স্বামীর তিন তিনটে ব্যাচেলার ছেলেকে বাড়ি ভাড়া দেয়ার সিদ্ধান্তে তুমুল বেগে চেঁচামেচি শুরু করে দিলেন রিনা বেগম। তিনি বুঝতে পারছেন না তার স্বামীর কি বুদ্ধিশুদ্ধি লোপ পেয়েছে ঘরে নিজের যুবতী মেয়ে থাকতে সে কি করে ব্যাচেলার ভাড়া দেয়। মাথায় কি বিন্দুমাত্র এ চিন্তা আসলো না। তার একটা যুবতী মেয়ে আছে। রাহেলা সোফায় পাশে মেঝেতে কান চেপে বসা। ফাবিহা নিজ কক্ষে বই পড়ছে। কিন্তু মায়ের চেঁচামেচিতে তার পড়ায় বিঘ্ন ঘটছে খুব। এমনটা নয় মায়ের চিৎকার চেঁচামেচি করাটা অযৌক্তিক তবুও কাজটা যেহেতু করা হয়ে গেছে সেহেতু চেঁচামেচি করে তো লাভ নেই। ফাবিহা একবার ভাবল বাহিরে বেরিয়ে মাকে কিছু বলবে পরে আবার ভাবল না থাক।'
“তুমি কি একটু থামবে?”
প্রচন্ড বিতৃষ্ণা ভরা কণ্ঠে কথাটা বললেন মাসুদ উদ্দিন। তার কথা শুনে রিনা বেগম আরো রেগে গেলেন। তিনি বললেন,
“কেন থামব?”
“দেখো রিনা আরহানরা খুব ভালো ছেলে। তোমার মেয়ের কিছু হবে না।”
“ছেলেরা যত ভালো হোক কিন্তু বিগড়ে যেতে কতক্ষণ!”
“এবার কিন্তু বেশি বেশি হচ্ছে। আমি আরহানকে জানি ও আমার একসময় স্টুডেন্ট ছিল।”
“তাই বলে ব্যাচেলার ভাড়া দিবে।”
“একটা কথা মনে রাখবে তোমার মেয়ে যদি ঠিক থাকে তাহলে কোনো ছেলেই তোমার মেয়েকে বিগড়াতে পারবে না। আর তোমার মেয়ে তো খুঁকি নয় যে কেউ ভুজুম ভাজুম বললেই সে গলে যাবে। আমি বাবা হয়ে আমার মেয়েকে বিশ্বাস করছি আর তুমি মা হয়ে পারছ না।”
রিনা বেগম ধমে গেলেন কিছুটা। তবে থামলেন না। বললেন, “তুমি এক্ষুণি গিয়ে ছেলেগুলোকে বলবে নতুন বাসা দেখে বেরিয়ে যেতে।”
“বাজে বকা বন্ধ কর। দু'দিন যাক তুমি নিজেই টের পাবে আমি ওদের বাড়ি ভাড়া দিয়ে ভুল করিনি। এখন চলো খিদে পেয়েছে লান্স কি করতে হবে না?”
রিনা বেগম কথা বললেন না। মাসুদ উদ্দিন ফাবিহাকে ডাকলেন। ফাবিহা সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দিল, “আমি খেয়েছি বাবা তোমরা খেয়ে নেও।”
মাসুদ উদ্দিনও আর দিরুক্তি করলেন না। এবার ডাকলেন রাহেলাকে। মেয়েটা কানে হাত দিয়ে মাসুদ উদ্দিন আর রিনা বেগমকে দেখছে।"
“এই রাহেলা তাড়াতাড়ি খাবার বাড়।”
রাহেলা চমকে উঠল। দ্রুত উত্তর দিল,
“সব বাড়াই আছে চাচা। খালি খাইতে বইলেই হয়।”
“তুই খাইছিস?”
“হ একটু আকটু।”
মাসুদ উদ্দিনের বিরক্তির কণ্ঠ,
“একটু আকটু আবার খায় কেমনে?”
“ওই আপার লগে একটু খাইছিলাম।”
“ওহ আচ্ছা। আবার খাবি?”
“না চাচা। তরকারির শোক যাইলে খামু।”
শেষ কথাটা খুব ধীরে বলল রাহেলা। মাসুদ উদ্দিন আর জোর করলেন না। বললেন,
“আচ্ছা শোন, কিছু খাবার বেড়ে আরহানদের দিয়ায়। ছেলেগুলোও বোধহয় না খেয়ে আছে।”
রাহেলা উঠে দাঁড়াল। তড়িৎ উত্তর দিল, “আইচ্ছা চাচা।”
রাহেলা হেঁটে গেল রান্নাঘরে। আর রিনা বেগম, মাসুদ উদ্দিন গেলেন ডাইনিং রুমে।
•••••••••••••
বাড়িটির গায়ের রঙ ধবধবে সাদা। দরজার মুখেই বামপাশের দেয়াল ঘেঁষে বড় গোলাপ গাছ লাগানো। টকটকে লাল গোলাপ ফুটেছে তাতে। আরহান দাঁড়িয়ে বাড়ির দরজায় ঝুলানো তালার কাছে। সেই কতক্ষণ যাবৎ নিজেদের মালপত্র নিয়ে তারা বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে। অজানা কারণেই ভিতরে ঢুকছিল না। পরিশেষে ঢুকল তারা। বাড়ির দরজা নেইম প্লেটে লেখা 'অতিথি নিবাস' সুন্দর নাম আরহানের ভালো লেগেছে। তবে সে বুঝেছে এটা মূলত বাড়ির অতিথিদের জন্য তৈরি। হয়তো তাদের উপর মায়া বা দয়া দেখিয়ে মাসুদ আঙ্কেল বা স্যার ভাড়া দিলেন। সে যেটাই দিক খুব ভালো হয়েছে না হলে এই ঢাকার-বাজারে ব্যাচেলাদের রুম পাওয়া খুবই কঠিন। আরহান দরজা খুলে ভিতরে ঢুকল। বাহিরে তৌহিদ আর শান্ত দাঁড়িয়ে।
আরহান সে একজন আরজে। এফএম রেডিতে কাজ করে। আরহানের কণ্ঠস্বর খুবই সুন্দর। তাই এই কাজটা পাওয়া। তৌহিদ একজন ভার্সিটির টিচার। তবে এখনও টিচার বলা যাবে না। কারণ তৌহিদ এখনও ভার্সিটিতে জয়েন করেনি। তবে খুব শীঘ্রই করবে। বাসাটার একটু সমস্যা হওয়ায় এত লেট। তৌহিদের গায়ের রঙ ফর্সা আরহানের চেয়ে ফর্সা রঙ। উচ্চতায় আরহান তৌহিদ দুজনেই সমান। 'শান্ত' মানুষটা নামের মতই শান্ত। তার একটা দূর্বলতা হলো সে জন্ম থেকেই বাক প্রতিবন্ধী। কথা বলতে পারে না। তবে শুনতে পারে। অল্পস্বল্প! এই পৃথিবীতে তাকে বুঝতে পারে তার এই দুই বন্ধু আর তার মা। যে গ্রামে থাকে। আপাতত তার পৃথিবীকে বোঝার জন্য এই তিনজন ব্যক্তিই আছে। শান্ত খুবই সহজসরল মানুষ। এলেমেলো চুলে, মোটা ফ্রেমে চশমার ভিড়ে সে বড়ই সুদর্শন যুবক। এছাড়া শান্তর বিশেষ একটা গুন আছে।'
আরহান ভিতরে ঢুকতেই একে একে তৌহিদ আর শান্তও ঢুকে পড়ল ভিতরে। সামনের বিছানায় বসল আরহান। শান্ত পুরো ঘরে চোখ বুলাল। দুটো বড় বড় রুম। কিছু আসবাবপত্র, রান্নাঘর, ওয়াশরুম, বাড়ির পিছনে ছোট্ট বারান্দা। বাড়ির সামনের চেয়ে পিছনটা বেশি সুন্দর। সারি সারি কিছু আছে। গাছে কাঠবিড়ালি ছুটছে। সবুজ ঘাসেরা বেড়েছে। তবুও শান্তর পুরো বাড়িটা ভালো লেগেছে। কেমন একটা শান্তি শান্তি অনুভব হচ্ছে। সে এগিয়ে এলো আরহান আর তৌহিদের দিকে। হাত নাড়িয়ে বুঝাল কিছু। আরহান তার হাতের ইঙ্গিত দেখে বলল, “বাড়িটা খুব ভালো লেগেছে তোর?”
শান্ত মাথা দুলায়। যার অর্থ,'হ্যাঁ, খুব।'
তৌহিদ হেঁসে বলল, “দেখ কোনো মেয়েটেয়ে পাশ কি না তাহলে বিয়ে দিয়ে এখানেই রেখে যাব।”
শান্ত হেঁসে ফেলল। হাসল আরহানও। তখনই দরজায় খটখট করে আওয়াজ করল রাহেলা। চিকন গলায় বলল, “ভাই সাবেরা ঘরে আইতাম?”
রাহেলার কণ্ঠ কানে আসতেই তিনজনই ঘুরে তাকাল একসাথে। তৌহিদ বলল, “আসেন।”
রাহেলা ঢুকল। পনের বছর বয়সী একটা মেয়ে। তৌহিদ বলল, “কে তুমি?”
রাহেলা কিছু বলার আগেই আরহান বলল,
“মাসুদ আঙ্কেলদের ঘরে দেখেছিলাম।”
এবার রাহেলা বলল,
“আমি হইলাম রাহেলা। এইবাড়ির কামের বেডি। তয় কামের চাইয়া কতা একটু বেশি কই। চাচায় আপনেদের জন্য খাবার পাডাইছে। খাইয়া লন।”
রাহেলা খাবারের ট্রে সমেত বিছানায় রাখল। এরপর ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল তিনজনকেই। তৌহিদ বলল, “এত কি দেখো?”
রাহেলা বলল, “আপনাগোরে দেখতাছি।”
তৌহিদ ভ্রু কুঁচকে তাকাল,
“তারপর...
“তারপর আর কি! হুনেন, আমি হইলাম রাহেলা পোলা মানুষ গো হেমন ভয় পাই না। আপনেরা এহিনে থাকবেন ভালো কতা। তয় আমার আপার দিকে নজর দিবেন না কেউ কইয়া দিলাম। আমার আপা হইল ডাইনী।”
কথা শুনে চোখ বড় বড় হয়ে গেল তৌহিদের। ভড়কানো গলায় বলল, “কি?”
আরহান হেঁসে ফেলেছে ততক্ষণে। রাহেলাকে একটু হলেও আচ করতে পেরেছে সে। রাহেলা একটু ভেবে বলল, “ওই যে হয় না পিনচেস...
আরহান বলে উঠল তখন, “ও প্রিন্সেস ডায়নার কথা বলছে।”
রাহেলা খুশি হয়ে তাকাল আরহানের দিকে। উচ্চ আওয়াজে বলল,
“হ ভাইজান ঠিক কইছে। আমার আপা হইল পিনচেস ডায়না। ওনার দিকে কেউ নজর দিবেন না। তাইলে কিন্তু চাচি আপনে গো গর্দান নিব।”
শান্তর কণ্ঠ শোনা গেল। সে আ আ শব্দ করে কিছু বলল রাহেলাকে। রাহেলা বুঝল না। অবাক হয়ে বলল, “আমনে আ আ করেন ক্যাঁ, কথা কইতে পারেন না।”
শান্ত অসহায় বেশে তাকাল আরহানের দিকে। আরহান বলল, “ও সত্যি কথা বলতে পারে না রাহেলা।”
রাহেলার চোখ ভেসে উঠল। নরম কণ্ঠে বলল,
“আমনে কথা কইতে পারেন না ভাইজান?”
শান্ত 'না' বোধক মাথা নাড়াল। রাহেলার চোখে পানি চলে আসলো। সে মৃদু স্বরে বলল, “আমারে ক্ষমা কইর দেন ভাইজান। আমি বুঝবার পারি নাই।”
শুকনো হাসল শান্ত। হাতের ইশারায় দেখাল কিছু। যা দেখে আরহান বলল, “ও কিছু মনে করেনি।”
রাহেলা কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল শান্তর মুখের দিকে। কি সুন্দর দেখতে পোলাডা। মাথায় কত বড় বড় চুল, চোহে আবার চশমাও পড়ে অথচ কথা কইতে পারে না। রাহেলার মন খারাপ হলো। শান্ত আবারও কিছু বলল। যা দেখে রাহেলা প্রশ্ন করল, “কি কইল ভাইজানে?”
আরহান বলল, “ও বলছে চিন্তা নাই আমরা কেউই তোমার ডায়না আপার দিকে তাকাব না।”
রাহেলা একবার শান্ত, একবার আরহান আর একবার তৌহিদের দিকে তাকাল। তারা তিনজনই হাসছে। রাহেলা বলল,
“আইচ্ছা ঠিক আছে। যাইগা আমি আপনেরা খাইয়া লইয়েন।”
তৌহিদ বলল,
“আচ্ছা যাও রানু মন্ডল।”
চোখ পাকিয়ে তাকাল রাহেলা। বলল,
“আমার নাম রানু না রাহেলা।”
তৌহিদ হাসল। রাহেলা বেরিয়ে এলো। তৌহিদ বলল, “আমি একটু হাতমুখ ধুয়ে আসি।”
আরহানের জবাব এলো,
“যা।”
••••••••••••••
শান্ত বিকেল। দোতলার বারান্দার রকিং চেয়ারে বসে বই পড়ছিল ফাবিহা। হঠাৎ তার নজর গেল সামনের বাড়িটা থেকে মাত্র বের হওয়া আরহানের দিকে। গায়ে জড়ানো সাদা টিশার্ট। কালো প্যান্ট। বোধহয় কোথাও যাচ্ছে। ফাবিহা দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। ছেলেটাকে তার খুব শান্ত টাইপ মনে হয়েছে। আসলেই কি ছেলেটা খুব শান্ত! খুব একটা ভাবল না এত ভেবে তার কি লাভ। সে বই পড়ায় আবার মনোযোগ দিল। বইটা প্রায় সমাপ্তির অংশটা পড়ছে। যেখানে শেষটায় লেখা ছিল,
“তাকে দেখার তৃষ্ণা আমার জনমভর রোক।"
ফাবিহা বইটি বুকে জড়িয়ে ধরল। মনে মনে বলল, কি অদ্ভুত– সুন্দর কথা। সামনে তাকাতেই দৃষ্টি আটকাল তার মাত্রই তাদের বাড়ির কালো গেটটা টপকে বেরিয়ে যাওয়া যুবকটির দিকে। আবারও কেমন যেন অদ্ভুত ঠেকল সব।
.
.
.
চলবে.........................................................................