অভ্র নীল - পর্ব ০৭ - শারমিন আক্তার বর্ষা - ধারাবাহিক গল্প

অভ্র নীল 
পর্ব ০৭ 
শারমিন আক্তার বর্ষা 
.
.
.
নীল ওঁর বাবা রায়হান সরকারকে ফোন করে ওদের সন্ধ্যার পরিকল্পনা সম্পর্কে জানিয়ে ওনার থেকে হেল্প চায়। সব শুনে বেশ উৎফুল্ল হলেন রায়হান। প্ল্যানটা ভাল। দুপুর দিকে স্ত্রীকে নিয়ে বেয়াই বাড়িতে আসেন রায়হান সরকার। রায়হান সরকার রাজীব চৌধুরীর সাথে কুশলাদি বিনিময় করেন। অতিথি আসছে দেখে দুপুরে তারা ভালো খাবার তৈরি করেন। একসঙ্গে বসেই খাবার খান। ঘড়িতে এখন তিনটা বাজে। রায়হান সরকার বাইরে ভ্রমণের ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। রাজীব চৌধুরী একটা জায়গা চিনেন, ছিমছাম আর বেশ শান্ত পরিবেশ।। সমস্যা হলো, সেখানে যেতে অনেক সময় লাগে। দূরত্ব অনেক শুনেই রায়হান যেতে রাজি হলো।

মাথার ওপর কড়া রোদ, ভীষণ গরম, এই সময় মানুষ ঘর থেকে বের হয় না। আর ওঁরা বাইরে হাঁটছে, রাজীব চৌধুরী এক জায়গায় বসলেন। কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরির পর তারা একটি সিনেমা হলে ছায়াছবি দেখতে গেল। যেহেতু পরিবারের সদস্যরা সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত বাইরে থাকবেন। সিনেমা দেখে মোটামুটি ভাল সময় কেটে যাবে। রাজীব সেই পুরোনো দিনের আড়াই ঘণ্টার ছবি আনন্দের সাথে দেখা শুরু করলেন। ছোটবেলায়, তিনি তার বাবার সাথে এই ছবিটি দেখেছিলেন। আজ মনে পড়ে গেল পুরোনো স্মৃতি।

ঘরোয়া ভাবে ছোট্ট একটা আয়োজন হবে। হাতে মাত্র দুই ঘণ্টা আছে এরইমধ্যে ড্রয়িংরুমটা সাজিয়ে ফেলতে হবে। নীল ওঁর প্ল্যানিংয়ে সবাইকে সামিল করেছে। তানজুম গর্ভবতী এজন্য সে একজায়গায় বসে ডেকোরেশন করা দেখছে। অভ্র আর শুভ অন্য কাজগুলো করছে। আকাশ গ্যাস বেলুন ফুলানোর কাজ করছে। তানজুম কে ফল কেটে এনে দিল নীল। মুচকি হেসে বলল, ' অনেকক্ষণ হয় খালি মুখে বসে আছিস। ফলগুলো খেয়ে পানি খাবি।'
তানজুম হেসে ফেলল।
' ঠিক আছে।'
নীল আচমকা তোয়ার কপালে টোকা মারল। তোয়া অস্ফুটে আওয়াজে বলল, ' ভাবী, মারছ কেন?'
নীল ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, 
' এভাবে হাত চালালে সন্ধ্যার আগে কিচ্ছু হবে না। জলদি জলদি হাত চালাও।'

সন্ধ্যার আগেই ড্রয়িংরুম সাজানো হয়। এরপর সবাই যার যার রুমে চলে গেল রেডি হতে। নীল রুমে ঢুকে বিছানায় একটা বাক্স দেখে অবাক হয়ে গেল। বাক্সটা হাতে নিয়ে দেখল একটা চিরকুটে লেখা- আজকের সন্ধ্যা তোমার নামে। মুচকি হেসে বাক্সটা খুলল ওঁ। একটা সাদা গাউন। খুব সুন্দর। নীল গাউনটা বিছানায় রেখে ওয়াশরুমে চলে গেল। হালকা সাজলো নীল এরপর রুম থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল। তোয়া দেখে অভ্রর উদ্দেশ্য বলল, ' ভাইয়া পেছনে দেখো।' 
অভ্র শুভর সঙ্গে কথা বলতে বলতে পিছনে ঘুরে তাকাতেই ওর দৃষ্টি নীলের ওপর আঁটকে গেল। অভ্র নীলকে দেখে তার দিকে এগিয়ে যেতে নিল। সিঁড়ির সামনে এসে নীলের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল অভ্র আর নীল তার হাত ধরল।

সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে তারা বাসায় ফেরেন। বাড়ির সদর দরজা খোলা দেখে বিরক্ত হন আছিয়া চৌধুরী সাথে চিন্তিতও বটে। ছেলে-মেয়েদের উপর বিরক্ত হয়ে ভেতরে ছুটে গেল, চারদিক অন্ধকার। সহসা মাথায় নরম, কোমল কিছু পড়ল। তারপর অন্ধকার দূর হয়ে চারদিকে আলোয় আলোকিত হলো। আছিয়া অবাক চোখে গোলাপ ফুলের পাপড়ির দিকে তাকাল। কয়েক কদম এগিয়ে যাওয়ার পর তিনি হঠাৎ আবিষ্কার করলেন যে ছেলে মেয়েরা ড্রয়িংরুমে দাঁড়িয়ে আছে। তারা হঠাৎ চিৎকার করে উঠল, 
'হ্যাপি এনিভার্সারি।'

অছিয়ার চোখে জল এসে গেল। শাড়ির আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে ওদের দিকে এগিয়ে গেল। রাজীব চৌধুরী বললেন, 'বেয়াই এজন্যই আপনি সারা বিকেল আমাদের নিয়ে বাইরে ছিলেন।' 
রায়হান বললেন, ' হ্যাঁ বেয়াই মশাই। শুভ বিবাহ বার্ষিকী।'
মিসেস রোজা বললেন, ' এখন কেক কাটবেন চলুন।'

চোখের জল মুছে নিয়ে দু'জন একসাথে কেক কাটেন। একটু একটু করে সকলে খেলো। অভ্র তাদের জানালো এসব নীল আর তোয়ার প্ল্যান। আছিয়া নীলকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেলেন। রাজীব চৌধুরী নীলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, 'তোমাকে আমাদের মেয়ে হিসেবে পেয়ে আমরা গর্বিত মা।'
অভ্র খুব ভালো গান গায়। সবাই তাকে গান গাইতে অনুরোধ করল। তোয়া অভ্রর রুমে গিয়ে ওঁর গিটার নিয়ে এসেছে। অভ্র গিটার বাজিয়ে গান ধরল,

                            এই সেই সময় যখন আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি
                       আমি আগের চেয়ে অনেক বেশি প্রেমে পড়েছি
                  আমি যেকোনো কিছু থেকে তোমাকে ভালোবাসি
             আমার ইচ্ছে তোমার সঙ্গে বাঁচতে চাই
                              তোমার চোখে আমি ভেসে যাই।
তোমাকে দেখার পর থেকে আমি তোমাকে ভালোবেসে ছি।
                    তোমাকে আবদ্ধ করেছি এই বুকে
              আহ, কি দারুণ লজ্জা তোমার ওই মুখে
                           যখন তাকাও আমার দিকে
                              হায়, আমি যাই মরে।

অভ্র গিটার বাজানো বন্ধ করল। নীলের দিকে তাকিয়ে আছে। সবাই খুব আনন্দে হাততালি দিচ্ছে, নীল লজ্জায় মুখ লুকাচ্ছে। অভ্র গান শেষ করে আকাশের হাতে গিটারটা দেয়।
অভ্র নীলের সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসল। এত মানুষের সামনে অভ্রকে এভাবে বসতে দেখে নীল দুই পা পিছিয়ে যায়। অভ্র ব্লেজারের পকেট থেকে একটা রিংয়ের বক্স বের করে নীল এর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
' শান্তি খুঁজতে খুঁজতে তোমায় পেয়েছি, নিজেকে ভুলে তোমার প্রেমে পড়েছি, ভালোবাসা কাকে বলে জানতাম না, তুমি শিখিয়েছো। জানিনা কতটা ভালোবাসি তোমায়, শুধু বলবো আমার ভালোবাসার কোন শেষ নেই, যদি তুমি তার সীমা খুঁজতে যাও, তুমি আমার ভালোবাসার অতল গহ্বরে হারিয়ে যাবে।
জীবনে চাওয়ার শেষ নেই,
স্বপ্নের কোনো কিনারা নেই, আকাঙ্ক্ষার কোনো সীমা নেই,
আমি তোমাকে চাই, তুমি আমার,
আমার সমস্ত আকাঙ্ক্ষা শুধু তোমার মধ্যে
আমার জীবন শুধু তোমাকে ঘিরে।
বসন্তের সুন্দর গোধূলিতে,
গাছের সৌন্দর্যে ফুল মেলে,
এই লোগো প্রবাহিত।
আমার জীবনের শেষ পর্যন্ত তোমাকে চাই। 
না, পরের জীবনেও তোমাকে চাই।'
 
অভ্র বাক্স থেকে হীরার আংটি বের করে নীলের আঙুলে পরিয়ে দেয়৷ অভ্র নীলের কপালে চুমু খেল হঠাৎ চারদিক থেকে হাসির রোল পড়ে গেল। অভ্র ম্লান কণ্ঠে বলল, 'হেহে, আবেগী হয়ে ভুলে গেছি সবার সামনে দাঁড়িয়ে আছি।'
নীলের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল।

রাত দশটা বাজতে চলল। একে একে সবাই এখন চলে গেছে। নীল সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল। অভ্র হেসে বলল, 'নীলপরী অপেক্ষা কর। আজ আমি তোমাকে সিঁড়ি দিয়ে উঠাব।'
নিল ইতস্তত করে।
'যদি পরে যাই?'
উঁহু, পরবে না।"

অভ্র নীলকে পাঁজাকোলে নিয়ে ছাঁদে এলো। এরপর নীলকে কোল থেকে নামিয়ে দিল। অন্ধকারে হঠাৎ ফুলের ঘ্রাণ নাকে আসছে। নীল বলল, 'ফুলের ঘ্রাণ?'
অভ্র পেছন থেকে নীলকে জড়িয়ে ধরল। সে নীলের কাঁধে তার মুখটা রাখে। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, 'আমি ফুল দিয়ে বিছানা সাজিয়েছি।'
' ছাঁদে?' জিজ্ঞেস করল নীল।
' হ্যাঁ।'
সাদা গোলমরিচের বাতি দিয়ে সাজানো চতুর্দিক, নীল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল হঠাৎ নীলের চোখ গেল ছাঁদের এক কোণে, সেখানে একটি বিছানা ফুল দিয়ে সাজানো। অভ্র পেছন থেকে নীলের গায়ে গোলাপের পাপড়ি ছিটিয়ে দিল। শরীরে কিছু পরায় নীল ভয় পেয়ে যায়। সহসা অভ্র নীলের ঘাড়ে গভীরভাবে চুমু খায়। অভ্রর স্পর্শে নীল কেঁপে ওঠে। শরীরে একটা শিহরণ বয়ে গেল। অভ্র কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে গেল। নীল বলল, 'কি করছ?'
' আমি তোমাতে ডুবতে চাই; 
তোমার দিঘল কালো চোখে হারিয়ে যেতে চাই।' 
নীলের ঘাড়ে নাক লাগিয়ে বলল অভ্র। নীল চুপ করে থাকল। খোলা আকাশের নিচে দমকা হাওয়ায় আনন্দের আভাস পাওয়া গেল। চাপা গলায় অভ্র অন্যভাবে বলল, 
' ভালোবাসা ঠোঁটে;
প্রেম আছে শরীরে।'
.
.
.
চলবে..........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন