শ্রীঘর
পর্ব ০২
আতিয়া আদিবা
.
.
.
অন্যদিন সাহিল তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরলেও আজকে একটু দেরী করে বাড়ি ফিরলো। তার হাতে একগুচ্ছ গোলাপ আর তাজা রজনীগন্ধার গাজরা। দিবা দরজা খোলার সাথে সাথে ফুলগুলো দিয়ে ভালোবাসা প্রকাশ করবে সে। মেয়েটার মাঝারি সাইজের খোঁপায় আজ সে গাজরা গুঁজে দিবে। মেয়েদের চুলের আলাদা ঘ্রাণ আছে। ফুল আর চুলের ঘ্রাণ মিলেমিশে যখন একাকার হয়ে যায় সেই গন্ধ বুক ভরে নিতে সাহিলের খুব বেশি ভালোলাগে। ডোরবেল বাজলো। দরজার ওপাশে কোনো সারা শব্দ নেই। সাহিল আবারো বেল বাজালো। এবার ধীর পায়ে কারো আগমনী শব্দ স্পষ্ট শুনতে পেলো সে। দিবা দরজা খুলে দিলো। পরিকল্পনা অনুযায়ী দরজার সামনেই হাটু গেঁড়ে বসে ফুলগুলো দিবার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
" ভালোবাসি।"
দিবা প্রানপণে চেষ্টা করে যাচ্ছে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার। সে মুচকি হেসে ফুলগুলো হাতে নিয়ে রুমের ভেতোর চলে গেলো। মুখে কিছু বললো না। সাহিল দরজা লাগিয়ে দিয়ে দিবার পিছু পিছু ভেতোরে ঢুকলো। দিবা শান্ত ভঙ্গিতে বললো,
"রাতে খাবে তো? নাকি খেয়ে এসেছো?"
সাহিল অবাক হয়ে বললো,
" আমি বাইরে থেকে খেয়ে আসলে তোমাকে ফোনে জানিয়ে দেই।"
দিবা অন্যমনস্ক হয়ে বললো,
" ও হ্যাঁ, তাই তো! ভুলে গেছিলাম। আচ্ছা তুমি থাকো আমি টেবিলে খাবার সাজিয়ে আসি।"
দিবার কথাগুলো কেমন যেনো অন্যরকম শোনা গেলো। সাহিল ভ্রুঁ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
" কিছু হয়েছে?"
দিবা হাসার চেষ্টা করে বললো,
" মানে? কি হবে! তুমি খাবে না? খুদা লাগে নি তোমার?"
" লেগেছে।"
" তো টেবিলে খাবার লাগাবে কে শুনি? বিয়ে তো একটাই করেছো। অন্য কোনো বউ তো নেই যে খাবার বেড়ে দিবে।"
একথা বলে দিবা ঘর থেকে বের হয়ে যেতে লাগলো। ঠিক সেই সময় সাহিল সন্দেহের দৃষ্টি নিয়ে দিবাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
" দাঁড়াও তো।"
দিবা থমকে দাঁড়ালো কিন্তু পিছু ফিরে তাঁকালো না। সাহিল পকেটে হাত দিয়ে গাজরা বের করলো। নিজ হাতে দিবার চুলগুলো নিয়ে খোঁপা করে তাতে গাজরা গেঁথে দিলো। তারপর দিবার মুখ তার দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বললো,
" সাত বছর ধরে এই মুখ দেখে আসছি। সাত টা বছর। কম সময় মনে হয় তোমার কাছে? তুমি কখন কি ভাবো, কখন তোমার মনের মধ্যে কি চলে আমি আঁচ করতে পারি, দিবা। এতটাও অবুঝ নই আমি, অন্তত তোমার ক্ষেত্রে নয়!"
এবার দিবার চোখ ভিজে উঠলো। চোখ দিয়ে অনর্গল পানি ঝরতে লাগলো। সাহিল অস্থির কন্ঠে বললো,
" কি হয়েছে বলবে না আমাকে?"
দিবা ফুঁপিয়ে বলে উঠলো,
" আমি প্রেগনেন্ট।"
একথা শুনে সাহিলের চোখ মুখ চিকচিক করে উঠলো। সে দিবাকে ছেড়ে এক কদম পিছিয়ে আসলো। কিছুক্ষণ পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর বিস্মিত কন্ঠে বললো,
" এটাতো খুশির সংবাদ, দিবা! এর জন্য তুমি কাঁদছো? মন খারাপ করে আছো? "
" না।"
" তবে?"
" আচ্ছা তুমি আমাকে ছাড়া অন্য কোনো মেয়ের গায়ে হাত দিতে পারবে কখনো? ছুঁয়ে দেখতে পারবে?"
সাহিলের মাথায় যেনো আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। সে হাসার চেষ্টা করে বললো,
" তুমি কি মজা করছো আমার সাথে?"
দিবা স্পষ্টভাবে মাথা নাড়লো।
এবার কিছুটা রাগী গলায় সাহিল বললো,
" এসব কি প্রশ্ন করেছো তুমি? সব সময় মজা ভালো লাগেনা দিবা। সময়, পরিস্থিতি বুঝতে হয়।"
" আমি মজা করছি না। তোমার এগেইনস্ট এ জাতীয় কমপ্লেইন এসেছে।"
সাহিল চোখ বড় বড় করে তাঁকিয়ে রইলো।
" তুমি নাকি জমিলার গায়ে হাত দেওয়ার চেষ্টা করো। "
" দিবা, তোমার মাথা ঠিক আছে? নাকি তুমি এখন বাচ্চা চাইছো না দেখে এসব নোংরা কথা বলছো। ইস্যু বানাতে চাইছো! কোনটা?"
" সিরিয়াসলি সাহিল? তোমার তাই মনে হয়?"
" এখন তো তাই মনে হচ্ছে। তোমার লজ্জা করছে না? নিজের হাজবেন্ডের চরিত্রে তুমি এভাবে আঙুল তুলছো!"
" আঙুল না তোলার কি আছে! ভার্সিটিতে থাকতে তুমি কি একাধিক প্রেম করো নি? একের অধিক গার্লফ্রেন্ড ছিলো না তোমার?"
" দিবা, সেটা সাত থেকে আট বছর আগের কথা! সেই বয়সটাই এমন ছিলো। কিন্তু আমি কখনো প্রেম করে এডভান্টেজ নেই নি! সেটা তুমিও জানো। তুমি তো সব জেনেই আমার জীবনে এসেছিলে। তাহলে এখন এসব কেনো বলছো?"
" বলছি কারন তোমার চরিত্রে সমস্যা, সাহিল। তখন গার্লফ্রেন্ড পাল্টিয়েছো আর এখন...."
এটুকু বলে চুপ করে হাঁপাতে লাগলো দিবা। সাহিল নির্বাক। হতভম্ব তাঁকিয়ে আছে দিবার দিকে। তার চোখও পানিতে ভিজে উঠলো। শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
" এখন কি দিবা? শেষ করো। বলো। আমি শুনছি।"
দিবা কোনো কথা বললো না। ধপাস করে ফ্লোরে বসে পড়লো। সাহিল বিছানার ওপর থেকে বালিশ হাতে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে যাওয়ার আগে বললো,
" আমার নিজের চরিত্র ভালো নাকি খারাপ তা প্রমাণ করার সময়টুকু দিয়ে তারপর তোমার জাজমেন্ট শোনালেও পারতে। এতদিনের সম্পর্ক, সংসার সব মিথ্যে ছিলো। যে সম্পর্কে বিশ্বাস নেই সেই সম্পর্ক সত্যি হতেই পারে না! কখনোই না।"
সাহিল রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। দিবা নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলো। সে কথাগুলো এভাবে বলতে চায় নি। কিন্তু পরিস্থিতি মাঝে মাঝে মানুষের ইচ্ছেগুলোকে প্রাধান্য দেয় না। তাই হয়তো আগের থেকে ভেবে রাখা বিষয়বস্তু গুলোর উপযুক্ত প্রয়োগ করাটাও অসম্ভব হয়ে ওঠে।
নোকিয়া ১২০০ মডেলের ফোনটিতে রিং বেজে উঠলো। জমিলা ফোন হাতে নিয়ে রিসিভ করে বললো,
" সালামালাইকুম আফা।"
অপর পাশ থেকে নারী কন্ঠ শোনা গেলো।
" সব ঠিক ঠাক?"
" একদম আফা। আপনি যেমনে কইছেন ঠিক তেমনে অভিনয় করছি।"
" ভেরি গুড। আগামীকাল কি করতে হবে মনে আছে তো?"
" হ আছে। তয় আফা, আমার পুলাডা কেমন আছে?"
" ভালো আছে। ওকে নিয়ে চিন্তা করো না। ও খুব তাড়াতাড়ি স্বুস্থ্য হয়ে যাবে। তুমি তোমার কাজগুলো মন দিয়ে করো। কোনো ভুল যেনো না হয় জমিলা।"
" কোনো ভুল হবে না। আপনি নিশ্চিন্ত থাকেন।"
" ঠিকাছে। কাল ফোন করবো। তুমি ঠিক সময় পুলিশ স্টেশন পৌঁছে যেও। কেমন?"
" জ্বি, আফা।"
" রাখছি।"
ফোন রাখার পর জমিলা উদাস চোখে আকাশের দিকে তাঁকালো। অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো,
" বাজান, তুই খুব জলদি স্বুস্থ্য হয়ে যাবি। আবার মায়ের কোলে ফিরা আসবি। খুব তাড়াতাড়ি!"
.
.
.
চলবে.........................