিকে তাকিয়ে রইল, নিঃশ্বাস ফেলতেও যেন ভুলে গেল।
ওপাশের ব্যক্তিটি আরও অস্থির হলো। এভাবে পাঁচ মিনিট কেটে গেলে সে অধৈর্য গলায় বলল,
-“আমি কি বাতাসের শনশন ভনভন আওয়াজ শুনতে কল দিয়েছি? একটু কথা বলেন, হ্যালোটাই অন্তত বলেন। শ্বাসও নিচ্ছেন নিঃশব্দে। কী চাইছেন? দমবন্ধ হয়ে মরে যাই? যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছেন, ফাইন! আমি মেনে নিয়েছি। কিন্তু মাঝে মাঝে একটু কল দিয়ে আপনার আওয়াজটাও শুনতে পারব না? সবসময় তো কল করি না। অমন করেন কেন?”
এ পর্যায়ে এসে পুরুষালি আওয়াজটায় বাচ্চামো আহ্লাদ শোনাল। তনুজা না হেসে পারল না। এ-পাশের হাসির শব্দ শুনতেই কলের ও-পাশে থাকা ভদ্রলোক একটা হার্টবিট মিস করল। বুকে হাত ডলতে ডলতে ডাকল,
-“মিস তনুজা?”
তনুজা দ্বিতীয়বারের মতো থমকে গেল। তার কাজই যেন আজ শুধু থমকানো। কথা তো বলছেই না। আওয়াজও করছে না। তারপর অনেক অনেক চেষ্টা করে সে বলতে সক্ষম হলো,
-“বলো, শুদ্ধ। কেমন আছ তুমি?”
নাহ! শুদ্ধ আর পারল না। বুকে হাত রেখে সোজা বেডের ওপর পড়ে গেল। সামান্য শব্দে তনুজা ভড়কাল, জিজ্ঞেস করল,
-“কী হয়েছে?”
এই কণ্ঠস্বরটা! এই পাষণ্ড মানুষটার গলার আওয়াজ শুদ্ধর কাছে কী, সেটা কীভাবে বোঝাবে তাকে? আজ কত বছর পর তনুজা তার নাম ধরে ডাকল? এই সুখে আগামী কয়েক ঘন্টা সে এভাবেই চিত হয়ে পড়ে থাকবে।
শুদ্ধকে কথা বলতে না দেখে তনুজা ডাকল,
-“শুদ্ধ?”
বুকে হাত রাখা অবস্থায় শুদ্ধ আবেশে চোখ বুজল,
-“মরে গেছি।”
______
অরণীর প্রতি দিনকে দিন ইফতির অনুভূতি বেড়েই চলেছে। এখন ইফতি এই বাসাতেই এসে থাকা শুরু করেছে। দূরত্ব যেহেতু কাছে টানছে। এবার কাছে থেকেই দেখবে। দেখা যাক, নৈকট্য দূরত্ব বাড়ায় নাকি সব ধরনের সংশয় মেটায়।
বারান্দায় বসে সিগারেট টানছিল ইফতি। অরণী ল্যাপটপ নিয়ে বারান্দায় আসতেই সিগারেটের ধোঁয়ায় কেশে ওঠে। আবার ফিরে যেতে নেবে, এমন সময় ইফতি ডেকে ওঠে,
-“কেশে কি মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাইছেন, আপু?”
অরণী কটমট করে তাকিয়ে বলল,
-“ডাক্তার দেখানোতে এত গাফিলতি কেন করেন, ইফতেখার?”
-“আপনি ডাক্তারি কেন পড়েননি? আপনার কাছেই দেখাতাম।”
-“আমি ডাক্তার হলে, আপনাকে সিগারেটের ছাঁই পানিতে গুলে ইনজেক্ট করতাম।”
-“এতে কি বিশেষ কোনো উপকার হয়, আপু?”
-“অবশ্যই হয়। এতে দুনিয়া থেকে পাগলের পরিমাণ কমে যায়।”
-“আমাকে মেরে ফেলার এত ইচ্ছা? তবে আসুন, ফ্ল্যাটে। গলা টিপে ধরুন।”
এই প্রথম অরণীকে তার সাথে ঝগড়ার সুরে রসিকতা করতে দেখল ইফতি। তাই নিজেও এতগুলো কথা বলে ফেলল। অথচ শেষ কথার প্রেক্ষিতে অরণীর জিজ্ঞেস করা প্রশ্নটা শুনে লজ্জায় ইফতি সম্পূর্ণ লাল হয়ে পড়ল। বারান্দায় আর একমুহূর্তও মেয়েটার সামনে দাঁড়াতে পারল না। আর একটু দাঁড়ালে হয়তো ইফতির অসংবেদনশীল মনটা বলে উঠত—সে আসলেই নৈকট্য চাইছে। কেননা অরণী জিজ্ঞেস করেছে,
-“স্পর্শ চাইছেন?”
.
.
.
চলবে....................................