নীরবে নিভৃতে - পর্ব ৩২ - তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া - ধারাবাহিক গল্প


একটা বদ্ধ ঘরে আঁটকে আছে রোজী। ওর সাথের দু'জনকে তিনদিন আগেই ডাকাতেরা মেরে ফেলেছে। তা-ও ওর চোখের সামনে। বিষয়টা রোজীর জন্য খুব ভয়ংকর ছিলো। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে আছে মেয়েটা। চিন্তাশক্তিও আগের মতো প্রখর নেই। বলতে গেলে খাওয়াদাওয়া, গোসল সবকিছুই নেই। তিনবেলা খাবার দিয়ে গেলেও রোজী কিছু খাচ্ছে না। এই জানোয়ারদের দেওয়া কোনো খাবার সে খাবে না বলেই সিন্ধান্ত নিয়েছে। সবুর, এই দলের প্রধান সে। শুনেছে তার ইচ্ছেতে এখনো বেঁচে আছে রোজী। কিন্তু কেনো? রোজীর মনে অনেক প্রশ্ন কিন্তু কোনো উত্তর নেই! 
____
সারারাত না ঘুমানোর ফজরের দিকে ঘুমিয়ে গেছেন সবুর হোসেন। নির্ঘুম রাতগুলো শেষ হয় ঠিক সকালের আগে থেকেই। 

সকাল সকাল মিষ্টির বিয়ের কথাবার্তা চলছে। আহনাফ একটু আগে সিদ্দিক আহমেদকে সবটা জানিয়েছে। হিসেব মতো তেরো দিন পর আহনাফ আর মিষ্টির বিয়ে। মিষ্টির বাবা-মায়ের বিয়ের দিন-তারিখ নিয়ে কোনো সমস্যা নেই বলে আহনাফের পরিবার থেকেই তারিখ ঠিক করা হয়েছে। সবকিছুর মধ্যে মিষ্টির কেমন একটা লাগছে আজ। মনে হচ্ছে আহনাফকে ঠকাচ্ছে ও। যে শরীর শতশত পুরুষ রূপী হায়েনার দল খুবলে খেয়েছে সেই শরীর কীভাবে আহনাফ গ্রহণ করবে! নেহাৎ লোকটা খুব ভালো তাই মিষ্টির উপর দয়া প্রদর্শন করছে বলেই মনে হয় ওর। 
" কী রে! গরম গরম ভাত না খেয়ে এই দরজার কাছে বসে আছিস কেনো?"
মিষ্টিকে দোরগোড়ায় বসে থাকতে দেখে শুধালো আনজুম বেগম। মেহেক রোশন আর সিদ্দিককে খাবার পরিবেশন করে দিচ্ছে। মায়ের কথায় উঠে দাঁড়ালো মিষ্টি। 
" আপুর সাথে খাবো মা। ভাইয়া আর বাবা খাওয়া শেষ করুক আগে। "
" তোর ভাইয়া কি মেহেককে ছাড়া খায়? একসাথে খাবার না খেলে জোর করে বসায় ছেলেটা। যা যা তুইও খেয়ে নে। এখন একদম অনিয়ম করবি না। আমি গেলাম পুকুরপাড়ে। "
" আচ্ছা মা।"
আনজুম মেয়েকে বলেকয়ে নিজের কাজে এগোলেন। মিষ্টিও খাওয়ার ঘরে যাচ্ছে। 

" বাবা মিষ্টির বিয়ের বিষয় আমি কিছু কথা বলতে চাই। আপনি বলতে বললে বলবো।"
মেহেক বুঝতে পারছে না রোশন হঠাৎ মিষ্টির বিয়ে নিয়ে বাবাকে কী বলতে চাচ্ছে। সিদ্দিক খেতে খেতে জবাব দিলেন, 
" অবশ্যই। বলো৷ "
" মিষ্টির বিয়েতে খাওয়াদাওয়ার সব খরচ আর গয়নাগাটি সবকিছু আমি দিবো। "
" সেটা হয় না বাবা। তুমি আমার জামাই! তুমি আমাদের পাশে থেকো তাতেই হবে। "

রোশনের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেহেক। মানুষটা ততটা খারাপ না যতটা মেহেক ভাবতো।
" ছেলে মনে করে রাজি হয়ে যান বাবা। মিষ্টিকে আমি বোনের থেকে কম ভালোবাসি না। বাবা ছাড়া মা, বোন কিংবা ভাই কিছুই নেই আমার জীবনে। তাই মিষ্টিকে পেয়ে নিজের বোনের মতোই ভাবি। আমি যদিও ভালো মানুষ না কিন্তু এতটুকু তো বোনের জন্য করতে পারি, তাই না?"
রোশনের কথায় খারাপ লাগছে সিদ্দিকের। আসলে মানুষ তো জন্মগতভাবে অপরাধী হয়ে জন্মায় না। পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে অপরাধ করতে বাধ্য হয়। ছেলেটার জন্য মায়া হচ্ছে উনার। মেহেকের চোখে জল টলমল করছে। রোশনের বিষয় চিন্তাভাবনা আগের থেকে বদলে গেছে মেহেকের। 
" ঠিক আছে। বিয়ের আগ পর্যন্ত কিন্তু এখানেই থাকবে তোমরা। "
" কিন্তু বাবা উনার তো ঝামেলা! "
মেহেক মাঝখানে কথা বলে। সিদ্দিক একটু চুপ থেকে বলেন,
" সেসব আমি বুঝে নিবো। কিছু টাকাপয়সা দিলে সবকিছু ঠিক থাকবে। তেমন কিছুর আঁচ পেলেই রোশন চলে যাবে। "
" ঠিক আছে বাবা।"

আজ দু'দিন হলো মিষ্টির সাথে কথা হয়নি আহনাফের। কল দিয়েছে, টেক্সট করেছে কিন্তু মিষ্টির কোনো রেসপন্স পায়নি। সেজন্য আজ সন্ধ্যা হতেই মিষ্টিদের বাড়ি চলে এসেছে আহনাফ। হবু জামাইকে আপ্যায়ন করতে ব্যস্ত আনজুম। রোশন মেহেককে সাথে নিয়ে একটু বেরিয়েছে। সারাদিন ঘরে থাকতে ভালো লাগে না। তাই বাড়ি থেকে বেরিয়ে সামনে হাঁটতে গেছে দু'জন। মিষ্টি নিজের ঘরে বসে আছে। আহনাফকে কী বলবে? কেনো এড়িয়ে যাচ্ছে তা তো নিজেও জানে না মিষ্টি। 
" আন্টি আমি আরকিছু খাবো না। মেহেক, রোশন ওদের কোনো সাড়াশব্দ নেই যে?"
" ওরা বাড়িতে নেই। একটু বেরিয়েছে। মিষ্টি ঘরেই আছে। তুমি গিয়ে কথা বলো। আমি বরং একটু আসছি। "
আনজুম বেগম আহনাফকে বলে রান্নাঘরের দিকে গেলেন। আহনাফ ইতস্তত ভাব কাটিয়ে মিষ্টির ঘরের দিকে এগোলো। এদিকে মিষ্টি নিজের ঘরে পায়চারি করে যাচ্ছে। অস্থির লাগছে ভীষণ। দরজার দিকে দৃষ্টিপাত করতেই আহনাফকে দেখছে মিষ্টি। মৃদু হেসে বলে মিষ্টি, 
" ভেতরে এসে বসুন স্যার। "
আহনাফ বিনা কথায় ঘরে ঢুকে সরাসরি বিছানার একপাশে বসলো। 
" শাড়িটা পরেছিলে?"
" উম?"
" শাড়িটা? "
মিষ্টির মনে পড়লো সবার নজর এড়িয়ে আলাদা করে একটা শাড়ি কিনে দিয়েছিল আহনাফ। 
" নাহ। "
" ভালো করেছো। আমাদের বাড়িতে গিয়েই পরবে একেবারে। "
মিষ্টি মাথা নাড়লো একবার। আহনাফ মিষ্টিকে স্বাভাবিক করতে চাইছে। মিষ্টি বুঝতে পারছে কিন্তু ঠিক নিজেকে সামলে নিতে পারছে না। 
" আঙ্কেল কেমন আছেন? "
" আলহামদুলিল্লাহ। "
আহনাফ বসা থেকে উঠে মিষ্টির কাছে এগিয়ে গেলো কিছুটা। মিষ্টি চমকাল। একপা একপা করে পিছিয়ে যাচ্ছে ও। আহনাফ এগোচ্ছে তবুও। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় থেমে গেছে মিষ্টি। আহনাফ মুচকি হাসলো। মেয়েটা ভয় পাচ্ছে! 
" কী কর.ছে..ন! "
মিষ্টির চোখেমুখে বিস্ময় ও ভয় স্পষ্ট। আহনাফ ওকে শান্ত করতে একটু পেছনে এগিয়ে গেলো। 
" টিপ বাঁকা হয়েছে।"
মিষ্টি কপালে হাত দিলো। আহনাফ সামনে এগিয়ে নিজেই টিপটা ঠিকঠাক জায়গায় পরিয়ে দিলো এবার। হাঁপ ছেড়ে বাঁচল মিষ্টি। 
" ধন্যবাদ স্যার। "
" একা ঘরে যা খুশি ডাকো কিন্তু বাইরে বসে স্যার বলে আর ডেকো না। অভ্যাস করতে হবে তো? "
মিষ্টির ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা আঁটকে নিলো। অদ্ভুত মানুষ! একবারও জিজ্ঞেস করলোনা কেনো দু'দিন কথা বলেনি! এমনভাবে কথা বলছে যেনো কিছু হয়নি। 

জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চারদিক। হাতে হাত রেখে খোলা মাঠে হাঁটছে মেহেক ও রোশন। ছোটোবেলার গল্প জানতে চেয়েছিল রোশন। ব্যাস! মেহেক সেই যে বলতে শুরু করেছে আর থামার নামগন্ধ নেই। অবশ্য রোশন সবকিছু বেশ উপভোগ করছে। মাঝে মধ্যে কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিচ্ছে প্রিয়তমার। 
" তারপর কি আর ধরতে পেরেছিলে পেন্সিল চোরকে?"
" আরে না। জানেন তখম তো জানতাম না কে চুরি করেছিল। কিন্তু একদিন জানলাম আমাদের ক্লাসের ফরিদা নিয়েছিল। ওর এমনিতেই হাতটানের অভ্যাস ছিলো। "
রোশন হাসছে। মেহেক দাঁড়িয়ে গেলো। ভ্রু উঁচিয়ে শুধালো, 
" আচ্ছা এবার আপনার পালা। আপনার ছোটবেলার কথা বলুন কিছু। "
মেহেকের প্রশ্নে ভাবনায় পড়ে গেল রোশন। বলার মতো কোনো স্মৃতি নেই ওর মস্তিষ্কে। সবকিছুই অস্পষ্ট, ধোঁয়াশা! 
" আমার ছোটোবেলায় তেমন কিছু নেই। মানে বলার মতো কিছু মনেই নেই। "
" মনে নেই? কিছু না?"
রোশন মেহেকের কোমরে হাত রেখে দাঁড়াল। মেহেকও রোশনের গলা জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। 
" উমম..... সত্যি মনে নেই সুন্দরী। সবকিছু অস্পষ্ট! "
মেহেক বুঝতে পারলো না সত্যি বললো লোকটা না-কি মজা! 
" হ্যাঁ হ্যাঁ বুঝতে পেরেছি। চলুন এখন বাড়ি যাই। মিষ্টি একা একা নিশ্চয়ই আমাদের মিস করছে। "
" ঠিক বলেছো। চলো। আজকে তিনজনে একসাথে লুডু খেলবো। তোমাদের দুই বোনকে হারিয়ে দেবো হুহ্। "
মেহেক জোরে হাসতে হাসতে বললো,
" দেখা যাবে সেটা।"
রোশন কথা না বলে হুট করে মেহেককে কোলে তুলে নিলো। মেহেক মোটেও চমকাল না তাতে। এই লোক যে এসব করে তা তো আর নতুন না। 
" এভাবেই বাড়ি নিয়ে যাবেন?"
" তোমার সমস্যা তাতে সুন্দরী? "
" মোটেও না। হেঁটে যাওয়ার বদলে যদি কোলে করে যাওয়া যায়, কার সমস্যা হয়!"
রোশন মুচকি হেসে হাঁটতে লাগলো। আকাশের সুন্দর চাঁদ খানাও যেনো ওদের সাথে বাড়ির দিকে এগোচ্ছে। 

বিয়ের জন্য তোরজোর শুরু হয়েছে দুই বাড়িতেই। সপ্তাহখানেক পরে মিষ্টি আর আহনাফের শুভ পরিণয় ঘটবে। সবাই তাই কোমর বেঁধে কেনাকাটা করতে শুরু করেছে। এরমধ্যে রোশন একবার জঙ্গলে গিয়েছিল টাকাপয়সা নিয়ে আসতে। একমাত্র শ্যালিকার বিয়েতে কোনো কমতি রাখবে না সে।



চলবে..........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন